প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৩১

0
483

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩১

বিরসতায় ঘিরা দিনটাতে সুইমিং পুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তথ্য। এটাকে অবশ্য পুল বলা যায় না। বিড়াট বড় এক অগভীর পানির পুকুর। মূলত এদিকটাতে আজ ট্রেনিং চলছে। তথ্য তাদের গাইড হিসেবে নিয়জিত এখানে। মনমরা হয়ে তথ্য আপাতত এদিকটাতে বসে আছে। সূর্য এখনও ডুবে নি। ডুববে ডুববে একটা ভাব। তথ্য’র মনে হয় ওর জীবনের সূর্যটা ডুবে গিয়েছে। ডুবলো তো ডুবলো এখনও উদয় হলো না। কোথায় যে হারালো? দীর্ঘ শ্বাস ফেলার কিছুই নেই ওর।
এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে তাকালো তথ্য। ওর দিকেই একজন হেঁটে আসছে। তথ্য তাকে চিনে। ওর সিনিয়র অফিসার। এই ব্যাক্তি তথ্য’কে অনেক সাহায্য করেছে তুষার’কে পেতে। ওনাকে আসতে দেখেই তথ্য পদচারণ থামালো। সম্মুখের ব্যাক্তিটি ওর সামনে দাঁড়াতেই তথ্য স্যালুট করলো। বরাবর দাঁড়িয়ে অফিসার অল্প হেসে তথ্য’কে ভিন্ন ভাবে সম্মোধন করলো আজ,

— মিসেস.তুষার, কি খবর?

তথ্য লজ্জা পেলো কিছুটা। কি এক অবস্থা করেই না তুষার পাগলটা ওকে বিয়ে করলো। পুরোই হুলুস্থুল এক কান্ড। মান ইজ্জত বাকি রইলো না কিছু। তথ্য’কে লজ্জা পেতে দেখে অফিসার এবার অল্প শব্দ করে হাসলেন। তার হাতে থাকা কাগজটা তথ্য’কে দিয়ে শুধু বললেন,

— হি ইজ ফাইন। ডোন্ট ওয়ারী।

তথ্য প্রশ্নবোধক চাহনি দিলো। অফিসার ইশারায় কাগজটাকে দেখিয়ে চলে গেলেন। দ্রুত পায়ে রুমে ছুটলো তথ্য। দরজা লাগিয়ে বসলো একদম মেঝেতে। তুষারের চিঠি। এই ডিজিটাল জুগে এই চিঠি’র মানে তথ্য খুঁজে পেলো না। দুরুদুরু বুকে কাগটা খুলতেই মতির দানার মতো ঝরঝরা লিখাগুলো নজর কাটলো তার।

প্রিয় প্রাণ,

প্রাণ বলেই সম্মোধন করলাম তোমাকে তথ্য। তুমি আমার প্রাণের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার প্রাণের টুকরো। আমার প্রিয় প্রাণ, তোমাকে একা ফেলে এসেছি বলে রেগে আছো? টেনশন হচ্ছে? ভাবছো না তো যে তুষার ছেড়ে চলে গেলো? ছয়মাস তো আর কম নয়। বুঝি আমি। জানি। কিন্তু কি করব বলো? তুমি তো সাধারণ কোন পুরুষ’কে ভালোবাসো নি তথ্য। বেসেছো ঝামেলায় পরিপূর্ণ এক দায়িত্ববান সন্তানকে। এমন এক কঠোর পুরুষ’কে যে নতুন বিবাহিত এক রাতের আদরের বউ’কে রেখে চলে আসে। আমি এতটাই কঠোর তথ্য। ঠিক এতটাই কঠোর যতটা কঠোর হলে সোহাগে পরিপূর্ণ আমার ঘ্রাণে মত্তে থাকা নতুন বউটাকে রেখে চলে এলাম। জানো আমি এতটাই কঠোর।
কিন্তু কি জানি হলো বুঝলে। আমি ভেঙে গেলাম। প্রথম ভাঙলাম যখন বাবা ছেড়ে চলে গেল। বাবা আর ফিরবে না তথ্য। সে ছাইচাপা কষ্ট নিয়ে চলে গেল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অথচ ত্যাগ করতে পারলো না তার পুতুলের মায়া।
দ্বিতীয় বার আমি আবার ভাঙলাম তথ্য। আমার পুতুল। আমার পুতুলটা যাকে আমি আমার সন্তানের মতো ভালোবাসি সে নিজের মধ্যে নেই। কেমন যে হয়ে গেলো আমি বুঝাতে পারলাম না। বিশ্বাস করো তথ্য, আমার বুকের পাজরের হাড়টা বুঝি মোচকে গেলো। কেমন জানি দম বন্ধ দম বন্ধ লাগে। তথ্য ওকে এমন ভাবে দেখতে যে আমার কি কষ্ট হলো আমি বুঝাতে পারলাম না।

জানো তথ্য আমাকে কাঁদানো এত সহজ না। অথচ আমি প্রচন্ড দূর্বল হয়ে যাচ্ছি। তুমি কাছে থাকলে তোমার বুকটাতে মুখ গুজে কেঁদে বুক হালকা করতাম।
প্রাণ আমার, আমি ফিরব। তুমি মন খারাপ করো না। করেও লাভ হবে না। তুমি তো নিষ্ঠুর এক পুরুষ’কে বিয়ে করেছো।

ভালো থেকো বলতে পারলাম না। জানি না, কতটা ভালো থাকতে পারবে।

ইতি,
তোমার অপ্রিয় প্রাণ।

চিঠিটা পড়া মাত্র ঝরঝরে কেঁদে উঠলো তথ্য। কাগজটা বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। কোথায় যাবে ও এখন? কোথায় পাবে ওর পুরুষটাকে? তুষারে’র এই কষ্ট কিভাবে লাঘব করবে ও?

___________________

বিছানায় কোণায় গুটিয়ে বসে আছে তোঁষা। দরজা বন্ধ ওদের রুমের। আরহাম বাসায় ফিরে নি এখনও। ভয়ে ভয়ে তোঁষা বারদুই ডাকলো আরহাম’কে। আরহামে’র সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয়টা বেশি বাড়লো। ও দেখেছে ওর বাবা এসেছিলো। দরজা ঠকঠক করার শব্দ হলো প্রথমে। তোঁষা যখনই বললো, কে। তখনই তুহিন উত্তর করলো। এর মানে ওর বাবা এসেছে। তোঁষা’কে ডেকেছে। একটু পর ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডেকেছে তোঁষা’কে। আরহাম’কে বললে আরহাম কিছুতেই বিশ্বাস করে না। তোঁষা’র কান্না পায় তখন।
হঠাৎ ই তোঁষা দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো তুহিন দাঁড়িয়ে। বালিশে মুখ লুকিয়ে ফেললো তোঁষা ততক্ষণে। একটু পর ধীরে ধীরে এক চোখ বের করে দেখলো না যায় নি ওর বাবা। এখনও দাঁড়িয়ে। তার মুখটাতে হাসি নেই। কেমন দুঃখ দুঃখ মুখটা। ধীরে ধীরে পুরো বালিশটা ই সরালো তোঁষা। তুহিন ডাকে ডাকলো,

— পুতুল?

— বাবা।

— হ্যাঁ বাবা। এদিকে আয় আম্মু।

— ভয় হয়।

— বাবা’কে ভয় হচ্ছে? কেন পুতুল? আমার পুতুল তার আব্বু’কে ভয় পায়?

— তুমি তো চলে যাও বাবা।

— যাব না?

— উহু।

— তাহলে কি করব মা?

— থেকে যাও।

— জায়গা নেই তো। কোথায় থাকব?

— আমার কাছে থেকে যাও। অন্তত আরহাম ভাই আসা পর্যন্ত। উনি বিশ্বাস করে না।

— তুই করিস?

— কি?

— বিশ্বাস।

— তোমাকে?

— হ্যাঁ।

— সত্যি?

— তিন সত্যি বাবা।

— তাহলে যাবি বাবা’র সাথে?

— কোথায়?

— মাত্রই না বললি বিশ্বাস করিস।

— আমি চলে গেলে আরহাম ভাই কাঁদবে বাবা।

— আমি ও কাঁদি পুতুল। কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকে ব্যাথা উঠে যায়। বাবা’র সাথে চলবি না আম্মু?

— চলব তো।

— রাতে বারান্দায় আসবি। বাবা অপেক্ষা করব।

— আরহাম ভাই আসা পর্যন্ত থাকো না বাবা।

— রাতে আবার আসব মা।

তোঁষা ঘাড় নাড়লো। তুহিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো তোঁষা। এদিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আরহাম। দশ মিনিট হবে সে বাসায় ফিরলো। রুমে ঢুকেই দেখলো তোঁষা কথা বলছে। প্রথমে আরহাম না বুঝলেও পরে বুঝলো তুহিনের সাথেই কথা বলছে। আরহাম যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে দশটা মিনিট যাবৎ তা খেয়াল ই হয় নি ওর। তবে কি তোঁষা’র হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? এর প্রখরতা কি কতই বেশি যে দিনদাহারে তোঁষা কল্পনা করছে? আরহাম এসব বিষয়ে যথেষ্ট পটু। তার জানা আছে এর ট্রিটমেন্ট তবে তোঁষা রেসপন্স করে না ওর কথা অনুযায়ী। এটাই হলো সমস্যা।

— বাবা এসেছিলো প্রাণ।

তোঁষা’র কথায় ধ্যান ভাঙলো আরহামে’র। তোতাপাখির ন্যায় তোঁষা বলে গেলো তার বাবা এসেছিলো। কি কি কথা হলো। আরহাম শুনলো সবটা। তবে এখন আর তোঁষা’র ভুল ভাঙাতে চাইলো না। প্রচন্ড মাথা ধরেছে আজ।
.
— তুই কি খাবি না?

— আগে বাবা’র কাছে যেতে দাও।

— রাগাস না আমায় তুঁষ।

— তুঁষ খাবে না। আগে বাবার কাছে যাবে।

এমনিতেই মাথা ধরে আছে আজ। তারমধ্য তোঁষা’র জেদ ধরে খাবার না খাওয়াতে রাগ হলো আজ আরহামের। এতদিক সামাল দিতে দিতে সে হয়রান। তবুও ধৈর্য ধরে তোঁষা’র হাত টেনে ধরে বসাতে নিলেই তা ঝারা দিয়ে ফেলে দিলো তোঁষা। আরহাম এবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

— খেতে বস।

— খাব না।

— বস বলছি।

— না।

তোঁষা’র জেদ এবার কাজে লাগলো না। হাতের প্লেটটা সজোরে টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো আরহাম। তোঁষা’র হাত টেনে ধরে দিলো এক ধমক। এই প্রথম। হ্যাঁ এই প্রথম আরহামে’র ধমকে কেঁপে উঠলো তোঁষা। আরহাম ওর বাহু চেপে ধরে জোরে ধমকে বললো,

— বল খাবি! খাবি বল!

তোঁষা বড় বড় চোখ করে দেখে যাচ্ছে আরহাম’কে। আরহাম তোঁষা’র জবাব না পেয়ে এবার দ্বিগুণ জোরে ধমকে উঠলো,

— বল খাবি!

— ব…বল খাবি। বল খাবি……

ভয়ে ভীতু তোঁষা বুঝ হারা হলো। বারবার এটাই বলে যাচ্ছে । আরহাম আস্তে করে ওর হাতটা ছেড়ে দিলো। তোঁষা’র মানুষিক অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ হচ্ছে তার অনুমান করা যাচ্ছে। আরহাম ঝট করে ওকে বুকে চেপে ধরলো। তোঁষা তখনও বিরবির করছে,

— বল খাবি।

আরহাম বেশ সময় নিয়ে চেষ্টা করলো তোঁষাকে খাওয়াতে। তবে তোঁষা আজ খাবেই না। অগত্যা বারান্দার লক খুলে আরহাম। তোঁষা এদিক ওদিক ওর বাবা’কে খুঁজছে। আরহাম ওকে পাশে বসিয়ে বললো,

— এখন নিয়ে আসি। খাবি।

— বাবা আসবে বলেছিলো।

আরহাম কথা না বলে উঠে গেলো প্লেট আনতে। রুমে ঢুকা মাত্র আরহাম শুনতে পেলো তোঁষা’র গলা,

— প্রাণ!!

ঘুরে তাকানো মাত্র ই দেখলো তোঁষা রেলিং ধরে নীচে তাকিয়ে ডাকছে,

— বাবা বাবা উপরে এসো। বাবা??

— প্রাণ পরে যাবি। তুঁষ। তুঁষ!

আরহাম ডাকতে ডাকতে দ্রুত পায়ে আসতে নিলেই তোঁষা বলতে লাগলো,

— বাবা’র কাছে যাব। বাবা ডাকে আমাকে।

বলেই উঁচু জায়গাটাতে উঠে লাফিয়ে পড়ে বাবা’র কাছে যেতে চাইলো তোঁষা।
মুহুর্তেই ধপ করে একটা শব্দ হলো। এই বাইশ তলার উপরে মুহুর্তেই নিস্তব্ধতায় মুড়ে গেলো। ধপ করে বসে পরলো আরহাম। গলা দিয়ে শুধু বেরুলো একটাই শব্দ,

— তুঁষ।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩২

বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে আরহাম। এই তো গত একমাস ধরে তার শরীর খারাপ করছে। মাত্রারিক্ত দূর্বল মনে হয় নিজেকে। এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলো ও। মেঘলা আকাশটার নিচে তার নিজের জীবনটাকে বড্ড অগোছালো মনে হলো। পরক্ষণেই মনে হয় না। এই অগোছালো জীবন যেটাতে তার তুঁষ আছে সেটাই সুন্দর। একটু হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে প্রোটিন শেইকটা হাতে তুলে ছিপি খুলে গটগট করে কয়েক ঢোক গিললো। ইদানীং শরীরচর্চা করা হচ্ছে না। নিজের যত্ন নিতে ইচ্ছে হয় না। তোঁষাটা কেমন কেমন করে। সারাক্ষণ লেগে লেগে থাকে। এই যে এখনও আরহামে’র বুকে শুয়ে আছে। আজ কিছুতেই ও বিছানায় শুবে না। বিছানা নাকি শক্ত। তাই আরহামে’র বুকে চরে শুয়ে আছে। আরহামের যদিও বুকে এখন ব্যাথা হচ্ছে তবুও সে তোঁষা’কে সরাবে না। থাকুক তার প্রাণ তার বুকে। এই বুক থেকে সরলেই উল্টো আরহামে’র কষ্ট হয়। সেদিনের কথা ভাবতেই আজ ও ওর বুক কেঁপে উঠে ভয়াবহ ভাবে।

ঐ দিন তোঁষা যখন পাগলামি শুরু করলো তখন লাফ দেয়ার আগেই জ্ঞান হারালো তোঁষা। উঁচু জায়গাটা থেকে পরলো কার্ণিশের কোণায়। আরহাম দৌড়ে গিয়ে তোঁষা’কে বুকে জড়িয়ে ধরে। একটুর জন্য। শুধু মাত্র একটুর জন্য তোঁষা বেঁচে গিয়েছিলো। তবে মাথায় আঘাত লেগেছিলো একটু বেশি। ড্রেসিং করে ব্লিডিং থামালেও তোঁষা’র আচরণে ভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিলো সেই সপ্তাহ থেকে। আরহাম বাদে কাউকেই চায় নি তোঁষা। তুহিনের নাম ও মুখে তুলে না।

ও কি চাচ্ছে আরহাম ঠাহর করতে পারছে না। সারাক্ষণ তার আরহামকেই লাগবে। ওকে ঘুম পারিয়ে বাসা থেকে যেতে হয়। ভয় তো আরহাম সেদিন পেলো যেদিন সিসি ক্যামেরায় দেখলো ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে তোঁষা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার মুখে শুধু একটাই ডাক “প্রাণ”। তার প্রাণ’কে ডাকতে ডাকতে সে কেঁদে অস্থির। সব ফেলে ঘন্টায় মধ্যে ছুটে এলো আরহাম। রুমের লক খুলে তোঁষা’কে বুকে জড়িয়ে যখন মাথায় হাত বুলালো তার কত পর গিয়ে থামলো ওর তুঁষ। শাস্তি সরুপ সে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো আরহামে’র বুকে।
ধারালো দাঁতে তোঁষা ইদানীং খুবই বাজে ব্যবহার করছে। আরহামে’র বুকে এখন প্রায়সময় ব্যাথা হচ্ছে। সেদিন কামড়ে যে ধরলো ছাড়তেই চাইলো না। ব্যাথার চোট সামলাতে না পেরে চোখ দিয়ে পানি পরে যখন তোঁষা’র মুখে পরলো তখন গিয়ে ছাড়লো পাঁজিটা। কাচুমাচু মুখে হাসি ফুটিয়ে কি সুন্দর করে বললো,

— চুমু দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

অথচ আরহামে’র অবস্থা বেগতিক হয়ে গিয়েছিলো। বুকে হাজার বরফ ঘঁষেও কাজ হলো না। সেদিন রাতে যখন তোঁষা বুকে ঘুমাতে চাইলো তখন আরহাম ব্যাথায় মুখ খিঁচে যে চোখের পানি ছাড়লো তা কি তোঁষা দেখেছিলো? দেখলে ও কি তোঁষা’র অনুভূতি প্রবণতা জাগ্রত ছিলো? সে কি বুঝে তার প্রাণের কষ্ট?

তোঁষা নড়চড় করতেই আরহাম ধীরে ধীরে তোঁষা’কে বুকে আরেকটু চেপে ধরে কোলে তুললো। এভাবে কতক্ষণ থাকবে? ওকে নিয়ে বিছানায় শুলেও শান্তি মিললো না। তোঁষা আরহাম’কে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ঘুমালো। ব্যাথা লাগলেও আরহাম সরালো না বরং কপালে গাঢ় চুমু খেলো।

____________________

তুষারের সাথে বরাবর বসা আরহাম। বড় ভাই’কে সে যথেষ্ট সমীহ করে তাই তো মাথাটা নীচু করে রাখা আরহামে’র। তুষার আরহামে’র হাতের উপর এক হাত রাখতেই চমকে তাকালো আরহাম। ওর চমকানিতে মৃদু হাসলো তুষার। সেই ভঙ্গি বজায় রেখেই প্রশ্ন করলো,

— তোর মন কি বলে আরু? কাজটা ঠিক করেছিস?

“আরু” এই ডাকটা আজ বহু বছর পর ডাকলো তুষার ওকে। বয়সে তুষার থেকে অনেকটাই ছোট ও। ছোট বেলায় এই তুষার নামক বড় ভাইটার পিঠে চড়ে অনেক ঘুরা হয়েছে। ভালোবেসে ওকে আরু ডাকতো তুষার পরে কি যেন একটা হলো। আরহাম ধীরে ধীরে একদম গুটিয়ে যেতে থাকলো।
এই মুহুর্তে মন চাইলো তুষারের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে রাখতে। মন খুলে দুটো কথা বলতে। একটু কাঁদতে। অভিযোগ জানাতে। কিন্তু কোনটাই সম্ভব হলো না। ঐ যে দূরত্ব। সেটা আজ আরহাম’কে দূর করে রাখলো। গাঢ় কণ্ঠে তুষার আবার জিজ্ঞেস করলো,

— বল?

— না।

— স্বীকার করছিস কাজটা ঠিক হয় নি?

— উপায় ছিলো না ভাই।

— আমি বিয়েটা হতে দিতাম তোর মনে হয়?

— কিছু ঘন্টা আগে আমি তুঁষ’কে তুলে নিয়েছিলাম। একটু দেড়ী হলে বিয়েটা দিয়ে দিতে তোমরা। তখন?

— হতে দিতাম না আমি।

— বাঁধা দিতে তো শুনলাম না।

দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তুষার। কাকে কি বুঝাবে? তবুও আরহামে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— পুতুল’কে কি করেছিস বল তো সত্যি করে।

— কি করেছি?

— ও এমন কেন ছিলো ঐদিন আরু? সত্যি টা বল।

আরহাম মাথাটা সহসা নীচু করে নিলো। তুষার উত্তরের অপেক্ষায়। খুবই নিচু গলায় আরহাম বললো,

— যারা আমাকে আমার প্রাণ থেকে দূর করতে চেয়েছিলো তাদের ভুলাতে চেয়েছি।

— কিহ!!

সহসা ধমকে উঠলো তুষার। আরহাম মাথা তুললো না। উঠে এসে কাঁধ চেপে ধরলো আরহামে’র। আরহাম মাথা তুলতেই তুষার ধমকে উঠলো,

— কি বললি? কি করেছিস? আরহাম!! কথা বল!

— মেমরি লস করার ট্রিটমেন্ট করেছিলাম কিন্তু পুরো সেশন শেষ করতে পারি নি তার আগেই তুঁষের আচরণ অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিলো। সাইড ইফেক্ট কি না বুঝতে পারছি না….

বাকিটা বলার আগেই সজোরে চড় মা’রলো তুষার।আরহাম প্রতিক্রিয়া দেখালো না যেন এটার ই অপেক্ষায় ছিলো। তুষার পরপর এবার দুটো ঘুষি মা’রলো আরহামের গালে। চেয়ার থেকে ছিটকে ফ্লোরে পরলো আরহাম। ওর কলার ধরে টেনে তুলে তুষার নিজের শক্ত হাতের আঘাত করলো আরহাম’কে।
তুষার আঘাত দিতে দিতে হঠাৎ থেমে গেলো যখন আরহাম শব্দ করে কেঁদে উঠলো। হতভম্ব হয়ে গেল তুষার। এভাবে কবে কেঁদেছে আরহাম? আদৌ কখনো কেঁদেছে এভাবে? আরহামে’র ঠোঁটের কোণটা কেটে র*ক্ত গড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে গেলো। সেই মুখে এই সুপুরুষটার কান্না বড্ড বেমানান। কোন পুরুষ মানুষ এই আঘাতে এভাবে কাঁদে? অন্তত আরহামের এই প্রতিক্রিয়া ভাবে নি তুষার।
হাঁটু ভেঙে আরহামে’র কাছে বসে নিজের কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো তুষার। ঠিক এক অসহায় বাচ্চার মতো আরহাম কাঁদলো। কেন কাঁদলো? কিসের জন্য কাঁদলো বুঝলো না তুষার।
আরহামে’র শার্টের বোতাম কয়েকটা ছিড়ে যাওয়াতে তুষার ওর বুকটা খেয়াল করলো। আরহাম’কে বুক থেকে তুলে বাকি বোতামগুলো খুলতেই থমকে গেলো। ভাইয়ের বুক হাত দিয়ে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— আরহাম? এই তোর বুকে এগুলো?

— তুঁষ করেছে ভাই। দেখো।

বলে পুরোটা বুক দেখালো ভাইকে। তুষার কথার খেই হারিয়ে ফেললো। এই ক্ষত বিক্ষত বুকে ও নিজেও মাত্র আঘাত করলো। তবে কি তীব্র থেকেও তীব্র ব্যাথায় কাঁদলো আরহাম?

আরহাম নিজ থেকে পুণরায় ভাইয়ের বুকে এলো। জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে সে। মাঝে শুধু বললো,

— আমাকে অনেক ব্যাথা দিয়েছে ও কিন্তু আমি তবুও ওকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি ভাই। ওকে ছিনিয়ে নিও না।

— নিব না। কিন্তু…

— কি?

তুষার আরহামে’র মাথায় হাত রাখলো। এই চাচাতো ভাইটা ও ওর অনেক প্রিয়। আরহাম অসহায় ভাবে তাকিয়ে ওর দিকে। তুষার আরহামে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমাকে একটাবার জানালে আজ এমন হতো না।

আরহাম মাথাটা নামিয়ে নিয়ে শুধু বললো,

— ওকে যখন আঘাত করতো চাচি তখন কেন থামাতে না ভাই?

— ছিলাম না তখন।

— আমি ওকে শুধু নিজের কাছে রাখতে চাই।

— তুই ওকে মে’রে ফেলবি আরু।

ফট করে চোখ তুলে তাকালো আরহাম। লাল হওয়া চোখে তুষার’কে দেখতে নিলেই তুষার বললো,

— কি মা’রবি আমাকে? চোখ নামা।

আরহাম সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো। তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

— তোঁষা অসুস্থ আরহাম।

চোখ তুলে প্রশ্ন করে আরহাম,

— মানে?

— তুই যখন বিদেশে গেলি এর বছর কয়েক পর তোঁষার আচরণে আমি কিছুটা সন্দেহ পোষণ করি। এক জায়গায় টিকতে পারত না। ফাঁপর লাগতো। ওর নাকি দম বন্ধ হয়ে আসতো। একবার চট্টগ্রামে যখন পাগলামি করলো তখন শিওর হলাম। আদনান ও জানে এ বিষয়ে। পরে আমি ডক্টর দেখালাম ওকে। আমার বন্ধু। রিত্ত’কে চিনিস না? ও ছিলো। কিন্তু সত্যি অন্য কিছু ছিলো আরহাম। জেনেটিক ভাবে শুধু তুই একা না আমাদের বংশে তোঁষার ও কিছু সমস্যা আছে। তুই যেমন সেনসেটিভ তেমনিই তোঁষা। ভালোবাসা কি যেই মেয়ে বুঝতো ও না সেই মেয়ে শুধু তুই তুই করে পাগল হয়ে ছিলো। ওর রাগ, জেদ, হাত তুলা কোনটাই স্বাভাবিক ছিলো না। মাঝখানে ওর পাগলামি অনেক তীব্র হলো একবার। আম্মু বুঝে নি ততটা। ইচ্ছে মতো মে’রেছিলো আমার পুতুলটাকে। জানিস আমার পুতুলটার কপাল ফেটে গিয়েছিলো। এতে তোঁষা বিগড়ে গেলো আরো। আমি রিত্ত’র সাথে বলা বলে ওকে ডক্টর দেখালাম পরে সবটা জানতে পারি।

আরহাম হা করে শুনলো সবটা। ওর মাথা নিমিষেই যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ও তোঁষা’কে তাহলে যেই ট্রিটমেন্ট দিলো সেটা রিএক্ট কি এজন্যই এমন হলো? তোঁষা’র ইন্টারনালি ক্ষতি হলো না তো? তুষার ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— এবার বল তোঁষার মেমোরি লস করার ট্রিটমেন্ট কতটা হার্ম করলো ওকে আরহাম। আমার পুতুলটাকে কি করলি তুই?

আরহাম কথা বললো না। হয়তো বা বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আস্তে করে উঠলো সেখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতে শার্টের বোতাম লাগালো কয়েকটা। বিরবির করতে করতে বললো,

— আমার তুঁষ ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওকে কেন মা’রব? ভালোবাসাকে কেউ মা’রে?

তুষার থামালো না আরহামকে। নিজেও বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।
.
আরহাম একা একাই হাঁটছে রাস্তায়। ওর গাড়ি গ্যারেজে। মনে শুধু একটাই ভাবনা তুঁষটার ক্ষতি হলো কতটা? এজন্য ই কি এমন করে? আরহাম নাকি ওকে মা’রবে। এটা কি সম্ভব? এলোমেলো পায়ে হাঁটছে আরহাম৷ কখন যে মেইন রোডে উঠলো খেয়াল হলো না। হঠাৎ এক গাড়ি এসে ধাক্কা মারতেই রাস্তার মধ্যে ছিটকে পরলো আরহাম। উঠে দাঁড়াতে চাইলেও পারলো না। দূর্বল শরীরটা চোখ বুজে নিলো সেই ব্যাস্ততম রাস্তায়।

তোঁষা’র প্রাণ পরে রইলো অবহেলায় রাস্তার মাঝে। অপর দিকে ঘুম ভাঙলো তোঁষা’র। এদিক ওদিক খুঁজে ও যখন তোঁষা’কে পেলো না তখনই মেয়েটা চিৎকার শুরু করলো অথচ এখন কেউ আে না। আসবে না তাকে থামাতে। আদৌ কি তার প্রাণ আসবে আর কখনো তোঁষা’কে থামাতে?

#চলবে…….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here