প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৩৬+৩৬
তরী হসপিটালে এসেছে প্রেগ্ন্যাসি নিয়ে কনফার্ম হওয়ার জন্য। সৌহার্দ্যের হসপিটালে মোটামুটি সবাই ওকে চেনে। তাই এই হসপিটালে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তরী। সময় নষ্ট করাটা ঠিক মনে হয়নি বলে কাছের এই হসপিটালে টেস্ট করানোটা-ই ভালো মনে হয়েছে তরীর। তবে পরের কাজগুলো এতো কাছাকাছি কোথাও করবে না সে। সবার আড়ালে লুকিয়ে সবটা করতে হবে। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু টের না পায়, তাই সচেতনতার সাথে সবটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তরী।
টেস্ট করানোর পর তরী ওয়েটিং রুমে বসে আছে। রিপোর্ট রেডি হতেও কিছু সময় লাগবে। তরী চেয়ারে বসে হাতে হাত ঘষছে আর চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সন্ধ্যার আগে তো বাসায় পৌঁছাতে হবেই। সৌহার্দ্য বাসায় যাওয়ার আগেই ওকে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। ভাবতে ভাবতে তরী সামনে তাকাতেই চমকে উঠলো। সামনে অরুণী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে হাত ভাজ করে তরীর দিকে তাকিয়ে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে সে।
তরী হতবাক হয়ে উঠে দাড়ালো। অবাক লাগে তাকিয়ে বললো,
“ত্… তুমি? এখানে….”
অরুণী হাসলো। বললো,
“আমার বাবার হসপিটাল! আমি থাকবো না তো কে থাকবে?”
“কিন্তু এটা তো….”
“এটাও আমার বাবার-ই হসপিটাল। আমার বাবার তিনটা হসপিটাল আছে। এটাও তার মধ্যে একটা। হয়তো তুই জানিস না! সেটা তোর ব্যাপার।”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো অরুণীর দিকে। এতো বড় বোকামি সে কীভাবে করলো? তাড়াহুড়ায় এমন কাজ করায় অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন অরুণী কিছু জেনে গেলে কীভাবে কী করবে তরীর মাথায় আসছে না।
“এই গাইনোকলিস্টের চেম্বারের সামনে তুই কী করছিস হঠাৎ? আর সৌহার্দ্যের হসপিটাল ফেলে এখানে কেন?”
তরী বিব্রত হয়ে বললো,
“তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি!”
তরী পা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলে অরুণী পেছন থেকে বললো,
“এমন তো নয় যে, তুই সৌহার্দ্যের কাছ থেকে লুকোচ্ছিস? আর এই গাইনী ডক্টরের চেম্বারে! ম্যাটার্নিটি রিলেটেড কিছু হয়েছে নাকি?”
তরী বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অরুণীর দিকে। অরুণী সেটা দেখে হাসতে হাসতে বললো,
“আরেহ্! ডোন্ট বি প্যানিকড্! যতই হোক, আমার একটা মাত্র বোন তুই। তোর ভালোমন্দ নিয়ে তো আমাকে ভাবতেই হবে। তাই না?”
তরী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“নিজের চরকায় তেল লাগাও। আমাকে নিয়ে কিছু ভেবে থাকলে মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে। এতে অন্তত বেঁচে থাকতে পারবে।”
অরুণী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো ,
“বেঁচে থাকার সব কারণ তো তুই-ই শেষ করে দিয়েছিস! এবার নিজেকে নিয়ে একটু ভাবিস। যতদিন তোর প্রতি সৌহার্দ্যের ভালোবাসা আছে, ততদিন তোর জীবনে শান্তি। ভালোবাসা শেষ, তো শান্তিও শেষ।”
তরী হেসে দিলো। বললো,
“ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, বরং দিন যেতে যেতে বাড়তেই থাকে। আর তুমি যেই ভালোবাসার কথা বলছো, সেটা ভালোবাসা না! সেটাকে মোহ বলে, যা সৌহার্দ্যের প্রতি তোমার রয়েছে। আর বাকি রইলো সৌহার্দ্যের আমার প্রতি ভালোবাসা শেষ হওয়ার কথা। সেটা কোনোদিনও ফুরোবে না! সৌহার্দ্যের পুরো অস্তিত্ব জুড়েই আমি আছি, আর আমার জীবন জুড়ে ও। তোমার এই দিনের আকাশে তারা গোনার অভ্যাসটা যত তাড়াতাড়ি দূর করতে পারবে, ততই তোমার জন্য ভালো।”
“আমার অভ্যাস, আমার মোহ নিয়ে তোর ভাবতে হবে না এট লিস্ট! নিজেকে নিয়ে ভাব। ছেলে মানুষের মন খুব তাড়াতাড়ি রং বদলায়। সৌহার্দ্যও তোকে ভুলবে।”
তরী শক্ত কন্ঠে বললো,
“আ*গু*ন নিয়ে খেলছো তুমি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করো। সৌহার্দ্য আমাকে ভুলতে পারবে না। এতো বছরেও যেটা আমার অনুপস্থিতিতে ঘটেনি, সেটা আমার উপস্থিতিতে ঘটবে এমনটা তুমি ভাবলে কী করে? আমার বরকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করো। একটু লজ্জাবোধ রেখে কাজ করো! এটাই তোমার জন্য বেটার।”
তরী দ্রুত পায়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। রিপোর্ট কালকে গিয়ে নেওয়া যাবে। এখন বাসায় ফেরাটা জরুরি। তরী একটা রিকশা ডেকে তাড়াহুড়ো করে সেটায় উঠে বসলো। ফোনে কাউকে মেসেজ করে জানালো,
“অরুণীর ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারির ব্যবস্থা করো। ওর সব আপডেট আমি চাওয়া মাত্রই যেন পাই!”
৪০.
সৌহার্দ্য প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যার পর পরই ডিউটি শেষ করে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বলে সিটে আরামে বসে গা এলিয়ে দিলো। গাড়ি স্টার্ট হওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায়ই একজন সিনিয়র ডক্টরের কল এলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করে বললো,
“হ্যালো, স্যার! আসসালামু আলাইকুম! ”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম! সৌহার্দ্য, পেশেন্টের ব্যাপারে কিছু ডিসকাশন ছিল। আমার কাছে তোমাকেই এপ্রোপ্রিয়েট মনে হয়েছে এই ইস্যুর জন্য। সো, লেট মি নো ইফ ইউ হ্যাভ এনি প্রব্লেম! ”
“নো, স্যার! আমি এখন ফ্রী-ই আছি।”
“আচ্ছা। তাহলে আমার চেম্বারে এসো। এন্ড হারি আপ! ইট’স আর্জেন্ট।”
“ওকে, স্যার। ড্রাইভার, গাড়ি ঘুরাও। পেছনের প্রাইভেট হসপিটালটায় চলো।”
হসপিটালে পৌঁছাতেই সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। এই হসপিটালেই অরুণী ইন্টার্নশিপ করছে। সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল। মনে মনে অরুণীর সাথে দেখা না হওয়ার প্রার্থনা করলো। কিন্তু সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। হুট করেই অরুণী সৌহার্দ্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আচমকা এমন হওয়ায় সৌহার্দ্য চমকালো।
“কী ব্যাপার? আজ হঠাৎ….. ”
অরুণীকে থামিয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য বললো,
“তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে, সময় বা প্রয়োজন, কোনোটাই আমার নেই।”
বলেই সৌহার্দ্য হনহন করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। অরুণী পেছন থেকে অনেক বার ডাকলো৷ কিন্তু সৌহার্দ্য সেসবে কর্ণপাত করলো না। অরুণী রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে গেল হসপিটাল থেকে।
৪১.
মধু গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। ঘড়িতে এখন রাত দশটার ওপরে বাজে। তার বাবা তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিল আটটার মধ্যে বাড়ি ফেরার জন্য। মধু যেহেতু সব টিউশন-ও ছেড়ে দিয়েছে, তাই অযথা এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা মিস্টার রায়হান একদম পছন্দ করেন না। মধুও তার বাবাকে অনেক সমীহ করে চলে।
মধু ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখলো, মিস্টার রায়হান সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সেটা ওনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মধু কোনোরকমে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, বাবা!”
মিস্টার রায়হান চোখ মেলে তাকালেন। মধুকে দেখে থমথমে গলায় সুজাতাকে ডাকলেন,
“সুজাতা! তোমার মেয়ে এসেছে। খেতে দাও ওকে!”
সুজাতা দ্রুত গতিতে আসতেই মধু একবার নিজের মাকে দেখে নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, তুমি এখনো ঘুমোওনি কেন? কালকে অফিস নেই তোমার?”
মিস্টার রায়হান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“জেগে তো আছি তোমার জন্য-ই! এতো লেইট করে বাড়ি ফেরা ঠিক না। এটা তোমায় আগেও বুঝিয়ে বলেছিলাম।”
“বাবা, আসলে আমি টাইমলি-ই রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় জ্যাম ছিল প্রচুর! সরি, বাবা। আর কখনো এমন লেইট হবে না। আমি খেয়াল রাখবো।”
মিস্টার রায়হান মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“খেয়াল তো তোমায় রাখতেই হবে। প্রহর নামিয়ে দিয়ে গেছে তোমায়, রাইট?”
“জি, বাবা!”
“ঠিক আছে। প্রহরকে বলো, কালকে আমার সাথে দেখা করার জন্য। কথাবার্তা একটু এগিয়ে রাখা দরকার।”
মধু ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কথাবার্তা? কী ব্যাপারে কথা বলতে চাইছো, বাবা?”
“সেটা প্রহর এলেই জানতে পারবে। এখন খেয়ে নাও গিয়ে। অনেক রাত হয়েছে।”
মধু গাল ফুলিয়ে বললো,
“যা-ই বলো না কেন, বাবা! আমি এখন বিয়ে-টিয়ে করছি না।”
সৌহার্দ্যের দাদী এদিকেই আসছিলেন। মধুর মুখে এমন কথা শুনে বললেন,
“ক্যান রে? তোর বয়স কম হইসে? এখন বিয়ে না করলে কবে করবি তুই? বিয়ের বয়স পার হইয়া যাওয়ার পর?”
“উফ্! দাদী, চুপ করো না!”
“ক্যান চুপ করবো? সৌহার্দ্য আর ওর বউকে দেখ একবার! তরীর বয়স তোর সমান-ই। ওর বিয়ে হইলে তোর সমস্যা কই?”
সুজাতাও দাদীর সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,
“হ্যা, তোমার দাদী তো ঠিকই বলছেন! সব স্বাভাবিক থাকলে তো এতো দিনে তোমার বিয়ে হয়েই যেতো! এখন হলে সমস্যা কোথায়?”
মধু সবার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বললো,
“সমস্যা তো নেই! ব্যাস, আরো কয়েকদিন তোমাদের সাথে থাকি! অনেকগুলো দিন দূরে ছিলাম। আবার দূরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
সুজাতা হাসলেন এমন কথায়। দাদী মুখ বাকিয়ে বললেন,
“তো সেইটা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তোর মাথায় রাখা উচিত ছিল! এখন ঢং করে কী হবে? যাহ্! খেয়ে গিয়ে ঘুমা! আপদ একটা!”
দাদী পা ঘুরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। মধু দাদীর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বললো,
“এ্যাহ্! বুড়ির বয়স হলেও তেজ কমেনি। তোমাকে তো আমি কালকে দেখে নেবো!”
মধুও নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। মিস্টার রায়হান সুজাতার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
“এই দুজনের লাগালাগি এ জীবনে শেষ হবে না!”
সুজাতাও হেসে বললেন,
“কারো তেজ তো কারো থেকে কম না! যেমন মধু, তেমন তোমার মা! সমানে সমানে লাগালাগি।”
•
সৌহার্দ্য ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো, তরী বেডে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য গলা ঝেড়ে বললো,
“কী ব্যাপার? মিসেস সৌহার্দ্য রায়হান কিছুটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে। ”
তরী নড়েচড়ে বসলো সৌহার্দ্যের কথায়। সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি চলে এসেছো? এতো লেইট হলো আজকে হঠাৎ!”
সৌহার্দ্য নিজের হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,
“ইমার্জেন্সি ছিল। তাই না চাইতেও লেইট হলো!”
তরী বিছানা থেকে উঠে বসে বললো,
“ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খাবার নিয়ে আসি।”
সৌহার্দ্য বাধা দিয়ে বললো,
“আমি ডিনার করে এসেছি। তুমি এখানে বসো।”
“ওহ! আচ্ছা!! ”
তরী আবার বিছানায় বসে পড়লো। তরীকে কেমন যেন অগোছালো, বিধ্বস্ত ও চিন্তিত লাগছে সৌহার্দ্যের চোখে। এপ্রোনটা হাত থেকে রেখে তরীর সামনে হাটু মুড়ে ফ্লোরে বসলো সৌহার্দ্য। তরীর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
“আর ইউ আপসেট?”
তরী সৌহার্দ্যের দিকে টলমলে চোখে তাকালো। কাছের মানুষের সামান্য যত্নে ভেতরে চেপে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে আসতে চায়। তরী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে না-বোধক মাথা নাড়ালো।
সৌহার্দ্য তরীর চোখের কোণের জলগুলো মুছে দিয়ে বললো,
“তাহলে কাঁদছো কেন? কী নিয়ে এতো ভাবছো? মন খুলে বলে ফেলো আমায়!”
তরী নাক টেনে বললো,
“আপনি আমায় কতটা ভালোবাসেন?”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন!! ”
“আপনি বলুন আমায় আগে!”
“অনেক! সীমাহীন!! অন্তহীন!!!”
“আমাকে ভুলতে পারবেন কখনো?”
সৌহার্দ্য হেসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“এসব কী কথা বলছো, চাঁদ? এতো বছরেও যেটা সম্ভব হয়নি, সেটা….”
“সম্ভব! সময় খুব নিষ্ঠুর। একটা মুহূর্ত-ই যথেষ্ট সবকিছু বদলে দেওয়ার জন্য।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোমার এসব কথার কারণ তো বুঝছি না! কিন্তু আমি একটা কথা-ই বলতে পারি। সৌহার্দ্য নিজেকে ভুলে গেলেও তার চাঁদকে ভুলতে পারবে না। আমি সবসময় তোমার সাথে থাকবো, সব পরিস্থিতিতে, সারাজীবন। তোমার হাত তো আমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ধরিনি। কেন এতো ইনসিকিউরড ফিল করছো?”
তরী চোখ মুছতে মুছতে বললো,
“যদি আমি কোনো অন্যায় করি, তাহলে কী করবেন?”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,
“তাহলে সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব থাকলেও আমি তোমার পক্ষে থাকবো, তোমার জন্য লড়বো। কারণ আমার বিশ্বাস আছে তোমার ওপর। তুমি কোনো অন্যায় করতে পারো না। আমার চাঁদ পবিত্র! সবচেয়ে পবিত্র। আর যদিও সে কোনো অন্যায় করেও ফেলে, সেটার পেছনে অবশ্যই কোনো যৌক্তিক কারণ থাকবে।”
তরী এবার শব্দ করে কেঁদে দিলো। সৌহার্দ্যের বুকে হামলে পড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো, “আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি, সৌহার্দ্য! খুবই বাজেভাবে ঠকাচ্ছি।”
তরীর এভাবে কান্নার মানে সৌহার্দ্য বুঝে উঠতে পারলো না। চিন্তিত ভঙ্গিতে তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
-চলবে…….
#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৩৭
প্রেগন্যান্সি রিপোর্টের পৃষ্ঠাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে আপনমনেই মলিন মুখে হাসলো তরী। এমনটা তো হওয়ারই ছিল! শুধু কনফার্মেশনের জন্য টেস্টগুলো করানো। শাড়ির আঁচল মাথা পর্যন্ত টেনে বেরিয়ে গেল সে হসপিটাল থেকে।
পেছন থেকে অরুণী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তরীর চলে যাওয়ার দিকে। কিছু একটা মনে হতেই রিসিপশনে গিয়ে বললো,
“এক্সকিউজ মি! কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়ে রিপোর্ট কালেক্ট করে গেল যে, নাম অরিত্রী সেহরীশ! ওনার কী প্রব্লেম?”
“খুন সম্ভবত উনি প্রেগন্যান্ট। শিওরলি বলতে পারছি না, ম্যাম!”
কথাটা শুনে অরুণীর মুখ মলিন হয়ে গেল। চোখের কোণে জল জমতে সময় নিল না। আঙুল দিয়ে পানিটুকু মুছতে মুছতে ভাবলো, এমনটা তো হওয়ারই ছিল!
৪১.
সৌহার্দ্য ডিউটি শেষে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়িতে ওঠার সময় সামনে তাকাতেই অদূরে অরুণী আর অর্ণবকে কথা বলতে দেখতে পেল। সৌহার্দ্য ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইলো ওদের দুজনের দিকে কিছুক্ষণ। ‘ওরা দুজন এখন, এখানে, একসাথে কী করছে?’- প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সৌহার্দ্যের। ওদের দিকে এগোতে গিয়েও এগোলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। আজ তরীকে একটু বেশি সময় দেবে বলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছে সৌহার্দ্য। এমনিতেই তরীর কালকের আচরণে সে বেশ চিন্তিত। তাই আগ বাড়িয়ে অরুণীর কাছে যাওয়ায় মন সায় দিল না। ফোন বের করে ওদের দুজনের একটা ছবি তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো সৌহার্দ্য।
অরুণী আর অর্ণবের একসাথে থাকাটা সৌহার্দ্যকে ভাবাচ্ছে বেশ। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওদের দুজনের উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো না! অর্ণব তরীকে ভালোবাসতো, এখনো বাসে হয়তো! ভয়টা এখানেই! সৌহার্দ্য গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এসব ভাবছিল, এমন সময়ই প্রহর কল দিলো।
“আজকে দেখা করিস যদি তোর সময় হয়!”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আজকে সম্ভব না। হঠাৎ দেখা করার কথা বলছিস কেন? বাসায় চলে আয় আমার!”
“বাসার সবার সামনে এসব বলা গেলে তো চলেই আসতাম! তোর বউয়ের সামনে এসব বললে কখন দেখবি আমাকেই আকাশের তারা বানিয়ে দিবে!”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো, “স্টপ টকিং ননসেন্স!”
“সৌহার্দ্য, আ’ম সিরিয়াস! মজা করছি না আমি তোর সাথে। তরীর আচরণ আমার কাছে সন্দেহজনক লাগলেও এখন আমি নিশ্চিত যে, খু*ন*গুলো তরী-ই করেছে। এই সত্যিটা তুইও জানিস। আর খুব শীঘ্রই এটা প্রকাশ পাবে সবার সামনে। তখন….”
সৌহার্দ্য ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“কিছু প্রকাশ করবি না তুই। যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে! চাঁদকে আমি আমার থেকে দূরে সরতে দিবো না। তোর সন্দেহ সত্যি বলে প্রমাণিত হলে তুই কিছু প্রকাশ করবি না। সব কেইস ক্লোজ করে দিবি। আমি চাঁদকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।”
“সৌহার্দ্য, তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস। তোর চাঁদের প্রেমে উ*ম্মা*দ হয়ে তুই ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়েছিস!”
“হ্যাঁ, তোর যা মনে করার করে নে। কিন্তু আমি যা বলেছি, তুই সেটাই করবি। নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
প্রহরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সৌহার্দ্য ফোন কেটে দিলো। প্রহর হতাশ চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরলো বিকেলে। হাতে একগোছা লাল গোলাপ আর মুখে হাসি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখলো, ঘরে কেউ নেই। সারাঘরে একবার চোখ বুলিয়ে হাত থেকে এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপটা টেবিলে রাখলো। বারান্দা, ওয়াশরুম চেক করেও তরীকে না পেয়ে তার মাকে ডাকলো। সুজাতা কফি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই সৌহার্দ্য বললো,
“মা! চাঁদ…. ”
“নিজের বাবার কাছে গেছে। দুপুরে বেরিয়ে ছিল, পরে আমাকে কল দিয়ে বললো, বাবার বাসায় কয়েকদিন থেকে আসবে। আমি আর কী বলবো?”
সৌহার্দ্য রাগী কন্ঠে বললো, “ও যেতে চাইলো, আর তুমি ওকে পারমিশন দিয়ে দিলে!”
সুজাতা অবাক হয়ে বললো,
“তো আমি ওকে আটকাবো কেন? আর তুই এমন করছিস কেন? তুই জানিস না? তোকে বলে যায়নি ও?”
“আমায় না জানালে জানবো কী করে? এমনটা কেন করলো ও? আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না! ও জানে না, ওকে ছাড়া থাকতে পারি না আমি?”
সৌহার্দ্য গাড়ির চাবি নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। সুজাতা পেছন থেকে ডাকলেও শুনলো না। ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলো, প্রহর ভেতরে আসছে। সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো,
“তুই? তুই আবার এখানে কেন এসেছিস?”
প্রহর মুখ বাকিয়ে বললো,
“তোরা বাপ-ভাই-বোন মিলে শান্তিতে থাকতে দিলে তো আর আসতাম না! কাছ দিয়েই যাচ্ছিলাম। মধু ফোন করে বললো, তোর বাবা নাকি দেখা করতে চেয়েছে আমার সাথে। তাই আসতেই হলো।”
সৌহার্দ্য কিছু না বলে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। প্রহর হতভম্ব হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই ছেলে আবার কই যাচ্ছে? মাত্র-ই না বাসায় ফিরলো!”
সৌহার্দ্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে তরীর বাড়ির সামনে পৌঁছালো। কলিং বেল বাজানোর কিছু মুহুর্ত পর মোহনা দরজা খুলে দিলেন। সৌহার্দ্যকে দেখে হাসি মুখে বললেন,
“আরেহ্ বাবা, তুমি! এসো, ভেতরে এসো! তরী, দেখ কে এসেছে?”
সৌহার্দ্য কোনো রকমে হাসার চেষ্টা করে ভেতরে প্রবেশ করলো। ড্রয়িং রুমে তরী আর অর্ণবকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে রাগের মাত্রা বেড়ে গেল সৌহার্দ্যের।
“কে এসেছে, মা?”
বলে সামনে তাকাতেই সৌহার্দ্যকে দেখে চোখ কপালে তুলে ফেললো তরী। অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি এখানে…”
সৌহার্দ্য রাগী দৃষ্টিতে একবার তরী আর একবার অর্ণবকে দেখে হনহনিয়ে তরীর রুমে চলে গেল। তরী হতভম্ব হয়ে সৌহার্দ্যের পিছু পিছু গেল। সৌহার্দ্য গম্ভীর হয়ে বিছানায় বসে আছে। তরী দরজা চাপিয়ে দিয়ে সৌহার্দ্যের সামনে এসে দাঁড়াতেই সৌহার্দ্য দ্রুত গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে তরীর বাহু চেপে ধরলো। রাগী কন্ঠে বললো,
“প্রথমত, আমাকে না জানিয়ে এ বাসায় থাকতে এসেছো! দ্বিতীয়ত, অর্ণবের সাথে পাশাপাশি বসেছো আমি অপছন্দ করা সত্ত্বেও! এখন তোমায় কী শাস্তি দেওয়া উচিত, তুমিই বলো।”
তরী অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“শাস্তি? ক্… কিসের শাস্তি? সৌহার্দ্য, আমার কথা শোনো। আমি তোমাকে রাতে জানাবো ভেবেছিলাম। তুমি তখন ফ্রী থাকতে, তাই তখন কল করবো ভেবেছিলাম।”
“শাট আপ! অজুহাত বানানো বন্ধ করো। তুমি ভালো করেই জানো, তোমার কল আমি এক রিংয়েই রিসিভ করি। সার্জারী থাকলে অন্য ব্যাপার! আমার থেকে দূরে থাকার জন্যই আজকে তুমি এখানে চলে এসেছো। কালকে রাতে তোমার কান্না দেখেই কিছুটা আন্দাজ করেছি আমি। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে! কী হয়েছে আমায় বলো?”
তরী ভীত দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। নিজেকে সামলে আশে পাশে তাকাতে তাকাতে বললো,
“কিছু হয়নি, সৌহার্দ্য! তুমি বেশি ভাবছো। বাবা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল, তাই ভাবলাম কয়েকদিন এখানে থেকে যাই।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। কেন যেন চেয়েও তরীকে ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না! তবুও বললো,
“তাহলে দেখা করে চলে যাই, চলো। এখানে থাকতে হবে না। এই অর্ণবের সাথে এক বাড়িতে তো আমি তোমাকে থাকতে দেবোই না!”
তরী আমতা আমতা করে বললো,
“অর্ণব ভাই তো এ বাড়িতে শুধু রাতে থাকে। সারাদিন তো থাকে না। তুমিও থাকো আজকে। আমি শুধু দুদিন থাকবো। পরশু চলে যাবো বাসায়!”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সৌহার্দ্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তরী খুশি হয়ে বললো,
“আমি কফি নিয়ে আসছি তোমার জন্য।”
“নিজের জন্যও এনো। একা একা কফি খাই না আমি তোমাকে ছাড়া।”
তরী শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রান্নাঘরে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুই কাপ গরম গরম কফি এনে একটা সৌহার্দ্যের হাতে দিলো। দুজনে কফি খেতে খেতে গল্প করলো অনেক। সৌহার্দ্য কফি খাওয়া বাদ দিয়ে তরীর হাসি মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো। এই একটা জায়গায়ই তার সকল সুখ, আনন্দ, আবেগ, অনুভূতি।
হঠাৎ গা গুলিয়ে উঠতেই তরী চমকে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ছুটে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। এই ভয়টা-ই সে পাচ্ছিল। এখন সৌহার্দ্যের হাতে ধরা না পড়লেই হয়। সৌহার্দ্য হন্তদন্ত হয়ে তরীর পিছু পিছু এলে তরী সৌহার্দ্যের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলো। ব*মি করে ফ্রেশ হয়ে দশ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো তরী। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতেই দেখলো, সৌহার্দ্য ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তরীর বুক কেঁপে উঠল এই ভয়ে যে, সৌহার্দ্য সবটা বুঝে ফেললো কি না!
সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে তরীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওর হাতের কব্জি চেপে ধরে মনযোগী ভঙ্গিতে কিছু একটা পরখ করলো। পরমুহূর্তেই অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তরীর ভীত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করতেই অরুণীর হসপিটালে গিয়েছিলে, তাই না?”
-চলবে…….
(সবার রেসপন্স প্রত্যাশিত! আর হ্যাঁ, গল্পের প্লট যেভাবে সাজিয়েছি, গল্প সেভাবেই এগোবে। সবাইকে ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ রইলো। ভালোবাসা🖤)#
All part
https://m.facebook.com/groups/272194598259955/permalink/491050573041022/?mibextid=Nif5oz
Our group link join plz
👇👇
https://www.facebook.com/groups/272194598259955/?ref=share