#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৮০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
ঘরোয়া ভাবে ইরার মেহেন্দির আয়োজন করা হয়েছে। হোটেলের ছাদটাকে মেহেন্দির জন্য বুকড করা হয়েছে৷ ছাদের আপাতত গান বাজনা চলছে। ছোটো স্টেজে ইরাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে৷ হেনা আর্টিস্টও চলে এসছে৷ ইরার বান্ধবীরাও ইতিমধ্যেই চলে এসেছে৷ তারা গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে। ইরাকে জলপাই রঙা শাড়ি পড়ানো হয়েছে। চুলে শুধুমাত্র একটা বেলীফুলের মালা পেঁচিয়ে রাখা। হালকা করে সাজানো হয়েছে তাকে। গায়ে আর কোনো অর্নামেন্টস নেই। একদম সাদামাটা লুক তার৷ এরই মাঝে তনুজাকে নিয়ে চলে এসেছে মৃত্তিকা৷ এই হোটেলের লোকেশন অর্পণ তাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল৷ আজ মা মেয়েতে একই রঙা শাড়ি পড়েছে। মৃত্তিকার গৌরাঙ্গে যে জলপাই রঙটা ফুটে উঠেছে৷ লম্বা চুলে বিনুনি গাঁথা। গায়ে কোনো সাজসজ্জা নেই৷ একদম সাদামাটা হয়েই এসেছে মৃত্তিকা। এভাবেই যেন তাকে আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। আজকের এই মেহেন্দি অনুষ্ঠানে জলপাই রঙটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে৷ মৃত্তিকাকে দেখা মাত্রই ইরা স্টেজ ছেড়ে নিচে নেমে এলো৷ শুরু থেকেই ভূমিকে সে নিজের একজন বন্ধু হিসেবে দেখে এসেছে। ভূমি বেঁচে আছে— কথাটা শোনার পর থেকেই ভাবছে‚ কখন তার সঙ্গে ভূমির দেখে হবে! কখন সে ভূমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে! সেই আজ দেখা হলোই৷ ইরা দৌঁড়ে গিয়ে মৃত্তিকাকে জাপ্টে ধরল৷ ক্রমাগত হাঁপাচ্ছে মেয়েটা৷ মৃত্তিকা আগলে নিল৷ কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু এই একটা সময়ে এসে সে কিছুতেই নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করবে না। কারো প্রতি সে দূর্বল হবে না। অর্পণ এবং ইরার বিয়েতে এমন অনেকেই থাকবে যাদের দেখলে সে হয়তো নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না কিন্তু মহুয়া মৃ’ত্যু আর তার অনাগত বাচ্চাটার মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ তো তাকে নিতেই হবে৷ মেহরাব শিকদারকে তো সে নিজের হাতে শাস্তি দেবে কিন্তু প্রলয়কে সে কোনো দিন ক্ষমা করবে না৷ প্রলয় যেটা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য। তার জন্যই নিষ্পাপ বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখতে পেল না৷ আজ আর পুরোনো কথা মনে করতে চায় না মৃত্তিকা৷ সেও জড়িয়ে ধরল ইরাকে৷ কিছু একটা ফিসফিসিয়ে বলল যেন! ইরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। মৃত্তিকা আর তনুজার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতে লাগল। এরই মাঝে অর্পণের সব কাজিন ভাই বোনরা চলে এসেছে। ওরা প্রথমে ইরার সঙ্গে কথা বললেও পরবর্তী ওদের নজর পড়ল মৃত্তিকার উপর। পুষ্পিতা তো বলেই ফেলল‚
“তুমি কেমন আছ ভাবিমণি।”
থম মে’রে গেল মৃত্তিকা। এবার কী জবাব দেবে সে? এমন পরিস্থিতিতে যে পড়তে হবে এটা সে আগে থেকেই জানত। এমন পরিস্থিতি সামনে আরও আসবে। ইরা বিষয়টাকে সামল দিয়ে বলল‚
“পুষ্প তোমার ভুল হচ্ছে৷ ও তোমার ভাবিমণি নয়। ও আমার ফ্রেন্ড।”
এবার পূর্ণতা বলল‚ “আমাদের ভুল হতেই পারে না। ছোটো ভাবি তুমি আমাদের সঙ্গে মজা করছ তাইনা?”
ইরা জানত এমনই একটা কিছু হবে৷ তাই সে মনে মনে নিজের উত্তর সাজিয়ে শান্ত স্বরে বলল‚
“আমি কোন মজা করছি না পাখি। যেটা সত্যি সেটাই বলছি। ও আমার ফ্রেন্ড মৃত্তিকা রায়চৌধুরী। এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে।”
ইরার কথা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হলো পূর্ণতা পুষ্পিতার৷ মৃত্তিকাকে দেখে মনে একটা আশা জেগেছিল যে‚ তাদের ভাবিমণি হয়তো আবারও ফিরে এসেছে৷ কিন্তু ইরার কথায় মনঃক্ষুণ্ন হলো দুজনের। এদিকে পূর্ণতা পুষ্পিতার কথায় বিভ্রান্ত তৃপ্তি৷ হা করে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকার দিকে। একদম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। বিশেষ মৃত্তিকার আঁখিদ্বয় নজর কেড়েছে ভীষণ ভাবে। তার দেখা সুন্দরী মেয়েদের তালিকায় সে মৃত্তিকাকেই শীর্ষে স্থান দেবে। মেয়েটার চোখ ধাঁধানো তাকে আকর্ষিত করছে। মেয়ে হয়েও কোনো হিংসাবোধ কাজ করছে না৷ মুগ্ধ নেত্রে চেয়ে রয়েছে মৃত্তিকার মুখ পানে৷ তার খুব ইচ্ছে হলো মৃত্তিকার সঙ্গে কথা বলার। এইতো চোখের সামনেই ইরার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। চাইলেই সে দূরত্ব ঘুচিয়ে ছুটে গিয়ে মৃত্তিকার সঙ্গে কথা বলতে পারে৷ তৃপ্তি আর নিজের ইচ্ছেকে আর দাবিয়ে রাখতে পারল না যেন। পূর্ণতা পুষ্পিতার পাশ কাটিয়ে মৃত্তিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ অন্যদিকে তৃপ্তিকে এভাবে মৃত্তিকার কাছে চলে যেতে দেখে যারপরনাই অবাক হলো পূর্ণতা পুষ্পিতা। তৃপ্তির এসব কৌতূহল ঠিক বুঝে এলো না ওদের৷ বিষয়টাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ওরা মেহেন্দি লাগাতে বসে পড়ল৷ আজ দু হাত ভরতি করে মেহেন্দি লাগাবে৷ ভূমি আর মৃত্তিকা যা-ই হোক সেসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে দুবোনই৷ নয়তো ছোটো ভাইয়ার বিয়েতে কিছুতেই মজা করতে পারবে না। অন্যদিকে মৃত্তিকার কাছে এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে তৃপ্তি হাসি মুখে বলল‚
“হাই! আমি তৃপ্তি জুনাইরাহ।”
মৃত্তিকাও হাসি মুখে নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল‚ “হ্যালো! আমি মৃত্তিকা রায়চৌধুরী। ডটার অফ এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী।”
মৃত্তিকার কথা শুনে সৌজন্যপূর্ণ হাসল তৃপ্তি৷ মৃত্তিকাকে জানার আগ্রহ যেন তড়তড় করে বাড়ছে৷ তখনকার পূর্ণতা পুষ্পিতার কথাটা তো ফেলে দেওয়ার মতো নয়৷ একেবারে হুবহু দেখতে মানুষ আদতে হয়? তা-ও আবার একই দেশে একই জেলায়? মনের খটকা মেটাতে তৃপ্তি জিজ্ঞেস করল‚
“তখন যে পূর্ণ পুষ্প বলল‚ আপনি নাকি ওদের ভাবিমণি?”
“আমি জানি না ওরা ঠিক কার কথা বলছে! আই থিংক ওরা কারো সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছে।”
এই নিয়ে তৃপ্তি আর কথা বাড়াল না৷ বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। একই দেখতে মানুষ হতেও পারে হয়তো সে এই প্রথম দেখছে বলেই তার কিছুটা অদ্ভুত লাগছে বিষয়টাকে৷ তৃপ্তি গিয়ে বসে পড়ল পূর্ণতার পাশে৷ মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে রইল ইরার কাছেই। এক হাত পুরো ভরতি করে দেওয়া হয়েছে৷ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে৷ আরেক হাতে মেহেন্দি দেওয়ার অভিযান চলছে৷ অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে নাজমার সঙ্গে কথা বলছেন তনুজা৷ উনি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না৷ হাঁটুতে ব্যথা হয় ভীষণ৷ মৃত্তিকা খেয়াল করল। সে ইরার পাশ থেকে সরে গিয়ে দাঁড়াল তনুজার সামনে৷ একটা চেয়ার টেনে তনুজাকে বসিয়ে কিছুটা অভিযোগের স্বরে বলল‚
“তোমাকে কতবার বলেছি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থাকতে। তোমার যে হাঁটুতে ব্যথা হয় সেটা কী ভুলে গিয়েছ?”
তার এহেন কথা গাল এলিয়ে হাসলেন তনুজা৷ এভাবে হাসির মানে খুঁজে পেল না মৃত্তিকা। সে জিজ্ঞেস করল‚
“দোষ করে এখন হাসছ? তুমি এত অবুঝ কেন মামনি?”
দু হাঁটু ধরে তনুজা বললেন‚ “কারণ তুই আমার মা।”
“অন্তত নিজের খেয়াল টুকু তো রাখবে।”
“আমার খেয়াল রাখার জন্য তো আমার মা আছে।”
“তোমার এসব কথায় আমার মন ভিজবে না মামনি।”
আবারও হেসে উঠলেন তনুজা৷ মৃত্তিকা আর কিছু বলল না৷ তনুজার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে৷ যেহেতু এটা হোটেল তাই সে নিজেই গিয়ে তনুজার জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারবে৷ অর্পণ বলেছিল এখানে নিরামিষভোজীদের জন্যও আলাদা করে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে৷ এ কথা মৃত্তিকাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল সে৷ তনুজাকে নিয়ে কর্ণারের একটা টেবিলে গিয়ে বসাল মৃত্তিকা৷ এরপর খাবার আনতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তনুজার জন্য খাবার নিয়ে চলেও এলো৷ পানির জন্য আলাদা গ্লাস আনা হয়েছে। তনুজার খাওয়া শেষ হবার আগ অবধি মৃত্তিকা সঙ্গেই বসে ছিল। এক চুল পরিমাণ স্থানচ্যুত হয়নি সে৷ তনুজার খাওয়া শেষ হতেই নিজের পার্স থেকে ঔষধ বের করে খাইয়ে দিল৷ ঔষধ খেয়ে তনুজা বললেন‚
“আগের জন্মে হয়তো কোন পূণ্য করেছিলাম তাইতো তোকে মেয়ে রূপে পেয়েছি।”
বিনিময়ের ক্ষীণ হাসল মৃত্তিকা৷ তনুজার পাশেই বসে রইল সে৷ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না তার! হেনা আর্টিস্ট সুন্দর করে ইরার দু হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে দিয়েছে। ইরার সকল বান্ধবী শুভাকাঙ্ক্ষীরাও এখানেই রয়েছে। শিকদার বাড়ি থেকেও পূর্ণতা পুষ্পিতা‚ তৃপ্তি‚ লাম আর লামিয়া এসেছে৷ ওরা সকলে একসঙ্গেই এসেছে৷ মেয়ে গুলোও বসে বসে মেহেন্দি দিচ্ছে অন্য হেনা আর্টিস্টের কাছ থেকে৷ পূর্ণতা সচরাচর হাতে মেহেন্দি লাগায় না। তবে আজ তার লাগাতে ইচ্ছে হলো৷ মেহেন্দির অনুষ্ঠান জমে উঠেছে৷ সফট টোনে মিউজিক বাজছে। একটা মেয়ে এসে জোর করে মৃত্তিকাকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে গেল ইরার কাছে৷ ইরাই মূলত এমনটা করতে বলেছে। এরপর একজন হেনা আর্টিস্টকে দিয়ে মৃত্তিকার হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে দেওয়ার কথা বলল ইরা৷ তবে মৃত্তিকা কিছুতেই রাজি হলো না৷ সে হাতে মেহেন্দি লাগাতে চায় না। তার মতে‚ ❝মেহেদীর অপর নাম র’ক্তাক্ত ক্ষ’তবি’ক্ষত!❞
রাত সাড়ে দশটা…
মেহেন্দি অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়েই বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছে পূর্ণতা পুষ্পিতা সহ বাকিদেরকে৷ এটাই প্রলয়ের নির্দেশ। বেশি রাত করে বাড়ির বাহিরে থাকা যাবে না৷ বোনদের ব্যাপারে সে সবসময়ই সচেতন৷ এমনিতেই কিছুদিন আগে তার উপর শত্রুপক্ষরা আক্রমণ চালিয়েছে৷ এমনও হতে পারে তার উপর থাকা রাগ‚ হিংসা-বিদ্বেষ গিয়ে চড়াও হলো তার ছোটো বোন দুটোর উপর বা তার পরিবারের বাকি সদস্যদের উপর। ইদানীং হারিয়ে ফেলার শোকে কাতড়াচ্ছে প্রলয়৷ শুধু মনে হয় তার জীবন থেকে সুখ গুলো একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে সকলে একসঙ্গে খেতে বসেছে। ছোটোরা খেয়ে এসেছে বিধায় রাতে আর কিছু খাবে না তারা। মেহেন্দির অনুষ্ঠান থেকে ভরপেট খেয়ে এসেছে ওরা৷ প্রলয় তখন খাচ্ছিল। এরই মাঝে পুষ্পিতা বলে উঠল‚
“বড়ো ভাইয়া জানো আজ আমরা হুবহু ভাবিমণির মতো দেখতে একজনকে দেখেছি।”
পুষ্পিতার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না প্রলয়৷ এ আর নতুন কী! সত্যিটা তো সে আগে থেকে জেনে ফেলেছে৷ এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই তার। সে নিজের মতো করে খাবার খেতে লাগল। কিন্তু সহ্য হলো না মেহরাব শিকদারের৷ খাবার মুখে নিয়ে বিষম খেলেন তিনি। তার মানে গ্রামের বাড়িতে সেদিন তিনি ঠিকই দেখেছিলেন৷ ভূমির মতো দেখতে অন্য কেউ আসলেই রয়েছে৷ ফিরোজা তাড়াহুড়ো করে মেহরাব শিকদারকে পানি এগিয়ে দিলেন। বাড়ি ভরতি মেহমান। মাথায় নতুন করে দুশ্চিন্তা গুলো আবারও ঘুরপাক খেতে শুরু করল। কাল অর্পণের গায়ে হলুদ। বিয়ের বাড়ির আমেজে নতুন করে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইছেন না মেহরাব শিকদার। কাল থেকে কমিউনিটি সেন্টারে গায়ে হলুদ‚ বিয়ে আর রিসেপশন অনুষ্ঠিত হবে৷
চলবে?…..