অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৬।

0
441

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৬।

ঘড়িতে আট’টা ত্রিশ। বসার ঘরে পিনপতন নীরবতা। সবার শুকনো চোখ মুখ। একজন পঞ্চাশোর্ধ হুজুর বসে আছেন ফারজাদের মুখোমুখি। ফারজাদকে বেশ কিছু প্রশ্ন করার পর তিনি এখন চোখ বোজে বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছেন। দিলরুবা বেগমের ভীত মুখশ্রী। প্রিয়তা, নীহাল আর মৌমিও সমানতালে চিন্তিত। ফারজাদ চুপচাপ বসে আছে নীরবে। হুজুর কী করছেন তা তার বোধগম্য হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর হুজুর চোখ মেলে তাকালেন। ফারজাদের আপাদমস্তক ফুঁ দিয়ে দিলেন তিনি। দিলরুবা বেগমের দিকে চেয়ে বললেন,

‘জাদুর প্রভাব শুরু হয়নি এখনো। তবে এটা ঠিক যে, কেউ উনার সাথে খারাপ কিছু করতে চাইছে। ঐ মানুষটার থেকে উনাকে দূরে থাকতে হবে। আর একটা কথা, মানুষের মধ্যে যেমন ভালো খারাপ আছে তেমনি আল্লাহর আরেক সৃষ্টি জ্বিনদের মাঝেও ভালো খারাপ আছে। মূলত মানুষকে বিপদে ফালানো কিংবা ক্ষতি করাই খারাপ জ্বিনের কাজ। তবে আপনারা চিন্তা করবেন না, খারাপ জ্বিনের সাথে লড়াই করার জন্য ভালো জ্বিনও আছে। আপাতত উনার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে অবশ্যই উনাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং সবসময় নিজেকে দোয়া দুরূদ পড়ে ফুঁ দিতে হবে। আর আমি প্রতি সপ্তাহে একদিন এসে রুকইয়াহ করে যাব। ইনশাল্লাহ, আল্লাহ সহায় হলে কেউ উনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’

দিলরুবা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হুজুরকে হাদিয়া দিয়ে বিদায় জানালেন তিনি। বাড়ির সবাই কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলো। হুজুর চলে যাওয়ার পর দিলরুবা বেগম ফারজাদকে বললেন,

‘তোমার আর ঐ অফিসে চাকরি করার দরকার নেই, ফারজাদ। ঐ জারাকে আমি আর একটুও বিশ্বাস করিনা, ও আমার ছেলেটার ক্ষতি করে ছাড়বে।’

ফারজাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘জি আম্মি, আমিও তাই ভাবছি। আর ঐ চাকরি করব না, এত ঝামেলা আমিও আর নিতে পারছি না।’

সে উঠে নিজের রুমে চলে গেল। দিলরুবা বেগম বসলেন সোফায়। দুশ্চিন্তায় কারোর আর খাওয়া হয়নি কিছু। প্রিয়তা বলল,

‘আজ নাস্তাটা আমি বানাই, আন্টি?’

দিলরুবা বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন,

‘না না, তুমি কেন বানাতে যাবে? আমি যাচ্ছি।’

‘আপনি বসুন, আন্টি। যাওয়ার আগে একটা দিন নাহয় আপনাদের রান্না করে খাওয়ালাম কিছু, আমার ভালো লাগবে তাতে।’

দিলরুবা বেগম বললেন,

‘তুমি কেন অযথা কষ্ট করতে যাবে, মা?’

‘কষ্ট কেন হতে যাবে? আমি তো বরং খুশি হব।’

নীহাল বলল,

‘করুক না, আন্টি। একটা দিন নাহয় ওর হাতের নাস্তা দিয়েই দিন শুরু করলেন।’

প্রিয়তার জোরাজুরিতে দিলরুবা বেগম আর না রাজি হয়ে পারলেন না। প্রিয়তা খুশি মনে রান্নাঘরে ঢুকল। তার পেছন পেছন এলো মৌমিও।

নীহাল বসার ঘরে অন্য সোফায় বসা। বলল,

‘এখনো দুশ্চিন্তায় আছেন, আন্টি?’

দিলরুবা বেগম তার দিকে চাইলেন। বললেন,

‘মায়ের দুশ্চিন্তা কি আর এত সহজে কমে, বাবা? ছেলেটাকে নিয়ে যে আমার কত চিন্তা! যতদিন পর্যন্ত না ওর সমস্ত দায়িত্ব আমি কারোর হাতে তুলে দিতে পারব, ততদিন পর্যন্ত আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব না।’

‘ফারজাদকে বিয়ে করিয়ে বউ আনুন, তারপর তার বউকেই নাহয় সব দায়িত্ব দিয়ে আপনি অবসর নিবেন।’

‘ছেলেটাকে কি আর রাজি করাতে পারি। সেই তো কবে থেকে বিয়ের কথা বলছি, পাত্তাই দিচ্ছে না আমাকে।’

‘উনার হয়তো কোনো পছন্দ আছে, তাই এত উপেক্ষা করছেন ব্যাপারটা।’

‘এমন হলেও তো আমি খুশি হতাম, ছেলেটা তো আমার এইদিকেও নেই। ওর প্রেম ভালোবাসার প্রতি ভীষণ বিমুখতা। ছেলেটাকে নিয়ে যে আমি কী করি।’

‘চিন্তা করবেন না, ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। আপনিই বরং দায়িত্ব নিয়ে একটা ভালো মেয়ে খুঁজে বের করুন, তারপর দেখুন উনাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে পারেন কি-না।’

দিলরুবা বেগমের তখনে খেয়ালে এল, এখনই কি একবার নীহালকে তার বোনের কথা বলে দেখবে? বলাটা কি আদৌ উচিত হবে তাঁর? তিনি দুটানায় পড়লেন। নীহাল খেয়াল করে বলল,

‘আপনি কি কিছু বলতে চাইছেন, আন্টি?’

দিলরুবা বেগম মৃদু হেসে বললেন,

‘না মানে, আসলে একটা কথা… কী করে যে বলি…’

‘কী কথা, আন্টি? বলুন না।’

‘তুমি আবার কী না কী মনে করো?’

‘ছেলে হিসেবে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।’

তাও দিলরুবা বেগম ইতস্তত করছেন। নীহাল বলল,

‘আচ্ছা, বলতে না চাইলে জোর করব না।’

দিলরুবা বেগম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করার চেষ্টা চালালেন। অতঃপর বললেন,

‘তোমার বোন মানে প্রিয়তাকে আমার ভীষণ পছন্দ। মেয়েটা ভীষণ ভালো, মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার মেয়ে মৌমি তো ওর জন্য পাগল। আমারও ওর ব্যবহার, ওর ব্যক্তিত্ব ভীষণ পছন্দ। আমার ছেলের দায়িত্বটা যদি আমি ওর হাতে দিতে পারতাম, তাহলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম পুরোপুরি। আমার প্রিয়তার উপর অনেক ভরসা, আমি জানি মেয়েটা আমার ছেলেটাকে ভালো রাখবে।’

নীহাল বাক খুইয়ে বসল। মৌমির সাথে সাথে দিলরুবাও বেগমও এমনটাই চান? সে অতি আশ্চর্যে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। দিলরুবা বেগম বললেন,

‘আমি তোমাদের মা বাবার সাথে কথা বলার কথা ভাবছিলাম, তোমরা দেশে ফিরলেই কথা বলব। এখন তুমি ফারজাদের বিয়ের কথা তুলাতেই তোমাকে আগে বলেছি, তোমার এই ব্যাপারে কী মতামত, বাবা?’

নীহাল মাথা নুইয়ে ঠোঁট কামড়ে ভাবল কী যেন। তারপর বলল,

‘আন্টি, নিঃসন্দেহে আপনাদের মতো ভালো মানুষ হয়না। আপনারা আমার বোনকে একটা নতুন জীবন দিয়েছেন। আমি এবং আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব তার জন্য। আর ফারজাদের কথা আর আলাদাভাবে কী বলব? উনার মতো ছেলে পাওয়া দুষ্কর। আপনার মতো শাশুড়ি আর ফারজাদের মতো স্বামী হয়তো প্রত্যেকটা মেয়েই তার মোনাজাতে চায়। আর ভাই হিসেবে আমিও আমার বোনের সুন্দর ভবিষ্যত’ই কাম্য করি। আপনাদের কাছে থাকলে আমার বোন নিঃসন্দেহ ভালো থাকবে। কিন্তু, আমার মা বাবা বা প্রিয়তা ব্যাপারটাতে রাজি হবে কি-না আমি বলতে পারছি না। আর এমনিতেই এই কয়টাদিন মেয়েটা যেসবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে তারপর এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ওর জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়বে।’

দিলরুবা বেগম বললেন,

‘হ্যাঁ, সেটা আমিও জানি। তাই বলছিলাম, তোমরা দেশে ফিরো আগে। প্রিয়তা নিজের স্বাভাবিক জীবনটা ফিরে পাক আবার, তারপর’ই নাহয় আমি তোমার মা বাবার সাথে কথা বলব।’

‘ঠিক আছে, আন্টি। প্রয়োজন পড়লে আমি নিজেও আমার মা বাবাকে বোঝাব।’

দিলরুবা বেগম খুশি হলেন। বললেন,

‘আচ্ছা।’

__________

মৌমি ভেজে রাখা পাউরুটি একটাতে কামড় বসিয়ে বলল,

‘আচ্ছা আপু, তোমার ভাই তোমার থেকে কয় বছরের বড়ো?’

‘ঐ তো ছয় সাত বছরের।’

‘মানে ফারজাদ ভাইয়ার সমবয়সী।’

‘তোমার ভাইয়ার বয়স কত?’

‘হবে হয়তো উনত্রিশ ত্রিশ।’

‘হ্যাঁ, নীহাল ভাইয়ারও তাই।’

‘ওহ, কী মিল উনাদের। আর তোমার বয়স কত?’

‘তেইশ, সামনের মাসে চব্বিশ হবে। তোমার?’

‘একুশ, কয়েক মাস পর বাইশে পড়বে। তারমানে আমরাও কাছাকাছি বয়সের।’

‘হু, তাই তো দেখছি।’

‘এই আপু, আমাদের অনেক মিল, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা, তোমার ভাই বিয়ে করবেন না?’

প্রিয়তা এই প্রশ্ন শুনে মৌমির দিকে তাকায়। মৌমি হেসে ফেলে বোকার মতো। দাঁত কেলিয়ে বলে,

‘না মানে, তোমার ভাইয়েরও কি আমার ভাইয়ের মতো বিয়ে না করার রোগে ধরেছে না-কি সেটা জানার জন্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম।’

প্রিয়তা ফের নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল,

‘করবে তো। মা বাবা উনার জন্য মেয়ে দেখছেন, তবে পছন্দমতো হচ্ছে না।’

‘কেন, হচ্ছে না কেন?’

‘নীহাল ভাই বলেছেন, আমার যাকে পছন্দ তিনি তাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু আমার তো বাংলাদেশী কোনো মেয়েকে পছন্দই হচ্ছে না।’

মৌমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,

‘তাহলে এখন কি বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করাবে?’

‘হ্যাঁ, পাকিস্তানী মেয়ে বিয়ে করাব ভাবছি। পাকিস্তানী মেয়েরা ভীষণ সুন্দর।’

মৌমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘তোমার কি এখানের কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?’

‘হয়েছে তো।’

‘কোন মেয়ে?’

প্রিয়তা তার দিকে চেয়ে বলল,

‘মৌমি নামের একটা মেয়েকে আমার ভীষণ মনে ধরেছে। ভাবছি তাকেই ভাইয়ের বউ বানাব।’

মৌমি চোখ নাড়িয়ে চাড়িয়ে বলল,

‘এই নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে।’

হুট করেই নিজের নাম মনে পড়তেই বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সে। হতভম্ব হয়ে বলে,

‘মৌমি তো আমার নাম।’

প্রিয়তা হেসে ফেলে। বলে,

‘আমিও তো তোমার কথাই বলছি।’

চলবে…

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here