রিদ-মায়ার প্রেমকাঁথা লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া ০২

0
1087

রিদ-মায়ার প্রেমকাঁথা
লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া

০২
আমার জীবনের হঠাৎ আগস্তকের আগমন ঘটেছিল ২০১৭তে। সে-বার আমি মাত্র নবম শ্রেণিতে পড়াতাম। দশম শ্রেণিতে উঠবো। ডিসেম্বর এক তারিখে আমার ফাইল পরীক্ষা ছিল। আর নভেম্বরের দুই তারিখের ছিল আমার জম্মদিন। বলা যায় মাত্র একমাস ছিল আমার পরীক্ষার। তাহলে বুঝতেই পারছেন ফাইনার পরীক্ষার মতো জটিল বিষয়টার মাথায় রেখেই ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে আরিফ ভাইয়ার হাত ধরে চলে গিয়েছিলাম সে-বার ঢাকা শহরে জম্মদিনটা স্পেশাল ভাবে পালন করার জন্য। হয়েছিলও তাই। আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় জম্মদিনটা ছিল ২০১৭তে আমার ষোলতম জম্মদিনের। সেই দিনটার কথা আজও মনে করলে বুক মুচড়ে উঠে তীব্র ভয়ে। উফ কি ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম আমি সেই রাতে ঐ অচেনা লোকটির সাথে। চেনা নেই, জানা নেই, তারপরও হুট করে ঐ লোকটার সাথে বেঁধে গেলাম। হুজুর টাইপ বুড়ো লোকটা যদি আমার চরিত্র নিয়ে কথা না বলতো তাহলে হয়তো বিষয়টা অন্য রকম হতো। স্বাভাবিক ভাবে আমি তাদের বুঝাতে পারতাম আসলে আমরা সত্যি বিপদে পরে উনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলাম। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। উল্টো কলঙ্কের তকমা গায়ে মেখে ভয় দেখিয়ে বিয়েটা দিয়ে দিল একটা অপরিচিত লোকের সঙ্গে যার নামটা পযন্ত জানা নেই আমার। যাকে আমি সাহায্য করতে চাইলাম বিপদগ্রস্ত বলে তার সাথেই আমার বদবাম রটিয়ে সোজা বিয়ে। উফফ সেই পরিস্থিতির কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠে। আমার জীবনে আমি এতো জটিল আর স্মরণীয় মূহুর্তে দ্বিতীয়টা পায়নি। পাওয়ার কথাও না। বাপ-ভাই আর পরিবারের ছায়াতলে বড় হয়েছি আমি তাই কখনো সেইভাবে পুরুষ মানুষের সঙ্গে চলাফেরা ছিল না আমার শুধু বাড়ির আপন পুরুষ গুলো ছাড়া। এই যেমন চাচাতো-খালাতো ভাইবোনরা ছাড়া আরকি। আচ্ছা যায় হোক! এবার আসি মূল কথায়। আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল লোকটাকে আমি রাতে আধারে রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট হলুদ আলোয় দেখেছিল সেরাতে। তারপর আমাদের সাহায্যকারীর বাসায়, মানে আমাদের যে বাসায় বিয়ে দেওয়া হয় সেই বাসায়ও দেখেছিলাম লোকটাকে প্রদীপের মৃদু আলোয়। মানে কারেন্ট ছিল না। সেরাতে বেশ ঝড়-ঝাপটা তুফান হয়েছিল বলে সেই এলাকায় বিদুৎ সংকটে ছিল। সেজন্য মূলত কারেন্ট ছেড়ে ছোট একটা মোমবাতির অল্প আলোয় আমাদের দুজনের বিয়েটা দিয়েছিল কাজি সাহেব। আরিফ ভাইকে হারিয়ে ফেলা, কাজি সাহেবের হুমকি-ধামকি, আবার অচেনা লোকটাকে নিয়ে ভয়, টেনশন সবকিছু মিলিয়ে আমার অবস্থা ছিল যাতা বলার বাহিরে। আতঙ্ক এতোটাই ছিল যে ঐ অল্প দেখা স্বামীর মুখটা আমি আর মনে রাখতে পারিনি। মানে সোজা কথা ভুলে গেছি আরকি। এমন না আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে অচেনা স্বামীর চেহারাটা ভুলে গেছি তাকে মনে রাখতে চায় না বলে। আসলে সত্যি বলতে লোকটাকে আমি মনে রাখতে চেয়েছিলাম এজন্য সেদিন রাতের শেষ প্রহরে পালিয়ে আসার সময় ঘুমন্ত স্বামীর মুখটা আমি বেশ ভালোভাবেই দেখেছিলাম। জীবনের শেষ দেখা বলে স্বামীর মুখটা স্মরণের রাখতেও চেয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হলো না। আমার ছোট মস্তিষ্ক থেকে আস্তে আস্তে স্বামী নামক লোকটার আবছা আলোয় মুখটা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আজকাল স্বামীর মুখটা স্মৃতিচারণ করলেও তেমন কিছুই আসে না মস্তিষ্কে শুরু ধোঁয়াসা একটা মুখ ছাড়া। তবে লোকটা বডিফিটন্সে আর হাইট-টা শুধু চোখে ভাসে ঐ একটু আরকি। ফ্রীতে তো লোকটা নামটাও জানি না যে স্মরণে রাখবো বা খোঁজে বের করবো। কি এক বিয়ে হলো আমার। হঠাৎ হওয়া স্বামীটা কেমন ধুম করেই বিলুপ্ত হয়ে গেল আমার জীবন থেকে। ২০১৭ সালে হওয়া ঐ ঘটনা পর বিগত এক বছর পাঁচ মাস পর আবারও আমার জীবনের এক নতুন মোর নেয়। নরম শ্রেণির পাস করলাম, দশম শ্রেণির এসএসসি পরীক্ষায় দিলাম। রেজাল্টও বের হলো। মোটামুটি ভালো রেজাল্ট পেয়েই পাস করলাম। ২০১৯ দিকে কলেজে উঠবো। যথারীতি আমার কলেজে ভর্তি হওয়া চিন্তাটাও আমার বাপ-ভাইয়ের উপর ছিল বরাবর মতো। এতে অবশ্য আমার নিজস্ব কোনো মতামত নেই। পরিবারের মেয়ে তাঁরা যেখানে বলবে সেখানেই ভর্তি হতে হবে আমাকে এক কথা। তাই পড়াশোনার বিষয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। আমার সাথে অবশ্য একদলে জুইও আছে। ওকেও আমার ছোট চাচা আমার সাথেই ভার্তি করাবে। যেহেতু আমরা দুজন জম্মের পর থেকে এক সঙ্গে হেলেদুলে বড় হয়েছি, পড়াশোনাও একত্রে করেছি, সেহেতু আমাদের আলাদা করা কারও চিন্তাতে আপাতত ছিল। তাই সহপাঠী হিসাবে জুইকে পাবো এটাও নিশ্চিত ছিলাম আমি। আচ্ছা যায় হোক! পরিবারগত অনেক বুঝ-পরামর্শ করার পর বাবা আর ছোট চাচার আদেশ হলো আমাদের দুজনকে চট্টগ্রামে ভর্তি করাবে। মানে আমাদের প্রথমে আরিফ ভাইয়ার ফ্ল্যাটে থাকতে হবে পরবর্তী সময়ে যখন আমরা হোস্টেলের সিট পেয়ে যাবো তখন আমাদের দুজনকে হোস্টেলে দেওয়া হবে এমনটাই কথা রইল। হলোও তাই! ভর্তি পরীক্ষা জন্য ভাইয়ার হাত ধরে সোজা চলে গেলাম আশুগঞ্জ টু চট্টগ্রাম শহরে। আরিফ ভাইয়া তখন সবেমাত্র মাস্টার করছিল। সেই বছরই তার লাস্ট ইয়ার ছিল মাস্টার্সের। ভাইয়া ফাইনালিস্ট ছিল। চট্টগ্রামে ভাইয়া লেখাপড়ার সুবিধার্থে থাকলেও চট্টগ্রাম শহরটার সাথে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল আরও একটা। সোজা কথা বলতে গেলে আমার নানুবাড়ি আর আম্মুর নিজ বাড়ি। সেই হিসাবে প্রতি বছরই আমাদের যাতায়াত থাকতো চট্টগ্রামে। কিন্তু তারপরও আমার এই চট্টগ্রাম শহরটাকে আপন মনে হতো না। এখানে পড়াশোনা নিয়েও ছিল বেশ আপত্তি। আমার ইচ্ছা ছিল আশুগঞ্জ কোথাও ভর্তি হবো। সেখানে আমার স্কুলের সহপাঠীরাও ছিল তাদের ছেড়ে আসতেও মন নারাজ। আমার এতো এতো নারাজগিটা চোখে দেখেনি কেউ, কানেও তুলেনি। ছোট মানুষ হওয়ায় পরিবারের বড়রা যা বলে সেটাই শুনতে হতো আমায়। আমার আজও মনে আছে সেদিনকার কথা। আম্মু আঁচল ধরে কি কান্নাটাই না করেছিলাম উফ!! কাঁদতে কাঁদতে গোটা একদিন খাওয়া দাওয়া বন্ধ রেখেছিলাম চট্টগ্রামে পড়তে যাবো না বলে। তারপরও আমার এতো বিদ্রুপ শূন্যে তুলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এসেছিলাম চট্টগ্রামে আরিফ ভাইয়ের হাত ধরে। প্রথম কয়েকদিন তোড়জোড় করে মন খারাপ চালিয়ে রেখেছিলাম বাড়ির সবার সাথে যাতে একটু মায়া-দয়া দেখিয়ে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্য আমার এবারও হতাশ করল! আমার ভিষণ রকমের মন খারাপেও আব্বু শক্ত মন নরম হলো না। আর না আমার এখান থেকে যাওয়া হলো। প্রচন্ড অনিহা আর বুক ভরা কষ্ট নিয়েই আরিফ ভাইয়ার আমাদের চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। আমাদের বাসা থেকে কলেজ দূরত্ব ছিল দশ থেকে পনেরো মিনিট মতো। তাই রোজকার মতো ভাইয়া আমাদের কলেজে নামিয়ে দিয়ে তারপর সে নিজের ভার্সিটিতে যেত। আরিফ ভাইয়া নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারেও ক্লাস করতো টিচার হিসাবে। আর আমরা কলেজ শেষ করে বিকালে দিকে আবার আরিফ ভাইয়ার কোচিং সেন্টারেও যেতাম বই-খাতা নিয়ে ক্লাস করতে। আমি আর জুই দুজনই ছিলাম মানবিকের স্টুডেন্ট। মূলত আমার ছোট থেকে রাজনৈতিক বিষয় গুলোতে প্রচন্ড ইন্টারেস্ট ছিল বিদায় সেজন্য মানবিক নিয়ে পড়াশোনা করা আরকি। সত্যি বলতে রাজনৈতিক বিষয় গুলো থেকে রাজনৈতিক কুটনৈতিক বুদ্ধি গুলো আমার হেব্বি লাগতো বলেই বাসার কাউকে না জানিয়ে নিজে নিজেই এই মানবিক বিভাগে ঢুকেছিলাম নবম শ্রেণিতে। জুই অবশ্য প্রথমে সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা স্টার্ট করে ছিল পরে সাইন্সের বইয়ের সাথে উঠতে না পেরে বাধ্য হয়ে সাইন্স ছেড়ে মানবিক শাখায় আমার সাথে যোগ হয়। কিন্তু কে জানতো আমার এই অত্যাধিক পরিমাণের রাজনৈতিকে পছন্দ করাটা যে আমার ভবিষ্যৎতের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে সেটা? হা হা হা! আমার বাল্যকালের মজা করাটা আজ আমার উপরই ভারি পরে গেলো। এজন্য মানুষ বলে কোনো কিছু নিয়ে মজা করতে নেই। সময়ে ব্যবধানে সেই বিষয় গুলো তোমার উপর পরতে বেশিক্ষণ লাগে না সেটা আমি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। পাবারই কথা। মূলত আমি সবসময় ক্লাসমিট বা কাজিনদের জোর গলায় বলে বেড়াতাম। আমার রাজনৈতিক পছন্দ! নেতাদের ক্ষমতা পছন্দ! তাদের কুটনৈতিক বুদ্ধি গুলা পছন্দ! ভবিষ্যৎ মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছাও মাঝেমধ্যে প্রকাশ করতাম বোকার মতো। আমার এই অতি আগ্রহের কথা গুলো আমার বান্ধবীরা শুনত মনোযোগ সহকারে। তারপর বুক ভরা দোয়া দেওয়ার আগে মাইশা বলতো,

‘ শুন মায়া তুই মন্ত্রী হলে আমাদের কি উপকার করবি সেটা আগে হিসাব-নিকাশ কর। ফ্রিতে তো দোয়া আর ভোট কোনোটাই দেওয়া যাবে না, তাই না। দেখ মায়া আমরা ছয় বান্ধবী আছি তোর। আমাদের ডিমান্ড কিন্তু তেমন বেশি কিছু না। শুধু প্রত্যেকে একটা করে সরকারি চাকরি আর বিসিএস ক্যাডার জামাই পাওয়ায় দিবি ব্যাস এতটুকুই। শুন মায়া প্রেমটা না-হয় আমরা কম্প্রোমাইজ করে নিবো ছয় বান্ধবী বেসরকারি বা বেকার পোলাপান সাথে করে। কারণ অসহায় পোলাপানদেরও তো একটা জাতিগত অধিকার আছে সুন্দরী মাইয়া গো লগে প্রেম করার। সেই আত্মত্যাগে প্রেম করবো বেকার ছেলে সঙ্গে কিন্তু জামাই বেলা কিন্তু নো কম্প্রোমাইজ! জামাই কিন্তু আমাদের বিসিএস ক্যাডারই লাগবে বলে দিলাম। নয়তো আমাদের সবার ভোট আর দোয়া তোর জন্য ক্যান্সেল হু।

আমাদের বান্ধবীদের কথা তদারতিতে দ্রুততা সঙ্গে মাহি বাঁধা দিয়ে বলতো..

‘ দোস্ত দোস্ত! রিক্তাকে মন্ত্রী হওয়ার দোয়াটা দ্রুত ক্যান্সেল কর, ক্যান্সেল কর। ঐটা রং নাম্বার! রিক্তা ভবিষ্যৎ মন্ত্রী হওয়া মানেই আমাদের দেশের ঘোর বিপদ ডেকে আনা। রিক্তার যে বোকা গিলু! দেখা যাবে ওর সামনে দিয়ে পুনরায় পাকিস্তানিরা আমাদের দেশ নিয়ে যাবে কুটনৈতিক করে আর ওহ কিছুই বুঝতে পারবে না। দেশ বলে কথা বিপদের ফেলা যাবে না। তাই রিক্তার মন্ত্রী হওয়ার দোয়া ক্যান্সেল। তুই বরং রিক্তার জন্য একটা নেতা জামাইর দোয়া করে দে শক্তপোক্ত। কালো, বেটে, অসুন্দর, বুড়িওয়ালা যেমনই হোক ব্যাস মন্ত্রী হোক তাহলেই চলবে। কিরে তোর চলবে না?

মাইশার কথার পাশ থেকে ফোড়ন কাটতো সুমি। অতি উৎসাহে বলতো।

‘ হ, হ, মাইশা ঠিক কইছে। রিক্তারে মন্ত্রী বানাইয়া দেশকে বিপদের ফেলার দরকার নাই। রিক্তা থাক তোর মন্ত্রী হওয়ার লাগবো না। মন খারাপ করিস না দোস্ত। যাহ আমরা তোরে মাইশার কথায় মন্ত্রী জামাইর জন্য দোয়া করে দিবোনে হ্যা। তোর মন্ত্রী মশায় অসুন্দর হোক সমস্যা নাই। কিন্তু তাকে অবশ্যই রগচটা মন্ত্রী হতে হবে যেন কথায় কথায় তোকে এমনই দু-চারটে থাপ্পড় মারে ভালোবেসে।

বেশ কৌতুক করেই আমার ছয় বান্ধবীরা আকাশ মুখী দু’হাত তুলে মোনাজাত করতো আমার জন্য। ভিষণ রকমের ক্ষেপাত আমায়। মাঝেমধ্যে বোকার মতোন চেতে যেতাম আমি ওদের উল্টোপাল্টা দোয়া আবার মাঝেমধ্যে বেশ এনজয় করতাম, যখন ভবিষ্যত মন্ত্রীর বউ বলে থাকতো আমায়।
এই একটা কথায় কখনো আমি চেতে যেতাম না। বরং ভালো লাগতো। পছন্দের রাজনৈতিক বলে কথা। নেতা জামাই পাইলে সমস্যা কি? বরং ভালোই লাগবে। মনে মনে যেমন বান্ধবীদের দোয়া করা নিয়ে খুশিতে থাকতাম। তেমনি ভয়ে ভয়ে থাকতাম এই ভেবে যে, আমার দেখে জীবনে একটাও ইয়াং নেতা ছিল না। সবগুলো নেতা ছিল কেমন বুড়ো মোটাতাজা আর কালো বুড়িওয়ালা বয়স্ক লোক। এখন বান্ধবীদের দোয়াতে যদি বুড়ো জামাই পায় তো? বুড়ো জামাই কি শুধু আমায় ধরে ধরে মারবে নাকি? আমার এতোসব চিন্তাতে জল ঢেলে গেলো ঐ হঠাৎ হওয়া বিয়ের পরপরই। আজ বছর দেড়েক হলো আমি কাউকে বলি না আমার রাজনৈতিক পছন্দ বা মন্ত্রী সাহেবও পছন্দ। কেউ এই নিয়ে মজা করলেও চুপ থাকতাম। বিয়ে নিয়ে আমার হঠাৎ চুপ থাকার কারণটা আজও কেউ ধরতে পারলো না। পারবে কিভাবে আমি কাউকে আজ পযন্ত আমার হঠাৎ হওয়া বিয়ের ঘটনাটি খোলে বলি না এই ভয়ে যে, বিয়ে মতো এতো বড় একটা জটিল ঘটনা শুনলে সবাই আমাকেই দোষ দিবে। তাছাড়া পরিবার যখন আমাকে এই বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবে তখন আমি কি বলবো তাদের? আমার কাছে তো উত্তর নেই। তাছাড়া আমার আব্বু ভিষণ রকমের রাগী আর জেদি মানুষ। উনার কানে এই খবর যাওয়া মানেই আমাকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া। আব্বু ভয়ে আজ পযন্ত আমি জুইয়ের সাথে পযন্ত বিয়ের বিষয়টা শেয়ার করিনি। ভবিষ্যতে কখনো করবো বলেও মনে হয়না। কারণ আমার সেই সৎ সাহস নেই।

আমি জানি না লোকটা কে ছিল, আর কাকেই বা সেরাতে আমি বিয়ে করেছিলাম। আব্বু এই বিষয়ে আমাকে কিছু জিগ্যেসা করলে আমি লোকটার নামটা পযন্ত বলতে পারবো না এজন্য মূলত চুপ থেকে গেলাম নিরবে। তাছাড়া আমি বিগত দেড় বছরের দুটো বিষয় লক্ষ করেছি, আগে বিয়ে শব্দটা আমার মাথা আসলে প্রথম প্রথম ভয় পেতাম। কিন্তু আজকাল শুধু হতাশা কাজ করে নিজের মাঝে স্বামী শব্দ নিয়ে। নাম-দাম ঠিকানা পরিচয়পত্র কিছুই জানি না তার। যাও একটু করে লোকটার ফেসটা মাথায় ছিল দীর্ঘ সময়ের দূরত্বে তার আদৌ-আলো চেহারাটাও ভুলে যাচ্ছি দিন বা দিন। আমার কপালে কি আছে কে জানে? কিন্তু সেই মানুষটার জন্য আমার জীবন যেন থেমে আছে। অদ্ভুত ভাবে আজও তার কথা আমার স্মৃতিতে গেতে আছে দৃঢ় ভাবে। নিশ্চিত বিয়েতে অনিশ্চিত স্বামী দেখা ইহজীবনে পাবো না বলে এটাও জানি। তারপরও লোকটা আমার মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ।

দীর্ঘ মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে ভেবেই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। আমার জীবনের ফেলে আসা দিন গুলো আবারও একবার স্মৃতিচারণ করলাম বিছানায় পা দুলাতে দুলাতে। বুক ভারির নিশ্বাস ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম জুইয়ের দিকে। মেয়েটা সেই তখন থেকেই সেজে যাচ্ছে থামাথামি নাই। এক ঘন্টার বেশি সময় হবে আয়নার সম্মুখে বসেছে সাজতে তারপরও সাজ কমপ্লিট হলো না মেয়েটার আজব। এবার বেশ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসল আমার জুইয়ের এতো দেরিতে। আজ আমাদের কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান। আমাদের ক্লাস অবশ্য আরও মাস খানিক আগেই শুরু হয়েছিল কিন্তু আমাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানটা একটু দেরিতে হচ্ছে বিশেষ কিছু অতিথির জন্য। বলতে গেলে আমাদের কলেজের ফাউন্ডার্সদের জন স্যারদের নাকি এই অনুষ্ঠানটা পিছাতে হয়েছে এটা আমাদের সিনিয়রদের বলা কথা। ভাই, প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার্স বলে কথা তাদের জন্য একমাস কেন চাইলে পাঁচ পিছাতেও কারও সমস্যা হবে না। যায় হোক সেসব কথা। কলেজ নিয়ে আপাতত আমার মাথা ব্যথা নেই। কে আসল? কে গেল! সেটা আমাদের দেখার কথা না। আমার বিষয় হচ্ছে এই মূহুর্তে জুঁইকে নিয়ে। মেয়েটা এখনো বিরতি বিহীন সেজে চাচ্ছে। সামান্য একটু অনুষ্ঠানের জন্য এতো সাজতে হবে? আজব। এবার আমি বেশ চটে গিয়ে রাগী গলায় বললাম জুইকে…

‘ অসভ্য মাইয়া আর কতক্ষণ আমাকে এইভাবে বসিয়ে রেখে সাজবি? সামান্য একটা অনুষ্ঠানের জন্য তোর এতো সাজতে হবে? লাইন মারতে যাবি কলেজে? আরিফ ভাইয়ার কাছে বিচার দিব তোর নামে দেখিস।

আমার চেতে যাওয়াতে তাড়াহুড়ো করে জুই আয়নার সম্মুখের ঝুঁকে পরে লিপস্টিক লাগাতে বললো…

‘ শুধু শুধু রাগিস কেন রিতু? এইতো শেষ আমার। আর অল্প।

‘ জুই এবার কিন্তু তুই বাড়াবাড়ি করেছিস! সত্যি আমার গরম লাগছে এই মরার শাড়ি পরে। তুই কি উঠবি নাকি আমি তোকে ফেলে চলে যাব ভাইয়ের সাথে?

আয়নার সম্মুখে থেকে তাড়াহুড়োয় মেকাপের জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জুই বললো…

‘ সরি! সরি! বইন এইতো শেষ আমার। চল, চল, দ্রুত আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলে সিনিয়রদের প্যারায় পরে যাবো আমরা আবার। চল চল।

জুঁইয়ের হঠাৎ এতো তাড়াহুড়ো গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উল্টালাম। মেয়েটা সত্যি পাগল। একতো নিজেই দেরি করবে তারপর আবার সেটা নিয়ে নিজেই আফসোস করবে। অদ্ভুত! আজ আর আরিফ ভাইয়ার বাইকে চড়লাম না আমরা কেউ। যেহেতু শাড়ী পরেছি তাই রিক্সা ধরে সোজা কলেজ গেইটে নামতেই চোখে লাগল কলেজ ভারি প্যানেলের সাজসজ্জা। সেই সাথে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ভারি ভারি পোষাক। এই যেন এক লাল সবুজের পতাকা পতাকা হয়ে আছে সবাই আহা! কি অদ্ভুত ভালোবাসার টান দেশের জন্য। যার জন্য এই ভরাদিন দুপুরে সবাই লাল সবুজ পতাকা পতাকা হয়ে ঘুরছে আশেপাশে। ছেলেরা সবাই লাল পাঞ্জাবি আর মেয়েরা সবাই সবুজ শাড়িতে আবদ্ধ। এই আবদ্ধ হওয়া থেকে কিন্তু আমরাও বাদ যায়নি। জুই আর আমি দুজনই সবুজ রঙ্গা শাড়ি পরেছি। পার্থক্য শুধু একটাই আমাদের শাড়িটা জামদানি ব্যাস।ছোট ছোট পা পেলে কলেজের গেইট ধরে ভিতর ঢুকে বুঝলাম আমরা মনেহয় একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছি। আমাদের আরও আগে আসার উচিত ছিল। কারণ অলরেডি অতিথি আসার সময় হয়ে গেছে। আমাদের পিছন পিছনই বিশেষ অতিথি আর প্রধান অতিথির গাড়ি ঢুকলো গেইট ধরে। তারমানে এই কলেজের এরাই ভিআইপি। সেই সাথে এই কলেজের ওনার। ছাত্রী জনসভায় আমি গিয়ে বরাবরই পিছনের সারিতে বসলাম। যেহেতু দেরিতে এসেছে তাই আপাতত আমাদের জায়গায়টা পিছনের সারিতে হলো। আমার হাতে ফোন নেই। জুইয়ের হাতে আরিফ ভাইয়ার একটা ফোন আছে। সেটাই দিয়ে সে অলরেডি ছবি তুলা শুরু করে দিয়েছে। আমি বিরক্তি ঝেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম গোল গোল চোখে। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টিতে ভিড়ল অতিথিদের ঝাঁক ঝমকপূর্ণ বেশ কয়েকটা সাদা-কালো গাড়ি। গেইট ধরে ভিতরে ঢুকছে তারা। সিনিয়র ভাইয়া আপুরা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে তাদের ফুল ছিটিয়ে বরণ করছে। সেই বরণে স্যাররাও দাঁড়িয়ে আছে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে। দূর থেকে অল্প সল্প চোখে লাগলো আমার। তিনটা গাড়ি থেকে তিনজন মানুষকে বের হতে দেখলাম ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায়। একজন বেশ বৃদ্ধা আর বয়স্ক টাইপের লোক। সাদা পাকা দাড়ি আর চুলে ভরপুর উনার। দ্বিতীয়জন অর্ধবয়স্ক হবে! বয়সটা ষাট ঊর্ধ্বে হবে। উনার চুলগুলো দূর থেকে ঠাহর করতে পারছিনা কতটা পাকা হবে? তবে তৃতীয়জনকে চোখে লাগাম মতোন ছিল। দূর থেকে এক ঝলক দেখেই বুঝতে পারলাম শত নারী রাতের স্বপ্ন হতে বাধ্য এই পুরুষ। আহা এই বুঝি সেই পুরুষ যাকে নিয়ে বিগত এক মাস ধরেই গঞ্জন শুনছিলাম কলেজের সিনিয়র আর আমার ক্লাসমিট মেয়েদের মাঝে? হতে পারে অস্বাভাবিক কিছু না। সুন্দর পুরুষদের নিয়ে মেয়েরা সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখবে এটাই স্বাভাবিক। আমি বিবাহিত না হলে এই মূহুর্তে আমি লোকটার প্রথম ঝলকে ক্রাশ খেয়ে বাঁকা হয়ে যেতাম। কিন্তু বিবাহিত মহিলাদের তো পরপুরুষ দেখা পাপ। এখন আমিও লোকটার দিকে নজর দিলে পাপ হবে নিশ্চিত। তাই গুমোট নিশ্বাসে সভ্য সুলভ দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম লোকটা থেকে। ঠিক হয়ে বসতে বসতে দেখলাম লোক তিনজনকে পিন্সেপাল স্যারসহ বাকি স্যাররা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের কক্ষে দিকে। পিছন পিছন সিনিয়র ভাইরাও আছেন। আমি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। কারণ উনার সবাই এবার হয়তো আমাদের সামনে এসে বসবেন স্টেজের আসনে। আমার মনোযোগ খালি আসনের দিকে। সিনিয়র ভাইয়ারা কতো ছুটাছুটি করছে অনুষ্ঠানটা সামলাতে গিয়ে। এই গরমে একেক জন্য ঘেমে নাজেহাল অবস্থা। লাল পাঞ্জাবি ঘেমে পিঠেদয়ে ল্যাপ্টে আছে তাদের। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, সাইড অতিথি দেখার জন্য অল্প সল্প কৌতুহল ছিল আমার। কিন্তু আমার মনোযোগ সব নষ্ট হয় হঠাৎ পেটে গোঁতা খাওয়ায়। বিরক্তি নিয়ে চাইলাম পাশে। জুঁই ঠোঁট উল্টিয়ে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো…

‘ রিতু আমি ওয়াশরুম যাব! প্লিজ আমার সাথে চল।

কেমনডা লাগে? বাসা থেকে মাত্র আসলাম। এখন বসতে না বসতেই ম্যাডামের ওয়াশরুম তাড়া পেয়ে গেল? এতক্ষণ বাড়িতে কি করেছিল তখন ওয়াশরুম যায়নি কেন? মেজাজ খারাপে চাপা রাগে দাঁত পিষে বললাম…

‘ তুই কি আজকে শপথ করছত? আমাকে শান্তি দিবি না? এমনই তোর জন্য এতো লেট হলো এখন বসতে না বসতেই তোর ওয়াশরুমের কাজ লেগে গেল?

‘ প্লিজ রিতু চল না। আসলে সাজুগুজ করায় ব্যস্ত ছিলাম বলে ওয়াশরুমে যাওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম সাজ শেষ করে একেবারে যাব। কিন্তু তাড়াহুড়ো এখানে চলে এসেছি বলে আর যাওয়া হয়নি। প্লিজ চল না বোন।

‘ গুড! ভেরি গুড! ভালো কাজ করেছিস। তখন যখন ওয়াশরুম কাজ চেপে সাজুগুজের কাজ চালিয়ে যেতে পারিস তাহলে এখানো চেপে যাহ। মুচড়া-মুচড়ি করে গোটা অনুষ্ঠানটা পার করে দে। আমি জানি তুই পারবি। তোকে পারতেই হবে। চাপাচাপিতে তুই যে দক্ষ সেটা প্রমাণ করার জন্য হলেও এখন চুপচাপ বসে থাক। আমি পারবো না তোর সাথে কোথাও যেতে।

কথাটা বলেই সামনে তাকাতে চাইলে পাশ থেকে জুই খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরে অসহায় গলায় বলল…

‘ প্লিজ রিতু চল না প্লিজ। বেশি ইমার্জেন্সি পেয়েছে। প্লিজ!

অল্প ঠোঁট কামড়িয়ে ওর মতিগতি বুঝার চেষ্টা করলাম। জুইয়ের অসহায় ফেসটা দেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম মেয়েটা আসলেই আমাকে আজকে শান্তি দিবে না।

ওয়াশরুম বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে জুইয়ের ব্যাগ আর ফোন। আর কাঁধে আমরা ছোট ব্যাগটি ঝুলছে। করিডোরে দাঁড়িয়ে আশপাশটা নজর বুলালাম। নাহ আপাতত এইদিকটায় তেমন একটা মানুষ নেই। সবাই মাঠে স্টেজের দিকেটাই আছে। ওয়াশরুম বাহিরে করিডোর একপাশের দেয়ালে থাই গ্লাসে নিজের প্রতিবিম্বটা এক পলক দেখে নিলাম। গোছানো শাড়ি, সবুজ চুড়িতে খারাপ লাগছে না আমায়। ঠিকঠাকি লাগছে। তারপরও চঞ্চল হাত দুটো দিয়ে ছেড়ে রাখা চুল গুলো আরও একবার গুছিয়ে নিলাম। অল্প ল্যাপ্টানো কাজলটা মুছে নিতেই তখন কানে বাজল কারও উগ্রতা গমগমে ডাক ‘ এই মেয়ে ‘ এই মেয়ে এদিকে শুনো।

সহজ সরল ভাবেই ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকালাম। চোখে লাগলো আমাদের পৌরনীতি ম্যাডামকে। তিনিও হাফ সিল্কের লাল সবুজ সংমিশ্রণের শাড়ি পরিহিত। বয়স পয়ত্রিশ! শ্যামবর্ণ গায়ে রঙটা খারাপ লাগছে না। বেশ ভালোই লাগছে। তবে উনি এতো মনোযোগ দিয়ে কাকে ডাকছে সেটা লক্ষ করতে চাইলে বুঝলাম ম্যাডাম আসলে আমাকেই অনুসরণ করে ডাকছিল। অল্প চমকিত হলাম আমি। এক বুক সাহস নিয়ে গেলাম ম্যামের সামনে। আমাকে দেখেই ম্যাম তাড়াহুড়োই প্রশ্ন করে বললেন…

‘ কোন ডিপার্টমেন্ট?

ম্যামের তাড়াহুড়োর কথায় বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে সিনিয়র ভাবছেন হয়তো তাই মিনমিন স্বরে ম্যামকে শুধরিয়ে বললাম…

‘ ম্যাম আমি মানবিক ডিপার্টমেন্টেী নতুন ছাত্রী। ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট!

ব্যস্তায় ম্যাম ফের বললো…

‘ ওহ তার মানে তুমি আমার ছাত্রী। আচ্ছা শুনো! আমার হাতের এই ফাইলস গুলো ফাউন্ডার স্যারের রুমে নিয়ে যাও। সোজা পিন্সিপাল স্যারকে দিবে। বলবে সুলতানা ম্যাডাম দিয়েছে কেমন। যাও!

এতক্ষণ না চমকালেও এবার বেশ জড়োসড়ো চমকালাম ম্যামের কথায়। ফাউন্ডার্স স্যারে রুমে যাব মানে? সেখানে তো এই মূহুর্তে সবাই বসে আছে আমি যাওয়া মানেই নিঘাত ভয়। এতো বড় বড় মানুষদের মাঝে আমি ছোট মানুষ হয়ে কেন যাব? উফফ! আমার তো এখনই ভয়ে বুক কাঁপছে ডিপডিপ করে। এই কাঁপাকাঁপির রোগ নিয়ে সেখানে যাব কিভাবে? কোনো কারণে যদি কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারায় সবার সামনে তো? ছিহ কি লজ্জা জনক ব্যাপার। অজস্র ভয় থাকার পরও ম্যাডামের মুখের উপর না করার সাহস হলোনা আমার। তাছাড়া ম্যাম যদি আমাকে বেয়াদব বলে ধমক লাগেই সেই ভয়ে ম্যাডামের হাত থেকে কাগজ পত্র গুলো আমার হাতে তুলে নিলাম। ম্যাডাম তাড়াহুড়ো আমার হাত খালি করে ব্যাগ আর ফোনটা নিজের কাছে রাখতে রাখতে বলল, ফাইলস গুলো পিন্সিপাল স্যারকে দিয়ে তারপর ম্যামের কাছ থেকে আমার ব্যাগ আর ফোনটা সংগ্রহ করে নেওয়ার জন্য। অসহায়ের মতো আমি মাথা নাড়াতেই ম্যাম দ্রুত পদে চলে গেল অফিস রুমে দিকে। অসহায় আমি ঠোঁট উল্টিয়ে এক পলক ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকালাম। মেয়েটা সত্যি আজকে আমাকে শান্তি দিবে না। এখনো ওয়াশরুমে বসে আছে। প্রচন্ড অস্তিত্ব সঙ্গে ফাউন্ডার্স স্যার দরজায় কড়া নেড়ে অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে চোখে পড়ল বেশ কয়েকজন মানুষকে। বিশেষ করে অতিথি সভার সবাই এখানেই বসা। তারমানে তাঁরা এখনো স্টেজে উঠেনি। আমি এই প্রথম কলেজের ফাউন্ডার্সদের সরাসরি দেখলাম। দেখতে সবাই মাশাল্লাহ। তিনজনই সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত। উনাদের সবাইকে দেখে সর্বপ্রথম আমার মাথায় যেটা আসল সেটা হলো ‘ উনার সবাই কি নেতার বংশধর নাকি?

‘ কি চাই?

ভরাট গলার পিন্সিপাল স্যারের হঠাৎ প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেমাল আমি। প্রচন্ড অস্তিত্বে সিঁটিয়ে ধীর গলায় বললাম…

‘ স্যার আমাকে সুলতানা ম্যাম পাঠিয়েছেন এই ফাইলস গুলো আপনাকে দিতে।

‘ ওহ আচ্ছা! ফাইল গুলো তোমার পিছনের বসে থাকা স্যারকে দাও।

সহজ সরল ভাবেই পিছনে ফিরেছিলাম আমি। সাহস নিয়ে ফাইলস গুলো এগিয়ে দিয়েছিলাম লোকটাকে। কিন্তু ইয়াং যুবকের অল্প পরিচিত মুখটা দেখে মূহুর্তেই ঠায় জায়গায় থ মেরে দাঁড়িয়ে পরলাম। শরীরে মধ্যে তৎক্ষনাৎ হাড় কাঁপানো বিদ্যুৎ বয়ে গেল এমনটা মনে হলো। সেই বিদ্যুৎতের তেজে তৎক্ষনাৎ আমার হাত দুটোও কেঁপে উঠল তুমুল গতিতে। এই লোকটা! এই লোকটাকে আমি কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে! কিন্তু কোথায়? কোথায়? সেকি আমার পরিচিত কেউ? কই আমার তো মনে পরছে না? আমার ধ্যানরতের মাঝেই লোকটা আমার থেকে কাগজ গুলো নিজে হাতে তুলে নিল সহজ ভাবেই। আমি যে উনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি সেদিকে উনি এক পলক চোখ উঁচিয়ে তাকাল না পযন্ত। আমাকে সম্পূর্ণ অনাগ্রহ করে হাল্কা কপাল কুঁচকে কাগজ গুলো একের পর এক চেক করে গম্ভীর গলায় বলল…

‘ কাগজে সমস্যা আছে। নেইম প্লেসের জায়গা গুলোতে ভুল। আব্বু নামের জায়গায় আমার নাম ব্যবহার করেছে সেখানে। এগুলা সংশোধন করতে দ্রুত পাঠান।

বাক্য গুলো শেষ করতে করতে হাত বাড়িয়ে কাগজ গুলো পুনরায় আমার হাতে তুলে দিতে দিতে চোখ উঁচিয়ে তাকাল পিন্সিপাল স্যারের দিকে। তখনো লোকটা আমাকে দেখলো না। হয়তো দেখার প্রয়োজন মনে করছে না তাই। কিন্তু আমি হ্যাবলা মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে। আসলে মনে করার চেষ্টা করছিলাম এই লোকটাকে আমি কোথায় দেখেছি এর আগে। তখনই পিন্সিপাল স্যার পুনরায় আমাকে ডেকে ধ্যানচুত্ত করে বলল।

‘ এই মেয়ে শুনো!

অস্তিত্বে ঘুরে তাকালাম স্যারের দিকে। তিনি হয়তো বারবার এই মেয়ে, এই মেয়ে বলে ডাকতে চাচ্ছে না ফাউন্ডার্সদের সামনে। তাই সহজ ভাবেই আমার নাম জিজ্ঞেস করে বলেন…

‘ নাম কি তোমার!

প্রচন্ড অস্তিত্বে মিনমিন স্বরে বললাম…

‘ রিক্তা!

স্যার শুনতে না পেরে পুনরায় বললে…

‘ কি নাম?

হাসফাস করে বললাম..

‘ জ্বিই স্যার! রিক্তা ইসলাম মায়া।

‘ ওহ আচ্ছা! শুনো মায়া এই ফাইলস গুলো তোমার সুলতানা ম্যামকে দিয়ে বলবে ভুল গুলো দ্রুত ঠিক করে পাঠাতে এখানে পুনরায়। যাও!

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে আড়চোখে তাকালাম পাশের লোকটার দিকে তিনি তখনো আমাকে দেখলো না পযন্ত। লোকটার এই গম্ভীর অ্যাটিটিউডে অপমান বোধ করলাম মূহুর্তেই। কেন বারবার হ্যাংলার তাকাচ্ছিলাম লোকটার দিকে তাও বুঝতে পারছি না। শুধু লোকটাকে আমার অল্প পরিচিত মনে হচ্ছে এজন্য বারবার তাকাতে হবে আজব?

‘ মায়া তোমার বাসায় কোথায়? কথা শুনে তো মনে হচ্ছে না তুমি চট্টগ্রামে মেয়ে? অন্য জেলার নাকি?

গম্ভীর লোকটা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালাম বৃদ্ধা বয়স্ক লোকটার মুখের দিকে। কি অমায়িক আদৌলে হাসি মুখ উনার। বয়স আশির কাছাকাছি মনে হলেও দেখতে বেশ ফিট এন্ড ফাইন দেখা যাচ্ছে। টাকার গরম বলে কথা। তারা তো এমনই যোয়ান থাকবে তাই না। তাছাড়া বড়লোকদের কি আর বয়স বাড়ে নাকি অহংকার মতো? তবে এই বয়স্ক লোকটার মুখের আদৌলে আমার অহংকারী ভাবটা চোখে পড়লো না। সেটা পরল সেটা হলো সচ্ছতা আর শুদ্ধার হাসি মুখ। সেই হাসিতে আমিও অস্তিত্বে হাসফাস করে মাথা কাত করে সম্মতি দিলাম। বুঝালাম হ্যা আমি অন্য ডিসটিকের মেয়ে । লোকটা ফের হাসলো। আগ্রহ নিয়ে বলল…

‘ কোন জেলার?

‘ জ্বিই ব্রাক্ষণবাড়িয়ার!

আমার কথা শুনে বেশ মজা পেল যেন বয়স্ক লোকটা। তিনি কৌতুক করে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলল…

‘ বাহ তুমি ব্রাক্ষণবাড়িয়া মেয়ে? দারুণ ত! তা মায়া তুমি ঝগড়া-টগড়া কেমন পারো? তোমার দক্ষতা কেমন মারামারি নিয়ে? ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মেয়ে বলে কথা তোমাকে অবশ্যই এসব পারতে হবে বুঝেছ? এই যে, তোমার পিছনে আমার নাতিকে দেখছ! ওর কিন্তু মারামারির মধ্যে বেশ পেটুক মানুষ। মুখ থেকে হাত চলে বেশি ওহ। তুমি ওকে হারাতে পারলে বুঝবো, না তুমি সত্যিই ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মেয়ে। কি পারবে?

লোকটার মজা কথায় পিন্সিপাল স্যারসহ সবাই হেঁসে উঠলো। আমি প্রচন্ড অস্তিত্বে হাসফাস করে মাথা নত মস্তিষ্কের আড়চোখে উনার নাতির দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। ঝেঁকে ধরা লজ্জা আর অস্তিত্বে নিয়েই কি করবো ভেবে না পেয়ে বোকার মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে দিলাম। যার অর্থ আমি পারবো হারাতে। সম্মতির দিতেই আরও লজ্জা পরে গেলাম বৃদ্ধা লোকটির কথায়।

‘ সাবাস এই না হলে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মেয়ে। তুমি অবশ্য..

বৃদ্ধা লোকটাকে বলতে না দিয়ে গম্ভীর লোকটা তৎক্ষনাৎ আমার উদ্দেশ্যে বললো…

‘ আউট!

চমকে তাকালাম পিছনে। লোকটা যে আমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বললো সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। কিন্তু কেন? আমি কি ইচ্ছা করে এখানে দাঁড়িয়ে আছি নাকি? উনার দাদাজান তো আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তাহলে আমাকে লোকটা এতো মানুষের সামনে অপমান করছে কেন? কি করেছি আমি?

‘ রিদ বিহ্যাব ইউর সেলফ!

এতক্ষণে বুঝালাম লোকটার নাম রিদ। আর বয়স্ক লোকটা উনার দাদাভাই। নাম জানি না। তবে বেশ শক্ত গলায় রিদ নামক লোকটাকে শাসাতে চাইল। কিন্তু ততক্ষণে লজ্জা আর অপমানে আমার চোখে জল চলে আসার উপক্রম হলো। রিদ নামক লোকটা উনার দাদাভাইয়ের কথা আবারও উপেক্ষা করে ফের আগের নেয় আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘ আই সে গেট আউট!

আর দাঁড়ালাম না। অপমানে বিনীতের সহিত ছলছল পিন্সিপাল স্যারকে বলে চলে আসতে চাইলাম। দরজা অবধি গিয়ে হঠাৎই কি মনে করে পিছন ফিরে আবারও তাকালাম অল্প করে। সাথে সাথে চোখাচোখি হলো দুজনার। উনি তখনো আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। উনার দৃষ্টিতে স্পষ্ট সন্দেহের ঘোর ছিল কিন্তু কিসের এতো সন্দেহ ছিল তা জানি না। তবে লোকটার অপমানটা আমার বেশ গায়ে লেগে উঠলো। ফাউন্ডার্স স্যার কক্ষ থেকে বের হয়েই হালকা ফুপিয়ে উঠলাম কান্নায়। বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম এতো গুলো অপরিচিত মানুষের সামনে আমি সেদিন। সেই লজ্জা ছুটে বেশ করে কান্দতে ইচ্ছা করছিল আমার। তারপরও নিজেকে সংযম করে ম্যামকে কাগজ পত্র গুলো দিয়ে চলে আসলাম বোকার মতো নিজের ব্যাগ আর ফোন না নিয়ে। অপমানের লজ্জাটা এতো বেশি লাগছিল যে মনেই ছিল না আমার ব্যাগ গুলো ম্যামের কাছ থেকে নিতে হবে।

#চলিত…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here