প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা #Writer_Mahfuza_Akter পর্ব-৪০

0
604

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪০

তরী হলরুমের সিঁড়ির শেষপ্রান্তে হেলান দিয়ে বসে আছে। মন ও মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে এলোমেলোভাবে বসে আছে সে। যতক্ষণ সে এই বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ কারো ভেতরে আসার অনুমতি নেই। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এসেছে, কেউ খাওয়ার কথা জিজ্ঞেসও করতে পারেনি ভয়ে। পৃথিবীর কোনো কিছুই এই মুহুর্তে তরীর চিন্তাজগৎকে স্পর্শ করতে পারছে। তার একমাত্র ভাবনা এখন সৌহার্দ্য আর এই অনাগত সন্তানকে নিয়ে। হয় এই দুজনকে একই সাথে আগলে নিতে হবে, নয়তো দুজনকেই ছাড়তে হবে। কিন্তু আগলে নিলে তার বাবাকে ছেড়ে দিতে হবে, যেটা সম্ভব-ই নয়। এতো বছরের শ্রম, প্রচেষ্টা ও প্রতীক্ষা এক মুহূর্তে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবলেই মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় তরীর। তবে সৌহার্দ্য আর এই বাচ্চাটাকে ছাড়ার কথা ভাবলে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

“ম্যাম! ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আসলে অরুণী নামের একজন আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে। নিষেধ করলেও শুনছে না!”

কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল তরীর। নড়েচড়ে বসে অস্ফুটে বললো,

“পাঠিয়ে দাও!”

লোকটা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। তরী এভাবে অনুমতি দিয়ে দিবে, ভাবতেও পারেনি হয়তো! অবাকতা নিয়েই বেরিয়ে গেল বাইরে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে অরুণী ভেতরে এলো। তরীকে এভাবে এলোমেলো হয়ে বসে থাকতে দেখে কৌতুকের হাসি খেলে গেল ওর মুখ জুড়ে। নিজের গায়ে জড়ানো চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

“এই ঠান্ডায় শীত লাগছে না তোর? অতি শোকে পাথর হয়ে গেলি নাকি? তেমন কোনো শোক তো এখনো আসেইনি!”

তরী বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অরুণীর দিকে। অরুণী ভ্রু নাচিয়ে হাসলো। তরী বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,

“কেন এসেছো এখানে?”

“কেন এসেছি, এটা জিজ্ঞেস করার আগে ‘কীভাবে এসেছি’ এটা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল তোর।”

তরী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

“তুমি আর তোমার বাবা আমার ব্যাপারে সব ধরনের খোঁজ নিয়েই ফেলেছো। এখানে আসাটা তোমার জন্য খুব কঠিন কোনো ব্যাপারই না।”

“বাহ! বুদ্ধি আছে তোর, মানতেই হবে। যাই হোক! সৌহার্দ্যকে তোর প্রেগ্ন্যাসির খবরটা আমিই দিয়েছিলাম। ওর আবার বেবি অনেক পছন্দ। কিন্তু তুই যে বেবিটা রাখবি না, এটাও আমি জানতাম। তবে আমি তোকে বলবো যে, সৌহার্দ্যের কথা শুনিস না। বেবিটা রাখার দরকার নেই। ওকে তো মরতেই হবে! হয় আজকে, নয় তো কাল!”

বলেই বাঁকা হাসলো অরুণী। তরী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“আমাকে কী করতে হবে না হবে, সেটা তোমার থেকে জানতে হবে না আমার। তোমার কথা শেষ হয়ে থাকলে বেরিয়ে যাও!”

“আমি তো তোর ভালোর জন্যই বলছি! যতই হোক, আমার একমাত্র ছোট বোন! তুই সৌহার্দ্যের কথা মেনে নিয়ে তোর অতীতের সবকিছু ভুলে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চাইলেও, তোর অতীত তোর পিছু ছাড়বে না। আমি ছাড়তে দেবো না। তোকে সৌহার্দ্যের জীবন থেকে দূরে সরাবোই আমি, সেটা তোর মৃত্যুর মাধ্যমে হলেও সরাবো। এই বেবিটা না রাখলে তখন নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারবি। কিন্তু রাখলে তোদের দুজনকেই মরতে হবে। এখন চয়েস তোর!”

অরুণী হাসতে হাসতে চলে গেল। তরী ঝাপসা চোখে বিমর্ষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। দুকূলেই তার বিশাল ঢেউ। ঠিক মধ্যখানে দাঁড়িয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে তরী। অরুণী যা বলেছে, সবই ঠিক। তবে বাচ্চাটাকে না রাখলে সৌহার্দ্যের সামনে গিয়ে আর দাড়াতে পারবে না কোনো দিন। মাথার চুল খামচে ধরে তরী চিন্তা করতে লাগলো এখন তার ঠিক কী করা উচিত! নিজেকে স্বাভাবিক করে অনেকক্ষণ ভাবলো সে। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। এই মুহুর্তে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় তার হাতে নেই। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে সৌহার্দ্যকে কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিলো তরী।

এইদিকে,
মিস্টার রায়হান সোফায় বসে বসে চা খাচ্ছিলেন। সৌহার্দ্যকে একা বাড়িতে ঢুকতে দেখে মিস্টার রায়হান অবাক হয়ে বললেন,

“তুমি একা এসেছো কেন? আমার বউমা আসেনি? তোমার মা-বোন তো সুখবর পেয়ে কত তোড়জোড় লাগিয়ে দিয়েছে! আর তোমার দাদীর কথা তো বাদ-ই দাও!”

সৌহার্দ্য শুনেও কিছু বললো না। ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো, তরী কল দিয়েছে। না চাইতেও চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো সৌহার্দ্যের। ফোন কানে চেপে বললো,

“কেন এমন করছো, চাঁদ? তোমাকে ছাড়া আমার দমবন্ধ লাগছে। এই কয়েকটা মুহুর্ত কিভাবে বেঁচে ছিলাম, আমি নিজেও ভাবতে পারছি না।”

তরীও কেঁদে দিলো কথাটা শুনে। আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সৌহার্দ্য আবারও বললো,

“একটু স্বার্থপর হও না! আমার জন্য। এই যে দেখো! আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তুমি ছাড়া আমার সব অনুভূতি ফিকে হয়ে গেছে। কাঁদতে চেয়েও পারছি না। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একবার সব ভুলে চলে এসো। আমার জন্য, আমাদের সন্তানের জন্য। আমার প্রতি কি একটুও মায়া হচ্ছে না তোমার?”

“আমি ভুলতে পারবো না, সৌহার্দ্য। তোমাকেও না, আমার মাকেও না। আমি ভুলতে চাইলেও সবটা সমাধান হয়ে যাবে না।”

“তাহলে তুমি কী করবে এখন? আমার সন্তানকে মেরে ফেলবে? আমি তোমাদের দুজনকে একসাথে চাই, তরী! তোমাদের দুজনকেই!!”

তরী চোখ মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“আমি এখন তোমার কাছে ফিরতে পারবো না, সৌহার্দ্য। তবে আমি যেদিন ফিরে আসবো, সেদিন তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আমার বিশ্বাস এবং ভালোবাসা তোমার কাছে আমানত রইলো। আশা করছি, তুমি সেটার মান রাখবে।”

তরী কল কেটে দিলো। সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে গেল তরীর কথা শুনে। তরী ঠিক কী বুঝাতে চাইলো? তরী কি সত্যি সত্যিই এবোরশন করিয়ে ফেললো? সৌহার্দ্যের মাথা কাজ করছে না। এমনসময়ই প্রহর কল দিলো সৌহার্দ্যকে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রহরের উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

“কনগ্রেটস!! এতো বড় সুখবর তোর বোনের কাছ থেকে শুনতে হলো? তোর বোনের সাথে প্রেম না করলে তো আমি কিছু জানতেই পারতাম না মনে হয়। পরে হঠাৎ একদিন আমার কোলে বাচ্চা ধরিয়ে দিয়ে বলতি, ‘এই যে, তোর ভাতিজা!’ আর আমার আত্মা তখন আমার নাকের ডগায় ঝুলতো। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!! ”

সৌহার্দ্য কোনো উত্তর দিলো না। নির্জীব হয়ে বসে রইলো। সাড়াশব্দ না পেয়ে প্রহর বললো,

“সব ঠিক আছে? তুই কথা বলছিস না কেন? আমি নিশ্চিত কোনো ঝামেলা হয়েছে।”

সৌহার্দ্য নাক টেনে বললো,

“তরী বাচ্চাটা রাখতে চায় না। এখন বলছে, আমার কাছে ফিরবেও না। আমার সাথে কেন এমন করছে ও? ও কি আমাকে একটুও ভালোবাসে না!”

প্রহর হতভম্ব হয়ে বললো, “হোয়াট? কী বলছিস এসব? আগামাথা কিছু বুঝতে পারছি না।”

সৌহার্দ্য প্রহরকে সবটা খুলে বললো। প্রহরের মুখ হা হয়ে গেল সবটা শুনে। সৌহার্দ্য বললো,

“আমাকে ও হয়তো কোনো দিন ভালোই বাসেনি! আমিই বোকা ছিলাম।”

“সৌহার্দ্য, তুই আসলেই বোকামো করেছিস। ওর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তুই ওকে নিজের থেকে দূরে সরার সুযোগ দিলি কীভাবে? আজ বুঝতে পারলাম, মেয়েটাকে আমি যতটা খারাপ ভাবতাম, ও ততটা খারাপ নয়। তুই ওকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। ওর বাসায় যা! ওকে তোর থেকে দূরে যেতে দিস না। বাচ্চার কথা পরে ভাবা যাবে। কিন্তু একবার ও চলে গেলে, আর ফিরে আসবে না।”

সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ অবুঝের মতো বসে থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। দ্রুত গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে তরীর ডুপ্লেক্স বাড়ির দিকে চলে গেল। বিকেলের দিকে সেখানে পৌঁছতেই দারোয়ান ওকে দেখে বললো,

“আপনি এখন আসছেন? ম্যাডাম তো দুপুরের খাবার খেয়েই চলে গেছে!”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো, “চলে গেছে? কোথায় চলে গেছে?”

“সেটা তো জানি না! বাড়িও এখন খালি। আজাদ ভাইয়ের বউও চলে গেছে সকালে। ম্যাম হয়তো আর ফিরবে না।”

সৌহার্দ্য কিছু ভাবতে পারলো না আর। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো সে। জনমানবহীন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক।

🍂🍁 বর্তমান 🍁🍂

“এরপর? এরপর কী হয়েছিল, বাবা? তরী কি আর ফিরে আসেনি?”

সৌহার্দ্য চশমা খুলে নিজের চোখ মুছলো। প্রণয়ী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য হেসে ওর নাক টেনে বললো,

“এসেছিল তো! কিন্তু এখন ঘুমাতে হবে আমাদের। অনেক রাত হয়ে গেছে। কালকে ক্লাস আছে না? সো, নো মোর ওয়ার্ডস্।”
প্রণয়ী শুয়ে পড়তেই সৌহার্দ্যের অপর পাশ থেকে প্রণয় বলে উঠলো,

“ও আজ আর ঘুমাবে না। সারারাত সৌহার্দ্য আর তার চাঁদকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবে, আর সারাদিন সবাইকে এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করবে কাল। দেখিও তুমি, বাবা!”

প্রণয়ী রাগী কন্ঠে বললো,

“ভাই! একদম খোঁচাবে না আমাকে। এখন তোমার সাথে ঝগড়া করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।”

“তোর সাথে ঝগড়া করে কে? তুই-ই তো ঝগড়ুটে!”

“কী বললে?”

সৌহার্দ্য দুই হাতে দুজনের মুখ চেপে ধরে বলে,

“চুপ! আর একটা কথাও না। কালকে আমার ডিউটিআছে হসপিটালে। ঘুমাও দুজন চুপচাপ। প্রণয় নিজের মুখ থেকে সৌহার্দ্যের হাত সরিয়ে বললো,

” আমি কী করেছি, বাবা? প্রণয়ী-ই তো শুধু বেয়াদবি করে। আমি ওর থেকে এক মিনিটের বড়। ও মানেই না সেটা।”

প্রণয়ী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় মিটমিট করে হাসছে। সৌহার্দ্য আলো নিভিয়ে দুজনের মাঝে শুয়ে পড়লো। মনে মনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবলো,

“আমি জানি তুমি ফিরবে আমার কাছে, চাঁদ। আমাদের সন্তানদের জন্য হলেও তোমায় ফিরতে হবে। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার অপেক্ষায় থাকবো আমি। আর আমার বিশ্বাসের জয় হবেই। তুমি আবার ফিরবে আমার কাছে।”

-চলবে…

[আমার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। তাই গল্প একদিন পরপর দেওয়ার চেষ্টা করবো। পাঠকেরা অপেক্ষায় থাকেন বলে সমস্যার ব্যাপারে জানিয়ে দিলাম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here