#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|২২|
#শার্লিন_হাসান
সবার সাথে বসে নিজের কফিটুকু শেষ করে নিবরাসের কফি নিয়ে রুমের দিকে যায় আনায়া। নিবরাস তার রুমে নেই! হয়ত তার পার্সোনাল রুমে। আনায়া সেদিকেই হাঁটা ধরে। রুমটার কাছাকাছি যেতে দেখে নিবরাস বেড়িয়ে এসেছে। আনায়াকে দেখে নিবরাস মুচকি হাসে।
আনায়া কফির মগ দিয়ে রুমে চলে আসে। পেছন দিয়ে নিবরাস ও আসে রুমে। কাউচের উপর বসে নিবরাস কফি খাচ্ছে আনায়া রুমজুড়ে পায়চারি করছে। নিবরাস তার দিকে তাকাচ্ছে একটু পর,পর। কফি শেষ করে নিবরাস প্রশ্ন করে,
-এনি প্রবলেম আনায়া?
-হ্যাঁ,হ্যাঁ অনেক প্রবলেম। এই তারিশা আমার সবকিছুতে দোষ খুঁজে বের করে এককথায় ঝগড়ুটে ননদ বলা চলে একে।
-আরে খুঁজুক তাতে তোমার কী? কয়দিন পর ও হোস্টেলে চলে যাবে।
-উফফ আল্লাহ বাঁচালো বলুন?
-আচ্ছা আগামী কালকে আমরা নাজিয়ার সাথে দেখা করতে যাবো।
-আর কয়েকদিন পর! ও হোস্টেলে উঠেছে কীনা জানি না।
-দু একের ভেতর চলে যাবে।
*****
পরের দিন সন্ধ্যায় সুহাসিনী সহ নাজিয়া আড়ংয়ে এসেছে। নাজিয়ার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। আগামী কালকে হোস্টেলে উঠবে সে। সুহাসিনী বসে আছে নাজিয়া নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিচ্ছে। দু’জন মিলে বিল পে করে বেড়িয়ে আসে।৷ নাজিয়াকে নিয়ে আইসক্রিমের দোকানে যায়।
নাজিয়ার ফেভারিট চকলেট আইসক্রিম। সুহাসিনীর প্রিয় বাটারস্কচ। আইসক্রিম খেয়ে নাজিয়া একগাদা চকলেট কিনে তার প্রিয় খাবার।
গেটের কাছে আসতে কারোর সাথে জোরেই ধাক্কা লাগে নাজিয়ার। তার জেম্মা কিছুটা সামনে। তার হাতের শপিং ব্যাগ কয়েক নিচে পড়ে যায়। সামনের ব্যক্তিকে দেখে আর কিছু বলেনি সে। কারণ সে ব্যক্তি তার শপিং ব্যাগ তুলতে ব্যস্ত। নাজিয়ার হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে স্যরি বলে সীতাব জুম্মান।
নাজিয়ার রেসপন্সের অপেক্ষা না করে সে আবারো নিজের কথায় মনোযোগ দেয় ব্লুটুথে। নাজিয়া তার যাওয়ার পাণে একবার তাকিয়ে আবার চলে আসে। ভদ্রলোক সেজন্য রুড বিহেভ করেনি। এই যে রেগে কাউকে যা-তা বলে দেওয়া এটা নাজিয়ার পছন্দ না।মানুষ মাত্র ভুল আর সে লোক ভুল করে স্যরিও বলেছে সেখানে তার লোকটাকে যাতা বলার রাইট নেই। এতে পারিবারিক শিক্ষাটাও প্রকাশ পায়।
গাড়ীতে এসে বসতে সুহাসিনী প্রশ্ন করে,
-এতো লেট হলো কেন?
-ওই হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গিয়েছে।
-ভাগ্যিস তুমি পড়ে যাওনি।
-আমি পড়লে আমাকে ধরার মতো কেউই নেই সেজন্য আমি এখন পড়বো না। যেদিন তোমাদের জামাই আসবে আমায় নিতে তারপর নাহয় তার সাথে শপিং করতে আসলে পড়বো।
-পাকনাবুড়ি! এতো তাড়াতাড়ি তোমায় বিয়ে দিয়ে বিদায় করছি না।
-তাহলে নিধি আপুকে দিলে কেন?
-সে পড়াশোনায় পাকিবাজ! আর তার বিয়ের বয়স হয়েছে সাথে সময়ও।
-তবুও!
-তেমায় সবাই একটু বেশী আদর করে পাখি। সেজন্য এতো সহজে তোমায় কেউই ছাড়বে না।
-তোমার দেখি মেয়ের থেকে আমার প্রতি ভালোবাসা বেশী।
-মেয়ে পূত্রবধু একই জায়গায়।
সুহাসিনীর কথায় নাজিয়ার হাসি মুখটা মূহুর্তে মলিন হয়ে যায়। আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করে না নাজিয়া। মনে,মনে পণ করে নেয় সুহাসিনীর থেকেও দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। বেশী মিশে গেলে সমস্যা তার উপর নজর পড়বে তার ছেলের জন্য দুনিয়ার কোন মেয়েকে তার পছন্দ হবে না। অবশ্য জায়ানে উড়েবেড়ানোর সময় কয়েকদিন বা কয়েকমাস। এরপর খাঁচায় বন্দী হবে! একবারে যাবত জীবনের জন্য। সব প্রমাণ সংগ্রহ করা শেষ সাথে বন্যার স্বীকারোক্তি ও নেওয়া শেষ।
বাড়ীতে আসতে,আসতে নয়টা বেজে যায়। তখন সীতারা আহমেদ, জায়ান, জাফিন, তিয়াশ খান সহ তারা লিভিং রুমে বসে কথা বলছে। তাঁদের বাসায় একজন নতুন কাজের বুয়া আনা হয়েছে। তার নাম বনিতা। বয়স অল্প না আবার খুব বেশী না। সুহাসিনীর থেকে কিছুটা বেশী হবে হয়ত। গরিব মানুষ সে। সুহাসিনী, সীতারার মতো মাসে,মাসে পার্লারে গিয়ে রুপচর্চা করতে পারে না আর না নিজের ছত্রিশ বয়সটাকে পঁচিশ বানাতে পারছে।
নাজিয়াকে দেখে জায়ান বলে,
-শপিং করা শেষ আয়াত পাখি?
-দেখতেই পাচ্ছো আবার জিজ্ঞেস করার কী দরকার?
নাজিয়ার এমন রসকষহীন কথায় সীতারা আহম্মেদ বিরক্ত হয়। আজকাল তিনি খেয়াল করেন নাজিয়া জায়ানের কথা তুচ্ছ করে। তেমন পাত্তা দেয়না বিরক্ত বোধ করে আগে এমন ছিলো না। দিনদিন তার মেয়ে চেন্জ হচ্ছে। হয়ত বড় হচ্ছে সেজন্য! আবার সন্দেহ লাগে তার মেয়ে তার সম্পর্কে সব জেনে গেলো না তো?
নাজিয়ার ব্যস্ততা দেখে এসব মনেই হয়না সীতারা আহম্মেদের।
রাতের ডিনার করে যে যার রুমে চলে যায়। নাজিয়া চুপিসারে বাইরে আসে। জায়ানের রুমে যায় চকলেট হাতে। কিছুক্ষণ মিলটিল দিয়ে জায়ানের গাড়ীর চাবি নিয়ে নেয়।
তারপর গ্যারেজে গিয়ে জায়ানের গাড়ীর লক খুলে গাড়ীর লোকেশন নিজের ফোনে সেট আপ করে যাতে সহজে গাড়ীর লোকেশন ট্রাকিং করতে পারে। কাজ শেষ হতে গাড়ী লক করে আবারো জায়ানের রুমে যায়। এবার যায় জায়ানের ফোনের উসিলা দিতে। জায়ান রাজী হয় ফোন দিতে। কিন্তু নাজিয়ার আপাতত ইন্টারেস্ট নেই মূলত চাবিটা জায়গায় রেখে
বাহানা দিয়ে চলে আসে। তার মুড এখন চেন্জ ফোন নিতে মন চাচ্ছে না।
নাজিয়া প্রস্থান করতে সাড়ে দশটায় জায়ান বেড়িয়ে পড়ে সকলের চোখ পাকি দিয়ে। আজকে অবশ্য সীতারা আহমেদ ও যাবে তার সাথে। তাঁদের নেতার সাথে কিছু কথা সাথে দেখাসাক্ষাৎ করবে তারা।
নাজিয়া ও সিদ্ধান্ত নেয় সেও আজকে তাঁদের পিছু নিবে। বেলকনি থেকে নজর রাখে জায়ান বেড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু গেটের কাছে গাড়ী নিয়ে অনেক্ক্ষণ কারোর জন্য অপেক্ষা করে। নাজিয়া রুমে এসে তড়িঘড়ি চেন্জ করে নেয়। ব্লাক জিন্স,হোয়াইট টি-শার্টের সাথে ব্লাক একটা জ্যাকেট পরিধান করে। কালো শু এর ভেতরে ছোট্ট একটা চাকু ঢুকিয়ে নেয়। কাঁধের চুলগুলো দুইভাগ করে সামনে আনে। মুখে একটা মাস্ক পড়ে নেয়।
তাঁদের বাড়ীর মোটামুটি সবাই ব্যস্ত কেউ অফিসের কাজে ল্যাপটপে কেউ বা সারাদিনের ক্লান্তির কারণে ঘুমের ঘোরে।
বনিতা বেগম নিচের লিভিং রুমের সাথের রুমটায় থাকে।
সীতারা আহম্মেদ তিয়াশ খানকে ঘুমের ঔষধ দেয় কফির সাথে। যার ফলে সে কয়েক মূহুর্তে ঘুমের ঘোরে চলে যায়। জাফিন তার বড় বাবার কাছে ঘুমাবে আজকে।
সীতারা আহম্মেদ খুব সাবধানে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়ে।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় কোথা থেকে বনিতা কাশতে,কাশতে লিভিং রুমে আসে। সীতারা আহম্মেদের পা সেখানে থেমে যায়। এই বুঝি বনিতা লাইট অন করলো আর সে ধরা খেলো। মনে,মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ধরা খেলে বনিতা আর কখনো বাড়ী যেতে পারবে না তাদের অন্দরমহলের কোন একপাশে লা”শ হয়ে শুয়ে থাকবে।
নাজিয়া রুম থেকে বেড়িয়ে রুম লক করে দেয়। সিঁড়ির কাছে আসতে গিয়েও আড়ালে চলে যায়। কারণ তার মা এখনো সিঁড়ির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে। বাইরের আলোয় কিছুটা আলোকৃত তাদের লিবিং রুম। তারউপর বনিতা উঠে গেছে। মা মেয়ে দুজনের মাথায় একটা চিন্তা ধরা না খেলেই হলো।
বনিতা আর লাইট অন করেনি। আবছা আলোয় সে কিচেন রুমে চলে যায়। সেখানের লাইট অন করে। এই সুযোগে সীতারা আহমেদ বাইরে বেড়িয়ে যায়। নাজিয়া সেখানে দাঁড়িয়ে বনিতার অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণের মধ্যে বনিতা চলে আসে। নাজিয়া ও বেড়িয়ে পড়ে সমস্যা হলো সে যাবে কী করে? সে তো ড্রাইভিং পারে না তেমন। আর গাড়ী বের করলে ধরা খাওয়ার চান্স আছে। যতটুকু পারে রাস্তায় বের হতে পারবে কিন্তু রাস্তায় গাড়ী বেশী থাকলে সে কন্ট্রোল করতে পারবে না।
ভাবছে নিবরাসকে জানাবে। কিন্তু কী মনে আর নক দেয়নি। হয়ত নিবরাস ঘুমাচ্ছে আর ডিস্টার্ব করতে মন চাইলো না তার। সিদ্ধান্ত নেয় পায়ে হেঁটে যাবে গাড়ীর লোকেশন ট্র্যাক করে বুঝার চেষ্টা করে কোনদিকে যাচ্ছে গাড়ী। সিদ্ধান্ত নেয় সিএনজি পেলে উঠে চলে যাবে।
এই ছোট,ছোট বুদ্ধি গুলো নিবরাস তাকে দেয়। শুধু তাইনা কীভাবে একা নিজেকে প্রোটেক্ট করতে হয় সবসময় রাতে বের হলে সাথে অস্ত্র রাখতে হয়। আর চোখ কান খোলা রাখতে হয়। নিবরাসের বলা সেই কথাটা নাজিয়াকে বেশী সাহস জোগায়,
-নাজিয়া তুমি একজন ভালো মানুষ হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বে আমি তোমার পাশে সবসময় আছি তোমায় প্রোটেক্ট করতে।
নাজিয়া লড়ছে যতটুকু সম্ভব তবে নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছে না এই লড়াই করার পেছনে। সে জানে তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কাছের মানুষগুলো যারা দিনের পর দিন অন্যায় করে যাচ্ছি নাজিয়া কিছুই জানতো না। নিবরাস বলার পরও তার বিশ্বাস হয়নি। তবে জায়ানকে কয়েকদিন ফলো করার পর তার মনে হয় সত্যি কিছু আছে। ধীরে,ধীরে তা আরো ক্লিয়ার হয়।
নিবরাস আনায়া বেড়িয়ে পড়ে। আনায়া জানে তার মায়ের সাথে আরেকবার মুখোমুখি হবে সে। নিবরাস গাড়ী ড্রাইভ করছে আনায়া বাইরে তাকাচ্ছে একটু পর,পর।
গাড়ীতে লাইট অন করে নিবরাস আনায়ার দিকে নিজের ফোনের ক্যামরটা ধরতে আনায়া হকচকিয়ে যায়। নিজের মুখে আপনাআপনি হাত চলে যায়। নিবরাস তা দেখে হাসে। আনায়া চোখ গরম করে তাকায়। ধমক দিয়ে বলে,
-এটা কোন ধরনের কাজ? তাও এই রাতের বেলা যদি আমি হার্ট অ্যাটাক করতাম?
-তাহলে ফ্রিতে আমিও তোমার ইজ্জত হরণ করতে পারতাম। উহ্! আহ্! এসব শব্দ শোনতে হতো না আর না বদলোক শব্দটাও। ফ্রিতে চুমুও খেতে পারতাম।
-বদলোকটা এতো বেশী অ’সভ্য হচ্ছে দিনদিন।
-আমার চুমু পাচ্ছে।
-এহহ্! এটা আবার কেমন কথা? শুনেছি মানুষের প্রেম পায় আর আপনার চুমু?
-আর কথা বলো না প্লিজ!
নিবরাস গাড়ী ব্রেক কষে। আনায়ার দিকে তাকিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে বলে,
-মহারানী যদি অনুমতি দিতেন তাহলে আমি আপনার অধরে আমার অধর মিলিয়ে একখানা রোমান্টিক ফিল নিতাম। সেই সাথে আপনার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করিতাম।
-বাজে কথা ছাড়ুন আর গাড়ী স্টার্ট দিন।
-ধুর আগে চুমু তারপর গাড়ী স্টার্ট।
কথাটা বলে নিবরাস আনায়ার অধরে নিজের অধর জোড়া মিশিয়ে নেয়। আনায়ার রাগ লাগছে প্রচুর! নিবরাস ছাড়তে মুখ ফুলিয়ে তার দিকে তাকায় আনায়া।
-এমন জামাই থাকলে রোগী হতে বেশীদিন লাগবে না।
-আচ্ছা একটু অপেক্ষা করো বাড়ী গিয়ে তোমায় প্রেগন্যান্ট বানাবো।
#চলবে