#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৭
নিচু হয়ে মেঝেতে স্পর্শ করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা বেজে ওঠলো। কেঁপে ওঠলাম আমি। এক ঢোক গিলে শ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করে ফোনটা রিসিভ করলাম। কাঁপা গলায়ই প্রশ্ন করলাম,
-‘ নির্ঝর তুই কোথায়? নির্মল কোথায়? দ্রুত বাসায় আয় দেখে যা বাসার কি অবস্থা। নির্মলকে বল আমি ফিরে এসেছি ‘।
আর কিছু বলার সুযোগ দেয়নি নির্ঝর ফোনটা কেটে দেয়। আমি মেঝেতে পড়ে থাকা লাল বর্ণের তরল পদার্থকে তেমন পাত্তা দিলাম না। নিজের রুমে গিয়ে বিস্কুটের প্যাকেট খুলে দুপিস খেয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। কাপড় পাল্টানোর জন্য ব্যাগ থেকে কাপড় হাতে নিতেই সরস্বতী কোথায় থেকে ছুটে এসে জাবটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো বুঝলাম না। এই রাতে সরস্বতী এখানে কেনো তাই ভেবে পাচ্ছি না। বুকের ভিতরটায় কেমন যেনো অস্থিরতা কাজ করছিলো। সরস্বতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
-‘ একি কথা! বউ মা কাঁদছে কেনো হুম? এই রাতে কি বরের সাথে ঝগরা করে চলে এলি নাকি দেখি দেখি কাঁদে কেনো বোকা মেয়েটা ‘?
সরস্বতী ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলে ওঠলো,
-‘ সব শেষ করে দিলি সাবা তুই সব শেষ করে দিলি ‘।
বলেই আমার হাত টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলো। বাড়ির সামনে আগে থেকেই রিকশা দাঁড়ানো ছিলো৷ বুঝলাম সরস্বতীই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। উত্তেজনায় হাত, পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে আমার। সরস্বতীও ঠোঁট ভাঙিয়ে সমানে কেঁদে যাচ্ছে। আমার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জোর করেই রিকশায় ওঠালো সরস্বতী। পুরো রাস্তায় শুধু এটুকুই বললো সব শেষ করে দিলি সাবা সব শেষ করে দিলি। আমার অবচেতন মন তখন ভয়ংকর অঘটন টের পেয়ে যায়। সরস্বতীকে জরিয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠি আর প্রশ্ন করি,
-‘ আমার নির্মল, আমার নির্মল কোথায় সরস্বতী ‘?
পনেরো মিনিটের মাথায় রিকশাটা থেমে গেলো বিশাল বড় এক বাড়ির সামনে রাএি তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। বাড়ির সামনে এতো ভীর দেখে আমার গলা থেকে বুক অবদি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। একহাতে শাড়ি অন্যহাতে সরস্বতীর এক হাত চেপে ধরলাম। সরস্বতী কান্নার মাঝেই তাচ্ছিল্য হেসে ওঠলো। বললো,
-‘ যা তোর নির্মলকে শেষ দেখা দেখে আয় ‘।
ও কথাটা শেষ করা মাএই ঠাশ করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম গালে। চিৎকার করে বললাম,
-‘ আর একটা কথা বললে আরেক থাপ্পড়ে গাল ফাটিয়ে ফেলবো একদম বেয়াদব মেয়ে। সব সময় সব কিছু নিয়ে মজা তাইনা ‘?
আমাকে অবাক করে দিয়ে সরস্বতী আমাকে জাবটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। বলতে থাকলো,
-‘ ওরে সাবারে আমাদের নির্মল আর নাইরে। সাবারে তুই কেনো ওরে চিঠি পাঠাইতে গেলি বইন। তুই কি এতো দিনেও বুঝস নাই পাগলটা তোরে ওর জীবনের থেকেও বেশী ভালোবাসছে? তোর অন্যকারো সাথে বিয়ে পাগলটা কিভাবে সহ্য করবে সাবা? চিঠিটা আজকে সন্ধ্যায় পাইছেরে। তুই জানোস না সাবা ঘুম থেকে ওঠেই ও চিঠি পাইছিলো। চিঠি পড়ার পর পরই স্ট্রোক হয়ে বমি হয় রক্ত বমি। তারপর হার্ট অ্যাটাক হয়ে বাসাতেই ওর মৃত্যু ঘটে। আমার সোনাটায় মারাত্মক ভয় পেয়ে মরছেরে সাবা। ও ভাবছে তোর হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে। কারণ তুই চিঠিতে বিয়ের দিন আজকেরই দিছোস। নির্ঝরের ফোন পেয়েই আমরা ও বাড়ি গেছিলাম শুধু চিঠিই পেয়েছিলাম ততোক্ষণে নির্মলকে হসপিটালে ডেড ঘোষণা করে দিছে ‘।
আমি আর কিছু শুনতে পারলাম না। আর কিছু শুনতে চাইলাম না। দুহাতে দুকান চেপে ধরে গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলাম,
-‘ চুপ কর। চুপ কর। আমার দোহাই লাগে তুই চুপ কর ‘।
বলেই পিছন ঘুরে ছুটে গেলাম বাড়ির দিকে। পাগলের মতো ভীর ঠেলাঠেলি করে বাড়ির ভিতরে সদর দরজা অবদি গিয়েই থমকে গেলাম। নির্মলের মা নির্মলের মাথা বুকে চেপে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, -‘ আমার বাবা, আমার বাবা গো তুমি আমারে ছাইড়া কই গেলা গো আমার বুকটা খালি কইরা গেলা বাবা গো ‘।
আমি নির্মল বলে এক চিৎকার দিয়ে সেখানেই জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরলো আমার পাশে মামি, জেসমিন,আর সরস্বতিকে দেখতে পেলাম। চারপাশে শুধু ক্রন্দনধ্বনি বেজে চলেছে। নির্ঝর নির্বাক হয়ে ড্রয়িং রুমের একপাশে বসে ভাইয়ের মরা মুখের দিকে চেয়ে আছে। ওকে দেখেই আমি আবারো নির্মল বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি মামির বুকে। ‘মামি গো আমার নির্মল ‘ বলেই আরেক চিৎকার দিলাম। তখনি নির্মলের মা হিংস্র বাঘিনীর মতো এসে আমালে খাবলে ধরলো। দুগালে থাপ্পড় বসিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকলো,
-‘ কালনাগিনী, ডাকিনী। আমার কলিজাকে খেয়েই তুই ক্ষ্যান্ত হলি? কোনদিনও ভালো হবেনা তোর। এক মায়ের বুক খালি করে কোন দিন সুখ পাবিনা তুই। ঐ আল্লাহ জানি তোকে কোন দিন সন্তানের মুখ না দেখায়। আমার বুক খালি করলি তুই আমার সন্তান কে খেয়ে বসলি পিশাচিনী ঐ আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম কোনদিন সুখ পাবিনা তুই। আল্লাহ জানি স্বামী -সন্তানের মুখ দেখায় না তোকে। খুনি তুই হত্যাকারী তুই আমার সন্তানের খুনি তুই। নির্ঝর এই খুনিকে পুলিশের হাতে তুলে দে ‘।
সত্যিই তো খুনি আমি। আমার নির্মলের খুনি আমি। অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবেসেছে বলেই না এভাবে প্রাণ হারালো ছেলেটা। না সেদিন আমি গ্রামে যেতাম আর না বিপদের মুখে পড়ে চিঠি পাঠাতাম আর না আমার নির্মল প্রাণ হারাতো। হ্যাঁ আমি খুনি নিজেকে স্পষ্ট ভাবে খুনি অনুভব করতেই ওনার হাত টেনে ধরে নিজেই নিজের গালে থাপড়াতে শুরু করলাম। আর্তচিৎকার করে বলতে থাকলাম,
-‘ মারুন আমায় মেরে ফেলুন আমায়। ও মা আপনি তো মা ছেলের খুনিকে হত্যা করলে কোন দোষ নেই। মেরে ফেলুন আমায় ‘। বলেই ওনার দু পা আঁকড়ে ধরে মৃত্যু ভিক্ষা চাইতে থাকলাম।
নির্ঝর এসে ওর মা কে সামলানোর চেষ্টা করলো। মামি টেনে সড়িয়ে নিলো আমাকে। নির্মলের প্রায় অনেক আত্মীয় স্বজন রাই জানতো নির্মল আমাকে পাগলের মতো পছন্দ করতো। এছাড়া আমার গায়ে বিয়ের শাড়ি। বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছি এ খবর ও তাঁরা জেনে যায়। সকলেই হতবাক হয়ে যায় নির্মলের মৃত্যু রহস্য জেনে সকলেই মূর্ছিত হয় আমার আর্তনাদ শুনে। নির্মলের মামার বাড়ির লোকজন পুলিশ নিয়েও আসে আমাকে গ্রেফতার করানোর জন্য। কিন্তু নির্মলের বড় আব্বু রোমান চৌধুরী তাঁদের ধমকে পাঠিয়ে দেয়। মাঝরাতে ধীরে ধীরে একান্ত আপনজনরা ছাড়া সকলেই সরে যায়। নির্মলের মাথার কাছে বসে আছে ওর মা হাত চেপে কান্না করছে ছোট বোন নেহা। নির্ঝর খানিকটা দূরে থম মেরে বসে আছে। মামি আর জেসমিন কে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে ছুটে চলে যাই নির্মলের কাছে। পায়ের কাছে বসে দু’পা আঁকড়ে ধরে আর্তচিৎকার করতে থাকি
-‘ নির্মল, নির্মল, আমার নির্মল। এটা কি হলো আল্লাহ। ও আল্লাহ গো তুমি আমার নির্মলকে ফিরিয়ে দাও। আমার নির্মলকে ভিক্ষা দাও গো আল্লাহ’।
আমার ক্রন্দনধ্বনিতে সকলেই নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো। আমি পাগলের মতো প্রলাপ শুরু করে দেই। সত্যি বলতে আমার সে সময় পৃথিবীর কোন মায়া ছিলোনা। ছিলোনা দিন দুনিয়াতে কোন হুঁশ।
সারাক্ষণ হাসিয়ে মাতিয়ে রাখা ছেলেটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে আছে। পা দুটো বরফের ন্যায় ঠান্ডা। ফর্সা পা দুটো হলদে বর্ণ ধারণ করেছে। সে পায়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললাম,
-‘নির্মল ও নির্মল ওঠো,ওঠোনা। দেখো তোমার সাবা, এই যে আমি তোমার প্রিয় এসেছি দেখো। ও নির্মল তোমার রাগিনী এসেছে তুমি তাকাবেনা? একটি বার দেখবে না লাল শাড়িতে তোমার প্রিয় রাগিনীকে কেমন লাগছে? ও নির্মল ওঠে দেখোনা। তুমি রাগ করেছো তাইনা? অন্যকারো জন্য বউ সাজতে হয়েছে বলে খুব রেগে গেছো? এই দেখো কান ধরছি এই যে আ’ম সরি প্রিয়। বিলিভ মি আমি শুধু তোমার জন্য বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। ওওও বুঝেছি এতোদিনের করা অবহেলার প্রতিশোধ নিচ্ছো তাইনা? কিন্তু চোখ বুজে আছো কেনো? নিথর হয়ে রয়েছোই বা কেনো? তুমি না আমার অপেক্ষায় থাকবে বলেছিলে? আর একটু সময় কেনো অপেক্ষা করলেনা নির্মল। এইভাবে আমাকে মাঝপথে একা ছেড়ে কেনো গেলে? কেনো ঠকালে আমায় কেনো বিশ্বাসঘাতকতা করলে’।
নেহা আমাকে জাবটে ধরে কাঁদতে শুরু করে। জেসমিন সরস্বতীও পাশে এসে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। নির্ঝরের পাশে বসেছিলো রাব্বি সহ আরো সকল বন্ধু-বান্ধব। অপ্রত্যাশিত সেই মৃত্যুটি সকলের হৃদয়কেই কাঁপিয়ে তুলেছিলো।
আমার করা সকল আর্তনাদে নির্মলের মায়ের বুকে হয়তো কিছু একটা কড়া নেড়েছিলো। আচমকাই নেহাকে ছাড়িয়ে ওনি আমাকে জাবটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন ওনি। ওনার ছেলের প্রিয় যে আমি। রাগ,ক্ষোপের বাইরে সব সত্যিই যে জানতেন ওনি।
আমিও ওনাকে জরিয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে বুক ফাটিয়ে হাহাকার করতে থাকি। একসময় সুযোগ হয় নির্মলের কাছে যাওয়ার ওর মাথাটা বুকে জরিয়ে ধরার। আমি যখন ওকে বুকে জরিয়ে ভয়ংকর আর্তচিৎকার করে কাঁদছিলাম তখন মনে পড়ে যায় গতকাল রাতের সেই কুকুরটির আর্তনাদ। গতকাল রাতে এ’সময়টিই কাঁদছিলো কুকুরটি। ভাগ্যের কি নির্মমতা। কি অসহনীয় যে ব্যাথা যার হয় কেবলমাএ সেই বুঝে।
ফজরের আজান কানে ভেসে আসতেই নির্মলের কপালে চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে অদ্ভুত ক্রন্দনধ্বনিতে বলে ওঠি,
-‘ ওহে প্রিয় তোমার নামের তিন কবুল পড়ে নিলাম কবুল, কবুল,কবুল। শুনেছি স্ত্রী কে নাকি স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়। স্ত্রী হলো স্বামীর অর্ধেক অঙ্গ। নিজের সেই অর্ধেক অঙ্গ কে এপারে একা রেখে ওপারে কিভাবে থাকবে প্রিয়? অসম্পূর্ণ যে রয়ে গেলে দিয়ে গেলে আমায় অসম্পূর্ণতা। তৃষ্ণা টুকু মেটানোর সুযোগও দিলে না প্রিয়? এই নির্মমতার পরও চাই ওপারে তোমার পদস্থলে একটুখানি ঠাই দাও ? তোমার আমার আবারো দেখা হবে প্রিয় ? আমাদের হৃদয়ের লেনাদেনা যে এপারে হয়নি প্রিয় ওপারে হবেতো’?
ঐ সময়টিতে নির্মলের বাড়ির প্রতিটি সদস্যই চোখ বড় বড় করে চেয়েছিলো। নেহা আর নির্ঝর সেদিন থেকেই ভাবির আসনে বসায় আমায়। নির্মলের শেষ স্মৃতি হিসেবে সর্বপ্রথম ঐ দুজনই আঁকড়ে ধরে আমায়।
আমার নির্মলের নিষ্প্রাণ দেহটাকে প্রাণ ভরে দেখেছিলাম সেদিন। আমার নির্মল না বড্ড অতৃপ্ত হয়ে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলো। নিস্তব্ধ সেই রাতে প্রিয়জনকে বুকে জরিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে বসে ছিলাম আমি। আগর বাতির কড়া ঘ্রাণে পেয়েছিলাম অন্যরকম এক মাদকতা। যেই মাদকতায় রোজ রাতে উন্মাদের মতো আজো ডুবে থাকি আমি। নির্মলের বাড়ির প্রতিটি সদস্যই ওর স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে আমায়। যে বাড়িতে যে রুমটায় নির্মল কয়েকটা বছর থেকেছে। যে বিছানায় ঘুমিয়েছে,যে বাথরুমে গোসল করেছে। যে ঘরের কোনায় কোনায় স্পর্শ লেগে আছে ওর। যে বাড়িতে শতশত স্মৃতি জরিয়ে আছে, যে ছাদে শতশত খুনসুটি তে মেতে থাকতাম আমরা সেই বাড়িতে জায়গা দিয়েছে আমায়। দিনের আলোর প্রতি ঘৃনা জন্মাতে শুরু করে সেদিন থেকেই যেদিন থেকে আমার নির্মলের জায়গা হয় সাড়ে তিনহাত মাটির নিচে। বিদঘুটে অন্ধকারে ওর নিথর দেহটিকে আবদ্ধ করে আসে ওরই আপনজনরা। ওরা যখন খাটিয়া কাঁধে আমার নির্মলকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে আসে সে সময়ই আমার বুকের বামপাশে তীব্র এক ব্যাথার সৃষ্টি হয়ে জ্ঞান হারাই। সেদিনই হার্ট ব্লক হয়ে যায় আমার। ইশ নির্মলের পরিবার এতো বোকা কেনো ছিলো? নিজের সন্তান, নিজের ভাইয়ের খুনিকে কেউ ট্রিটমেন্ট করিয়ে সুস্থ করে তুলে? নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সুযোগ করে দেয়? মানুষ গুলো বড্ড বোকা তাই তো নির্মলের খুনি সালমা রহমান সাবাকে আজো তাঁরা ফাঁসিতে ঝুলায়নি। নাকি মানুষ গুলো ভীষণ চালাক? রোজ রোজ আমায় গলা কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করতে দেখে সীমাহীন আনন্দ পায় কি তাঁরা? এতো নিষ্ঠুর কেনো তাঁরা? আমার নির্মল যে রোজ রাতে খালি হাতে শূন্য বুকে ফিরে যায় তা কি তাঁরা বুঝেনা?শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিবেশ থেকে মুক্তির অপেক্ষায় দিনগুনে চলেছি। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দ্রুত ফিরতে চাই আমার প্রিয়র নিকটে। একটি বার তাঁকে বলতে চাই ‘ওহে প্রিয় দাওনা তোমার পদস্থলে একটু ঠাঁই’ সে বাক্যটির পরিপেক্ষিতে শুনতে চাই ‘ওহে প্রিয় পদস্থলে নয় তোমার ঠাঁই হবে আমার বক্ষস্থলে ‘।
১৪-০২-২০১৫ (সালমা রহমান সাবা)
১৪.
কেটে গেলো ৯ টি বছর। আমার নির্মল আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে বহুদূরে। যেখান থেকে ফিরে আসা কোনদিনই সম্ভব নয়৷ নির্মলকে হারানোর জন্য দুটো জিনিস দায়ি। এক ভুল,দুই দ্বিধা। আমার একটি ভুল একটি দ্বিধার জন্যই ওকে আমি হারিয়ে ফেললাম। ভালোবাসা নিয়ে এতো দ্বিধা রাখতে নেই। তুমি কাউকে ভালোবাসো কিনা সেটা সর্বপ্রথম তুমিই নির্ধারণ করবে এবং প্রিয়জনকে জানিয়ে দেবে। সেদিন যদি গ্রামে ফেরার আগে একটিবার ভালোবাসার কথা বলে যেতাম নির্মলকে আমার নির্মল অতৃপ্ত হয়ে অন্তত দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিতো না। মাঝরাতে তেষ্টা পেলে আজো আমি পানি পান করিনা। আমার নির্মল যে এর থেকেও ভয়ানক তেষ্টা নিয়ে চলে গেছে। প্রিয়জনকে ঘিরে সকল অনুভূতি সর্বদাই দ্রুত প্রিয়জনের কাছে ব্যাক্ত করা উচিত। নয়তো কখনো কখনো চরম আফসোসে ভুগতে হয়। যে আফসোস রয়ে যা আমৃত্যু।
নির্মলের মৃত্যু ঘটে সেদিনই সাল ২০০৭। স্ট্রোক এবং হার্ট এট্যাক একসাথে হওয়ার ফলেই মৃত্যু হয় ওর।
যখন মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ একটি ধমনীতে এক ক্লোন্টের কারণে বন্ধ হয়ে যায় তখনই মানুষের স্ট্রোক হয়। হার্ট অ্যাটাক ঘটে যখন হৃদস্পন্দনের একটি অংশে রক্ত সরবরাহ কাটা হয়। রক্তের সাথে হৃদয় সরবরাহ করে এমন ধমনীগুলির মধ্যে একটি ক্লোনের কারণে এটি ঘটে।
প্রিয়জনকে খুনের দায়ে এই পৃথিবীতে শাস্তি হয় না কেনো? শুধুমাএ প্রমাণ নেই বলে? আমি যদি বলি ঐ চিঠিটাই বড় প্রমাণ তবুও কেউ কেনো বিলিভ করেনা? কেউ কেনো বুঝতে চায়না ওর স্ট্রোক হয়েছো শুধু মাএ ঐ চিঠিটার জন্যই ওর এট্যাক হয়েছে শুধু মাএ ঐ চিঠিতে লিখিত আমার কথাগুলোর জন্যই। তাহলে কেনো ওরা মানতে চায় না খুনি আমিই?
“আচ্ছা এই পৃথিবীতে নতুন কোন নিয়ম তৈরী হতে পারেনা? যে নিয়মে লেখা থাকবে এ পৃথিবীতে প্রিয়জন ছাড়া বেঁচে থাকা নিষেধ, এ পৃথিবীতে প্রিয়জন ছাড়া একা একা বেঁচে থাকা ঘোর অপরাধ। যে পৃথিবীতে তোমার প্রিয়জনের দীর্ঘসময় ঠাই হয়নি সে পৃথিবীতে দীর্ঘসময় অবস্থান করার কোন অধিকার নেই তোমার । প্রিয়জন বিহীন এ পৃথিবীতে তোমার স্থান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো তোমাকে। যে মৃত্যুকে সুখমৃত্যু হিসেবে হাসি মুখে বরণ করে নেবে তুমি” এই মৃত্যু কি কেউ দেবেনা আমায়? হায় সৃষ্টিকর্তা আর কতো সইতে হবে?
১৪-০২-২০১৬ (সালমা রহমান সাবা)
“প্রেমের অদ্ভুত এক নিয়ম রয়েছে। অতিরিক্ত প্রেমই অতিরিক্ত কষ্ট বয়ে আনে৷ ভালোবাসার অদ্ভুত এক নিয়ম রয়েছে। অতিরিক্ত ভালোবাসাই বিচ্ছেদের মূল কারণ৷ তা কেবল অতিত ঘেটে দেখলেই বোঝা যায়। এই পৃথিবীতে পরিপূর্ণভাবে,খাঁটি ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে যারা একে অপরের থেকে ছিন্ন কেবল তাঁরাই হয়েছে” তাইনা নির্মল?
১৪-০২-২০১৭ (সালমা রহমান সাবা)
“ভালোবাসা অমর তাইতো মানুষের মরণ হয় অথচ তাঁদের ভালোবাসা গুলো থেকে যায় জীবন্ত ভালোবাসার কখনো মরণ হয় না। কোন মানুষের মরণ হলে তাঁর একজনও ভালোবাসার মানুষ যদি দুনিয়াতে না থাকে তাহলে সে মানুষের পুরো জীবনই বৃথা”
১৪-০২-২০১৮ (সালমা রহমান সাবা)
“ভালোবাসা মারাত্মক ভয়ংকর এক মহামারীর নাম। যে মহামারী তে অসংখ্য আবেগ,অনুভূতির মৃত্যু ঘটে”
এর সুস্পষ্ট উদাহরণ নির্মলই দিয়ে গেছে আমায়। লাভ দ্যাট মিনস-
Love=
L= Lakes Of Sorrows ( দুঃখের সাগর )
O= Ocean Of tears ( অশ্রু মহাসাগর )
V=Valley Of Death ( মৃত্যু উপত্যকা )
E= End Of Life ( জীবন শেষ )
১৪-০২-২০১৯
_______________________
হ্যাভেনের অপারেশন সাকসেসফুল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে তাঁর। কেবিনের বাইরে দুজন দেহরক্ষী দাঁড়িয়ে আছে৷ এদিকে পুরো পরিবারে সৃষ্টি হয়েছে ভীতিকর অবস্থা। আহির পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা কারোরি অজানা নয়৷ সে এখন কোথায় আছে সেটাও জানে সকলে। তালুকদার বাড়িদের পারিবারিক বন্ধু রোমান চৌধুরী। রোমান চৌধুরী, নির্ঝর চৌধুরী এবং প্রফেসর সালমা রহমান সাবাকে খুব ভালো করেই জানেন তালুকদার বাড়ির প্রতিটি সদস্য। বাড়ি থেকে পালিয়ে আহি তাঁদেরই পারিবারিক বন্ধুর আত্মীয়র বাসায় ওঠেছে। এই ভেবে কিছুটা নিশ্চন্ত হলেও। স্বস্তি পাচ্ছে না কেউই সকলের বুকেই ধুরুধুরু ভাব। হ্যাভেন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পূর্বমূহর্তেই আহিকে বাড়ি ফেরাতে হবে। কিন্তু ভয় একটাই হসপিটাল বেডে শুয়েই হ্যাভেন সিসি ক্যামেরা ফুটেজে আহিকে দেখতে চাইবেনা তো? বাড়ি থেকে হসপিটাল যাওয়ার পর মূহুর্ত থেকে সবটাই যদি দেখতে চায়? কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। না পরিবারের কেউ ঠিক থাকবে আর না ঐ মেয়েটা ভাবতেই হুমায়ুন তালুকদারের বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। হ্যারিকে দ্রুত ফোন করে বললেন,
-‘ভোরের আলো ফোটার পর পরই বউমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এবং সন্ধ্যা থেকে সকাল অবদি সিসি ক্যামেরা ফুটেজে রেকর্ডকৃত ভিডিও সড়িয়ে ফেলবে৷ কি বলছি আশা করি বুঝতে পারছো ‘?
.
চলবে…
সকাল থেকে লেখা শুরু করতে চেয়েও পারিনি জোরপূর্বক নানুবাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বাসায় এসে সন্ধ্যার পর তারাহুরো নিয়েই লিখতে বসেছিলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটি তে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে ধীরে ধীরে সব উত্তর মিলবে। ধৈর্য ধরে পড়বেন সকলেই।