#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৬
-“সৌহার্দ্য তোকে ঠকিয়েছে! ভালোবাসার নাটক করেছে ও তোর সাথে। নয়তো এতো সহজে তোকে ভুলে গিয়ে ঐ বো*বা মেয়েটাকে নিজের বউ বলে মেনে নিল কেন? ওর নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ আছে।”
নিজের বাবার বলা এতো গুলো কথায় কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও শেষোক্ত কথাটা শুনে অরুণী নড়েচড়ে বসলো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরমান সাহেবের রাগী মুখটার দিকে। পরমুহূর্তেই সকল সংশয় মন থেকে সরিয়েও নিলো। আবার দেয়ালের সাথে ঘেঁষে গুটিশুটি মে”রে বসে রইলো সে।
আরমান সাহেব অরুনীর পাশে গিয়ে বসলেন। মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বললেন,
-“কেন এমন করছিস, মা? নিজেকে স্বাভাবিক কর। একটা প্রতারক ছেলের জন্য এভাবে নিজের জীবনটা শেষ করে দিবি?”
অরুণী র*ক্তি*ম দৃষ্টিতে তাকালো তার বাবার দিকে। ঝাড়া মেরে তার হাত সরিয়ে দিলো নিজের মাথার ওপর থেকে। কর্কশ গলায় বললো,
-“শাট-আপ, বাবা। সৌহার্দ্যকে প্রতারক বলার সাহস আর কখনো দেখাবে না। নয়তো আমি ভুলে যাবো যে, তুমি আমার বাবা।”
বলেই অরুনী হাতের কাছে থাকা একটা ফুলদানি অদূরে ছুঁড়ে ফেললো। আরমান সাহেব দ্রুতগতিতে সরে গেলেন নিজের মেয়ের কাছ থেকে। অরুণী ফোঁ*পা*চ্ছে প্রচন্ডভাবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সে। কাউকে আঘাত করতে না পেরে নিজেই নিজেকে আঘাত করছে অনবরত।
আরমান সাহেব চোখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছয় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। অরুণীকে এখন ঘুমের ওষুধ না দিলে ওকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কোনো মতেই সম্ভব নয়।
আরমান সাহেব পাশের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাকেট নিলেন। হিসেব করে দেখলেন, তিনি অরুণীকে দ্বিতীয় ইনজেকশনটা দিয়েছেন এক সপ্তাহ আগে। এরপর থেকেই অরুণীর আচরণে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। তার মানে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই সবটা আগাচ্ছে। আজকে অরুণীকে তৃতীয় ইনজেকশনটা দেওয়াবেন তিনি। এজন্য ওর শ*রী*রে ঘুমের ইন*জে*ক*শন পুশ করাটা জরুরি। তাই তিনি তড়িৎ গতিতে সি*রি*ঞ্জ ফিল-ইন করে অরুণীর কাছে গেলেন। অরুণীর হাত ধরতেই সে ক্ষিপ্ত নজরে তাকালো। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরমান সাহেব বেশ নি*ষ্ঠু*র ভাবে অরুনীর হাতে ইন*জে*ক*শনের সূঁচটা গেঁথে দিলেন। অরুণী একটা চিৎকার দিলো। কিন্তু সেই চিৎকারের তীব্রতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেল আর অরুনী নিজেকে এলিয়ে দিলো কোনো এক অন্ধকার রাজ্যে।
-“দেখুন মিস্টার আরমান! আপনি যেটা চাইছেন, সেটার পরিণতি কিন্তু মোটেও ভালো হবে না। আমার তো এখন নিজের সন্দেহ হচ্ছে যে, এই মেয়েটা আপনার নিজের মেয়ে কি না! নিজের মেয়ে হলে ওর জীবনটা আপনি এভাবে নিজ দায়িত্বে নষ্ট কীভাবে করছেন?”
আরমান সাহেব ডাক্তারের দিকে রাগী দৃষ্টি তাক করে বললেন,
-“আমার মেয়েকে নিয়ে আমি কী করবো সেটা আপনার বলে দিতে হবে না। ওর কীসে ভালো, কীসে মন্দ আমি বেশ ভালো করেই জানি ও বুঝি। আর আমি যা করছি ওর ভালোর জন্যই করছি।”
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অরুণীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এই মেয়েটা তার মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম উচ্ছ্বল ও হাসিখুশি মেয়ে ছিল। আর আজ? কোনো এক অজানা কারণে মেয়েটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি নিজেও কিছু করতে পারছেন না। এমন অপারগতা তাকে প্রচন্ড কষ্ট দিচ্ছে। আচ্ছা, তিনি যে অরুণীকে এভাবে নির্দোষ মনে করছেন! আসলেই কি সে নির্দোষ? নাকি এটা অরুণীর কোনো পাপের শাস্তি? বিষয়টা আসলেই জটিল!
২৭.
সকাল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছে। ঠিক আকাশের মেঘের মতোই মন খারাপের কালচে মেঘ জড়ো হয়েছে তরীর মনেও।
‘স্বপ্ন’ জিনিসটা প্রচন্ড অদ্ভুত। আর সেই স্বপ্নের সাথে যখন জীবনের রঙ মিশে যায়, হাজারো আশার যোগসূত্র তৈরি হয়, যখন সেই স্বপ্ন পূরণের মাঝেই মানুষের জীবনের সুখগুলো পুঞ্জীভূত হতে হতে একাকার হয়ে যায়, ঠিক তখনই মানুষ স্বপ্নকে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ মনে করে। পৃথিবীর সকল কিছুর অস্তিত্ব সেই স্বপ্নের সামনে ফিকে হয়ে দাঁড়ায়! আর সেই স্বপ্ন ভঙ্গ যেন জীবনের সব রঙগুলো একমুহূর্তে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এমনটা হওয়ার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক নানা কারণ জড়িত বলে প্রায় সব মানুষ-ই এই রকম মানসিকতা নিজের ভেতর পুষে রাখে।
তরীর মানসিক পরিস্থিতি ঠিক সেরকমই বর্তমানে।
আজ তরী এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট দেখার পর থেকে নিজের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বেশ সন্দিহান। বেশ গুমোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে বারান্দায়। অনেকটায় নির্বিকার, নীরব সে আজ।
-“এভাবে মন খারাপ করলে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। যা হয়, ভালোর জন্যই হয়- এই ধ্রুব সত্যটাকে মেনে নাও।”
তরী পেছন ঘুরলো না। সৌহার্দ্য প্রতিটি কথা তার ইন্দ্রিয়ে পৌঁছালেও তেমন ভাবাবেগ দেখালো না সে।
আচ্ছা, তার কি কান্না করা উচিত? কিন্তু তার যে হাজারো কষ্টেও কান্না পায় না। কাঁদতে সে ভুলেই গেছে সেই সুদীর্ঘ কাল আগে। মন থেকে শেষ যেদিন কেঁদেছিল, সেদিনই তার চোখের সব পানি ফুরিয়েছে। এরপর যতবার কাঁদতে হয়েছে, সবটাই ছিল নাটকীয়তা। লোকসম্মুখে ঘটনা প্রবাহের স্বাভাবিকতা উপস্থাপন করার অভিনয় মাত্র।
তরীর নীরব ভাবুক মুখশ্রীর দিকে সৌহার্দ্য নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিছু একটা ভেবে বললো,
-“সিলেক্টেড ক্যান্ডিডেট-দের লিস্টে তোমার নাম আসেনি তো কী হয়েছে? সরকারিতে নাই-বা হলো! আমি তোমাকে প্রাইভেটে পড়াবো।”
তরী শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। সৌহার্দ্যের মনে কী চলছে তা সে বুঝতে পারছে না। বোঝার চেষ্টাও তার মধ্যে নেই। জীবন থেকে একের পর এক জিনিস হারাতে হারাতে অনুভূতিরা সব মরে গেল নাকি?
সৌহার্দ্য পুনরায় কিছু বলার জন্য নড়ে উঠতেই তরী নিজের হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বোঝালো, সে ডাক্তার হবে না। সৌহার্দ্য অবাক হলো। তবে অসম্ভাব্যতা উপলব্ধি করতে পেরে মলিন হাসলো। হয়তো তরী বাস্তবতাটা বুঝতে পেরেছে। আবেগের বশে নেওয়া সিদ্ধান্তটার অযৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে পেরেছে সে হয়তো। ভেবেই সৌহার্দ্য তরীর মাথায় আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে বললো,
-“তোমার হাতে আরো অনেক সুযোগ আছে, তরী! অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড-টাইম সিস্টেম আছে। আই উইশ, তুমি সেখান থেকে বেস্ট একটা সাবজেক্ট পাবে। শুধু আগের থেকে পড়াশোনায় মনযোগটা বাড়িয়ে দাও।”
একটা ভরসার হাত পেয়ে তরীর মনটা ভালো হয়ে গেল। কিছু না পাওয়ার মাঝেও অনেক প্রাপ্তি লুকিয়ে থাকে। তরী সুনয়নে সৌহার্দ্যের দিকে তাকাতেই সৌহার্দ্য কাজের কথা বলে চলে গেল। তরী ভাবতে লাগলো আনমনে অনেককিছু। অনেক চিন্তা, পরিকল্পনার আবহ ঘোরাঘুরি করতে লাগলো ওর মনোজগৎ জুড়ে।
সৌহার্দ্য গাড়িতে উঠেই প্রহরকে কল করলো। মিস্টার আফনাদের বলা কথাগুলোর পেছনের রহস্যটা জানতে হবে তাকে, আর এ ব্যাপারে শুধু প্রহর-ই সাহায্য করতে পারবে। কল দেওয়ার পর একবার রিং হতেই প্রহর রিসিভ করলো,
-“হোয়াট’স আপ, ড্যুড? আমাকে স্মরণ করার কারণ জানতে পারি?”
সৌহার্দ্য আনমনে হেসে দিলো। পরমুহূর্তে বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় আসতেই মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,
-“একটা দরকারে ফোন দিয়েছি আপনাকে, মিস্টার অভীক শাহরিয়ার। আপনার সাথে দেখা করতে চাই।”
প্রহর নাকমুখ কুঁচকালো। বললো,
-“উফ! কেমনে পারিস তুই আমার সাথে এতো ফর্মালিটি দেখাতে? অসহ্য!! আমার ক্লাস ছিল আজকে। ক্যান্সেল করে দিচ্ছি, ওয়েট। পারলে চলে আয় জাহাঙ্গীরনগরে!”
-“ক্লাস ক্যান্সেল করতে হবে না। আমার জন্য কেন তুই এসব করতে যাবি? ফ্রি হয়ে তারপর না-হয়……”
-“শাট-আপ! আমি এখন কী করবো না করবো তোর কাছ থেকে শিখে নেবো না নিশ্চয়ই! আর তুই তো আসবি তোর বউকে নিয়ে কথা বলতেই! ভাবীর বেশ ভালোই ইফেক্টস পড়েছে তোর ওপর দেখছি। অরুণীর ভুত তোর মাথা থেকে নামিয়ে দিয়েছে। ভাল্লাগলো দেখে। আয়, তাহলে!”
-“আসছি! বিশ মিনিটের মতো লাগবে।”
সৌহার্দ্য কান থেকে ফোন নামিয়ে নিলো। ওয়ালেটের ভেতর থেকে চাবি বের করার সময় ওয়ালেটের একপাশ জুড়ে থাকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে ছবিটায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবলো,
-“ধন্যবাদ, চাঁদ। আমার কাছে আবার ফিরে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। তুমি ফিরে আসবে আমি কোনোদিন এক্সপেক্ট-ই করিনি। তুমি না ফিরে এলেও আমার মনে তোমার স্থান তুমি পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলে। সেই স্থান আমি কাউকে দিতে পারতাম না। হয়তো দ্বিতীয় বার প্রেম আসতো আমার জীবনে! কিন্তু তোমার মতো কেউ হতো না। তোমার মতো প্রেমও আসতো না। তুমি অনন্য! আকাশের বুকে যেমন একটাই চাঁদ, আমার হৃদয়াকাশেও তুমি একমাত্র অনন্যা! আমার চাঁদ। ভীষণ ইচ্ছে করে তোমায় বুকে আগলে নিতে, তোমার সিক্ত প্রণয়ে পুরোপুরি আসক্ত হতে! একবার হারিয়ে যখন ফিরে পেয়েছি, তখন তোমায় নিজের সাথে সম্পূর্ণ আবদ্ধ করবোই আমি। ভালোবাসি, চাঁদ! মা-রা-ত্ম-ক ভালোবাসি!!!”
-চলবে…..
[সবাই এতো অপেক্ষা করেছো, ভাবতেও পারিনি। অনেক সরি অপেক্ষা করানোর জন্য। কেউ বকা দিও না☹️]