#তোমাকে_চাই_নিরবধি (১১)
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
Story Link-গল্পের লিংক (রিভিউ+আলোচনা)💓
রাতভর কন্যা’কে বুঝিয়ে শুনিয়ে সকালবেলা নিজের সাথে বকুল’কে ভোজন কক্ষে নিয়ে আসলেন, জাহানারা। একসাথে মাতা-কন্যাকে ভোজন কক্ষে উপস্থিত দেখে ভদ্রতাসূচক স্মিত হাসলো, গিন্নীরা। বকুল মায়ের পাশ ঘেঁসে জড়সড় হয়ে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একরাতে মেয়েটা’র চোখ-মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। চেহারায় মলিনতা স্পষ্ট।
এরমধ্যে রেণু বেগম খাবার টেবিলের একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বকুল’কে বললো,
“ওভাবে দাঁড়িয়ে কেন তুমি, বকুল? বসো, খেতে বসো।”
বকুল ধীরেসুস্থে বসলো, মাহাদ ভাইয়ের পাশে খালি চেয়ারটায়।
আয়শা খাতুন জাহানারা’কে বললো, জাহানারা, তুমিও বসো ওদের সাথে। রাতে তো ভালো করে কিছুই খেলে না।”
“খুব একটা খিদে নেই আমার। আমি আপনাদের সবার সাথে খাবো, ভাবীজান। আম্মাজান কোথায়? উনি খেয়েছে?”
শান্ত স্বরে বললো, জাহানারা। আয়শা খাতুন জানালো,
“আম্মাজান খায়নি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। এতক্ষণ এখানেই ছিলো, এখন উনি উনার কক্ষে বিশ্রাম করিতেছে।তুমি আসিলে ডাকি’তে বলছে। আমি ডাকিয়া আনি আম্মাজান’কে। তুমি বসো।”
বলতে বলতে শ্বাশুড়ি মায়ের কক্ষে’র দিকে পা চালালো, আয়শা খাতুন। তাকে থামিয়ে দিয়ে জাহানারা বললো,
“আপনার যেতে হবে না, ভাবীজান। আমিই যাচ্ছি আম্মাজান’কে ডাকিতে। আপনি খাবার গোছগাছ করুন।”
আয়শা খাতুন দাঁড়িয়ে গেলো। জাহানারা গেলো আম্মাজানে’র কক্ষে। পুত্র-কন্যারা নিজের মতো খাচ্ছে। এরিমধ্যে বকুলের খাবার বেড়ে এগিয়ে দিলো, রেণু বেগম। বকুল খাবার প্লেটে হাত রেখে নাড়াচাড়া করছে। তার চোখে জল টইটম্বুর। মাথা নিচু। শাড়ী’র আঁচল দিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে, বারবার। তার সামনেই বসা, ফারহান মল্লিক। মানুষটা’র মুখোমুখি হতেই বুকের এতক্ষণে’র ক্ষ’ত’টা পুনরায় তাজা হয়ে উঠলো। তার বুকটা অদৃশ্য এক যন্ত্রণা’য় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। আহ্! এতো সাধের মানুষটি কখনো তার হলো না। এই আক্ষেপ বাঁচা যায়? তবুও বাঁচত হয় আমাদের।
এতো চাওয়া না পাওয়ার ভীরে, হঠাৎ করেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো মেয়েটা’র বক্ষ চিরে। এরিমধ্য বকুল চট করে মাথা তুলে এক পলক তাকালো, ফারহান মল্লিকে’র মুখোপানে। লোকটা নিজের মতো করে আরামসে খাচ্ছে। আশেপাশে কি হচ্ছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। যদি একটিবার খেয়াল করে দেখতো, তার বিরহে অষ্টাদশী এক কন্যা কেমন মৃ ত্যু’সমো য’ন্ত্র’ণা’য় ছটফট করছে। সে বিরহ উপলব্ধি করতে পারলে, হয়তো শক্তপোক্ত ফারহান মল্লিকের বুক কেঁপে উঠতো। ম’রি’য়া হয়ে উঠতো, মেয়েটাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য।
কিন্তু, কিন্তু পাষাণ মানুষটা বুঝলো না, উপলব্ধি করতে পারলো না এক কিশোরী কন্যার উথাল-পাতাল ভালোবাসা।
বকুল চোখ সরিয়ে নিলো। তারপরও অচেতন মন বারংবার চোরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে, শখের পুরুষটাকে । এরিমধ্য ফারহান মল্লিক নিজের প্লেটের দিকেই তাকিয়ে, চাপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ওমন করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন না, আপা। আমি বিবাহিত। বিবাহিত পুরুষ আমি, ঘরে আমার আস্ত সুন্দরী এক বধূ রয়েছে। পরনারী’র ঝলসানো দৃষ্টি আমার জন্য মা’রা’ত্ম’ক ক্ষ’তি’ক’র।”
কণ্ঠস্বর চাপা হলেও কথাখানি সকলের কর্ণকুহরে পৌঁছাতে সক্ষম। ফারহান মল্লিকে’র থেকে এজাতীয় কথাবার্তা শুনে, ছোট বড় সকলেই অবাক হয়ে তাকালো তার মুখোপানে। এমন ঠাট্টা, রসিকতা করার মতো ছেলে সে নয়। পরমুহূর্তে আয়শা খাতুন উদ্বিগ্ন হয়ে ছেলের নিকট ছুটে আসলো।ছেলের কপাল ছুঁয়ে বললো,
“তোমার শরীর খারাপ, জ্বর-ট্বর হয়েছে না-কি পুত্র? সকাল থেকে কিসব আবোল-তাবোল বকছো!”
“আমি একদম ঠিক আছি, আম্মাজান।”
পুত্রের সেকথা বিশ্বাস করলো না, আম্মাজান। হাত ওলট-পালট করে সে জ্বর-ট্বর পরিক্ষা করছে। এদের মাতা-পুত্রে’র কান্ড-কারখানার মাঝে, কক্ষে’র সকলে পুনরায় একবার তাকালো জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা বকুলের দিকে। কথাখানা যে ফারহান ভাই তাকেই বলেছে, তা বোধহয় বুঝে ফেলছে সকলে। এতো গুলো মানুষের সামনে, লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে বকুলের। সে ততক্ষণাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সকলের মুখোমুখি একবার চোখ বুলিয়ে আমতা আমতা করে মেয়েটা বললো,
“উনার প্লেটে একটা পোকা ছিলো, পোকা… পোকা দেখছিলাম আমি।”
সরু চোখে নিজের প্লেটে’র দিকে তাকালো,ফারহান। বকুলের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো, বিন্দু। বুবু যে মিথ্যা বলছে, সে বিন্দুর ছোট্ট মস্তিষ্কও বুঝে নিয়েছে। এই হাসি শুনে, বকুল আরো খানিকটা লজ্জা পেলো। কেউ যে তার কথা বিশেষ করে বিশ্বাস করেনি, তা তাদের চোখেমুখের ভাবভঙ্গিমাই বলে দিচ্ছে। বকুলের ইচ্ছে হলো, মাটির সাথে মিশে যেতে। কেন যে তাকাতে গেলো, সে। বদ লোক একটা! মানুষ খারাপ হয়, তাই বলে এতোটা খারাপ? এতোগুলো মানুষের মধ্যে, এভাবে কেউ কাউকে লজ্জা দেয়? বকুল লজ্জায় টিকতে না পেরে, ওখান থেকে দৌড় দিলো। তাকে ততক্ষণাৎ থামিয়ে দিয়ে সালমা বেগম বলেন,
“না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো, বকুল? খাবারটা শেষ করে যাও আম্মা।”
“খেতে ইচ্ছে করছে না, মামীজান।”
“কিছুই তো খেলে না তুমি। অল্প একটু খেয়ে যাও। বোসো এখানে।”
গুরুজনের কথা অমান্য করার রেকর্ড নেই, বকুলের।
লজ্জা-দ্বিধায় আড়ষ্ট হওয়ার ভঙ্গিতে পুনরায় চেয়ারে বসলো,বকুল। তার এতক্ষণে’র জমিয়ে থাকা চক্ষু জল গড়িয়ে পড়ছে অবলীলায়। যা দেখে তার দিকে এগিয়ে আসলো, রেণু বেগম। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“কাঁদছো কেনো,মেয়ে?”
“কই, কই? আমি কাঁদছি না তো, মামীজান। কাঁদছি না আমি। চোখ জ্বলছে খুব। চোখে পোকা পড়েছে বোধহয়।”
বলতে বলতে চোখের জল হাত দিয়ে আড়াল করতে ব্যাস্ত হলো, বকুল। সবকিছু একবার পর্যবেক্ষণ করে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ালো, ফারহান মল্লিক। ততক্ষণাৎ কুহেলিকা’র জন্য রাখা খাবার প্লেট’টি হাতে নিয়ে, চলে গেলো নিজের কক্ষে।
কুহেলিকা এখনো, ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। চোখে জল নেই, তবুও কাঁদছে। যাকে বলে, জোর করে কান্না। দরজায় দাঁড়িয়ে ফারহান মল্লিক সেদিকে একবার তাকিয়ে শুধালো,
“কি হবে কেঁদে-কেঁদে নিজের বুক ভাসিয়ে? ভুলে যাও, ভুলে যাওয়ার মতো ভালো কিছু নেই।
মানুষ অকারণে মনে রাখতে বলে, মনে রাখা মানেই শুধু কষ্ট পাওয়া, কেনো কষ্ট পাবে তুমি?
ভুলে যাও…..
ভুলে যাওয়া মুক্তির, আনন্দের। মনে রাখা বন্ধন, যন্ত্রণা!”
আকস্মিক কারো কথা শুনে, সেদিকে একবার তাকালো কুহেলিকা। ফারহান মল্লিক’কে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো পুনরায়। হাত দিয়ে চোখ মুছে, মাথা নিচু করে নিলো। ফারহান মল্লিক মৃদু হেসে, ধীরেসুস্থে ভিতরে প্রবেশ করলো। খাবার প্লেট পালঙ্কের উপর রেখে, নিজও বসলো কুহেলিকা’র কাছাকাছি। অতঃপর বউয়ের নিচু মাথা দু’হাতে ভর দিয়ে উপরে তুলে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“কান্নাকাটি হলো তোমার? শেষ হলে, খাবারটা খেয়ে নেও।”
কুহেলিকা ততক্ষণাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,খানিকটা দূরে সরে গেলো। এরপর ঝংকার তুলে শুধালো,
“আপনি দূরে সরুন। ছোঁবেন না আমায়। আমি খাবো না। খাবো না।”
ফারহান সেদিকে আরো একটু এগিয়ে বললো,
“শোনো, বালিকা?
তুমি যতো দূরে সরে যাবে, আমি তোমাকে নিজের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসবো।”
কুহেলিকা কিচ্ছুটি বললো না। ঘৃণিত চোখে একবার তাকালো কেবল। সে দৃষ্টি পড়ে নিয়েছে, ফারহান মল্লিক। উঠে দাঁড়ালো, ততক্ষণাৎ। মৃদু স্বরে একবার বললো,
“খাবারটা খেয়ে নিও।”
কুহেলিকা প্রত্যুত্তর করলো না। ফারহান সে অপেক্ষা না করে, কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়লো।
____________
তপ্ত এক দুপুর। গোপন কক্ষে’র কেদারায় জড়সড় হয়ে বসে থরথর করে কাঁপছে, এক লোক। মুখটা তার কালো মাফলার দিয়ে প্যাচানো। মনে হচ্ছে, এখানকার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে প্রবেশ করেছে সে। নিজেকে আড়াল করতে, এই মাফলার। কেননা, মাফলার পড়ার মতো শীত এখন নেই।
এই লোকটার চোখে-মুখে কেবল আ’ত’ঙ্ক। ভয়ে কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। তাকে ভীষণ নার্ভাস দেখাচ্ছে।
তারই সম্মুখে বসে একের পর এক বিড়ি টানছে, জমিদার পুত্র মাহাদ মল্লিক। ছেলেটা একেবারেই নিশ্চুপ। নিরব! এতে ভয় বাড়লো আগান্তুক ব্যক্তিটি’র। তাকে এখনে জরুরী তলব দিয়ে ডেকেছে, মাহাদ মল্লিক। কেনো ডাকা হয়েছে, জিজ্ঞেস করার সাহস হলো তার।
সে অস্হির হয়ে কিছু শোনা’র জন্য, অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাহাদ মল্লিক শান্ত স্বরে বললো,
“তোমার উপর আমার কুহেলিকা’র দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিলো , কি ছিলো না?”
লোকটা ভয়ে ভয়ে চটজলদি বললো,
“জি.. জ্বি।”
উঠে দাঁড়ালো, মাহাদ। বাঘের মতো গর্জে উঠলো, ছেলেটা। হাতে থাকা জ্বলন্ত বিঁড়ি’র আগুনটা আগন্তুকে’র গালে চেপে ধরে বললো,
“কু ত্তা’র বা’চ্চা! তুই থাকতে কি করে কুহেলিকা’র বিয়ে হলো? কি করে হলো? আমাকে তুই একটা খবর পর্যন্ত দিসনি, কেনো দিসনি?”
য’ন্ত্র’ণা’য় চি’ৎকা’র করে উঠলো লোকটা। যা দেখে তরতর করে ক্রোধ বাড়লো, মাহাদ মল্লিকের। হাতের বিঁড়িটা ফেলে দিয়ে লোকটার কলা চেপে ধরলো। অতঃপর চেয়ার থেকে উঠিয়ে বুক বরাবর এক লা থি বসিয়ে দিলো। ছিটকে লোকটা পড়ে গেলো, মেঝেতে। বুকে হাত রেখে, আর্তনাদ করে উঠলো।
“ওমা গো! ম+রে গেলাম, ম+রে গেলাম হুজুর।ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন আমায়।”
মাহাদ মল্লিকের সেসব কথায় বিন্দুমাত্র দয়া হলো না। সে পুনরায় মেঝেতে পড়ে থাকা মানুষটার বুকে পা’ড়া দিয়ে চিৎকার করে বললো,
“তুই কোথায় ছিলি? বল, বল, কেন আমায় জানালি না।কুহেলিকা’র বিয়ে, একথা কেন তুই আমায় বললি না?”
“আমি আপনাকে জানিয়েছি, হুজুর। আপনাকে, আপনার নামে শহরে চিঠি পাঠিয়েছি।”
“তুই সত্যি বলছিস?”
“সত্যি বলছি হুজুর, আমি সত্যি বলছি।”
মাহাদ মল্লিক ততক্ষণ সরিয়ে ফেললো, পা। ছেড়ে দিলো লোকটাকে। তার শরীর ক্রোধে থরথর করে কাঁপছে। তার ঠিকানায়, এরকম কোনো প্রকার চিঠি যায়নি। তাহলে, তাহলে কে সরিয়ে ফেলছে সেই চিঠি? কার এই চ’ক্রা’ন্ত? জমিদার পুত্রে’র চিঠি বিলুপ্ত করেছে, কার এতো বড় সাহস?
চলবে……
[আসসালামু আলাইকুম! রমজান মোবারক, পাঠক মহল! গল্প কেমন লাগছে আপনাদের? মন্তব্য করুন। লেখার, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিন।]
#কালেক্ট_গল্প_কথা
Story Link-গল্পের লিংক (রিভিউ+আলোচনা)💓https://facebook.com/groups/329590663119170/