#আশার_হাত_বাড়ায় |৪|
#ইশরাত_জাহান
🦋
কাচের দরজা খুলে শ্রেয়া বলে,”মে আই কাম ইন?”
সাথে সাথে শ্রেয়ার দিকে তাকালো ফারাজ ও বৃদ্ধ স্মার্ট মহিলা।মহিলাটির মুখে হাসি।উনি বলেন,”ইয়েস নাই লেডি কাম।”
শ্রেয়া এগিয়ে আসে।মহিলাটি বলে,”প্লিজ সিট।”
শ্রেয়া বসে চেয়ারে।ফারাজ দেখলো শ্রেয়ার দিকে।নার্ভাস হয়ে আছে শ্রেয়া।তাই ফারাজ নিজে কিছু না বলে মহিলাটিকে বলে,”আপনি আজকের ইন্টারভিউ নিন মিস এনি।”
মহিলাটির নাম এনি।উনি এই কোম্পানির ফ্যাশন এক্সপেরিমেন্টাল।যত ড্রেস ডিজাইন বা নতুন কালেকশন আসবে তার দেখাশোনা তিনি করেন।এছাড়া তিনি নিজেও ডিজাইন করে থাকেন।এনি মুখে মাধুর্য ফুটিয়ে বলে,”তোমার পুরো নাম?”
“শেহনাজ উম্মে শ্রেয়া।”
“শেহনাজ ইজ এ বিউটিফুল নেম।কে দিয়েছে এই নাম?”
“আমার বাবা।তার কাছে এই নামটা প্রিয় তাই।”
“গ্রেট।তোমার কোয়ালিফিকেশন?”
“আমি মার্কেটিং নিয়ে বিবিএ কমপ্লিট করেছি যশোর এমএম কলেজ থেকে।”
“ওয়েল তোমার সিভি আমরা দেখেছি।যেটা একদম পারফেক্ট।তোমাকে আমরা মেইনলি অ্যাসিসট্যান্ট পদে রাখতে চাই।লুক দিস হ্যান্ডসাম।উনি তোমার বস।তোমার কাজ হলো বিভিন্ন সিডিউল দেখে রাখা।তোমার বসের বিভিন্ন উপদেশ ফলো করা।মাঝে মাঝে আমাদের কোম্পানির কাজে তোমাকে আমাদের সাথে বাইরেও যেতে হবে। আর মিটিংয়ের সময় তোমাকে তোমার বসের সাথে থাকতে হবে।তার প্রয়োজনীয় ডিটেইলস তোমাকে সেফ রাখতে হবে।মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট তোমাকে ফ্যাশন সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে হবে।যেটা সম্পর্কে আমি তোমাকে ট্রেইনিংয়ে রাখবো।তুমি কি এই কাজগুলো করতে পারবে?”
শ্রেয়ার কাছে কাজগুলো সহজ মনে হলো।যদিও অতটা সহজ না।কারণ এটা বড় কোম্পানি।কিন্তু এটাতে টিকতে না পারলে সে ভবিষ্যতে এগোতে পারবে না।মাঝে মাঝে বাবার কেসের কাগজপত্র শ্রেয়া নিজের কাছে রাখতো। আর শ্রেয়া খুব বেশি কিছু না জানলেও মার্কেটিং পড়ার জন্য একটু আধটু অনুমান সে ফ্যাশন সম্পর্কে রাখে।যশোরের গ্রামের দিকে থাকলেও শ্রেয়া শহরের দিকে মাঝে মাঝে যেতো।টুকটাক অনলাইন ভিডিও দেখেছে।যেহেতু এনারা নিজেরাও ট্রেনিং দিবে তাই শ্রেয়া সৎ সাহস নিয়ে বলে,”জি আমি পারবো।”
শ্রেয়ার সম্মতি পেয়ে ফারাজ এবার একটি পেপার বেড় করে বলে,”আপনাকে কাল তারিখ থেকে জয়েন হতে হবে।কিছু ট্রেনিং আছে।আমার মনে হয় আপনি আগে থেকে ট্রেনিংয়ে থাকলে কাজ সম্পর্কে বুঝতে বেশি সুবিধা হবে।আপনার সেলারি আর টাইম এই পেপারে দেওয়া আছে।দেখে নিন আর সাইন করুন।”
কাগজটা ভালোভাবে পড়ে নিলো শ্রেয়া।কিছু কিছু কঠিন ইংরেজি পড়তে কষ্টও হয়েছে তার।এমনিতেও বাইরে কথা বলে না সে।তার ভিতর এদের সামনে ইংরেজি পড়ছে।ভয় মনে কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে।একমাত্র ভালোভাবে পড়াশোনা করার কারণে সে আজ কাগজের লেখাগুলোর অর্থ বুঝতে পারছে।সেলারি আর টাইম সবকিছু শ্রেয়ার জন্য পারফেক্ট।শুধু তাই না যে সেলারি তাতে শ্রেয়া খেয়ে পড়ে জমাতে পারবে। তাই নির্দ্বিধায় সই করে দিলো শ্রেয়া। এনি হাত বাড়িয়ে বলে,”কংগ্রাচুলেশন শেহনাজ মাই লেডি।যদিও তোমার অফিসিয়াল কাজ এক তারিখ থেকে বাট তুমি আগে আগে এসো।আমি তোমাকে ফ্যাশন সম্পর্কে ডেভেলপ করে তুলবো।”
“শিওর ম্যাম। আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।”
বলেই হাত মেলায় শ্রেয়া।
শ্রেয়াকে উদ্দেশ্য করে ফারাজ বলে,”আপনার সিভির কপি আর একটা ছবি জমা দিবেন।এটা কোম্পানির কর্মকর্তাদের জন্য আবশ্যক।”
“ওকে স্যার।
বলেই হাসি মুখে বিদায় জানিয়ে চলে আসে শ্রেয়া।শ্রেয়া বেড় হতেই এনি বলে,”দিস লেডি ইজ আউটস্ট্যান্ডিং।বাট হার লাইফ ইজ ইন সো ডেঞ্জার। আই হোপ সি উইল ট্রাই হার বেস্ট ফর থ্রো আউট দ্যা ইভিল পারসন ফ্রম হার লাইফ।”
“ডোন্ট নো এনি।”
বলেই দীর্ঘশ্বাস নেয় ফারাজ।শ্রেয়া বেড় হতেই। অর্পা তাকিয়ে থাকে শ্রেয়ার দিকে।বলে,”কি হয়েছে দোস্ত?”
“আমি সিলেক্টেড।ওনারা কনফার্ম করেছে।”
খুশি হলো অর্পা।শ্রেয়াকে নিয়ে বাইরে আসে তাড়াতাড়ি।বলে,”আমার অনেক ভালো লাগছে তোর সফলতায়।”
“এসব কিছু তোর জন্য সম্ভব হয়েছে।”
“আমার হাত ধরে হয়তো তোর ভাগ্য বদলাতে যাচ্ছে কিন্তু তোর চেষ্টার ত্রুটি নেই।তুই এগুলো ডিজার্ভ করিস।”
“আমি আজ মন থেকে দোয়া করি।যেসব মেয়েদের জীবনে কেউ নেই তাদের জীবনে একটা করে অর্পা থাকুক।অন্তত মুক্ত বাতাসে শান্তিতে বেঁচে থাকার একটা আস্থা পাবে তারা।”
“তুইও তো আমার জন্য অনেক করেছিস।আমার হোমওয়ার্ক করে দিতি আবার আমার কলেজের বেতন আংকেলকে বলে তুই দিয়ে দিতি।আমার পড়াশোনার জন্য তোর হাতও তো আছে।আমরা দুই বান্ধবী একে অপরের জন্য।তাই কেউ কারোর প্রতি কৃতজ্ঞ দেখাবো না।”
“হুম।”
“কি রে মন খারাপ কেনো?”
“ওনারা বলছে কাল থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য আসতে।আসলে আমার ভালো হবে।কিন্তু আমার দ্বারা তো সম্ভব না।বাসা ঠিক করা হয়নি তো।”
“এই সময় তো একটু টাফ কিন্তু আমাদের ড্রাইভার আংকেলের পাশেই একটা ছোটখাট ঘর আছে।একটা ঘর একটা রান্নাঘর আর বাথরুম।সাথে ছোট্ট করে একটা বারান্দা।আমার মনে হয় তোর হয়ে যাবে।আংকেল বলেছিলো ওটার কথা আজ আমাকে।তুই কি দেখবি ওটা?”
“চল দেখি।”
“আচ্ছা চল।আংকেল এখন বাজারে।আমি কল করে তার বাসায় আসতে বলবো।”
“আচ্ছা।”
দুই বান্ধবী মিলে বাসা দেখতে গেলো।যদিও একটু সমস্যা হয়েছে কিন্তু ড্রাইভার পরিচিত থাকায় সমস্যা হয়নি।এছাড়া অর্পা ওর পরিচয় দেওয়াতে বাড়িওয়ালা রাজি হলো।বাড়িটি অর্পার বাসা থেকে কিছুটা দূরে কিন্তু একই এলাকায়।
*****
সব কাজ শেষ করে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরে আসে শ্রেয়া।চুপচাপ রান্না করতে থাকে।বাবার দেওয়া ঈদের টাকাগুলো জমানো আছে শ্রেয়ার কাছে। রিমলির থেকে ওগুলো চেয়ে নিলো।প্রথম মাস ওটা দিয়ে চালাতে হবে। কাল সে চলে যাবে এই বাড়ি থেকে।
রান্না করার পর খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে শ্রেয়া সবাইকে ডাক দিতে থাকে।রুবিনা আর তার দুই মেয়ে মিলে এসেছে খাবার খেতে।রনি তার মতো বাইরে ব্যাস্ত।আজকে শ্রেয়া ছোট মাছ চরচরী করেছে আর ডাল।অনেক দেরি করে আসাতে শ্রেয়ার তাড়াহুড়ো করে এই রান্না করতে হয়।রুবিনা নাক সিটকে বলে,”এগুলো কি রেধেছো?আমার মেয়েরা এগুলো খায় না।ভালো কিছু রান্না করতে পারোনি?”
আজ আর শ্রেয়া চুপ থাকলো না।তবে তর্ক না করে বলে,”আসলে মা বাইরে অনেক কাজ করে এসে ক্লান্ত ছিলাম।আপনার মেয়েরা এগুলো না খেলেও বাইরের খাবার খুব খায় যেটা অনেকদিন আমার খাওয়া হয় না।আজকে আপনি এই শিলে করে ঝাল বাটা তরকারি খান আমরা অনলাইন অর্ডার করে খাই।কি বলো আপুরা ভালো হবে না?”
সবাই অবাক হলো শ্রেয়ার কথাতে।কিন্তু অনলাইনের খাবারের নাম শুনে লোভ লাগলো রুহি আর রুমার।ওরা বলে,”আমাদের সমস্যা নেই।ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করো।”
আলতো হেসে শ্রেয়া বলে,”আচ্ছা।”
তারপর অর্ডার করে দেয়।রুবিনা চোখ ছোটছোট করে দেখতে থাকে শ্রেয়াকে।শ্রেয়া এবার ননদদের দিকে তাকিয়ে বলে,”অর্ডার করেছি।আসতে সময় লাগবে আমি একটু রূপচর্চা করে নেই।মুখটা কেমন তেল চিপচিপে হয়ে আছে।তোমাদের ভাইয়ের নজর আবার ইদানিং আমার দিকে নেই।একটু তার নজর ফিরাতে চাই।”
বলেই শ্রেয়া ঘরে চলে আসে।আজকে সে রূপচর্চা করবে।ফেসপ্যাক বানিয়ে মুখে লাগালো শ্রেয়া।চোখের উপর শসা দিয়ে ফ্যানের নিচে শুয়ে থাকে।রুহি আর রুমা এসে উকি দিয়ে দেখলো।রুবিনা কোনমতে খেয়ে নিলো আজ।এমন না যে মাছ খেতে খারাপ হয়েছে।ছোট মাছ আর ডাল খারাপ কিসে?
শ্রেয়াকে দেখ রুমা বলে,”হ্যা রে আপু আজ এই মেয়ের হলো টা কি?”
রুহি নিজেও উকি দিয়ে বলে,”কি জানি কি হয়েছে!আমি কিভাবে জানবো।তুই যেখানে আমিও সেখানে।”
“সকালেও তো বকা শুনেছে আজ।মায়ের শাড়ির জন্য।যে মেয়ে এত কষ্ট করার পরও আমাদের সবার পছন্দে আলাদা খাবার রান্না করে সে আজ মাত্র দুইটা পদ রান্না করেছে।তাও কি না ডাল আর ছোট মাছ।”
“সে যাই হোক আমরা তো আজ ইয়াম্মি খাবার খাবো।”
বলেই দুই বোন হাসতে থাকে।শ্রেয়া মুখটা ধুতেই আজ তার মুখটা অনেক ফ্রেশ দেখায়।নিজের কাছেই ভিন্ন অনুভব করে।নিজেকে আয়নায় দেখে মনে মনে বলে,”এভাবে নিজেকে সাজিয়ে রাখলে হয়তো আমার বরটা অন্য নারী দেখতো না।”
অনলাইনের খাবার চলে এসেছে।অনেকগুলো খাবার দেখে তাড়াহুড়ো করে শ্রেয়ার দুই ননদ।শ্রেয়া তাদেরকে থামিয়ে বলে,”দাড়াও সার্ভ করতে হবে তো।এখানে তো আমরা সবাই আছি।খুদা লেগেছে খুব।তোমরা তো এমনভাবে খাও যে শেষে এসে ঝুটা খাবার আমাকে খেতে হয়।”
অবাক হলো রুহি আর রুমা।রুবিনা পাশেই ছিলো। জোরে চিল্লিয়ে বলে,”আমার মেয়েদের খাওয়ার খোটা দেও।আমার বাড়িতে থেকে আমার মেয়েদের কথা শোনাও তুমি?সাহস কত তোমার?”
“প্রথমত মা আপনার মেয়েদের নিয়ে সত্যি কথাটাই বলেছি।কোনো খাবার খোটা দেইনি। আর দ্বিতীয়ত এটা আপনার একার বাড়ি না।এই বাড়িতে আপনিও যেমন বউ হয়ে এসেছেন আমিও তেমন বউ হয়ে এসেছি।সেক্ষেত্রে এই বাড়ি আপনার হলে এই বাড়ি আমারও।আপনিও অন্যের মেয়ে আমিও অন্যের মেয়ে আপনিও এই বাড়ির বউ আমিও এই বাড়ির বউ।সুতরাং বাড়ি নিয়ে কথা শুনাবেন না।আপনাদের স্বভাবটা বলেছি কোনো অন্যায় করিনি।”
বলেই খাবার বাড়তে থাকে শ্রেয়া।সবার জন্য না।শুধু নিজের প্লেটে নেয় খাবার।বাকিদের প্লেট গ্লাস এনে দিয়ে বলে,”তোমাদের আমি যতই দিবো কম হয়ে যাবে।তখন আবার আরেক কথা শুনতে হবে।তাই তোমরা নিজেরা নিয়ে খাও।আমি খেতে বসলাম।এখন না খেয়ে থাকার মতো ধৈর্য আমার নেই।”
শ্রেয়া বসলো খাবার খেতে।অবাক হয়ে আছে বাড়ির সবাই।রুহি আর রুমা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে।তারপর খেতে বসে।যেহেতু শ্রেয়া আজ কঠোর হয়ে নিজে থেকে খেতে বসেছে তাই রুবিনা আর কিছু করতে পারলো না।তার দায়িত্বে থাকলে সে শ্রেয়ার জন্য মেয়েদের না খাওয়া খাবারই দিতো।এই দৃশ্য দেখে শ্রেয়া মনে মনে বলে,”যাওয়ার আগে তোমাদের নাস্তানাবুদ করতে চাই।কাল তো চলেই যাব।বুঝবে কাল থেকে সব।আমাকে নিয়ে আসার পর কাজের মহিলা বেড় করে দেওয়া।কাল তো হঠাৎ করে চলে যাবো।দেখবো কাজগুলো কে করে।”
ঘরে এসে ব্যাগ গুছাতে থাকে শ্রেয়া।এই সময় রুবিনা ঘুমিয়ে আছে।রুহি আর রুমা নিজেদের মতো ব্যাস্ত।এটাই সুযোগ সবকিছু গুছিয়ে রাখা।বিয়ের সময় তার যেসব জামা কাপড় ও গহনা দেওয়া হয়েছিলো সেগুলোই গুছিয়ে নিলো শ্রেয়া।খাটের দিকে তাকাতেই মনে পড়লো এই খাট আর ড্রেসিং টেবিল তার বাবার জমানো টাকা দিয়ে বানানো।বাড়ি করার জন্য টাকা গুছাতে থাকে শ্রেয়ার বাবা।সেখান থেকে কিছু অংশ নিয়ে মেয়ের জন্য ছোট ছোট স্বর্ণের গহনা ও ফার্নিচার করে দেন তিনি।মেয়ের সুখের জন্য সবকিছু দেওয়া।চারপাশে তাকিয়ে শ্রেয়া কল করে অর্পাকে।
মিমির সাথে খেলাধুলা করছে অর্পা।শ্রেয়ার কল পেতেই রিসিভ করে বলে,”কিছু হয়েছে দোস্ত?”
হাসি পেলো শ্রেয়ার।অর্পা তাকে নিয়ে এত চিন্তিত।হালকা হেসে বলে,”আরে না কিছু হয়নি।বলছি যে এই রুমের বেশিরভাগ ফার্নিচার আমার বাবার টাকায় গড়া। কাল তো চলে যাবো।লোকজন তো তেমন চিনি না।তোদের ড্রাইভার আংকেলের নাম্বারটা দে আমি কথা বলে লোক ডাকতে বলি।ফার্নিচরগুলো নিয়ে যাবো।”
“বাব্বাহ!শ্রেয়া রানীর দেখছি বুদ্ধি বেড়েছে।এটাই তো চেয়েছিলাম।আচ্ছা লোক পাঠাবো আমি।আর শোন কাল সকালে আমিই আসবো তোকে নিতে।যখন কল করব রেডি হয়ে থাকবি।রনি কোনো ঝামেলা করলে আমি আছি।”
“আচ্ছা দোস্ত।”
চলবে…?