#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ০৩
রাত তখন দুইটা। ল্যাপটপ নিয়ে বসে মুভি দেখছে মাহানুর। সন্ধ্যায় অহনা এসেছিলো। দুই বান্ধবী মিলে অনেকক্ষন গল্প করলো। চকলেট কেক তৈরি করলো। অহনার ধারণা ঠিক ছিল মাহানুর তাকে পেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়ে গিয়েছিলো। ডিনার করে আয়াস তাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। মাহানুর অনেক বলেছিলো থেকে যেতে কিন্তু অহনা তাড়া দেখিয়ে চলে যায়।
হটাৎ ফোনে মেসেজের নোটিফিকেশন আসতেই মাহানুরের নজর ফোনের ওপরে পরে। ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকে। তাঁদের চারজনের গ্রূপে সকলে মেসেজ দিয়ে ভরে রেখেছে। এখনও সকলে জেগে আছে। মাহানুর মেসেজ করলো,
-আব্বেহ শা’লা’শা’লীরা এখনও ঘুমাস নি তোরা! আবার রাতে চুরিটুরি করতে যাবি নাকি?
-হ্যাঁ তোর বাসায় চুরি করতে আসবো। বি কেয়ারফুল।(মুহিব)
-ওকে আয়। আমিও লাঠি নিয়ে তৈরি।(মাহানুর)
-না ভাই তোর যদি কোনো বোন থাকতো তাহলে নাহয় ভেবে দেখতাম!(সিয়াম)
-তোরা আর ভালো হবি না রে।(অহনা)
-ভালো মানুষরা আর কত ভালো হবে। আজব!(সিয়াম)
-ইসসসস!(মাহানুর)
-গাইস শোন সবাই, রাতে আমি অহনার মুলাকে দেখেছি। বন্ধুর সাথে কী নিয়ে জানি রাগারাগি করছিলো। (মুহিব)
-কেঠা? আমাগো বখাটে রিদ জিজু নাকি? (মাহানুর)
-হো। (মুহিব)
-ভাই তোরা রিদকে জিজু বলবি না। আমার ভালো লাগে না। (অহনা)
-কেনো ভালো লাগে না জানন? (মাহানুর)
-এতো হ্যান্ডসাম, ফর্সা, বড়োলোক্স, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির ছেলেকে তোর ভালো লাগে না!তাহলে তোর ভালো লাগে টা কী? (সিয়াম)
-আমি ছয় ফুট ছেলে চাই পেলে বলিস আমাকে। (অহনা)
-নিজে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির আর পোলা খুঁজে ছয় ফুট! ওম্যান। (মুহিব)
-আমার আবার বেশি লম্বা ছেলে পছন্দ নয়। আমি পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি আমার জামাইকে হতে হবে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। দ্যাটস এনাফ। (মাহানুর)
-পেয়ে যাবি চিন্তা নেই। (সিয়াম)
-আচ্ছা সবাই কাল সকালে মার্কেটিং করে যাবতীয় দরকারি জিনিস মনে করে প্যাক করিস। সন্ধ্যায় একবারে স্টেশনে দেখা হচ্ছে তাহলে। (অহনা)
-ইয়েস। (মাহানুর)
মেসেজিং শেষ হলে ফোনটা বিছানার কিনারে রেখে ঘুমিয়ে পরে মাহানুর। আগামীকাল অনেক কাজ আছে এখন বেশি রাত না জাগাই ভালো মাহানুরের মতে।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল আলো চোখ মুখে পরতেই কপাল কুঁচকে ফেলে মাহানুর। বিরক্ত হয়ে অন্যপাশ ফিরে শোয়। আকস্মিক দরজায় ঠক ঠক আওয়াজে ঘুম উড়ে যায় তার। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে দশটা পঁচিশ বাজে। লাফ দিয়ে উঠে মাহানুর। আজ আর ভার্সিটি যাবে না সে। বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং টেবিলে আসে। সবার নাস্তা করা শেষ শুধু সে আর ছোট ফায়াজ বাদে। মাহানুর কোনোরকম নাস্তা করে সায়রিনকে নিয়ে বেরিয়ে পরে শপিং করতে। ইচ্ছে মতো কেনাকাটা করে তিনটায় তারা বাসায় আসে। মাহানুর চটজলদি শাওয়ার নিয়ে ব্যাগ প্যাক করতে থাকে। তাকে সাহায্য করছে হাজেরা। প্যাকিং শেষ হয় পাঁচটায়। মাহানুর দ্রুত করে নিজে তৈরি হয়ে নিলো। যেহেতু অনেকক্ষন জার্নি করতে হবে তাই সে কমফোর্টেবল ড্রেস পরেছে। জিন্সপেন্ট, হাঁটু পর্যন্ত শার্টটপ্স, উঁচু করে ঝুঁটি, গলায় কালো ওড়না, চোখে চশমা আর ঠোঁটে লিপগ্লোস ব্যাস সে রেডি। কাঁধে ব্যাগপ্যাক ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয়। একে একে সকলের সাথে দেখা করে রওনা হয় মাহানুর।
___________________________
ত্রিশ মিনিট ধরে ট্রেনে বসে আছে তারা এখনও ছাড়ার নাম নেই। অহনা ফোন টিপছে। সিয়াম আর মাহানুর নিজেদের মধ্যে বক বক করছে আর মুহিব তার গফের সাথে কথা বলছে। মাত্রই বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া হয়েছে। এখনই দুই মিনিটের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেবে। না চাওয়ার সত্ত্বেও অহনার বারে বারে রিদের কথা মনে পরছে। রিদ কী এইকয়দিন তাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তা করবে? অস্থির হয়ে কী সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষের মতো তার খোঁজ নিবে? তার হোস্টেলের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?
অহনাকে চুপ থাকতে দেখে মাহানুর বলল,
-আজ অহনা আপা এতো চুপচাপ কেনো? কোনোভাবেই কী সে তার মুলাকে মিস করছে?
-এইরকম কিছু না।
ছটপটে বলল অহনা। সিয়াম, মুহিব শব্দ করে হেসে উঠে। মাহানুর আগ্রহী হয়ে জিগ্যেস করে,
-আচ্ছা তোদের বাসার আশেপাশে ভালো ভালো ঘুরতে যাওয়ার জায়গা আছে না?
-অনেক আছে। আমাদের বাড়িটা একটু গ্রাম সাইডে। সেখানকার প্রকৃতি এমনেই অনেক সুন্দর।
-ওওও!
-আমার চাচা তার পরিবার নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে। আমার যে আপুর বিয়ে তাঁদের বাড়িটা একদম শহরের মধ্যে আর সবচেয়ে বেস্ট জিনিস হলো তাঁদের বাড়ি থেকে আর্মিদের ক্যান্টনমেন্ট দেখা যায়। ছাদে উঠলে দেখতে পাবি কিভাবে আর্মিদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।
মাহানুর অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে। তৎক্ষণাৎ আবার ভোঁতা মুখ করে বলল,
-আমার আর্মি মানুষ পছন্দ না বাট আমি তাঁদের দেখতে চাই।
-জানিস মাহানুর আমরা যে জিনিস সবথেকে বেশি অপছন্দ করি সে জিনিসই কিন্তু আমাদের ভাগ্যে লেখা থাকে।
মাহানুর আর কিছু বলল না। ঝড়ের গতিতে চলছে ট্রেন। জানালা দিয়ে রাতের সৌন্দর্য দেখতে থাকে সে। প্রকৃতির দারুণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ মাহানুরের মন চাইলো সময়কে এখানেই আটকে রাখতে। বাহিরে দৃষ্টি রেখেই মনে মনে আওড়ালো,
-এই পথ যদি না শেষ হয় এখানেই থেমে যাক সময়।
এগারোটার দিকে ঘুমিয়ে পরেছিল অহনা, সিয়াম, মুহিব। মাহানুর বসে বসে ফোন চালাচ্ছিলো। এখন প্রায় রাত শেষ প্রহর।কিছুক্ষনের মধ্যেই চট্টগ্রাম স্টেশন এসে পরবে। মাহানুর ত্বরিতগতিতে তিনজনকে ডেকে ঘুম থেকে জাগায়। মুহিব ঘুম ঘুম চোখে সব ঘোলা ঘোলা দেখছে। বিরক্ত হয়ে বলল,
-ভাই তোরা যা আমার ঘুম আসছে। আমি আরেকটু ঘুমিয়ে তারপর আসছি।
সিয়াম মৃদু চাপর মারলো মুহিবের মাথায়। তৎক্ষণাৎ মুহিবের ঘুম উবড়ে গেলো। ব্যাগ উঠিয়ে তাড়া দেখিয়ে বলল,
-কিরে তোরা এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
কেউই উত্তর দিলো না বিরক্তিকর চোখে শুধু তাকিয়ে রইলো। স্টেশন আসতেই একে একে চট্টগ্রামের সকল যাত্রীরা নেমে পরে। মুহিব বিড়বিড় করে দোয়া পরছে। এতো রাতে যদি তাঁদের ওপর কোনো ভুতে আক্রমণ করে! সিয়াম একটা অটোরিকশা ভাড়া করে নেয়। চারজন বসতেই শোঁশোঁ করে অটো চলতে থাকে। মুহিব ভীত হয়ে সিয়ামের সাথে চিপকে বসেছে। মাহানুর সেটা দেখে হেসে বলল,
-কিরে তুই এভাবে সিয়ামের সাথে লেগে বসেছিস কেনো? তুই কী কোনো ভাবে এখন ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছিস?
মাহানুরের কথায় ভড়কে গেলো সিয়াম। ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেয় মুহিব কে। তারপর বলে,
-ওই বেটা দূরে সরে বস আমি কিন্তু কোনো গে মে না বলে দিলাম।
-দোস্ত এমন করিস না আমার না অনেক ভয় করছে।
-তুই বিশ্বসুন্দরী হয়ে যাসনি যে ভুত এতো মানুষ রেখে তোকেই নিয়ে যাবে। বো’কাচো*!
সিয়ামের কথায় মুহিব বাদে সবাই হেসে ফেলে।মুহিব কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো শুধু। শহরের রাস্তা পেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় প্রবেশ করে তাঁদের অটো। উঁচুনিচু রাস্তা হওয়ায় অটোআলা সুবিধা ভাবে গাড়ি চালাতে পারছে না। মাহানুর অহনাকে জিগ্যেস করে,
-কিরে কোথায় নামতে হবে?
-আমার না স্পষ্ট মনে নেই তবে আরেকটু সামনেই আমরা নেমে পরবো। সামনের ব্রিজের ঐখানে আমার আব্বু দাঁড়িয়ে থাকবে।
-তাহলে আর চিন্তা নেই।
মাহানুর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে একটু ফেইসবুকে ঢুকবে কিন্তু একটুও নেট নেই। লাগাতার কয়েকবার লগ ইন করার চেষ্টা করে শেষে ব্যর্থ হয়ে চ শব্দ করে উঠে। হটাৎই অটো মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায়। মুহিবের কলিজা ধক করে উঠলো। সিয়াম জিগ্যেস করলো,
-মামা কী হলো?
-মনে হয় অটোর তেল শেষ আপনেগো এইখানেই নামতে হইবো।
-কিন্তু আমরা তো আরেকটু সামনের নামবো!
উদ্বিগ্ন হয়ে বলল মাহানুর। অহনা আশেপাশে দেখে বলল,
-আচ্ছা এখানেই নেমে পরি বেশিসময় হাঁটতে হবে না মনে হয়।
-ঠিক আছে।
সকলে নেমে পরে অটো থেকে। সিয়াম ভাড়া মিটিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে পা ফেলে সামনে এগোয়। এতক্ষন ভয় না পেলেও এখন অহনারও ভয় করছে। কেমন সুনশান নীরব রাস্তা। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলো জ্বালিয়ে আগে বাড়ছে। কেমন অপরিচিত রাস্তাঘাট। অহনা শুকনো ঢোক গিললো। তার আব্বুর কাছে শুনেছে গ্রামে নাকি ডাকাত বেড়েছে যদি এখন তাঁদের ওপর কেউ হামলা করে। অহনার বক্ষস্থলে পানি শুকিয়ে যায়। কম্পিত কণ্ঠে বলে,
-গাইস আমার মনে হচ্ছে আমরা ভুল রাস্তায় এসেছি।
আকাশ থেকে পরার মতো করে সকলে অহনার দিকে তাকায়। অহনা মেকি হেসে বলল,
-এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? মানুষ মাত্রই ভুল।
মাহানুর অহনার পিঠে একটা কিল দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-এই মধ্য রাতে জঙ্গলের মতো রাস্তায় এসে তুই কিনা বলছিস ভুল রাস্তায় আছি আমরা! এখন তোকে এখানেই পুঁতে রেখে যাবো।
অহনা কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে রইলো। সিয়াম মাহানুর মিলে ভাবছে এখন কোনদিক যাবে। মুহিব পারে না গলা ফাটিয়ে কেঁদে দেয়। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-আমি কানে ধরলাম এটাই তোদের সাথে আমার শেষ জার্নি বেঁচে থাকলে আর তোদের সাথে কোথায়ও যাবো না।
কেউই ভ্রুক্ষেপ করলো না মুহিবের কথায়। অহনা ফোন বের করে তার আব্বুকে কল দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু নেটওয়ার্ক নেই। মাহানুর পিছনে ফিরে চোখের চশমা খুলে ওড়না দিয়ে মুছে পুনরায় পরতে যাবে তখনই তার নজর পরে সামনের দিকে। কেমন দানব আকৃতির দুইটা মানুষ নাকি জীবজন্তু তাঁদের দিকেই আসছে। মাহানুর ত্বরিত চশমা পরে নেয়। এখন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কেউ আসছে এদিকে। আঁধারে শুধু তাঁদের অবয়ব বুঝা যাচ্ছে। মাহানুর আঁতকে বলল,
-ভাই ঐটা কী ভুত নাকি কোনো দানব!
মাহানুরের কথায় সকলে সামনের দিকে তাকায়। অহনা ভয় পেয়ে কেঁদে দেয়। মানুষ কী আর এতো লম্বা হয় নাকি! সিয়াম স্ট্রং থাকে। অহনাকে কাঁদতে দেখে মাহানুর ধমকে বলে,
-চুপ একদম চুপ। যেই হবে আমরা চারজন মিলে মোকাবিলা করবো। বুঝেছিস?
-মুহিব হয়তো ঠিক বলেছিলো ঐটা ভুতই হবে দোস্ত।
চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল অহনা। অহনা পাশ ফিরে মুহিবের পানে তাকায়। বড় বড় চোখ করে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুহিব। অহনা ভাবলো হয়তো ভয়ে আঁকড়ে আছে তাই সে হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দেয়। ধপাস শব্দ করে মাটিতে পরে গেলো মুহিব। অহনা আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠলো। সিয়াম মাথায় চাপর দিলো। মাহানুর রাগে বিরক্তে বলল,
-এই হাতির মতো শা’লা’রে এখন আমরা কিভাবে নিয়ে যাবো! অজ্ঞান হওয়ার কী আর সময় পেলো না!
সিয়াম কিড়মিড় করতে করতে বলল,
-একবার ভালোভাবে বাসায় যাই তারপর মুহিবের বাচ্চা আর অহনার বাচ্চারে আমি নিজের হাতে গলা টিপ্পা মা’রু’ম।
অহনা মাটিতে বসে মুহিবকে ডাকতে থাকে। সামনে অজ্ঞাত আরো নিকট আসতেই তারা বুঝতে পারে দুইজন পুরুষলোক। অহনা আস্তে আস্তে বলল,
-এরা হয়তো ডাকাত। আমরা মুহিবকে রেখে পালাতে পারবো না তোরা মারামারি করার প্রস্তুতি নে।
-ফিকার নট আমরা আছি।
বলল মাহানুর। কাঁধের ব্যাগ খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়ায় সে। তিনহাত সমান সামনে আসতেই মাহানুর চেঁচিয়ে অজ্ঞাত লোকদের বলে,
-সামনে আসবি না ডাকাতের দল একদম উড়িয়ে দেবো।
সামনের দুইজন অজ্ঞাত লোক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। সিয়াম ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট তাঁদের ওপর নিবদ্ধ করে। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে অজ্ঞাত। মাহানুর সেই সুযোগে দুইজনের চোখে মাটি ছুঁড়ে মারে। তারপর ফোন অহনার হাতে দিয়ে সিয়াম আর মাহানুর দুইজিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে। মাহানুর ইচ্ছামতো লা’থিউষ্টা, কিলঘুষি যা পারছে দিচ্ছে। সিয়াম যাকে মারছে সে ভড়কে গিয়ে বলল,
-ভাই আমরা চোর ডাকাত না।
-হো ভাই তোরা তো আমাদের ভাইবন্ধু! এই মধ্যরাতে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিস!
ক্ষিপ্ত হয়ে মাহানুর বলল। হাতাহাতির এক পর্যায় অজ্ঞাত লোক মাহানুরের গালে চড় বসিয়ে দেয়। মেয়েমানুষ বলে এতক্ষন হাত তুলছিলো না কিন্তু এই মেয়ে তো তাঁদের কথাও শুনছে না, ছাড়ও দিচ্ছে না। তাই অধয্য হয়ে চড় মেরেই ক্ষেত হয়। বলিষ্ঠ শক্ত হাতের ভয়ংকর থাপ্পড় খেয়ে মাথা ঘুরে যায় মাহানুরের। তার গালে একজন থাপ্পড় মেরেছে ভাবতেই রাগে শিরশির করছে তার শরীর। তাল সামলাতে না পেরে পিছনের দিকে পরে যেতে নিলে অজ্ঞাত লোক তাকে ধরে ফেলে। কিন্তু ইটের ওপরে পা রাখায় দুইজনই নিজেকে সামলাতে পারে না ঝোপঝাঁরের মধ্যে পরে যায়।
অন্যদিকে ওপর ব্যক্তি এবার সিয়ামকে উল্টো মারতে থাকে। আর চেঁচিয়ে বলে,
-ভাই বিশ্বাস করেন আমরা ডাকাত নই। এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম হটাৎ খিদে লাগায় কোনো রেস্তোরা খোলা আছে নাকি সেটা খুজছিলাম।
সিয়ামের কেনো জানি এবার বিশ্বাস হলো অজ্ঞাত লোকের কথায়। দুইজন দুইজনকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। অহনা চিৎকার করে বলল,
-সিয়াইম্মা মাহানুর ওই লম্বা লোকের সাথে ঐখানে পরে গিয়েছে জলদি ওকে উঠা।
মাহানুরের মাথা টনটন করছে। বড় বড় চোখ করে তাকাতেই দেখতে পায় তার ঠিক ওপরে অজ্ঞাত সেই পুরুষ। মুখে মাক্স পরা শুধু আঁখিজোড়াই দেখা যাচ্ছে। চড়ের কথা মনে পরতে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো তার মাথায়। চেঁচিয়ে বলল,
-জিরাফের নানা, দানব তোর সাহস কত বড় আমাকে মেরে আমার ওপরে পরেছিস। তোকে তো আজ আমি কাঁচা চিবিয়ে খাবো।
মাহানুরের ধাক্কা দেওয়ার পূর্বেই লোকটা আস্তেধীরে উঠে দাঁড়ায়। মাহানুর কোনোরকম দাঁড়াতেই শরীরে ক্লান্ত অনুভব করে। সিয়াম দ্রুত মাহানুরের কাছে এসে তাকে ধরে। আস্তে আস্তে বলে,
-এরা ডাকাত না মাহানুর।
-আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু ওই জিরাফের বাচ্চারে আমি ছাড়ুম না আমারে থাপ্পড় দিয়েছে!
-চুপ চুপ বইন।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু দরকারি জিনিস নিতে বের হয়েছিল আরহাম আর তার সাথী জোবান। সহসা দুইজন মধ্য রাতে একটু গ্রামের দিকে ঘুরতে এসেছিলো হটাৎ ভীষণ খিদে পেয়ে যায় দুইজনের। তাই জিপগাড়ি রোডে রেখে তারা রেস্তোরাঁর খোঁজে বের হয়। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে এতো দূরে চলে এসেছে তারা দুইজনও জানে না। দূর থেকে অন্ধকারে চারজন মানুষকে দেখে এগিয়ে আসে রেস্তোরাঁর কথা জিগ্যেস করতে। আচমকা তারা এমন ভাবে আক্রমণ করবে ভাবতেই পারেনি আরহাম। ছেলে যেমন তেমন মেয়ে হয়েও কিভাবে পুরুষের সাথে মারামারি করছে!রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এক পর্যায় চড় দিয়ে বসে মেয়েটিকে। মেয়েটির চোখের দিকে তাকালেই আরহামের মনে হয় কোনো জ্বলন্ত অগ্নিগিরির দিকে দৃষ্টি রেখেছে। এখনও ফোঁস ফোঁস করে নিঃশাস নিচ্ছে।
সিয়াম অপরাধী স্বরে বলল,
-দুঃখিত ভাই। আমরা আসলে পথ হারিয়ে ফেলেছি দূর থেকে আপনাদের দেখে ডাকাত মনে হয়েছিলো তাই আক্রমণ করেছি।
-বুঝতে পেরেছি সমস্যা নেই ভাই।
আরহাম একবারও তাঁদের দিকে তাকালো না। আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে সে। জোবান নিচে পরা মুহিবকে দেখে বলে,
-ঐ ভাই এভাবে পরে আছে কেনো?
-আসলে আপনাদের ভুত ভেবে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
আরহাম সরু চোখে তাকালো মুহিবের দিকে। ছেলেরা এতো ভীতু হয়!মনে মনে ভাবলো সে। জোবান সবাইকে পরোক্ষ করে বলল,
-আপনারা যদি চান আমরা আপনাদের নিদিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতে পারি। সামনেই আমাদের জিপগাড়ি।
সিয়াম মাথা ঘুরিয়ে একবার মাহানুরের দিকে তাকায় ইশারায় না বলছে সে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে অহনার দিকে তাকায়। অহনা তাকে হ্যাঁ বলছে। সিয়াম হালকা হেসে বলল,
-আপনাদের অসুবিধা হবে না?
-একদম না। তাই না আরহাম স্যার আই মিন ভাই?
আরহামের ভীষণ বিরক্ত লাগলো জোবানের কথায়। তবুও ভদ্রতার খাতিরে রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
-হ্যাঁ। আসতে পারেন।
-জি ঠিক আছে।
মাহানুর জেদ হলেও আজ আর ঘাড়তেড়ামি করতে পারলো না। দাঁড়িয়ে থাকার এক বিন্দুমাত্র শক্তি নেই তার। মনে মনে সিয়ামকে অনেক বকলো। আরহাম আর সিয়াম মিলে মুহিবকে ধরে নিয়ে হাঁটা ধরে। অহনা মাহানুরকে ধরে রেখেছে। দশ মিনিট হাঁটতেই রোডে আসে তারা। কালো রঙের জিপগাড়ি দেখে মাহানুরের কেমন যেনো সন্দেহ হলো দুইজনের ওপর। তারা কী কোনোভাবে সরকারি কর্মকর্তা! রাস্তার পাশে ল্যামপোস্টের আলোয় অহনা দেখতে পায় মাহানুরের ঠোঁটের পাশ দিয়ে চুঁয়ে চুঁয়ে রক্ত পরছে। অহনা বিচলিত হয়ে বলল,
-মাহানুরের ঠোঁট দিয়ে রক্ত পরছে সিয়াম।
সিয়াম আর জোবান ঘুরে তাকায়। জোবান মাহানুরকে দেখে বলল,
-আমাদের গাড়িতে ফার্স্টএইড বক্স আছে।
একে একে সকলে জিপগাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভ করছে জোবান তার পাশে বসেছে অহনা। পিছনে মুহিবকে জাগানোর প্রয়াস করছে সিয়াম। কয়েকবার পানির ছিটে মুখে দিতেই ধরফড়িয়ে চোখ মেলে মুহিব। পিটপিট করে তাকিয়ে সিয়ামকে জিগ্যেস করলো,
-ভাই আমি কী বেঁচে আছি নাকি মারা গিয়েছি?
-এখনও বেঁচে আছিস ন’লা।
দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল সিয়াম। একপাশে বসেছে মাহানুর তার সাথে বসেছে আরহাম। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। জোবান ফার্স্টএইড বক্স দিয়ে আরহামকে বলল,
-ভাই একটু মেয়েটার রক্ত মুছে বেন্ডেজ লাগিয়ে দিন।
-দিচ্ছি।
মুখের ওপর না করতে পারলো না সে। চটপটা মাহানুর আজ নেতিয়ে পরেছে। চোখ মেলে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না তার। আরহাম আড়চোখে মাহানুরের দিকে তাকিয়ে বক্স খুলে তার দিকে ঘুরে বসে। কিছুক্ষন আগে এই মুখশ্রী হিংস্র লাগলেও এখন কেমন কোমল লাগছে। আরহাম বাঁকা হাসলো মাহানুরের ঠোঁটের কোণায় রক্ত দেখে। বিড়বিড় করে বলল,
-নেতিয়ে পরা সাদা গোলাপ!
মুখ থেকে মাক্স খুলে বড় একটি নিঃশাস নেয় আরহাম। একটা থাপ্পড়েই যে মেয়ের রক্ত বের হয়ে যায় সে এসেছিলো আরহাম চৌধুরীর সাথে লাগতে! না চাইতেও আরহামের দুই ঠোঁট প্রসারিত হয়। হাত বাড়িয়ে স্যাভলন লাগাতেই মৃদু কেঁপে উঠে মাহানুরের ওষ্ঠজোড়া। আরহামের হাত মৃদু কেঁপে উঠে। যে মানুষের নাম শুনলে অন্যরা কাঁপে সে কিনা মেয়েদের সংস্পর্শে আসলে কাঁপে! বেন্ডেজ লাগাতে যাবে এমনসময় চট করে বদ্ধ আঁখিজোড়া খুলে ফেলে মাহানুর। আরহাম শুকনো ঢোক গিললো। খানিকের জন্য দৃষ্টিমিলন হয়ে যায় দুইজনের। আরহাম তাকিয়ে থাকে মাহানুরের রক্তলাল নয়নের দিকে আর মাহানুর তাকিয়ে থাকে আরহামের রুক্ষ কঠিন মুখশ্রীর ও ধারালো আঁখিজোড়ার দিকে।
>>>>চলবে।