অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৫।

0
440

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৫।

প্রিয়তা নিজের ভাবনাকে নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখল আপাতত। ফারজাদের মুখ থেকে পুরোটা শুনেই তবে কিছু বলবে, এর আগে না। ফারজাদ আসার আগেই নীহাল প্রিয়তার খোঁজ নিয়ে ফারজাদদের বাড়িতে আসে। টিকেটের ব্যবস্থা করে ফেলেছে সে, তিনদিন পর ফ্লাইট। তাদের যাওয়ার কথা শুনে মৌমির মন খারাপ ভীষণ। দিলরুবা বেগমেরও তাই। প্রিয়তার মনেও মিশ্র অনুভূতি। দেশে ফিরার আনন্দের সাথে এই মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টও যোগ হয়েছে আবার।

এখন সন্ধ্যা। মৌমি চা এনে রাখে টি টেবিলে। সোফায় বসা বাকি মানুষ। সবাই উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। ফারজাদ চায়ের কাপে চুমুক বসাল। চোখে মুখে অপ্রসন্ন ভাব ব্যাপক। নীহাল বলল,

‘মেয়েটা তো ভারী অসভ্য। এমন শিক্ষিত একটা মেয়ে হয়ে এটা কেমন ছেলেমানুষী!’

দিলরুবা বেগম বললেন,

‘ছেলেমানুষী? না-কি তার অন্য উদ্দেশ্য?’

প্রিয়তা বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই,

‘আমারও তাই মনে হয়, অন্য উদ্দেশ্য।’

ভ্রু কুঁচকাল ফারজাদ। বলল,

‘কী উদ্দেশ্য?’

প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলল,

‘আজকাল এসবে কেউ বিশ্বাস না করলেও, এরকমটা হচ্ছে সত্যিই।’

‘কী হচ্ছে?’

ফারজাদ প্রশ্ন করল। প্রিয়তা অপ্রস্তুত সুরে বলল,

‘কালো জাদু।’

চমকাল ফারজাদ। বলল,

‘কী?’

‘হ্যাঁ, ভালোবাসা পেতে এসব অনেক মানুষ’ই করছেন। আর এটা খুব জঘন্য একটা কাজ।’

ফারজাদ মেলাতে পারছে না কিছু। জারা কি এত নিচে নেমে গিয়েছে যে, সব রেখে পরিশেষে সে কালো জাদুতে নামবে? দিলরুবা বেগম আঁতকে উঠলেন। ভয়ে বুকে মোচড় দিল তাঁর। কালো জাদু ভয়ংকর জিনিস, জীবন ধ্বংস করে দেয় এটা। তিনি ভীত সুরে বললেন,

‘তাছাড়া আর কোন কারণে জারা চুল কাটবে? এসব চুল, নখ, শরীরের অংশ তো কালো জাদুতেই লাগে। শেষে কি-না ও আমার ছেলের উপর কালো জাদু করতে চাইছে?’

দিলরুবা বেগমের মুখ পাংশুবর্ণ বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই। ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠল তাঁর। প্রিয়তা দিলরুবা বেগমের হাতের উপর হাত রেখে বলল,

‘ভয় পাবেন না, আন্টি। শয়তান কখনোই আল্লাহর বিপক্ষে জিততে পারে না। এত ক্ষমতা তার নেই। আপনার ছেলের কিচ্ছু হবে না।’

ফারজাদ প্রিয়তার দিকে চাইল। মেয়েটা কী সুন্দর তার মা’কে সাহস দিচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগেও সে নিজে কত ভীত ছিল। নীহাল বলল,

‘তাহলে তো আমাদের পুলিশকে জানানো উচিত এক্ষুনি, এটা তো জঘন্য একটা কাজ।’

‘পুলিশ প্রমাণ ছাড়া কোনো কাজ করবে না, নীহাল। এমন হলে তো আমাদের প্রমাণ লাগবে আগে।’

ফারজাদের কথায় সম্মতি জানিয়ে প্রিয়তা বলল,

‘হ্যাঁ, পুলিশ কেইস করতে প্রমাণ লাগবে। আর সবথেকে বড়ো কথা হলো, এসব ব্যাপারে পুলিশের থেকেও আমাদের বেশি সাহায্য কোনো বড়ো হুজুর বা আলেম করতে পারবেন। যাদের এই বিষয়ে জ্ঞান আছে। আর এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা উচিত। কারণ, কালো জাদু ভয়ংকর, এটা যত সময় ব্যাপি চলবে তত বেশি প্রকট হয়ে উঠবে।’

ফারজাদ মাথায় হাত দিয়ে বসল। জীবনে কখনো এসবের সম্মুখীনও যে হতে হবে তা সে কল্পনাও করেনি। এইজন্যই ভালোবাসার প্রতি এত বিমুখ তার, এটা মানুষকে অমানুষ বানাতেও দু’বার ভাবে না।

দিলরুবা বেগম অস্থির। তিনি বললেন,

‘আমার পরিচিত এক হুজুর আছেন। উনি এইসব নিয়েই কাজ করেন, উনাকে খবর দিব একবার?’

প্রিয়তা কিছু বলার আগেই ফারজাদ বলল,

‘আম্মি, আমরা তো অন্ধকারের উপর ঢিল ছুড়ছি, যদি এমনটা না হয়।’

‘নাহলে তো আরো ভালো। হুজুর একবার তোমাকে দেখলেই সবটা বুঝতে পারবেন।’

‘জি আন্টি, আমারও তাই মনে হয়।’

প্রিয়তার সম্মতি পেয়ে দিলরুবা বেগম আশ্বস্ত হয়ে সেই হুজুরের সাথে যোগাযোগ করলেন। হুজুর জানালেন, এখন তিনি অন্য এক জরুরি কাজে আছেন, আসতে পারবেন না, কাল সকালে আসবেন। এই সন্ধ্যা থেকে সকাল অনেকটা সময়। এই অনেকটা সময় অপেক্ষা করতেও দিলরুবা বেগমের ভয় করছে।

ফারজাদ নিজের ঘরে গেল। ঝুট-ঝামেলা যেন আজকাল পিছুই ছাড়ছে না তার। জারার উপর তার বিরক্তি, রাগ আর ক্ষোভের মাত্রা তরান্বিত হলো বেশ। মেয়েটা এত ঘৃণ্য কাজ কীভাবে করতে পারে। আবার পরক্ষণেই ভাবল, এভাবে আন্দাজের উপর কারোর উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? অসহ্য লাগছে এসব। বসের কথায় আবার অফিসে জয়েন করাটাই হয়তো তার সবথেকে বড়ো ভুল ছিল।

দিলরুবা বেগম নামাজ পড়ে ছেলের রুমে ছুটে এলেন। ফারজাদ তখন বিছানায় শোয়া। এমনিতে নক করেই ঢুকেন তিনি। আজ তারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। ফারজাদ মা’কে দেখে উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে, আম্মি?’

দিলরুবা বেগম জবাব না দিয়ে বিড়বিড় করে অনেকগুলো দোয়া পড়ে ফারজাদের পুরো শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলেন। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,

‘কী করছেন এসব?’

‘বাবা, কালোজাদু থেকে বাঁচার সবথেকে বড়ো উপায় হলো তিন কুল পড়া। সূরা এখলাস, সূরা ফালাক আর সূরা নাস তিনবার পড়ে সারা শরীরে ফু দিলে শয়তানের বদ নজর থেকে বাঁচা যায়। ঐ জারার উপর আমার কোনো বিশ্বাস নেই, বাবা। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো তুমি, এই দোয়াগুলো তোমায় খারাপ নজর থেকে বাঁচাবে।’

ফারজাদ ম্লান হাসল। বলল,

‘এত ভয় পাবেন না, আম্মি। আমার আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে, কোনো কালো জাদু আমার কিছু করতে পারবে না।’

দিলরুবা বেগম অসহায় সুরে বললেন,

‘না না, তুমি জানো না, দুই জিনিস দ্বারা সব সম্ভব, এক দোয়া, আর এক কালোজাদু। দোয়া করে যেমন সব পরিবর্তন করা যায়, তেমনি কালোজাদু করেও সব করা যায়। আমার ভয় করছে। তবে আল্লাহর উপরও আমার ভরসাও আছে অগাধ, উনি আমার ছেলেকে অবশ্যই রক্ষা করবেন।’

‘হ্যাঁ, রক্ষা করবেন। আর আপনার দোয়া তো আমার সাথে আছেই।’

‘তা তো অবশ্যই। তুমিও আয়তুল কুরসী আর তিন কুল পড়ে ফুঁ দাও নিজেকে, এগুলোর অনেক ক্ষমতা। ইনশাল্লাহ, আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।’

মা’কে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে পাঠাল ফারজাদ। মায়ের শুকনো মুখটা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। কাল হুজুরের সাথে কথা বলেই জারার মুখোমুখি হবে সে, মেয়েটাকে এসবের জবাবদিহি করতেই হবে।

নীহাল আর প্রিয়তাকে দিলরুবা বেগম আজ রাতটা এখানেই থাকতে বললেন। দিলরুবা বেগমের মনের অবস্থার কথা চিন্তা করে তারাও আর না করতে পারেনি।

মৌমি বলল,

‘জারা মেয়েটাকে দুটো থাপ্পড় দিতে পারলে আমি শান্তি পেতাম।’

প্রিয়তা বলল,

‘থাপ্পড় দিয়ে আর কী হবে, বলো? উনি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য রীতিমত পাগল হয়ে গিয়েছেন। নয়তো এসব করার আগে উনার বিবেকে বাঁধত অবশ্যই।’

‘উনার বিবেক বলে কিছু আছে না-কি? কী জঘন্য একটা মানুষ, আমার ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে।’

‘থাক উনাকে নিয়ে সমালোচনা করে লাভ নেই। দোয়া করো, আমাদের ধারণা যেন মিথ্যে হয়।’

‘হ্যাঁ, তাই করছি। আমার ভাইয়ের কিছু না হোক, আমার ভাইটা ভীষণ ভালো মানুষ।’

প্রিয়তা মৌমির গালে হাত রেখে বলল,

‘আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, কিছু হবে না।’

_________

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আরো একবার ফারজাদকে আপাদমস্তক ফুঁ দিয়ে দিলেন দিলরুবা বেগম। ফারজাদ রুমে চলে আসে অতঃপর। প্রিয়তা কিছুক্ষণ দিলরুবা বেগমকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মৌমির ঘরে আসে। আবার কী ভেবে সে একবার ফারজাদের ঘরের সামনে যায়। দরজাটা ভিড়ানো। সে টুকটুক শব্দ করে বলে,

‘আসব?’

‘আসুন।’

ভেতরে গেল প্রিয়তা। ফারজাদ লেপটপ কোলে বিছানায় বসা। তাকে দেখে বলল,

‘কিছু বলবেন?’

প্রিয়তা ইতস্তত সুরে বলল,

‘রুকাইয়ার আয়াতগুলো জানেন আপনি?’

ফারজাদ বলল,

‘উঁহু, সব জানি না।’

প্রিয়তা বলল,

‘সুরা ফাতিহা, সুরা বাকারা ১-৫ আয়াত, সুরা বাকারাহ ১০২ আয়াত, সুরা বাকারাহ ১৬৩-১৬৪ আয়াত, সুরা বাকারাহ ২৫৫ আয়াত, সুরা বাকারাহ ২৮৫-২৮৬ আয়াত, সুরা আলে ইমরান ১৮-১৯ আয়াত, সুরা আ’রাফ ৫৪-৫৬ আয়াত, সুরা আ’রাফ ১১৭-১২২ আয়াত, সুরা ইউনুস ৮১-৮২ আয়াত, সুরা ত্বহা ৬৯ আয়াত, সুরা মু’মিনুন ১১৫-১১৮ আয়াত, সুরা সফফাত ১-১০ আয়াত, সুরা আহকাফ ২৯-৩২ আয়াত, সুরা আর-রাহমান ৩৩-৩৬ আয়াত, সুরা হাশর ২১-২৪ আয়াত, সুরা জিন ১-৯ আয়াত, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, সুরা নাস। এই সুরা এবং আয়াতগুলো সাধারণত রুকাইয়ার জন্য পড়া হয়। আপনি পড়তে পারেন, এগুলোতে ভীষণ উপকার আছে।’

ফারজাদ স্মিত হেসে বলল,

‘আচ্ছা পড়ব। আর আমার জন্য চিন্তা না করে এবার ঘুমিয়ে পড়ুন, একটা মানুষের জন্য আর কত দুশ্চিন্তা করবেন।’

প্রিয়তা বলল,

‘আমার জন্যেও আপনি কম করেননি। তাই আপনার বেলায় আমিও দুশ্চিন্তা না করে পারছি না। আমি চাই না আপনার কোনো ক্ষতি হোক।’

‘হবে না। আপনাদের এত এত দোয়ার ভিড়ে আমার কোনো ক্ষতি হবে না।’

প্রিয়তা প্রসন্ন হাসল। বলল,

‘আচ্ছা, নিশ্চিন্ত হলাম। দোয়াগুলো পড়ে ঘুমাবেন, শুভ রাত্রি।’

‘শুভ রাত্রি।’

প্রিয়তা চলে গেল। ফারজাদ এবার বোধহয় একটু বেশিই মুগ্ধ হলো মেয়েটার আচরণে। তাকে নিয়ে এত চিন্তা তার, আশ্চর্য!

চলবে…

(শুধু কালো জাদু না যেকোনো ধরনের খারাপ অথবা অতিপ্রাকৃতিক পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সর্বদা আয়তুল কুরসী এবং তিন কুল পড়ে নিজেকে ফুঁ দিন, এটার প্রভাব ভীষণ প্রকট। শুধু আপনার বিশ্বাসটা মজবুত হতে হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here