#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ২২
স্রোত ফ্রেশ হয়ে বনলতা বেগমের রুমে গেলো।বনলতা বেগম জায়নামাজে বসে আছেন।স্রোত চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো।অপেক্ষা বনলতা বেগমের নামাজ শেষ হওয়ার।
বনলতা বেগম নামাজ শেষ করে দেখেন স্রোত এক ধ্যানে কিছু ভাবছে।বুঝলেন মেহরাদের কথা ভাবছে।স্রোতের পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথা হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে স্বরে বললেন,
“টেনশন হচ্ছে? ”
ধ্যান ভাঙ্গে স্রোতের।সে বনলতা বেগমের কোমড় জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রাখে।বনলতা বেগম বুঝলেন মেয়ের মন খারাপ একটু বেশিই।তিনি আবার বললেন,
“টেনশন করো না।সব ঠিক হবে।আমার ছেলে সহীহ সালামতে ফিরে আসবে।”
স্রোত ঐভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এতো নিশ্চিত কিভাবে আম্মু? তোমার ভয় হচ্ছে না?”
বনলতা বেগম হাসলেন।স্রোতকে ছেড়ে তার পাশে বসে বললেন,
“ভয় আগে হতো,এখন হয় না।সাত বছর এই প্রফেশনে।দেশ-বিদেশের আরো অনেক মিশনে মেহরাদ গিয়েছে।অনেকসময় সুস্থ হয়ে ফিরেছে,অনেকসময় আহত হয়ে ফিরেছে।হসপিটালে কত রাত কাটিয়েছি এই ছেলেকে নিয়ে।তাই এখন আর ভয় না।”
“কখনো এই প্রফেশন থেকে বেড়িয়ে আসতে বলো নি?”
“তোমার শ্বশুরের ইচ্ছে ছিলো ছেলে দেশসেবায় নিয়োজিত হবে।আমি বাঁধা দিয়েছি অনেক, শুনে নি। চিন্তা করো না।সব ঠিক হবে।”
“হুম”
“পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?”
“ভালো!”
“শেষ হবে কবে?”
“রিটেন শেষ হবে পরশুদিন।তারপর কিছুদিন অফ।তারপর অবজেক্টিভ স্ট্রাকচার্ড প্র্যাকটিক্যাল, তারপর ওরাল,প্র্যাকটিকেল।আরো এক-দেড় মাস লাগবে।”
“যাও পড়তে বসো।চিন্তা করো না।”
স্রোত নিজের রুমে চলে যায়।তার মাথায় শুধু একটা কথা-ই ঘুরছে,
“আমি যদি না ফিরি তাহলে আমার হয়েই থেকো স্রোত।”
কি করুণ আকুতি!এই আকুতি ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো আছে?
আজ সকাল থেকেই আকাশে ঘন মেঘ, শুধু ঝরে পড়ার অপেক্ষা।আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কবিগুরু ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ এই লাইনটা আজকের মতো কোনো দিনেই লিখেছিলেন।আজ যেনো আকাশের মন খারাপ।
আজ স্রোতের লিখিত পরীক্ষা শেষ। একটা বিশাল ধাপ পেড়িয়ে নিজ স্বপ্নের দিকে এগিয়ে গেলো।ছুঁই ছুঁই অবস্থা যেনো।কত বছরের সাধনা,কত বছরের কষ্ট,কত বছরের নির্ঘুম রাতের তপস্যা আজকে শেষ।দশদিন পর থেকে অবজেক্টিভ স্ট্রাকচার্ড প্র্যাকটিক্যাল শুরু। আজ স্রোতের খুশি হওয়ার কথা!কত দিনের ইচ্ছে ছিলো আজকের এই দিনটা।আজ নিজেকে মুক্ত পাখির মতো অনুভব করার দিন ছিলো।কিন্তু স্রোতের মন আকাশেও মেঘ জমেছে।কেনো জানি ঐ মানুষটার কথা বেশিই মনে পড়ছে।কি করছে মানুষটা?ঠিক আছে তো?খেয়েছে?কে জানে কি অবস্থায় আছে!এই মানুষটার জন্যই তো তার নিজ দায়িত্বে অন্ধকার করা জীবনটায় আলো এসেছে।মানুষটা জোর করে আলো হয়ে এসেছে,ঠিক যেনো নিশীভাতি।
রাত যত বাড়ছে,আকাশের মন খারাপের পাল্লাও বেড়ে চলেছে।সন্ধ্যার দিকে আকাশটা একটু ভালো হলেও আবার খারাপ হয়ে গেছে।ঝড়ো বাতাস বইছে।একটু পরপর বজ্রপাত হচ্ছে।কি তান্ডব হবে সৃষ্টিকর্তাই জানেন।তখনই কলিংবেল বাজলে কে এসেছে দেখার জন্যে বের হয়।বনলতা বেগম ড্রয়িংরুমে থাকায় তিনিই দরজা খুললেন।স্রোত ড্রয়িংরুমে এসে দাড়িয়েছে।রিনিও পাশে দাঁড়ানো। দরজা খুলতেই একটা মেয়ে “সারপ্রাইজ” বলে বনলতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে।মেয়েটিকে দেখে স্রোত ভূত দেখার মতো চমকে উঠে।পেছনে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে।তার মুখে হাসি।পাশে কয়েকটা লাগেজ।স্রোতের বুঝতে অসুবিধা হলো না যুবক মাহিরার হাসবেন্ড তাঈফ।তাঈফের ছবি সে ফ্যামিলি ফটোর অ্যালবামে সে দেখেছে।আর মাহিরার সাথে তার প্রায়ই কথা হয়।মাহিরা যে দেশে আসবে তা কেউ জানতো না।স্রোত, বনলতা বেগম বড্ড বেশিই অবাক হয়েছে।
নিজেকে ছাড়িয়ে মাহিরার দিকে তাকিয়ে আছে বনলতা বেগম। মাহিরা হাসছে।বনলতা বেগম মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন,
“তোর এই অভ্যাসটা কবে ছাড়বি?সবসময় এমন করিস।”
মাহিরা হাসতে হাসতে ভেতরে প্রবেশ করে স্রোতের দিকে যেতে যেতে বলে,
“তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে ভালো লাগে মা।দরজার বাহিরে হঠাৎ আমাকে দেখে যখন ভূত দেখার মতো চমকে উঠো, সেই সিনটা দেখতে যে কি ভাল্লাগে মা।”
“নাটকবাজ মেয়ে।” মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে এবার তাঈফের দিকে নজর দেন বনলতা বেগম।তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“তুমিও এই নাটকবাজের সঙ্গ দিলে!”
তাঈফ ভেতরে হেঁসে ভেতরে প্রবেশ করে।বলে,
“সঙ্গ না দিলে যে আপনার মেয়ে আমাকে আস্ত রাখবে না।জানেনই তো ও কেমন!”
স্রোত হাসছে ওদের কান্ডে। এর মধ্যে মাহিরা ওকে জড়িয়ে ধরেছে।কুশলাদি বিনিময় করেছে। স্রোত বলে,
“পরশুদিন রাতে তো কথা হলো।তখন তো বলতে পারতে!”
মাহিরা হেঁসে জবাব বললো,
“তখন আমরা এয়ারপোর্টে ছিলাম।”
“এরজন্যই ঐদিন ভিডিও কল দাও নি!”
“একদম!” বলে শব্দ করে হেঁসে ফেলে মাহিরা।
তখন রিনি বলে উঠে,
“আর কইয়েন না,ভাবীজান, আপা সবসময় এমন করে।আরেকবার আমি দরজা খুলছিলাম বুঝছেন?খুইলা তো আপারে দেইখা আমি অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম।আপার লগে ২ ঘন্টা আগে কথা কইছিলাম আমি আর চাচি। আপা বাংলাদেশে আইসা আমগোরে ফোন দিছিলো।কিন্তু জানায়ছে না।আমি ত ডরে শেষ আছিলাম।”
রিনির কথায় সবাই হেঁসে ফেললো।স্রোত বুঝলো এই পরিবারের সবাই অনেক মজার মানুষ,হাসি-খুশি।সে মেহরাদের কাছে কৃতজ্ঞ এমন একটা পরিবারে তাকে আনার জন্যে।তাকে বিয়েতে জোর করার জন্যে।
মাহিরা তখন এক তোড়া লাল গোলাপ মায়ের হাতে দিলো।বনলতা বেগম তা গ্রহণ করে বললেন,
“তোদের ভাই বোনের পা গ লামী আর শেষ হলো না।”
“ছোটবেলার অভ্যাস মা।ফুল পেলে তুমি আজও কত খুশি হও!সবসময় এমন করে যাবো।”
“হয়েছে।ফ্রেশ হতে যা।আমরা খাবার তৈরী করি।”
“হ্যাঁ মা।বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে।কতদিন তোমার হাতের রান্না খাইনা।প্লেইন ল্যান্ড করার কথা ছিলো এগারোটার দিকে।আকাশের অবস্থা খারাপ ছিলো বলে সেই প্লেইন ল্যান্ড করেছে বিকালে।আর ফ্লাইটের যেই বাজে খাবার।ছিহ!।”
মাহিরা-তাঈফ চলে যায় ফ্রেশ হতে।এদিকে বনলতা বেগম ফুলগুলো স্রোতের হাতে দিলেন।তিনি জানেন স্রোতও ফুল পছন্দ করে।স্রোতের মনে পড়ে যায় প্রথমদিন ওরা সবাই যখন ঘুরতে বের হয়েছিলো তখন মেহরাদও সবার জন্য ফুল এনেছিলো,মা পছন্দ করে বলে।তাছাড়া, স্রোত যখন চট্টগ্রামে ছিলো,তখনও তাকে এত্তো এত্তো ফুল দিয়েছিলো।ভাই-বোন দুজনই মায়ের পছন্দকে এখনো গুরুত্ব দেয়।সে যত এই পরিবারকে দেখছে তত অবাক হচ্ছে।বনলতা বেগম তখন বললেন,
“আসো রান্না করতে করতে গল্প করি।তোমার সময় হবে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আজকে ফ্রি আছি।”
“আসো তাহলে।”
বনলতা বেগম রান্না করছেন।রিনি এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।স্রোত পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে।তার মনে পড়ে যায়,তার মা যখন রান্না করতো,সে মাঝে মাঝেই এভাবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো।আর কত গল্প করতো মা-মেয়ে।যা বর্তমানে অতীত ছাড়া কিছু না।দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।বনলতা বেগম বললেন,
“কি ভাবছো?”
“তেমন কিছু না!”
“তোমার মনে আছে আমরা যেদিব প্রথম রাতের শহর দেখতে বেড়িয়ে ছিলাম,মেহরাদ আমাদের জন্য ফুল,গাজরা এনেছিলো?মনে আছে?”
“হ্যাঁ, আছে!” স্রোত মাথা নাড়িয়ে বলে।
“আজকে মাহিরা আনলো।তোমার মনে প্রশ্ন জাগে না জরা এমন কেনো করে?”
স্রোত তাকিয়ে রইলো।কিছু বললো না।এমনটা সে আগে দেখে নি।বনলতা বেগম বলতে শুরু করলেন,
“তোমাদের বাবা আমাকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন।ডাক্তার মানুষ ছিলেন।আমার বাবাকে উনিই চিকিৎসা করতেন সেই সুবাদেই উনার আমাকে দেখা।তারপর পরিবারে কথা বলা,তারপর বিয়ে।উনি আমার সাথে কখনোই জোর গলায় কথা বলতেন না।আমি যে গৃহিনী মানুষ,উনি এতো বড় ডাক্তার কখনো আমাকে ছোট নজরে দেখেননি।যদিও আমি সেই আমলের অনার্স পাশ।কিন্তু সংসারের জন্য কখনো চাকরি করার কথা ভাবি নি।আর এটা তোমাদের বাবা সম্মান করতেন।তবুও যদি কোনো কারণে সকালে আমার সাথে ঝগড়া করতেন,বকাবকি করতেন রাতের বেলাতেই ফেরার সময় আমার জন্য ফুল নিয়ে আসতেন,হাবিজাবি খাবার নিয়ে আসতেন।উনি জানতেন এগুলা আমার পছন্দ। রাগ না করলেও উনি এমনটা করতেন।যা আমার ছেলেমেয়েরা দেখেছে,শিখেছে।মেহরাদ তো ছোট থেকেই বাড়ির বাহিরে থাকতো।যখন বাড়িতে ফিরতো তখন আমার জন্য ফুল আনতো।মাহিরা তো আমার সাথেই থাকতো।স্কুলে রেজাল্ট খারাপ করলে আমি যাতে রাগ না করি আমার জন্য নিজের জমানো টাকা দিয়ে ফুল আনতো,হাওয়াই মিঠাই আনতো।আরো কত কি!আমার ছেলে-মেয়ে দুইটাই বাবার মতো হয়েছে। এদের সাথে তুমি কখনোই রাগ করে থাকতে পারবে না। দেখলে না,আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে না জানিয়ে চলে আসলো।সবসময় এমন করে।মাকে সারপ্রাইজ দিতে ওদের ভালো লাগে।”
বনলতা বেগম স্মিত হেঁসে বলা শেষ করলেন। স্রোত অপলক চেয়ে রইলো ঐ হাসিতে।কত প্রশান্তির হাসি এটা!একটা মেয়ে জীবনে আর কি চায়?স্বামী,সন্তানূের জন্য যে তার সারাটাজীবন বিলিয়ে দেয়,তার তো এতোটুকু খুশী প্রাপ্য।কিন্তু তার মা!!কিচ্ছু পায় নি,কিচ্ছু না,শুধু অ শা ন্তি ছাড়া।কখনো ক্ষমা করবে না তার বাবাকে!তার মা এক আকাশ পরিমাণ দুঃখ নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছে।
#চলবে….
[যেই ঝড়ই আসুক না কেনো,শেষটা সুন্দর হবে।জীবনে দুঃখ না আসলে সুখের গুরুত্ব বুঝা যায়?]
Bindas Life