#শান্তিসুধা
৬.
একদিনের পরিচয়ে একজন পুরুষের সঙ্গে একই ঘরে, একই বিছানাতে রাত কাটানো। এটা কেবল এরেঞ্জ ম্যারেজেই সম্ভব। শান্তি মুখে যতই চোটপাট করুক। মনে মনে ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে নুবাইদের পাশে শুয়েছে। মাঝরাত পর্যন্ত এপাশ-ওপাশ করে অবশেষে ঘুমিয়েছে। পাশে নুবাইদ। ঘুমিয়ে আছে শান্তশিষ্ট, ভদ্র মতোন। স্বামী-স্ত্রী ওরা। আজ প্রথম রাত। মনের মিল না থাকায় দুজনের মাঝে দূরত্ব একহাত সমান। সেই দূরত্ব ঘুচল মধ্যরাতে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শান্তি নড়েচড়ে কোলবালিশ হাতড়াতে শুরু করল। চলে এলো নুবাইদের খুব কাছাকাছি। বলিষ্ঠ দেহের পুরুষটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। একটা পা তুলে দিল কটিদেশে। গায়ের ওপর নরম কম্বল, আর একটা মানুষ কোলবালিশ। আরামদায়ক ঘুমে বিভোর শান্তি।
নুবাইদও আরামে ঘুমাচ্ছিল। আচমকা তার আরামের ঘুমে অশান্তি এসে ভর করল। ঘুম ভেঙে গেল নারী শরীরের উষ্ণ, কোমল ছোঁয়াতে। মস্তিষ্ক সচল হতেই মনে পড়ল, বিয়ের কথা। শান্তি নামক বউয়ের কথা। হৃদয়ে শিহরন জাগল। চনমনে হয়ে উঠল পৌরুষ। ঘাড়ের কাছে শান্তির তপ্ত নিঃশ্বাসের স্পর্শ। নিজেকে যুদ্ধ ময়দানের এক যোদ্ধা মনে হলো তার। আর শান্তির ছোঁয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসকে মনে হলো প্রতিপক্ষ। যে কিনা চারদিক থেকে আক্রমণ করেছে তাকে। হাঁসফাঁস লাগতে শুরু হলো। সন্তর্পণে শান্তির হাত সরিয়ে দিল। বিপত্তি ঘটল তক্ষুনি। নড়েচড়ে উঠে পুনরায় বেশ আয়েশ করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তাকে। ওর নরম বুকের সঙ্গে লেপ্টে গেল নুবাইদের পিঠ৷ নিঃশ্বাস আটকে গেল নিমেষে। কান দুটো গরম হয়ে মস্তিষ্ক এলেমেলো হয়ে গেল নুবাইদের। কোমরের বাম পাশে উঠানো শান্তির পা সরিয়ে দিল জোর খাঁটিয়ে। এরপর হাত সরিয়ে সটান উঠে বসল। নিঃশ্বাস ছাড়ল বড়ো বড়ো করে। জান যায়, যায় অবস্থা। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল ঘুমন্ত শান্তি। বিড়বিড় করে কী যেন আওড়াল। এরপর অন্য পাশে ফিরে ঘুমিয়ে গেল আবার। নুবাইদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ওর পানে। শরীর জুড়ে শুরু হলো তুমুল অশান্তি। যে অশান্তি তাকে আর বিছানায় টিকতে দিল না। আর না ঘুমাতে পারল। শীতার্ত রাতে জ্বলতে থাকা পুরুষালি শরীরটাকে হিম ধরাতে বাকি রাত কাটাল বেলকনিতে বসে।
ফজরের আজান দিলে ঘরে এলো। বিছানায় গিয়ে বসল শান্তির পাশে। তাকাল ঘুমে বিভোর বউয়ের পানে। ধক করে উঠল বুকের ভেতর। অল্পবয়সী, সুশ্রী এই কিশোরীটা তার বউ? ভালোলাগার শিহরনে ডুবে গেল মন। অপলকে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। অদ্ভুত নেশাঘোরে হাত বাড়াল। লালচে ফর্সা গাল ছুঁয়ে প্রগাঢ় কণ্ঠে ডাকল,
‘ শান্তি, শান্তি। ‘
এরপর সময় গড়াল আরো কয়েক মিনিট। গাল ছুঁয়ে, পলকহীন তাকিয়ে মুখ এগুলো নুবাইদ। এ কী নেশা এলো তার ঘরে? এ নেশা তাকে এত টানছে কেন? বড্ড বেহায়া হয়ে গেল কী? হবে নাই বা কেন? যার নাম শান্তিসুধা, যার মুখে জগতের সকল শান্তি। তাকে পেতে বুঝি হৃদয় চনমন করে না? মুহুর্তেই নিজেকে সংযত করল নুবাইদ। আপনমনে বলল,
‘ কন্ট্রোল নুবাইদ, কন্ট্রোল। ‘
এরপর মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। মৃদু কেশে উঠে শান্তির গাল থেকে হাত সরিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ডাকতে লাগল,
‘ শান্তি উঠো নামাজের সময় চলে যাচ্ছে। ‘
উঠল না শান্তি। নুবাইদ গলার স্বর উঁচু করল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল শান্তি। নুবাইদ ফের ডাকল। শান্তির ঘুম ছেড়ে গেল সহসা। চোখ খুলে নুবাইদের মুখ দেখতেই তড়াক করে উঠে বসল। নিঃশ্বাস ফেলল ঘনঘন৷ কয়েক সেকেন্ড পেরুলে চোখ কটমট করে তাকাল নুবাইদের দিকে। রয়েসয়ে দিল এক চিৎকার,
‘ সমস্যা কী তোর? আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করছিস কেন? এক্ষুনি রুম থেকে বেরো, বেরো! ‘
স্তব্ধ নুবাইদ। এ কেমন আচরণ? ঘুম থেকে উঠেই তুই তুকারি। চরম বেয়াদব মেয়ে তো! তার বউ এত অশিষ্ট মেনে নেওয়া যায় না। তাই শান্ত মুখে কঠিন চোখে তাকাল। ধমক দিল চাপা স্বরে,
‘ চুপপ, এক্ষুনি বিছানা ছাড়বে। ওজু করে নামাজ পড়বে আমার সঙ্গে। দোয়া করবে মৃত মায়ের জন্য। সৃষ্টিকর্তার কাছে মাফ চাইবে নিজের করা পাপ গুলোর জন্য। কথার হেরফের হলে চরম মূল্য দিতে হবে। ‘
‘ আপনার সাহস তো কম না নাফের। আমাকে ধমক দিচ্ছেন, থ্রেট করছেন! ‘
চোখ বড়ো বড়ো করে, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল শান্তি। নুবাইদ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ সকাল সকাল অশান্তি করো না শান্তি। ভদ্র মেয়ের মতো উঠে এসো। ‘
প্রতিত্তোর দিতে গিয়েও চুপ মেরে গেল শান্তি। নুবাইদের চোখ, মুখোভঙ্গি ভালো ঠেকল না। বুকের ভেতর ধুকপুক করে উঠল ওই দৃষ্টি দেখে। সন্তর্পণে ঢোক গিলল সে। মেজাজ দেখিয়ে বিছানা থেকে উঠে বড়ো বড়ো পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল নুবাইদ। ভাবল, জোরজুলুম করে কিছু করে লাভ নেই। একে শিক্ষা দিতে হবে অন্যভাবে। অত্যন্ত কৌশলে বশ মানাতে হবে।
চোখেমুখে পানি দিয়ে রাগে কাঁপছে শান্তি।
‘কত বড়ো সাহস নাফেরের! তাকে ধমক দেয়, হুমকি দেয়। শান্তিকে ধমক, হুমকি? এর বিনিময়ে ভয়ংকর একটা শিক্ষা যদি না দিয়েছি নাফেক্যাফে, তো আমার নামও শান্তিসুধা না। ‘
দম ছাড়ে শান্তি। ওজুর নিয়ম ভুলে গেছে। তাই মুখ হাত ভিজিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই নুবাইদের বুকে নাক, মুখ ঠেকল। নিমেষে মুখ শক্ত করে ফেলল সে। নুবাইদ স্মিত হেসে বলল,
‘ ভুলভাল ওজু করে নামাজ হয় না। আবার করো আমি বলে দিচ্ছি। ‘
কিছুক্ষণ পূর্বের কঠিন চোখ এখন আর নেই। একরাশ শীতলতা এসে ভর করেছে ওই চোখে। মুখে শান্ত, মিষ্টি হাসি। যা দেখে গা জ্বলে উঠল শান্তির। অতিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,
‘ শয়তানের মতো হাসছেন এখন তাই না? একটু আগে যে খাটাশের মতো ধমকালেন সেটার কী হবে? এই হাসি দেখিয়ে এখন ঘুষ দিয়ে লাভ নেই। ‘
মুখ ঘুরিয়ে রইল সে। নুবাইদ এক ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ তুমি এমন কি মহামান্য ব্যক্তি যে হেসে হেসে তোমাকে ঘুষ দিতে হবে? ‘
‘ নাফেরর। ‘
‘ হুঁশশ! ‘
ত্যাঁড়া শান্তিকে ওজু করিয়ে নামাজ পড়াল নুবাইদ। নামাজ শেষে বিনয়ের স্বরে বলল,
‘ এবার ঘুমাতে পারো। ‘
এত সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস নেই শান্তির। তাই এ কথা শুনতেই ধপধপ পা ফেলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। নুবাইদ আলতো হেসে বিড়বিড় করল,
‘ উফফ, শরীর ভর্তি রাগ মেয়েটার। ‘
অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছে নুবাইদ। তাই আজ অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। তবুও রোজকার নিয়ম অনুযায়ী সকাল আটটায় সকালের খাবার খেতে ডাক পড়ল। অন্যদিনের মতো আজ সে সহজ ভাবে যেতে পারল না। নানারকম দ্বিধা নিয়ে গেল। ডাইনিং রুমে উপস্থিত হতেই খালামুনির প্রশ্নের সম্মুখীন হলো,
‘ তোর বউ কোথায়? উঠেনি এখনো? ‘
আম্মু বলল,
‘ নাফের বাবা শান্তি উঠেনি? ‘
খালামুনি ফের বলল,
‘ নতুন বউ সাতসকালে শাশুড়ি মায়ের কাছে আসবে। তা না এখনো ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। এ কেমন কথা নাফের বাবা? ‘
আম্মু আর খালামুনির দিকে শান্ত চোখে তাকাল নুবাইদ। মৃদু হেসে বলল,
‘ নামাজ পড়ে শুয়েছে। শরীরটা বোধহয় ভালো নেই। তাই ডাকিনি। ‘
নাজির তালুকদার, নুবাইদের দাদাভাই বললেন,
‘ বাচ্চা মেয়ে অতো বুঝে না। এ নিয়ে কথা বাড়িও না বউ মা। ‘
‘ বাচ্চা বাচ্চা বলে বেশি মাথায় তোলা যাবে না বাবা। এ মেয়ের যা হালচাল শুনলাম আর দেখলাম। তাতে এখন থেকেই শক্ত হাতে গড়ে নিতে হবে। ‘
নুবাইদের শান্ত মুখ কিছুটা গম্ভীর হলো। খেয়াল করে তাসলিমা বেগম বোনকে থামিয়ে নুবাইদকে বলল,
‘ নাফের, বেলা করে ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। আমাদের বাড়ির কিছু নিয়মকানুনও রয়েছে। ওকে এগুলোতে অভ্যস্ত হতে হবে। প্রথম প্রথম খাপ খাওয়াতে পারবে না ঠিক৷ কিন্তু প্রথম থেকেই সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। যাও ডেকে নিয়ে আসো। বিয়ের পর প্রথম দিন শশুর বাড়ির সবার সঙ্গে সকালের খাবার খাবে। শরীর খারাপ হলে শুয়ে থাকলে তো শরীর ভালো হবে না৷ খাবার খেয়ে, ওষুধ খেয়ে না হয় রেস্ট করবে। ‘
তাসলিমা বেগম বিচক্ষণ মানুষ। মায়ের বিচক্ষণতায় বরাবরই মুগ্ধ নুবাইদ। তাই সায় দিয়ে ঘরে গেল। ডাকল শান্তিকে। চোখ বন্ধ রেখেই চ্যাঁচিয়ে উঠল শান্তি,
‘ওহ নাফের, ঘুমাতে দিন। এত ডাকাডাকি করছেন কেন? ‘
‘ ব্রেকফাস্ট করে ঘুমিও শান্তি। এখন উঠো আম্মু ডাকছে।’
‘ ধুরর বাল। ‘
বলেই উঠে বসল শান্তি। অতিষ্ঠ হয়ে দুহাতে মাথা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
‘ কার পাল্লায় পড়লাম রে। ভালোভাবে ঘুমাতে দিচ্ছে না। একটু পরপর শান্তি, শান্তি করে জ্বালিয়ে মারছে।’
শান্তির মুখের ভাষা শুনে বিতৃষ্ণ নুবাইদ। তবুও নম্র স্বরে বলল,
‘ তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও। অপেক্ষা করছি আমি। ‘
বিরস মুখে উঠে গেল শান্তি। নুবাইদ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, এত বৈপরীত্যে সম্পর্ক কীভাবে আগাবে? সুখকর হবে তো তাদের দাম্পত্য জীবন?
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
প্রিয় পাঠক, আজ থেকে বইমেলা শুরু হয়েছে। আমার দ্বিতীয় বই বাইজি কন্যা বইমেলায় পাওয়া যাবে নয় তারিখ থেকে। নবকথন প্রকাশনীর স্টল নং ৬১৩ তে গেলেই বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন। এছাড়া অনলাইন বুকশপ থেকেও নিতে পারবেন।