রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া ০৯

0
717

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া

০৯
বেড সাইডে বসা আমি। আমার মাথায় মোটা করে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিচ্ছে অর্ধ বয়স্ক একজন নার্স। নার্সটির শক্তপোক্ত চেহারায় বিরক্তির রেশ থাকলেও আমি ছিলাম নাজেহাল ক্রান্দনরত অবস্থায়। আমার জ্ঞান ফিরেছে আরও ঘন্টা খানিক আগে। জ্ঞান ফিরে নিজেকে প্রথমে হসপিটালে আবিষ্কার করলাম। আমার সাথে জুই, শ্রেয়া,নাদিয়া তিনজনই ছিল কিন্তু ইমার্জেন্সি রুমে এক্সট্রা মানুষের ভিড় করা যাবে না বলে শ্রেয়া আর নাদিয়া বাহিরে দাঁড়ানো। আর আমি? বেডে বসা অবস্থায় দু’হাতে জুইয়ের একটা হাত জড়িয়ে ধরে ভয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিলাম। তার কারণ আমার কপালের কাটা জায়গাটা ভিষণ চলছিল অ্যান্টিসেপ্টিক লাগানোর ফলে। থমথমে পরিবেশে আমার নাক টানার শব্দ ছাড়া কেবিন জুড়ে আর দ্বিতীয় কোনো শব্দ নেই। দুপুরের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর যখন হুশে ফিরলাম আমি, তখন থেকে রিদ খান বা তার লোকেদের দেখা পায়নি আমি। হয়তো আমাকে দেখার প্রয়োজন বোধ মনে করেন নি তাই আসেনি। এমনিতেই কোনো এক মনস্তাত্ত্বিক কারণে প্রথম থেকেই রিদ খানের অপছন্দের তালিকায় ছিলাম আমি। এবার সেও আমার অপছন্দের তালিকায় যুক্তি হয়ে গেল পরিপূরক ভাবে। এতকাল আমার মনে থাকা রাজনৈতিককে ঘিরে সকল ভালো লাগাটা ক্রমশয় ধীরে ধীরে তিক্ততার রুপ নিয়ে নিল। তার কারণটা অবশ্য আমাকে করা রিদ খানের অমানবিক আচরণটাকে দায়ী করা যায়। তার বদৌলতে আজ রাজনৈতিককে ঘিরে আমার ধারণা বদলালো। মনে ভিষণ ভাবে ভারি খেল যারা রাজনৈতিক করে তাঁরা কখনো সভ্য জাতীর মধ্যে পরে না। সেক্ষেত্রে রিদ খানকে তার উদাহরণ হিসেবে দাড় করা যায়। লোকটা আসলেই অহংকারী। ক্ষমতার দাপটে দিন দুপুরে পাবলিক প্লেসে মানুষ মারতেও তার বিবেকে বাদে না। নম্রতা, ভদ্রতা, বলতে কোনো শব্দ নেই রিদ খানের মাঝে, বরং যা আছে সেটা হলো উগ্র, অহংকারী, বিবেকহীন নিচুস্তরের মনোসত্তা। যাদেকে সাধারণ মানুষ আর যায় হোক ভালোবাসা নয় বরং অপছন্দের লিস্টে প্রথমে ফেলে দেয়। সেক্ষেত্রে আমারও অনিহার ঘৃণার লিস্টে ছিল রিদ খানের নামটি প্রথমে। আজকাল আমার সাথে যতো খারাপটা হচ্ছে না কেন তার সবকিছুর পিছনে দায়ী ছিল শুধু মাত্র রিদ খান নামক লোকটি। হঠাৎ করেই আমার জীবনে চলে আসল। তারপরও থেকে আমার সুন্দর জীবনটা দিন দিন কেমন অগুছালো করে তুললো। এর শেষ কোথায় আমি নিজেও জানি না। তবে এই রিদের খানের আগমন আর চায় না আমার জীবনে। আমি ভিষণ ভয়ভীত এই লোকটার বারবার অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন নিয়ে। যার শেষ আমি দেখছি না কোথাও। কিন্তু আমার এর শেষ চায়। ভিষণ করে চায়। আমার দীর্ঘ মনস্তাত্ত্বিক ধ্যান ভাংলো হঠাৎই বয়স্ক নার্সটির গম্ভীর কথায়।

‘ দেখি উঠে দাঁড়ান আপনি! আপনার কোমরের কাটা জায়গাটা ওয়াশ করতে হবে।

কান্নার ভেজা চোখে নার্সের দিকে তাকালাম। উনার কথায় যেন নিজের কোমরের ব্যথাটা মূহুর্তে আরও জোড়ালো টনটন ব্যথা অনুভব করলাম। জুই আমার হাত ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে করতে বলল…

‘ দেখি উঠ! গায়ের এপ্রোনটা খুলতে হবে।

নিশ্চুপ ভঙ্গিতে জুইয়ের সাহায্যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে তীব্র কোমরের ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম তৎক্ষনাৎ! জুইয়ের বাহু ধরে নুইয়ে গিয়ে আতনার্দের কেঁদে উঠি। সত্যি বলতে ভিষণ ব্যথা পাচ্ছিলাম আমি। আমার গায়ের সাদা ড্রেসটাতে এখানো ছুপছুপ রক্তের দাগ লেগে আছে। এমনকি বুকে জড়ানো মাথার সাদা হিজাবটাতেও রক্তে লাল হয়ে আছে। বয়স্ক নার্সটি বিরক্তির নিয়ে আমার বাহু চেপে উনার সম্মুখে টেনে দাঁড় করাল। আমি তখনো চোখ মুখ কুঁচকে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু বয়স্ক নার্সটি পরপর দক্ষ হাত চালিয়ে আমার এপ্রোনের বোতাম গুলো টেনে খুলতে খুলতে বললো…

‘ নাক টিপলে দুধ বের হবে অথচ এই বয়সে বয়ফ্রেন্ড জুটাইছে রাজনৈতিক লিডার। এখন তো শুধু কপাল আর কোমর ফাটাইছে, দুই দিন যাক! তারপর দেখা যাবে আরও কি কি ফাটায় লিডারে।

বয়স্ক নার্সিটির কটাক্ষ কথায় মূহুর্তে কান্না থেমে গেল আমার। বিষন্নে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। মহিলা নার্সটিকে আমাকে খোঁচা মারল রিদ খানকে নিয়ে? কিন্তু কেন? কি এমন করলাম আমি যে রিদ খানকে আমার বয়ফ্রেন্ড মনে হলো উনার? আমার বিষন্নের ঘোরের মধ্যে হঠাৎ আপত্তির মুখ খুললো জুঁই। আমার পক্ষ ধরে বললো…

‘ তেমন কিছু না আন্টি। ওহ শুধু একটা দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে ব্যাস। এমনিতে আমাদের কারও সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।

জুইয়ের কথা যে বয়স্ক নার্সটির বিশ্বাস হলো না সেটা উনার মুখ দেখেই ঠাহর করতে পারলাম আমি। কি কারণে উনি আমার উপর সন্দেহরত তাও বুঝতে পারছি না। তবে উনি নিজের বিরক্তি চেপে আমার গা থেকে এপ্রোন, আর গলা থেকে হিজাবটা টেনে খুলে জুইয়ের হাতে দিতে দিতে জুইকে কটাক্ষ করে আমার উদ্দেশ্যে বলল…

‘ কে কতোটা ধুয়া তুলসী পাতা সেটা আমাকে বুঝাতে হবে না মেয়ে। আমার মাথা চুল এমনই পাকা ধরেনি! বয়সেই গুণেই পেকেছে। মন্ত্রীর ছেলের গাড়িতে আসা, ক্ষমতার দাপটে হসপিটালের এতো হুলুস্থুল পাকিয়ে বিশেষ ট্রিটমেন্ট নেওয়া, এতো সবকিছু তো মানুষ এমনই এমনই করে না, তাই না? তাছাড়া পুরুষ মানুষে দৃষ্টি দেখলেই একজন নারী বুঝতে পারে তার মনে কি আছে! সেক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞ চোখ ধুঁকা খাওয়া নয়। তাই আমাকে মিথ্যা না বলে নিজের বোনকে ঠিক করে ধরো, ওর কোমর ওয়াশ করতে হবে।

কথাটা বলতে বলতে নার্স মহিলাটি আমার কোমরের জামাটা টেনে পেটের উপর তুলে আহত স্থানে তুলো চেপে রক্তটা পরিষ্কার করতে লাগলো। কাটা জায়গায় ব্যান্ডেজ করে দিয়ে পুনরায় জামাটা ঠিক করে দিল। ব্যস্ত হাতে উনার যন্ত্রপাতি গোছাতে গোছাতে নিস্প্রভ শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। এবার আর উনার দৃষ্টিতে বিরক্তি ছিল না তবে চেহারাটা বেশ শক্ত রেখেই আমাকে উদ্দেশ্যে ফের বলল…

‘ শোন মেয়ে! তোমার বয়সী আমারও একটা মেয়ে ছিল। সেও তোমার মতো ভুল করে কিশোরী বয়সে ছাত্র লীগের লিডার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছিল, বিনিময়ে আজ সে কবরে আছে। কিন্তু আমার মেয়ে কেন, কিভাবে মরেছে সেটা এখন না বলি। তবে তোমাকে এতোটুকুই সাবধান করছি রাজনৈতিক করা ছেলেদের সাথে ভবিষ্যত কখনোই ভালো হয়না। তুমি চাইলেও তাদের সাথে স্বাভাবিক জীবন পার করতে পারবে না। কারণ এরা নিজেদের জীবনের নিশ্চয়তা যেমন তোমাকে দিতে পারে না তেমনই নিজের পরিবারেরও না। ভাগ্য ভালো থাকায় আজ তো তুমি শুধু কপাল আর কোমর ফাটিয়ে হসপিটালের এসেছো কিন্তু পরের বার ভাগ্য তোমার সহায় না ও থাকতে পারে। তাই সাবধান করছি মন্ত্রী ছেলের পিছন ছেড়ে দাও নয়তো অকালে সবকিছু হারাবে।

বয়স্ক নার্সটির ভাসা ভাসা চোখে অশ্রু দেখলাম আমি। হয়তো মেয়ে হারানোর শোক ছিল তাতে। কিন্তু মুখের ভঙ্গিমা নিদারুণ শক্ত তেজস্কী। আমাকে কথা গুলো বলে ড্রেসিং করা রক্তের ভাটিটা হাতে তুলে নিয়ে গেল। আমি উনার যাওয়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। নিষ্পাপ আমি কোনো কিছু না করেও সবসময় অপরাধী হয়ে যায়। এবারও তাই হলো। মন্ত্রী ছেলে মানে রিদ খানের সাথে আমার কি এমন ভাব দেখলো তারা যার জন্য মহিলাটি এতো বড়ো আদেশ বাণি শুনিয়ে গেল আমাকে সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমি। হতভম্ব আমি অবাক চাহনী ঘুরিয়ে তাকালাম জুইয়ের দিকে। নার্সটির কথা আগা মাথা কিছুই ঢুকেনি আমার মাথায়। সবকিছু কেমন মাথার উপর দিয়ে গেল। তবে মনে মনে সন্দেহ হলো বেশ। নিশ্চিত আমার বেহুশ হওয়ার পর কিছু একটা হয়েছিল হসপিটালের আমাকে ঘিরে। যার জন্য হয়তো নার্সটি ভুল বুঝে আমাকে রিদ খানের সাথে জড়িয়ে দিল। জুই হিজাবটা আমার বুকে ওড়নার মতো করে জড়িয়ে দিতে দিতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল…

‘তোকে আমরা রিদ খানের গাড়িতে করে এনেছিলাম এখানে। উনার বডিগার্ড আসিফ ভাইয়া আমাদের হেল্প করেছিল তোকে হসপিটালের আনতে। তবে এখানে এসে কিছু আপত্তিকর ঘটনা হয়েছিল তোকে ইমার্জেন্সি বোডে নিতে গিয়ে। এজন্য মূলত নার্সটি ভুল বুঝলো তোকে। এবার চল এখন বাসায় যায়!

জুইয়ের মুখে আপত্তিকর ঘটনা’ শব্দটি আমার মনে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করলো কি এমন ঘটেছিল যে তিনি আমাকে রিদ খানের নামে সাথে জড়াচ্ছিল। জুই পাশ থেকে আমার কাঁধ জড়িয়ে রুম থেকে বের হতে চাইল। আমি কোমরের ব্যাথায় তখনো পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলাম ধীর ধীরে। তবে আমার মনে কৌতুহলটা তখনো ছিল বেশ। সেটা দমাতে না পেরে প্রশ্ন করেই ফেললাম৷.

‘ কি হয়েছিল? কোন সমস্যা?

জুইয়ের কয়েক সেকেন্ড লাগলো আমার কথাটা বুঝতে। বুঝেই সম্মতি দিয়ে বললো…

‘ হুমমম! হয়েছিল একটু!
‘ কেন?
‘ নেতাদের কোলে চড়ে হসপিটালের দোতলায় আসলে যা হয় তাই-ই হয়েছিল। এই নিয়ে গুঞ্জনের মুখে পরেছিস তুই।
ভয়ানক ভাবে চমকে উঠে থমকে দাঁড়ায় আমি। বিষন্নে মাথা ঘুরে উঠলো আমার। হতভম্ব গলায় মৃদু চিৎকার করে উঠি তখনই…
‘ কিহহ?

মায়ার হঠাৎ চিৎকারের থতমত খেয়ে উঠলো জুই। চমকে উঠা ভঙ্গিতে মায়াকে নিয়ে জুইয়ের পা থামল তক্ষুনি হসপিটালের করিডোরে। ইতস্তত জুই তৎক্ষনাৎ চোখ ঘুরাল আশেপাশে। চোখে পড়লো হসপিটালের যাতায়াতকারী মানুষের বাঁকা চোখ। তাদের মধ্যে একজন রিদ নিজেও ছিল। তবে তাঁর বাঁকা চোখ মায়ার উপর নয় বরং সরাসরিই তাকিয়ে ছিল মায়ার দিকে। কিন্তু হতবুদ্ধি মায়া তখনো বিষন্নের ঘোরে জুইয়ের দিকে তাকিয়ে। ইতস্তত জুই খানিকটা দ্বিধা নিয়ে চোখ ঘুরে মায়ার দিকে তাকাল। মায়ার কাঁধে হাতটা আরও একটু চেপে ধরে খুঁচিয়ে আস্তে করে বলল…

‘ কি করছিস? আস্তে কথা বল! আশেপাশে মানুষজন দেখছে তোকে।

ধ্যানরত মায়া মনোযোগ তখনো জুইয়ের দিকে। যেন অনেকটা শকটে আছে জুইয়ের কথায় সে। রিদ খানের কোলে ছিল সে ভাবতেই যেন আতঙ্ক চেয়ে যাচ্ছে মায়ার শরীর জুড়ে। তারপরও জুইয়ের অনবরত খোঁচানিতে মায়া বাধ্য হলো ঘাড় বাঁকিয়ে সামনে তাকাতে। ভাগ্যের ফেরে মায়ার সেখানেও চোখাচোখি হয়ে গেল রিদের সাথে। মূলত রিদও হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল আসিফের সাথে। যেখানে আসিফ রিদকে কিছু বলছিল আর রিদ সেটা মনোযোগ সহকারে শুনছিল, হালকা কপাল কুঁচকে মৃদু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে দিতে। মূলত তাদের দুজনের মধ্যকার কথোপকথনে মধ্যে মায়ার হঠাৎ চেচিয়ে উঠাতে মনোযোগ নষ্ট হয় রিদের। অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ঘাড় ঘুরাল আর দৃষ্টিতে ভিড়লো মায়ার হতভম্ব চেহারাটা। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই রিদের সেই বিরক্তিকর দৃষ্টি শিথিল হয়ে আসল মায়ার উপর। অনেকটা বিস্মিত নিয়ে চোখ ঘুরাল মায়ার পা থেকে মাথা অবধি। এই প্রথম মায়াকে খোলা চুলে দেখলো রিদ। নয়তো এই নিয়ে তাদের যতবার দেখা হয়ছিল প্রতিবারই মায়াকে হিজাব পরা অবস্থায় দেখেছে সে। আঘাত না পেলে হয়তো আজও তেমনই দেখতো রিদ। তবে আজকের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে ঘিরে এই প্রথম রিদের চোখে প্রদশিত হলো মায়া নিজে। বিষন্নয়ে থমকে যাওয়া দৃষ্টি আবারও ঘুরাল রিদ মায়ার পা থেকে মাথা অবধি। কলেজের সাদা ড্রেসের সাথে মায়ার মাথার সাদা ব্যান্ডেজটিও যেন আজ চমৎকার দেখাল রিদের চোখে। কিন্তু আতঙ্কিত মায়া রিদের সাথে চোখাচোখি হতেই তৎক্ষনাৎ জুইয়ের বাহু টেনে নিজেকে আড়াল করতে চাইল। জুইয়ের পিছনে লুকাতেই আবারও চমকে উঠল জুই। কি হয়েছে? জানতে চেয়ে মায়াকে সামনে আনতে চাইলে বাঁধা দেয় মায়া। ভয়ার্ত মুখে জুইয়ের পিছন থেকে উঁকি মারতে আবারও চোখাচোখি হয় রিদের শান্ত দৃষ্টির সাথে। ভয়ার্ত মায়া আরও ভয়ার্ত হলো রিদের শান্ত দৃষ্টি ভিড়ে পরে। তাই পিছনে থেকে জুইয়ের এপ্রোনটা শক্ত হাতে চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ভয়ে। ক্রন্দন গলায় বলতে থাকলো…

‘ বাসায় যাব! আমি বাসায় যাব! প্লিজ জুই আমাকে বাসায় নিয়ে চল। এই লোকটা! এই লোকটা ভালো না। ভিষণ বাজে! আমার ভয় হয় এই লোকটাকে দেখলে। এ…এই লোকটা আমাকে আবার আঘাত করবে। প্লিজ জুই আমাকে বাঁচা-না বোন। আমাকে নিয়ে চল না এখান থেকে, প্লিজ!!!

কথা গুলো শেষ করতে করতে মায়া আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠে রিদের ভয়ে। মায়ার হঠাৎ কান্নায় জুইও থতমত খেয়ে যায়, এবং বুঝতে পারে মায়া এই মূহুর্তে রিদকে ভিষণ ভয় পাচ্ছে। কিন্তু একটা এক্সিডেন্টকে ঘিরে মায়ার হঠাৎ রিদকে এতোটা ভয় পাওয়ার কারণটাও বুঝল না। আবার রিদের অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হসপিটালে উপস্থিত থাকাটাও বুঝল না। মোট কথা কোনোটাই জুইয়ের মাথায় ঢুকল না। তবে জুই মনে করেছিল ওদের হসপিটালের দিয়ে রিদ হয়তো চলে যাবে কিন্তু এই পযন্ত রিদের হসপিটালের উপস্থিত থাকাটা সত্যিই জুইয়ের মাথায় আসল না। জুই ভাবলো রিদ কি তাহলে এতক্ষণ ধরে ওদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল এখানে নাকি নিজের আহত ছেলেদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল কোনটা? ইতস্তত জুই আড়চোখে রিদের দিকে তাকাতেই দেখল রিদের শান্ত দৃষ্টি আপাতত এদিকে তাক করা। কেমন গম্ভীর আর নিশ্চুপ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রিদ। ইতস্তত জুই খানিকটা জড়সড় হয়ে দাঁড়াল। জড়তা যেন আষ্টেপৃষ্টে কামড়ে ধরল জুইয়ের শরীর। তাই মায়াকে কিছু বলতে চেয়েও কন্ঠ অবরোধ করলো জুইয়ের রিদের শান্ত দৃষ্টির অতলে। জড়তার জুইয়ের গলা দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারলো না বলে এক মূহুর্তে জন্য সেও অসহায় হলো।
~~
আধশোয়া অবস্থায় পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে খাটে বসা আমি। ভিষণ যন্ত্রণায় কোমর টনটন করছে ব্যথায় যার তাড়নায় এখনো ঘুম নেই আমার। অর্ধরাত্রি হতে চলল। আমাদের অন্ধকার রুম জুড়ে তখনো আলোর অভাব। পাশেই জুই বেঘুরে ঘুমাচ্ছে বলে রুমের আলো জ্বালায়নি। কিন্তু আরিফ ভাইয়ার রেখে যাওয়া দ্বিতীয় ফোনটা আলোয় সবটা পরিষ্কার আমার চোখে। আমি ততক্ষণে বেশ কয়েকবার ফোন করে ফেলেছিলাম হাফেজ সাহেবের নাম্বারে। কিন্তু বরাবর ব্যর্থ হচ্ছিলাম উনাকে ফোন মিলাতে। বুক ভরা কষ্ট আর হতাশার দৃষ্টি ফেলে আবার কল লাগালাম হাফেজ সাহেবের ফোনে। জানি মধ্যরাতে কাউকে ফোন করাটা ব্যাড ম্যানাসের মধ্যে পরে! কিন্তু তারপরও অচেনা স্বামীটার জন্য আজকাল মনটা বড্ড পুরছে। ভিষণ মিস করছি তাঁকে। বিশেষ করে আমার এতো অনুসন্ধানের পর যখন লোকটাকে খোঁজে পাচ্ছি না তাই আগ্রহটা আরও বাড়ছে দিন দিন অচেনা স্বামীকে খোঁজে পাওয়ার আকাঙ্খায়। কে সে? কি তার পরিচয়? বড্ড জানতে ইচ্ছে হয় আমার। জীবনে কোনো দিন তার দেখা পাবো কিনা তাও জানি না। শুধু জানি আমার তাঁকে চায় খুব করে চায়। তাঁকে খোঁজে না পাওয়ার তৃষ্ণা আমাকে আরও কাতর করে তুলছে। বুক ভারির দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও কল দিলাম হাফেজ সাহেবকে। বরাবরই মতো অফ যাচ্ছে হাফেজ সাহেবের নাম্বার। তাই ক্লান্তিতে কোলের উপর ফোনটা রেখে গা এলিয়ে শুলাম খাটে। কপালের উপর একটা হাত রেখে আবেশে চোখ বন্ধ করলাম। দুশ্চিন্তায় আহত মাথাটা টনটন করছে তীব্র ব্যাথায়। একদিকে নিজের অচেনা স্বামীকে খোঁজ না পাওয়ার যন্ত্রণা যেমন আমাকে ঘায়েল করচ্ছিল, ঠিক তেমনই আমার জীবনে হঠাৎ রিদ খানের আগমনে মুড়িয়ে দিচ্ছিল অপমানের ঘোরে। তার কধির্ত আমাকে করা বারবার অপমান গুলো আমার বেশ আত্মসম্মানে লাগছিল। আমার ছোট্ট একটা জীবনে এতো অপমানিত কখনো হয়নি যতোটা রিদ খান আমাকে বিগত দিনে করেছে। তার সাথে আমার কি শত্রুতা তা জানি না। তবে তার করা আজকে ব্যবহাটার ছিল চরম বিষাদের নেয়। আমাকে এতোটা আঘাত করে হসপিটালের পাঠিয়েও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখা গেল না। বরং অসন্তোষের কঠোর দৃষ্টি ছিল তার চেহারায় আমার উপর। কি নিয়ে আমার সাথে এতোটা ক্ষুদ্ধ ছিল তাও জানি না। আর না জানতে চায়। যতবার ভাবি এই লোকটার সম্মুখীন হবো না ততবারই মুখোমুখি হতে হয় আমায়। সেকি ইচ্ছা করে আমার মুখোমুখি হয় নাকি সম্পূর্ণটায় কাকতালীয় তাও বুঝতে পারি না। মোট কথা আমি কিছু বুঝতে পারি না। শুধু মাথায় আসে কোনো কিছু ইচ্ছাকৃত হলে রিদ খান আর যায় হোক আমার সাথে বাজে ব্যবহার করতো না। বরং আপোষেই কথা বলতো। কিন্তু আমাদের মাঝে বিষয় গুলো অনিচ্ছাকৃত হওয়ায় হয়তো রিদ খান আমাকে মেনে নিতে পারছে না তার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত দেখায়। কিন্তু আমিই বা কি করবো? লোকটার মুখোমুখি হওয়া পিছনে আমারও কোনো হাত নেই। সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত আমাদের পরপর দেখা গুলো। হয়তো আমি চট্টগ্রাম থাকছি বলে রিদ খানের মুখোমুখি বারবার হতে হচ্ছে আমাকে। কিন্তু আমি যদি এই চট্টগ্রামে আর নাই বা থাকি তাহলে আমার সাথে রিদ খানের দেখা হওয়ার সম্ভবনাও নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আপুর বিয়েতে বাসায় গেলে আর কখনোই ফিরবো না চট্টগ্রামে। যে করেই হোক কেঁদেকুটে নিজের বাড়িতেই থেকে যাব। আর আরিফ ভাইয়াকে বলবো আমাকে যেন চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সফার করে আশুগঞ্জের একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। তারপরও এই চট্টগ্রামে আর নয়। বিষাদ মনে উঠে বসলাম কোলের ফোনটা হাতে নিয়ে। গুমরে উঠা ফিলিংসে আর কিছুই ভালো লাগছে না। দুপুরে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরে এই পযন্ত বিছানায় বসে আমি। কপালের ব্যান্ডজ কাল ছাড়াতে হবে। আরিফ ভাইয়া বাসায় নেই আমাদের বাড়িতে আশুগঞ্জ আছে আপুর বিয়ের জন্য। সেখানে নাকি আরও কয়েক দিন থাকবে তারজন্য আপাতত আমি আর জুই একাই বাসার মধ্যে ছিলাম। তবে যাওয়ার আগে আরিফ ভাইয়া আমাদের বাসার কাজের মহিলা স্বপ্না খালা বলেছে রাতে থাকতে। উনি উনার দশ বছরের মেয়ে মরিয়মকে নিয়েই আছে আমাদের সাথে। আমি এক পলক তাকালাম মেঝের দিকে, আবছা আলোয় দেখলাম স্বপ্না খালা আর মরিয়ম দুজনই ঘুমিয়ে। আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাতের ফোন নিয়ে খালি পায়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে গেলাম বারান্দায়। অন্ধকারময় আকাশটায় আজ চাঁদের দেখা নেই। চাঁদ বিহীন আকাশেন নিগার নিষ্ক্রিয় ঘুটঘুটে আঁধারের মেলা। আমি শূন্য দৃষ্টি আকাশে ফেলে আবারও ফোন মিলালাম হাফেজ সাহেবের ফোনে। জানি কলটা যাবে না। নাম্বারটা অফ বলবে! তারপরও মনের ছটফটে কল দিতে থাকলাম হাফেজ সাহেবের নাম্বারে যদি কোনো চমৎকার হয়ে যায় এই আশায়। কিন্তু আমার চমৎকার আকাশে আজ অন্ধকারে মেলা বলে এবারও আমি বিফল হলাম হাফেজ সাহেবকে কল মিলাতে।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here