#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ২৩
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে সবাই। আলভি আর রিশতার বিয়ের কথা বার্তা চলছে এখন। রিশতার মা – বাবা এসেছে ঘন্টা খানিক আগেই। পাকা কথা দিয়ে তারা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। আগামী শুক্রবারে আলভি – রিশতা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। আলভির পাশেই মাথা নিচু করে বসে আছে রিশতা। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে রক্তিম আভা। প্রেয়সীর রক্তিম আভায় ছেয়ে যাওয়া মুখশ্রীর পানে এক ধ্যানে চেয়ে থাকে আলভি। পাশে বসে থাকা অরনী আর মেহরুন মুখ টিপে হাসে।
এই সমস্ত কিছু হয়েছে মেহরুন আর আদ্রিশের জন্য। সাথে অরনীরও সাহায্য ছিল। ওদের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় আলভি। সব কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে! এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না কিছু।
কাল রাতে মেহরুন আদ্রিশকে আলভি আর রিশতার বিয়ের ব্যাপারে বলেছিল। সবটা শুনে, অরনী আর মেহরুনের পরামর্শে অবশেষে সবকিছুর বন্দোবস্ত করে ফেলে আদ্রিশ। আর রিশতার মা বাবাকে সকালে আসতে বলে তারা, বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে।
আদ্রিশের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় আলভি। কাঁধে হাত রেখে সে বলল
-‘ দোস্ত তোর জন্যই আমার ভালোবাসার মানুষটাকে এতো দ্রুত পেতে চলেছি। তোর প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
তাচ্ছিল্য হেসে পকেটে হাত গুজে গম্ভীর কণ্ঠে আদ্রিশ বলল
-‘ তোর বোনকে বিয়ে করার জন্য কিন্তু তুই থাপ্পড়ও মেরেছিলি আমায়। অথচ আমি তার প্রতিশোধ তো দূর, রিশতার পুরো পরিবারকে রাজি করিয়েছি শুধুমাত্র তোর খুশির কথা ভেবে।
মাথা নিচু করে ফেলে আলভি। তখন তো না বুঝেই এসব করে ফেলেছিল। অপরাধী কন্ঠে সে বলল
-‘ তুই এখনও এসব মনে রেখেছিস?
-‘ মনে যদি রাখতামই তাহলে কিছুতেই তোর আর রিশতার বিয়েটা হতে দিতাম না আমি।
আলভি জড়িয়ে ধরে আদ্রিশকে। আলভি বলল
-‘ কিন্তু তুই এতোকিছু এক রাতের মধ্যে করলি কিভাবে? আমি তো টেরও পেলাম না। ভেবেছিলাম রিশতা হয়তো মানবেনা। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল।
আদ্রিশ ভাব নিয়ে বলল
-‘ এসবের জন্য এই আদ্রিশই কাফি হে।
পিঠ চাপড়ে আলভি হাসতে হাসতে বলল
-‘ ভাই তুই আমার জন্য যা করেছিস জীবনেও ভুলব না আমি।
আদ্রিশ ভ্রু উচিয়ে বলল
-‘ ভুলে যাওয়ার মতোও তো কিছু করিনি আমি।
হেসে ফেলে আলভি। এই আদ্রিশটা এমনই। ওর সাথে কথায় পারবেনা কেউ।
আদ্রিশের পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে মেহরুন। এই মানুষটাকে যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে সে।
.
সব ঠিকঠাক করে আরাভ আর অরনী তাদের নিজ গন্তব্যের পথে পা বাড়ায়। অরনী ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিশের দিকে। দৌড়ে এসে অরনীকে জড়িয়ে ধরে আদ্রিশ। অরনীও আদ্রিশকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। আদ্রিশের বুকে তীব্র ব্যথা অনুভুত হয়। বোনটাকে সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। আজ সেই বোনটাও তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
অরনীর হাত আকড়ে ধরে আদ্রিশ করুন কন্ঠে বলল
-‘ তুই এখানে থেকে যা। আমায় ছেড়ে যাস না আপু। তোকে খুব ভালোবাসি রে। তোকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে আপু।
অরনী কাঁদতে কাঁদতে বলল
-‘ আর কতোদিন ভাইয়ের বাড়িতে থাকবো, বল। চলে তো যেতেই হতো। এটাই যে নিয়তি। প্রতিটা মেয়েকেই তো তার চিরচেনা শৈশব কৈশরের স্মৃতি, তার বাবার বাড়ি ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা জায়গা, শশুর বাড়ির পথে পা বাড়াতে হয়।
আদ্রিশ এবার বেশ অনুনয়ের সুরে বলল
-‘ আপু তুই থেকে যা না। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমার কি হবে? কে দেখবে আমায়?
চোখ অশ্রু টলমল করলে হালকা হেসে অরনী বলল
-‘ কে দেখবে মানে মেহরুন আছে কি করতে তাহলে? মেহরুন দেখবে তোকে।
ঝাপসা চোখে মেহরুনের দিকে এক পলক তাকায় আদ্রিশ। মেহরুনের চোখে অশ্রু টলমল করছে। অরনীর বিদায় দেখে নিজের বিদায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। কতোদিন নিজের বাবার বাড়ি যাওয়া হয়নি! মেহরুনের কষ্টের মুহুর্তগুলোতে পাশে পেয়েছিল অরনী নামক মানুষটিকে। যে কিনা সবসময় নিজের বড় বোনের মতো আগলে রেখেছিল ছিল তাকে। অরনীকে সে ভীষণ মিস করবে। একসাথে বসে আড্ডা দেওয়া, হাসি তামাশা আর হয়তো হবে না কখনো। এসব ভেবেই মেহরুনের কান্না পাচ্ছে খুব।
আদ্রিশ চোখ মুছে অরনীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত কন্ঠে বলল
-‘ যদি বিয়ের পর শশুড় বাড়ি যাওয়ার বিধান না থাকত তবে তোকে সারাজীবন আমার বাড়িতে রেখে দিতাম রে আপু।
অরনী চোখ জোড়ায় আবারও অশ্রু কণারা এসে ভিড় জমায়। আদ্রিশ শক্তভাবে উক্ত কথাগুলো বললেও তার ভেতরটা যে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না অরনীর। আদ্রিশকে ছেড়ে থাকতে তো তারও ভীষণ কষ্ট হবে। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মেছে তাকে যে মানিয়ে নিতে হবে সবটা! এই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরনী।
অরনী এবার মেহরুনের দিকে এগিয়ে ওর হাতটা ধরে বলল
-‘ আমার ভাইটার খেয়াল রেখো, মেহরুন। ভাইটা বড্ড ভালোবাসে তোমায়। ওকে কখনো কষ্ট দিও না তুমি। ও বড্ড অভিমানি। কখনো কোনোকিছু নিয়ে কষ্ট পেলে কাউকে কিছু বলেও না। তুমি ওকে আগলে রেখো, কেমন?
মেহরুন ঠোঁট টেপে মাথা নাড়াল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ভেজা কন্ঠে বলল
-‘ আর কিছুদিন থাকলে হতো না আপু?
অরনী হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। হালকা হেসে জবাব দেয়
-‘ এই পাগল এমন করছিস কেন তোরা? এমন একটা ভাব করছিস যেন জীবনে কোনোদিন আর আসবো না। আমার যখন মন চাইবে আমি কিন্তু তখনই এসে হাজির হবো বলে দিলাম।
অরনীর কথা শুনে হেসে ফেলে মেহরুন। মানুষটা এমনই। হাজার কষ্টের মাঝেও হাসিয়ে ছাড়বে ঠিকই।
আদ্রিশ এবার আরাভের কাঁধে এক হাত রেখে চোখ মুছে ভারী কন্ঠে বলল
-‘ আমার বোনটাকে আগলে রাখবেন ভাই। বোনটা আমার খুব ভালো মনের মানুষ। ওকে আগলে রাখবেন। ছায়া হয়ে থাকবেন সবসময় ওর পাশে। আমার বোনের কোনো ক্ষতি হলে আমিও কিন্তু ভাই হিসেবে ছেড়ে দিব না কাউকে।
শেষোক্ত কথাটা বেশ শক্ত ভাবেই বলল আদ্রিশ। আরাভ হেসে আদ্রিশের কাধ চাপড়ে বলল
-‘ ভয় নেই, আমি সবসময় তোমার বোনকে আগলে রাখব ভাই। আগলে রাখবো বলেই শত বাধা শত প্রতিকুলতার মাঝেও তাকে নিজের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি। আর এখন নিজের বউকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পালা। ইনশাআল্লাহ আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তাঁর পাশে থাকব আমি। আর শোনো তোমার যখনই অরনীর জন্য খারাপ লাগবে তখনই তুমি চলে আসবে আমার বাসায়, বুঝলে?
আদ্রিশ মাথা নেড়ে সায় জানায়। এমন একটা ভালো মানুষের হাতে বোনটাকে তুলে দিতে পেরে স্বস্তি পায় আদ্রিশ।
পাশে থাকা আলভি আর রিশতার মাথায় হাত বুলিয়ে অরনী মুচকি হেসে বলল
-‘ নতুন জীবনের শুরু হতে চলেছে তোমাদের। দোয়া করি খুব সুখী হয় তোমরা।
রিশতা জড়িয়ে ধরে অরনীকে। করুন কন্ঠে রিশতা আলভি দুজনেই একসাথে বলল
-‘ তোমায় খুব মিস করবো আপু। আমরা তোমায় অনেক ভালোবাসি আপু।
অরনী হেসে বলল
-‘ আমিও। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে, ইনশাআল্লাহ। ওহ ভুলেই তো গিয়েছি, তোদের বিয়েতে তো আমি আর আরাভ আসছিই, তখন তো দেখা হবেই। কি তাই না বলো আরাভ?
অরনীর কথায় মাথা নেড়ে সায় জানায় আরাভ।
আরাভ অরনী সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় তাদের নতুন পথে, নতুন গন্তব্যে। সূচনা হতে চলেছে তাদের নতুন পথচলার। যে পথে নানানরকমের বাঁধা আসতে পারে কিন্তু একজন বিশস্ত মানুষের হাত ধরে সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে পথ চলতে হবে। অরনী প্রথমে ভয় পেলেও আশস্ত করে আরাভ। ভরসার হাত রাখে অরনীর কাঁধে। ভরসা পায় অরনী। কোনো ভুল মানুষকে ভালোবাসেনি তবে!
অরনী চলে যেতেই ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে আদ্রিশ। অরনীকে বিদায় জানাতে হবে, এমন দিনও যে দেখতে হবে তা কখনো ভাবেওনি আদ্রিশ। আজ বড় কষ্ট হচ্ছে তার। প্রতিদিন চোখের সামনে আর কখনো দেখা হবেনা বোনটাকে। সে যে এখন পরের বাড়ির বউ!
পাশে বসে আলভি আর রিশতা সান্তনা দেয়। কিন্তু আদ্রিশ ঠায় এক হাঁটুতে হাত রেখে বসে থাকে। আদ্রিশের পাশে গিয়ে বসে মেহরুন। আদ্রিশের কাঁধে এক হাত রাখে মেহরুন। আদ্রিশ চকিত তাকায় মেহরুনের দিকে। আদ্রিশের চোখ এখনো ছলছল করছে। তা দেখে বুক কেঁপে ওঠে মেহরুনের। আদ্রিশ কোনো কথা না বলে হুট করে জাগটে ধরে মেহরুনকে। আদ্রিশের পিঠে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় মেহরুন।
#চলবে~
ঈদে নানান রকমের ব্যস্ততার কারণে গত দুদিন যাবত গল্প দেওয়া সম্ভব হয়নি। আজও অনেকটা ব্যস্ততার মাঝে গল্প দিতে হয়েছে। এজন্য আজকের পর্বটা একটু এলোমেলো হতে পারে, তার জন্য দুঃখিত।
পরিশেষে, লেট ঈদ মোবারক🌙💖
ঈদ কেমন কাটলো সবার?