#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে(পর্বঃ পাঁচ)
ঈর্ষার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে বর্ষার। সে শোয়া থেকে উঠে বসে। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টের পায় নি। তবে বেশ আরাম করে ঘুমিয়েছে সে। দীর্ঘসময় ধরে কান্না করলে চোখজোড়া ক্লান্ত হয়ে পরে। ঘুম ভালো হয়।
বর্ষা চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। কয়টা বাজে সে অনুমান করতে চাইছে। কিন্তু করতে পারছে না। তাদের ঘরে কোনো ঘড়ি নেই।
ঈর্ষা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা বলল,
আমি খাবো না।
ঈর্ষা অনুনয়ের স্বরে বলল,
আপা, সকালে তোমার পেটে দুটো দানা পরেছে কি পরে নি! তা নিয়ে পুরো দিন পারি করে দিবে? একটু খেয়ে নাও।
বললাম তো খাবো না। খিদে নেই। কানের কাছে প্যান প্যান করিস না তো।
আমি তো প্যানপ্যান করছি না।শুধু বলছি খাবার খেয়ে নাও।
খাবার খেতে বলা আর কানের কাছে প্যানপ্যান করা একই।
ঈর্ষা চুপ করে রইলো।
বর্ষা আবার বলল,
খাম্বার মত দাঁড়িয়ে থাকবি না প্লিজ। অন্য ঘরে যা। মন মেজাজ ভালো নেই। গালে থাপ্পর বসিয়ে দিবো।
ঈর্ষা থাপ্পর খাওয়ার ভয়ে তার বড় বোনের আদেশ অর্ধেক পালন করার সিদ্ধান্ত নিলো। সে প্যান প্যান করা বন্ধ করলো। কিন্তু অন্য ঘরে গেলো না। খাবার হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। প্যানপ্যান করলে সত্যিকার অর্থেই থাপ্পর খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু অন্য ঘরে না গেলে সম্ভাবনা নেই। এই ঘর তার বোনের একার না, সেও অংশীদারি।
বিকালের দিকে বর্ষা ফুরফুরে মেজাজে রান্নাঘরে ঢুকলো। রুমানা খাবার বাটিতে বারছে। ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখা হবে। আমেনাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। বর্ষা সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
মা, আমেনা কোথায়?
ছাদে। কাপড় তুলতে গিয়েছে। কেনো?
আমি এক কাপ চা খাবো।
তা বেশ তো। আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
না। তোমার বানানো চা খাবো না। আমেনার বানানো চা খাবো। ওর বানানো চায়ের স্বাদ ভিন্ন।
কেমন ভিন্ন?
ভিন্ন মানে আলাদা। অন্যরকম মজা। এরকম মজার চা তুমি বানাতে পারবে না।
রুমানা নিচু স্বরে বলল,
তুই এভাবে বিয়েটা না ভাঙ্গলেও পারতি।
আমি বিয়ে ভাঙ্গি নি মা। বিয়ে ভাঙ্গবে এমনটা আগে থেকেই আমার ভাগ্যে লিখা ছিলো।
তুই ছেলেকে এরকম ফালতু কথা বলবি তাও আগের থেকে ভাগ্যে লিখা ছিলো?
অবশ্যই ছিলো। ভাগ্যে লিখা ছিলো বলেই বলেছি। মা শোনো, প্রতিটি মানুষের জীবনে পূর্বে যা ঘটেছে, যা বর্তমানে ঘটছে এবং যা ভবিষ্যতে ঘটবে সব আগের থেকে লিখা। প্রি প্ল্যান্ড।
বর্ষা।
বলো, মা।
নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করিস না।
বর্ষা হেসে ফেললো।
নষ্ট জিনিস নতুন করে নষ্ট করা যায় না, মা।এসব চিন্তা বাদ দাও। আমেনা আসলে ওকে বলবে ফার্স্ট ক্লাস এক কাপ চা বানিয়ে আমার ঘরে রেখে আসতে। আমি গোসলে যাচ্ছি। চায়ের কাপটা যেনো পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখা থাকে। আমার গোসল করতে সময় লাগবে। দেখা যাবে, আমি চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার আগেই মশা, মাছি চা খেয়ে বসে আছে।
বর্ষা নিজের ঘরে চলে এলো। তার শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে। আলমারি থেকে পুরানো একটি সুতির শাড়ি বের করলো সে। হালকা সবুজ রঙের মাঝে সাদা ছোট ছোট ফুল। শাড়িটা নিয়ে সে বাথরুমে ঢুকলো। বেসিং এর ওপর দেয়ালে ডিম্বাকৃতির আয়না। বর্ষা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলো। কতদিন পর সে নিজের চেহারা আয়নায় দেখছে! চোখের নিচে হালকা কালি পরেছে। গহীন রাতের অন্ধকারের সাথে তার যে গোপন সম্পর্ক রয়েছে, চোখের নিচের কালি তার সাক্ষী। যত্নের অভাবে চামড়া খসখসে হয়ে গেছে। চেহারায় রুক্ষ্ম ভাব।
অথচ কয়েকটা বছর আগেও সে এমন ছিলো না। নিজের প্রতি ভীষণ যত্নশীল ছিলো। দিনে পনেরো থেকে বিশ বার আয়নায় নিজেকে দেখতো। বাড়িতে থাকলেও তার চোখে শোভা পেতো কালো কাজল। আর এখন আয়নায় নিজেকে দেখার ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনীহা! কি যেনো নেই। আহাঃ কি যেনো নেই!
বর্ষার চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এলো। গাল গড়িয়ে পানি পরতে লাগলো। সে তার চোখের পানি সমগ্র মুখে ঘষে ঘষে মাখতে লাগলো।
রুমে আমেনা চা রেখে গেছে। পিরিচ দিয়ে কাপ ঢেকে রাখা। বর্ষা চায়ের কাপে চুমুক দিলো। ঠান্ডা হয়ে গেছে। চা গরম করার জন্য রান্নাঘরে যেতে হবে। চুলা জ্বালাতে হবে। পাতিলে চা ঢেলে গরম করতে হবে। সামান্য গরম চা খাওয়ার জন্য এত আয়োজন করতে ইচ্ছে করছে না বর্ষার। ঠান্ডা চা খেতে বিস্বাদ লাগে না। সে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছাদে চলে আসলো। সিমেন্টের বেদির ওপর বসলো। চারিদিকে কুয়াশার পাতলা চাদর পরেছে। যদিও আবহাওয়া খুব একটা ঠান্ডা না। মেঘের ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্য তার আলো সূক্ষ্ম সূতার ন্যায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার বিকালগুলো ভীষণ সুন্দর হয়। এই সুন্দর বিকালগুলো সবসময় একা উপভোগ করতে ইচ্ছে করেনা। পাশে কারোর উপস্থিতির প্রয়োজন পরে। সেই মানুষটা ছাদে হাত ধরে হাঁটবে। চায়ের কাপে ভাগ বসাবে। গুটুর গুটুর করে গল্প করবে। বর্ষার ভাবতে লাগলো।
তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য কার উপস্থিতি এখন প্রয়োজন?
একে একে তার পরিচিত প্রতিটি মানুষকে সে কল্পনা করতে লাগলো। মা এবং বাবা অতি আবেগপ্রবণ। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, বিয়ে সংক্রান্ত আলাপ ছাড়া অন্য কোনো আলাপ তাদের সাথে করা সম্ভব না। ঈর্ষা অথবা শাহানার সাথে কথা বলতে ভাল্লাগবে। কিন্তু বিকালের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে না। তবে কার থাকা উচিত ছিলো?
বর্ষার মাথায় একজনের নাম আসলো। সে সিমেন্টের বেদি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এই মানুষটাকে নিয়ে অল্প কিছুক্ষণের জন্য তার কল্পনায় জগতে হারিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
বর্ষা হাঁটতে শুরু করলো। তার পাশে কল্পনার সেই মানুষটিও হাঁটছে।
কেমন আছেন?
ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?
জ্বি ভালো আছি। আপনার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে আজ ফোন করা হয়েছে।জানেন?
জানি।
আমাদের বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো।
হু।
আপনি খুশি হয়েছেন?
না।
কেনো হোন নি? আমার মত খারাপ মেয়েকে বিয়ে করে খুশি হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না।
আপনি খারাপ মেয়ে?
অবশ্যই খারাপ মেয়ে। সাথে দুশ্চরিত্রা।
হোয়াট ইজ ‘দুশ্চরিত্রা?’
দুশ্চরিত্রা মানে বোঝেন না?
না।
বুঝবেন কিভাবে? ইংলিশ পড়তে পড়তে তো বাংলা ভুলে গেছেন। আপনাদের মত লোকদের কি করা উচিত জানেন?
কি করা উচিত?
নিতম্বে লাত্থি দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।
‘নিতম্ব’ কি জিনিস আবার?
‘নিতম্ব’ মানে প্রগতীপন্থি। সহজ বাংলায় পাছা।
ও আচ্ছা ‘হিপ!’ আই গট ইট।
বর্ষা হেসে ফেললো।
আপনি কি জানেন আপনি ‘দ্যা গ্রেট বলদ’?
মাত্রই জানলাম।
আজকের বিকালটা সুন্দর তাই না? শিহাব মাথা নেড়ে বলল, হু।
আপনাকে কল্পনায় কেনো ডেকেছি জানেন?
কেনো?
আমার হাত ধরে হাঁটতে। হাঁটবেন?
হাঁটবো।
আমার সাথে গুটুর গুটুর করে গল্প করবেন?
করবো।
সাথে আমার কাপ থেকে আপনি এক দুই চুমুক চাও খাবেন। যদিও ঠান্ডা হয়ে গেছে। তবুও বিস্বাদ লাগবে না।
আমি তো চা খাই না।
সেটা আমার দেখার বিষয় না। যেহেতু বলেছি খাবেন, সেহেতু খেতে হবে।
শিহাব হেসে চায়ের কাপ হাতে নিলো।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পরেছে। শেষ বিকালের আলো কুয়াশার পর্দা ভেদ করে ছুঁয়ে দিচ্ছে সব। কেমন অদ্ভুত এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা রেলিং ঘেঁষে একা দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে। পূর্ব দিকের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি শোনা গেলেই ঘরে ফিরে যাবে সে।
লেখিকাঃ আতিয়া আদিবা