প্রিয়_রুদ্র_ভাই #পর্ব-১৫ #তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

0
682

#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-১৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

গোধূলি বিকেল পেরিয়ে মসজিদে আজান শুনা গেলো। রুদ্র ও তটিণী টেবিলে মুখোমুখি। ইফতার করে সবাই নামাজ পড়তে চলে গেলো৷ তটিনী পেটে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো। রুদ্র টুপি মাথায় দিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, ‘বাসায় একমাত্র এই একটার জন্যই অশান্তি হবে, রোজা রাখে ইফতার করে কিন্তু নামাজ পড়ার সময় যতো অলসতা।’

তটিনী তড়িৎ গতিতে দাড়ালো। বলল, ‘আপনি কিভাবে জানেন আমি নামাজ পড়িনা? মানে কোনো টপিক পেয়ে গেলেই হলো আপনার? আমার থেকে প্রতিশোধ নিবেন নিন। কিন্তু নামাজ নিয়ে না, আমি নিয়মিত নামাজ পরি হ্যাঁ৷ রোজা রেখে নামাজ পড়বো না কেন? আপনার মতো পেয়েছেন নাকি সারাদিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটাবো?’

রুদ্র হনহন করে চলে গেলো। তটিনী মুখ বাঁকিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে লাগলো। তাকে এখন দুনিয়ার সমস্ত আলসেমি ঘিরে ধরেছে। আলসেমিকে সাইটে রেখে সে নামাজ আদায় করলো। কিন্তু তাতেও তার পেট ফে টে যাওয়ার মতো ব্যথা কমলো না। সে ঘরের এদিক সেদিক হাটতে লাগলো।

নামাজ শেষে সবাই নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করছে। তটিনীর মাথা ঘুুরতে শুরু করলো। সে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলো। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আপনজনদের খুঁজতে লাগলো। তটিনী গলার স্বর যতটুকু সম্ভব বাড়িয়ে চিৎকার করলো, ‘মা….!

ঈশানী দৌড়ে বের হলেন। চিৎকার সবার কানেই পৌঁছে গেছে। বাড়ির সবাই জড়ো হলেন তটিণী-র রুমে। ঈশানী মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে বলতে লাগলেন, ‘কি হয়েছে তোর মা?’

তটিণী-কে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। রুদ্র ডাক্তারকে ফোন করলো। তটিনীর শরীর কাঁপছে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে বলল, ‘আমার কি হয়েছে মা? আমি কি বাঁচবো না?

রোবা নাহার ধমক দিয়ে বললেন, ‘একদম ওসব বলবে না তটিনী, তোমার কিছু হয়নি।’

ডাক্তার তটিনীকে চেক-আপ করে বললেন, ‘রমজান মাস, গ্যাসে প্রব্লেম করে বেশি। ওকে প্রতিদিন সেহরিতে ঔষধ খাওয়াবেন, তারপর খাবার খেতে দিবেন। প্রেসার ও কমে গেছে। প্রেসারে ঔষধ খাওয়াবেন।’ চিন্তার কিছু নেই।

ঈশানী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার চঞ্চল মেয়েটা কিরকম শান্ত হয়ে গেছে ডাক্তার।

ডাক্তার হেসে বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, সে একটু পরই আগের মতো হয়ে যাবে।’

রুদ্র ডাক্তারের কথামতো ঔষধ আনতে গেলে রোবা নাহার বললেন, ‘এগুলো তো ঘরেই আছে। আমাদের ওর খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। রমজানে এমন সমস্যা প্রায় অনেকেরই হয়।’

রোবা নাহার ঔষধ এনে তটিণী-কে খাইয়ে দিলেন। তটিনী কিছুসময় পরই ঘুমিয়ে পড়লো। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ঈশানী তটিণী-র মাথার কাছে বসে থাকলেন এশার নামাজের পূর্ব পর্যন্ত।

তটিণী-র ঘুম ভাঙলো দশটার দিকে। সে তখন পুরো ফিট। তাকে দেখে মনে হবে না সে কিছু ঘন্টা আগেও অসুস্থ হয়ে গেছিল। লাফিয়ে লাফিয়ে সে খাবার টেবিলে বসে পড়লো। চিকেন রোস্ট খেতে খেতে বলল, ‘এতো ইয়াম্মি কেন সব? উফফ বড়ো মা এটা যা হয়েছে না। ওয়াও।

রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘খাবি খা এতো চেঁচাচ্ছিস কেন?’

তটিনী মুখের টুকু গিলে বলল, ‘আপনার সমস্যা কি?’ আমার যা ইচ্ছে তা-ই করবো।

রাজ চিকেন লেগ পিস চিবাতে চিবাতে বলল, ‘সত্যিই অনেক মজা।’

তুরফান ও রাজ একে-অপরের দিকে চোখাচোখি করতেই তটিনী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওরা নিশ্চিত কোনো প্লান করছে রুদ্র ভাই। আগের বারের মতো আজও আপনার দিকে আমার রোস্ট চলে গেলে আমার কোনো দোষ নেই। ওরাই এসব করে সবসময়। আমি আগে থেকে আপনাকে জানিয়ে রাখলাম। হুহ।

রুদ্র চোখ গরম করে রাজ ও তুরফানকে শাসালো। দুজন ভদ্র বাচ্চা হয়ে খেতে লাগলো। তটিনী দাঁত বের করে হাসলো। সেই কতো বছর আগের প্রতিশোধ নিতে পারলো সে আজ। বেশ হয়েছে। দুটো অনেক জ্বালিয়ে ছিলো তাকে।

কিন্তু রাজ ও তুরফানের মনে ছিল অন্যকিছু। তটিনী হাঁসের মাংস পছন্দ করে না। রাজ ও তুরফান প্লান করে তটিণী-র দিক থেকে চিকেনের বাটি সরিয়ে ফেললো। তটিনীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে হাত দিয়ে চিকেনের বদলে হাঁসের মাংস নিয়ে মুখে দিয়ে ফেললো। স্বাদ ভিন্ন মনে হতেই সে চোখ বড়বড় করে তাকালো নিজের হাতের দিকে। হাতের মাংস মেঝেতে ফেলে দিয়ে হড়বড় করে বমি করে দিলো খাবার টেবিলে। যা-র কিছুটা রুদ্রের প্লেটেও গিয়ে পড়লো। রুদ্র হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে গেলো। সবাই তটিনীকে নিয়ে ব্যস্ত হলো আবারও। রুদ্রের ঘেন্নায় বমি পেতে লাগলো। ঈশানী সবাইকে সোফাতে বসতে বললেন। সবকিছু পরিষ্কার করে আবারও টেবিলে খাবার দিলেন। কিন্তু ঠিকমতো খেতে পারলেন না কেউ-ই, সবারই মনে খুঁতখুঁত থেকে গেলো, খাবারে আবার বমি পড়ে যায় নি তো?’

রুদ্র তো খেতেই এলো না আর। তটিনী মন খারাপ করে বসে থাকলো। ঈশানী মেয়েকে বকলেন না। কারণ তিনি জানেন তার মেয়ে অসুস্থ।’

*
রমজান মাসে সেহেরি খেয়ে ঘুমানোর পর মূলত সবাই ভোরে ঘুম থেকে উঠতে চায় না। তটিণী-র ভোরের পর আর ঘুম ধরা দিলো না। সে বাগানে হাঁটতে বের হলো মোবাইল হাতে নিয়ে।

নিজের রুমের বারান্দা থেকে বাগানে তটিণী-কে দেখতে পেলো রুদ্র। মাস্টার্সে ভর্তির প্রস্তুতি সে এখন থেকেই শুরু করেছে। ভালো কথা সে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাবে। মূলত সেজন্যই এমন প্রস্তুতি। তটিণী-র দেখা ওই স্বপ্নের মতো হয়তো তটিনী পাল্টাবে না, কিন্তু রুদ্র ঠিকই বিদেশে যাবে পড়তে।

চোখের সাদা ফ্রেমের চশমা খুলে রুদ্র বাড়ি থেকে বের হলো। বাগানে এদিক সেদিক তাকিয়ে তটিণী-কে খুঁজে চললো। মুহুর্তে তার চোখে ধরা দিলো কোনো জান্নাতি হুর৷ তটিনীর পড়োনে সাদা রঙের ড্রেস। সাদা লং কুর্তিও মাথায় ওড়না দেওয়া। এতো পবিত্র দেখতে লাগছে যে রুদ্রের চোখ জ্বলে উঠলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। তখনই তটিনী ফিরে তাকালো। হাতে তার সাদা নাম না-জানা ফুল। কানে সেটা গুঁজে নিলো। রুদ্রের দিকে এগিয়ে এসে হেসে বলল, ‘আপনি এতো সকালে? পড়াশোনা করছিলেন বুঝি?’

রুদ্রের দৃষ্টি মাটির দিকে। বলল, ‘হ্যাঁ বাগানে একটু হাটতে এলাম।’

তটিনী আবদার করলো, ‘চলুন না বাহির থেকে হেঁটে আসি?’

রুদ্র আবদার ফেলতে পারলো না। গেইটের দিকে হাঁটা শুরু করলো৷ ইশারা বুঝে তটিনী হাঁটতে শুরু করলো রুদ্রের পিছে পিছে। পুরো এলাকা হেঁটে বেড়ালো দুজন।

সকাল আটটার দিকে বাড়িতে পৌছে যে যার রুমে চলে গেলো। রুদ্র নিজের রুমে গিয়ে থম মে রে রইলো। তার চোখে কখনো তটিণী-র এতো পবিত্রতা ধরা পড়েনি। এই প্রথম তার অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছে। তটিনীকে আবার দেখতে ইচ্ছে করছে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও দূরত্বে থাকতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে ছুয়ে দিলেই পবিত্র হয়ে যাবে তার ছোট্ট ফুল!

তটিণী-কে নিয়ে রুদ্র ডাইরির ভাজে লিখে ফেললো কিছু আবেগী কথামালা।

‘নদীতে মানুষ ময়লা আবর্জনা ফেলে দেয়। কেউ কেউ গোসল করে। নৌকা দিয়ে পারাপার হয়। কিন্তু আমি তটিনী ইফফাত নামক মানবী নদীর থেকে পারাপার হতে চাই না। বরং তার পবিত্রতা রক্ষা করে যেতে চাই আজীবন। মানবী নদীর মাঝে একমাত্র আমিই ডুব দিতে চাই। আবর্জনা নয় তাকে প্রেমের মাদকতার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে চাই। প্রিয় পবিত্রতা? তুমি সকালের স্নিগ্ধ পবিত্র ফুলের মতোই একটি পবিত্র আত্না। রুদ্রের মনে এভাবেই থেকে যেও কেমন?’

ডাইরি বন্ধ করে রাখলো রুদ্র। সে তেমন কাব্যিকতা নিয়ে লিখতে পারে না। কিন্তু যা-ই লিখেছে সেটা মন থেকে। রুদ্র আনমনে হেসে ফেললো মানবী নদীকে মনে করে। রুদ্রের রোমান্টিক মনের বারোটা বাজাতে মুঠোফোন মানবী নদীর বার্তা এলো,-

‘আপনার মানিব্যাগটা জুতা কিনার পর ফেরত দিবো রুদ্র ভাই। গতমাসে তিন জোড় জুতা কিনেছিলাম। একটাও জুইতের না৷ ভালো দেখে দামী ব্র্যান্ডের অন্তত পাঁচ জোড় জুতা কিনে নেই। প্রমিজ করছি আপনার মানিব্যাগ যথাসময়ে ফেরত দিয়ে যাবো।’

রুদ্রের রোমান্টিক ভাব দূর আকাশে ফালালো। তার মনে হলো তার রোমান্টিকতা তাকে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলছে, ‘লজ্জা করেনা? এমন পাষণ্ড মানবীকে নিয়ে রোমান্টিক ভাবনা ভাবতে? আমার কি আত্নসম্মান নেই? নেক্সট টাইম আমাকে না এনে আন-রোমান্টিকতাে আনবি। খবরদার আবার তোর মনে এনেছিস তো!

রুদ্র নিজের ভাবনায় হেসে ফেললো। তটিণী-র প্রতি আজ রাগ হলো না। মানবী নদীকে এমন রুপেই তো মানায়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here