#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬৭)
শ্বশুড়বাড়িতে পা রেখেই তানভীর সাবিনাকে ডাকলো। সাবিনার কানে ফোন। লাবিবার সাথে কথা হচ্ছে। একটু আগেই লাবিবা ফোন করে জিজ্ঞেস করলো তানভীর এসেছে কিনা? সাবিনা বললো, ” আসেনি তো। জামাইয়ের আজ ফেরার কথা না?”
” শুনো আম্মু। ও কিছুক্ষনের মধ্যেই যাবে বুঝেছো? রান্না করেছো না সকালে? একটু খাইয়ে দিও। এসেই চলে গেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে। ”
” কি বলিস? এতোদূর জার্নি করলো ছেলেটা। এসেই আবার দৌড়াচ্ছে। না না এটাতো ঠিক নয়। তোর আব্বু তো আমাকে নিয়ে সন্ধ্যায় ও বাড়িতে যেতে চেয়েছিল।”
এরই মধ্যেই তানভীরের গলা পেয়ে সাবিনা ফোন রেখেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। খুশিতে কথা ভুলে গিয়েছে সাবিনা। বিদেশ থেকে ফিরতে না ফিরতেই জামাই তাদের সাথে দেখা করার জন্য চলে এসেছে। এরকম একটা জামাই পাওয়ার জন্য সাবিনা সারাজীবন আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছে। মন থেকে চাইলে আল্লাহ কি না দেয়!
” আম্মু কেমন আছেন?”
” তুমি দেশে ছিলেনা এতোদিন ভালো ছিলাম না বাবা। তুমি চলে এসেছো এখন অনেক বেশি ভালো আছি। ”
” কয়েকটা দিনই তো আম্মু। ”
” তোমার পেরেন্টস এর কাছে হয়তো নরমাল। আমাদের কাছে তো না বাবা। আমাদের তো এতোদিন কোনো ছেলে ছিলো না। তুমি ই আমাদের ছেলে। ”
তানভীরের গলা শুনে বাচ্চা পার্টি ছেড়ে কবিরের বউ রুপসী হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। তানভীর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন আছেন ভাবী?”
রূপসী পানির গ্লাসটা তানভীরের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
” এইতো আলহামদুলিল্লাহ। লাবিবাকে নিয়ে এলে না কেন? ওকেও সাথে করে নিয়ে আসতে। ”
তানভীর পানি মুখে দ্বিতীয় ঢুক দিতে যাচ্ছিলো, রূপসীর কথা শুনে তালুতে উঠে গেলো। সমানে কাঁশতে লাগলো। সাবিনা রূপসীকে রেখেই কিচেনে চলে গিয়েছিলো। কাশির শব্দ শুনে দৌড়ে এলো। পিঠে মালিশ করতে করতে বললো,
” বসে খাও। এইতো ঠিক হয়ে যাবে।”
তানভীর গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই রূপসী নিয়ে নিলো। লাবিবা যে এখানে নেই আর কোথায় থাকতে পারে তানভীরের বুঝা হয়ে গেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
” আম্মু, আব্বু আসলে বলবেন। আমি তাহলে এখন আসি। ”
” আসি কি? বসো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে তারপর বের হবে। না জানি কখন খেয়েছো।”
” আম্মু পরে আসবো। ”
” একদম না। বসো। ”
ধমক খেয়ে তানভীর সোফায় বসলো। রূপসী টিপ্পনি কাটলো, ” দেখলেন তো কতো তাড়া? সেজন্যই বলছি সেখানে যাবেন বউকে পকেটে করে নিয়ে যাবেন তাহলে আর তাড়া থাকবে না। ”
” বউ যদি পকেটে নিয়ে ঘুরা যেত ভাবী তাহলে সব থেকে সুবিধা বোধ হয় কবিরেরই হতো। ”
” কি এমন জাদু করলেন বলেন তো আমার সহজ সরল ননদটাকে? বেচারার শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার এত্তো তাড়া! আপনি ছাড়া কিভাবে দিন গুলো যে কাটলো সে একমাত্র যারা দেখেছে তারাই বলতে পারবে। ”
রূপসীর কথা শুনে তানভীর আর তাড়া অনুভব করলো না। সোফায় গা এলিয়ে বসলো। রূপসীকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন? বেশি মিস করেছে বুঝি?আপনি থাকতে বউ আমার কষ্টে ছিল এটাতো মানতে পারলাম না ভাবী।”
” দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মিটে?এতোদিন তো দেখে শুনে রাখলাম। এবার তো রেহাই দিন। ”
রূপসী লাবিবাকে নিয়ে কথার ঝুড়ি খুলে বসলো। এতোদিন কি করেছে , কি খেয়েছে, কোথায় কোথায় গিয়েছে, কে কি বলেছে সব বলতে লাগলো। সাবিনা খাবার দিয়ে গেছে। তানভীর খেতে খেতেই রূপসীর কথা শুনলো। খাওয়ার পর বেশি সময় নিলো না বেরিয়ে পড়লো। মনটা যেনো এখন বেশি অস্থির করছে। লাবিবার সান্নিধ্য না পেলে কিছুতেই শান্ত হবে না। কোমল মেয়েটা মাঝে মাঝেই তানভীরের প্রতি এতোটা কঠিন হয়ে যায় তানভীর তখন দিক খুঁজে পায় না। এইযে অভিমান করে এতোগুলো দিন ফোনটা তুললো না তার কোন খবরই নিতে দিলো না তানভীরের কি টেনশন হয়নি? দূরত্বের যন্ত্রনা কি তার একার? তানভীর কি ভালোবাসে না? ভাবতেই তানভীর মৃদু হাসলো। ঘন্টাখানেকের পথ শেষ করে তানভীর যখন বাসায় আসলো তখন বাসায় ফিরোজ খানও উপস্থিত। বাবা ছেলে মিলে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনায় বসল। সোনাহা খাবারের কথা বললে জানালো খেয়ে এসেছে। সেজন্য কড়া করে এক কাপ কফি শুধু দিল। তানভীর কফি টা হাতে নিয়ে একবার সিড়ির দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো না মোটেও লাবিবার কথা। সংক্ষিপ্তে আলোচনা শেষ করতে চাইলো। এরমধ্যেই টেবিলে লাবিবার উপস্থিতি টের পেলো। তানভীরের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো। আড়চোখে তাকিয়ে হাতে ভাজা টিক্কা কাবাবের প্লেটটা তানভীরের দিকে এগিয়ে রাখলো। প্লেটের দিকে তাকিয়ে তানভীর মৃদু হাসলো। তুলে নিলো একটা কাবাব। লাবিবা আশা করেছিলো তানভীর তার দিকে তাকাবে। তাকিয়েই থাকবে। এতোদিন পর তাকে দেখবে, এইযে শাড়ি পড়লো সাজলো বলবেনা সুন্দর লাগছে? কিছুই হলোনা।
” বিদেশী মেয়েদের সাথে মিশে মাথাটা গেছে। বউ আর ভালো লাগবেই না।”
বিরবির করে বললেও তানভীরের খাড়া কান ঠিকই শুনতে পায়। মনে মনে হেসে কফিটা ধীরে ধীরে শেষ করে যাতে লাবিবাও খাবারটা শেষ করতে পারে। লাবিবা উঠে যেতেই ফিরোজকে বললে ফিরোজ বলে,
” হ্যা যাও রেস্ট নাও গিয়ে। ”
” লাবিবা স্টপ।” লাবিবা শুনলে তো। এক প্রকার দৌড়েই যেনো উপরে উঠছে।
” আমি বলেছি থামতে। ” লাবিবা থামেনা বরং সোহানার রুমে চলে যায়। সোহানা ভেবেছিলো ফিরোজ এসেছে তাই না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,
” তুমি কি আবার বের হবে?”
” মামুনি।”
লাবিবার ডাকে ঘাড় ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
” কি হয়েছে? ”
” আমার ড্রেস টা কোথায় রেখেছো? শাড়ি সামলাতে পারছি না আর। চেঞ্জ করবো। ”
চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সোহানা যা বোঝার বুঝে গেলো। চেঞ্জ করতে চাইলে যে কোনো ড্রেস চেঞ্জ করে নিতে পারতো। আগেরটাই কেনো লাগবে? সোহানা লাবিবার উপর আদেশ করলো,
” শাড়ি পরেই থাকো। আর যাও রুমে যাও। তানভীরের কি লাগে গিয়ে দেখ। ”
” আমাকে ড্রেসটা দাও আমি চেঞ্জ করবো। ”
” বললাম না রুমে যাও। তানভীরের কি লাগবে গিয়ে শুনো। ”
লাবিবা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সোহানা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। এতো বড় মেয়ে হয়েছে তাও কেমন জেদ করে। কদিন পর এদের ই ছেলে মেয়ে হবে। সামলাবে কি করে? আল্লাহ জানে। বিছানা ছেড়ে সোহানাই উঠে রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। তানভীরকে এদিকে আসতে দেখে কিছু না বলেই ডায়নিং এ ফিরোজ খানের নিকট চলে যায়। তানভীর রুমে ঢুকতেই লাবিবা বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ায়। তানভীর আটকাতে যায় কিন্তু হাত পিছলে যায়। তানভীর ক্রোধ নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। এতোদিন পর বউকে পেলো বউ এসে গলা জড়িয়ে বসে থাকবে তা নয় রাগ দেখাচ্ছে তার উপর। ধমক দিয়ে বলে, ” খবরদার এক পা এগুবেনা। আমি কিন্তু পাগল হয়ে যাচ্ছি এবার। ”
লাবিবা থমকে দাঁড়ায়। তানভীরের চোখে দৃষ্টি রেখে তাচ্ছিল্য হাসে। ” চাতক পাখি হয়ে সতেরোটা দিন কাটিয়ে দিলাম। আপনার সতেরোটা মিনিট সহ্য হচ্ছেনা?”
তানভীর পা বাড়িয়ে সেকেন্ডেই জড়িয়ে ধরলো লাবিবাকে। লাবিবার দুইপা পিছিয়ে গেলো। তিনপা পিছোতেই আলমারিতে হাত রেখে ব্যালেন্স করে দাঁড়ালো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা জল। তানভীর ছাড়লো না। মিনিটের পর মিনিট পার হলো। গলায় নাক ডুবিয়ে শ্বাস টানলো। অদ্ভুত রকমের আওয়াজ কানে এলো। হাতের বাঁধন একটু আগলা করে আদুরে গলায় ডাকলো, ‘ আমার রাণী! ‘ লাবিবা চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। কতদিন পর ডাকটা শুনে কলিজা যেনো ঠান্ডা হয়ে গেলো । তানভীর আবার তাকে চেপে ধরলো। কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিলো।
বললো,” আই মিস য়্যু মোর দ্যান য়্যু।” লাবিবা উত্তর করলো না। তানভীরের বাধ ভেঙে গেলো। দু হাতে আজলে তুলে সামনে নিয়ে এলো। লাবিবার চোখের জল ঠোঁট দিয়ে শুষে নিলো। ফিসফিস করে বললো,
” আই লাভ য়্যু ।” লাবিবা তানভীর কে ছাড়িয়ে নিলো। অভিমানী কন্ঠে বলল, ” জিততে গিয়ে আমি নিজেই নিজেকে ঠকিয়ে ফেলেছি। আপনাকে ভালোবাসা আমার একদমই উচিত হয়নি।” বলতে বলতেই আবার অশ্রুদানা গড়িয়ে পড়লো। তানভীরের ভীষন খারাপ লাগলো। লাবিবা চলে যেতে নিলে আবার টেনে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো। লাবিবা মুখ ভার করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। না পারতে বললো,
“ছাড়ুন।”
“এভাবেই থাকো। যত অভিমান,অভিযোগ, নালিশ সব আমার বাহুতে রেখেই শুনবো। দূর থেকে নয়।”
” লাগবেনা আমার। কোন অভিযোগ নেই। কিচ্ছু নেই। ”
তানভীর বিছানায় বসে লাবিবাকে টেনে নিজের কোলের উপর বসালো। বুকের উপর শক্ত করে চেপে ধরলো। লাবিবার থুতনি ধরে মুখটা উঠিয়ে টুপ করে পর পর চুমু খেয়ে নিলো। জানতে চাইলো,
” কি চাই আমার রাণীর? বলো। ”
লাবিবা চুপ থাকলো। বেশ কিছুক্ষন পর নিজের মুখ খুললো। ” আমার পাসপোর্ট রেডি করেন। আপনার যতগুলো দেশের ভিসা আছে আমারও ততোগুলো দেশের ভিসা চাই। ”
” নট পসিবল।”
” যতটা পসিবল ততোটা আপাতত চাই। ”
” আমি চাইনা তোমাকে সাথে নিতে। আমি একদমই সময় দিতে পারবোনা। মাঝখান থেকে একটা টেনশনে থাকবো। ”
” কাদের সময় দেবার জন্য?” ঝটপট তানভীরের প্যান্ট থেকে ফোনটা বের করে গ্যালারি ওপেন করে সিঙ্গাপুরে থাকা মেয়েদের সাথে পিক গুলো বের করে মুখের সামনে ধরে বলে, ” এদের জন্য?” তানভীর না চাইতেও হেসে ফেলে। এদিকে লাবিবা শুধু ফুঁসছে। ফোনটা নিয়ে পাশে রেখে দেয়। হাসি থামিয়ে বলে, “জেলাসি? ট্রিপিক্যাল বউদের মতো বিহেব করছো কেন ? তুমি তো সেরকম নও জান। ওরা জাস্ট আমার কলিগ মাত্র। তুমি তো আমার রাণী। ”
” আমি যা বলেছি তাই চাই।”
” আচ্ছা। আর কি চাও বলো? ”
” ভালোভাবে গাড়ি চালানো শিখতে চাই। ”
” শিখিয়ে দিবো। আর কি?”
” অস্ত্র চালানো শিখতে চাই। ”
তানভীর চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। লাবিবা একদমি আমলে নেয় না। এমন ভাব যেনো সে ললিপপ কিনে দেবার বায়না ধরেছে। তানভীরের কপাল ভাঁজ করে জানতে চায়, ” আর?”
” মামুনি কোথায় যায়? মামুনীর সাথে যেতে চাই।”
” আর?”
” আপাতত এটুকুই লিস্ট। আপনার পায়ে পা রেখে চলতে চাই।”
তানভীর জোরে শ্বাস নিয়ে গা এলিয়ে দেয়। মাথার নিচে ক্রস করে হাত রেখে বালিশ তৈরী করে। আফসোস সুরে বলে, তোমার লিস্টে প্রয়োজন গুলো আছে কিন্তু প্রয়োজনে আমি নেই। লাবিবা ঝটপট তানভীরের বুকের উপর শুয়ে পড়ে। আদুরে গলায় বলে,
” আপনি আমার জীবনের প্রায়রিটি,প্রয়োজন নন।”
( গল্পটি সম্পূর্ণরুপে কপি পোস্ট করা নিষেধ। তবে শেয়ার দিতে পারেন। অনান্য আইডি বা পেইজে কপি, ইউটিউব ভিডিও বা থিম কপি করার অনুমতি নেই। )
চলবে ___
®লাবিবা তানহা এলিজা