যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_১৭ জাওয়াদ জামী জামী

0
277

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী জামী

সারাদিন আরমানের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ালেও রাতে ঘরে আসতে হয় মাশিয়াকে।। আরমান বইয়ের মাঝে ডুবে রয়েছে। ঘরে ঢুকে কোনও উচ্চবাচ্য না করে বিছানায় শুয়ে পরল।

” রাত দশটা বাজে। এখনই ঘুমাবে! এই তুমিই নাকি বাবার বাড়িতে অনেক অব্দি জেগে থাকতে? ”

” শুরু হয়ে গেল মাস্টারি। আমি কখন ঘুমাই কিংবা ঘুমাবো সেই কৈফিয়ত কি এখন আপনাকে দিতে হবে! ”

” আমি শুধু বলতে চাইছি ঘুম না আসলে বই নিয়ে বস। ”

” বই নিয়ে আসিনি। ”

” আমি এনেছি। তুমি ভুলে যেতেই পার, তাই বলে আমার ভুললে চলবে কিভাবে। বিয়ের খুশিতে তুমি দুনিয়াদারি ভুলে থাকতে পার, আমি পারিনা। তোমার সাথে তোতোমার বইগুলোও এই বাড়িতে এসেছে। সুধার কাছ তোমার বই আছে। নিয়ে এস। ”

আরমানের কথা শুনে মাশিয়া ওর দিকে তব্দা খেয়ে তাকিয়ে থাকল। কিছু বলার জন্য ওর কথারা আজ কণ্ঠা থেকে নির্গত হলোনা। ও শুধু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে রইল আরমানের দিকে।

” এভাবে তাকিয়ে আছ কেন! চোখ নামাও। তোমার দৃষ্টির আ’গু’নে ভস্ম হতে আমার দেরি লাগবেনা। ” মাশিয়াকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরমান আবারও কথা বলল।

” আপনি কি সত্যিই মানুষ! নাকি বদ জ্বীন? বিয়ের দিন অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে আপনার মাথায় বইয়ের চিন্তা এসেছে! ”

” তোমার মত ত্যাড়া, বেয়াদব মেয়েকে বিয়ে করতে গেলে নানান চিন্তা করতে হয়, আর সেই সাথে সাহসীও হতে হয়। বদ জ্বীনও যেখানে তোমাকে দেখলে দশ হাত দূরে থাকে, সেখানে আমাকেই তোমার পড়াশোনার ব্যাপারে ভাবতে হবে তাইনা? ”

” আমি পড়বনা। পড়তে ভালো লাগেনা। ”

” সেটা আমি বুঝব। বই নিয়ে এস যাও৷ ”

” না মানে না। আমি পড়বনা। ”

” তাহলে কাল থেকে সংসারের সব কাজ করবে। ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে বাড়ি-ঘর ঝাড়ু দিয়ে রান্নাঘরে যাবে। এরপর একটা সংসারের যা যা কাজ সব করবে। তাহলে পড়তে হবেনা। ”

” আমি কাজ করতে জানিনা। আর জানলেও করবনা। ”

” না জানলে আম্মা শিখিয়ে দেবে। আগামী দশদিন তুমি তার কাছ থেকে সবকিছু শিখে নিবে। এখন ঘুমিয়ে পর। সকাল সকাল উঠতে হবে। কাল থেকে সংসার সামলানোর দ্বায়িত্ব তোমার। ”

আরমানের কথা শেষ হতেই এক ঝটকায় উঠে বসল মাশিয়া। এরপর বিছানা থেকে নেমে দুপদাপ পা ফেলে ঠাস করে দরজা খুলে বাহিরে গেল। ওর সব রাগ দরজার ওর ঝেড়েছে যেটা আরমান বুঝতে পারছে।

” সুধা, জেগে আছ? দরজাটা একটু খুলবে? ”

কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে সুধা মাশিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।

” তোমার ঐ হিটলার ভাই সত্যিই কি তোমার নিজের ভাই? আম্মা’র নিজের ছেলে? ”

” এই কথা জানার জন্য তুমি এসেছ, ভাবি! কাল সকালে জিজ্ঞেস করলেই পারতে? কিংবা ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে। সে উত্তর দিত। ” সুধা বুঝল দু’জনের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। মাশিয়াকে দেখে ওর হাসি পাচ্ছে।

” তোমাকে কি সাধে জিজ্ঞেস করলাম! তাকে জিজ্ঞেস করলে সে সঠিক উত্তর দিত বলে তোমার মনে হয়? তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মা’রা’র সমান। আমার বিশ্বাস হিটলারও তাকে দেখলে লজ্জা পেত। আমার সন্দেহ আছে ঐ হিটলার সত্যিই এই বাড়ির ছেলে কিনা। ” মাশিয়া রাগে গজগজ করছে।

” ভাবি, বিশ্বাস কর ভাইয়া আমার নিজের ভাই। আম্মার নিজের ছেলে। তুমি টেনশন ফ্রি থাকতে পার। ”

” যেদিন থেকে ঐ হিটলারের সাথে দেখা হয়েছে, সেদিন থেকে টেনশন আমার ঘাড়ে জেঁকে বসেছে। আমি ছাড়াতে চাইলে কি হবে টেনশন আমাকে ছাড়তে চায়না। টেনশনের সাথে এখন আমার গভীর মিতালী। আর এসব কিছুর কারিগর তোমার হিটলার ভাই। নিশ্চিন্ত একজন মানুষকে টেনশনের সাগরে হাবুডুবু খাওয়াতে তোমার হিটলার ভাইয়ের জুড়ি নেই। ”

” আমার ভাইয়াকে তুমি যেমনটা ভাবছ, সে কিন্তু তেমনটা মোটেও নয়। আমার ভাইয়ার মত মানুষই হয়না। ”

” হুম, তোমার ভাইয়া ওয়ান পিস। তারমত এক পিস সারাদেশ ঘুরলেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এক মিনিট, আমি এখানে আসা অব্দিই ঐ হিটলারকে নিয়ে কথা বলছি কেন? ঐ হিটলারকে চ্যাপ্টার এখন বাদ। তুমি আমার বইগুলো দাও। ”

” পড়তে বসবে নাকি? বাহ্ আমার ভাবি দেখছি খুব এ্যাক্টিভ! বিয়ের তিনদিন যেতে না যেতেই পড়তে চায়! তুমি এতগুলো বই একা নিতে পারবেনা। চল আমি দিয়ে আসি। ”

” পড়তে কি আর চাই সাধে। সংসারে এত কাজের থেকে আমার জন্য পড়া অনেক সহজ। ” বিরবির করে বলল মাশিয়া৷

সেদিন রাত বারোটা পর্যন্ত মাশিয়াকে পড়ালো আরমান। যদিও মাশিয়া ফাঁকি দেয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে, কিন্তু আরমানের সাথে শেষমেশ পেরে ওঠেনি। বাধ্য হয়ে ওকে পড়তে হয়েছে।

পরদিন ভোরে মাশিয়াকে ঘুম থেকে উঠতে হয়। ও উঠতে না চাইলেও আরমানের ধমকে বাধ্য হয়ে বিছানা ছাড়ে। ফজরের নামাজ আদায় করে সুধা, শশীর সাথে ওকে ও পড়তে বসায় আরমান। কাজের মেয়ে ঠিক করায় আয়েশা খানমের বেশ সুবিধা হয়। তার কাজ শুধু ছেলেমেয়েদের চা-নাস্তা দেয়া। বাকি কাজগুলো কাজের মেয়েই করবে।

সুধা কলেজে গেছে। আরমান কোন একটা কাজে বাহিরে গেছে। বাসায় শুধু আয়েশা খানম, শশী আর মাশিয়া। কাজের মেয়ে থাকায় আয়েশা খানমে কোন কাজই করতে হচ্ছেনা। আরমান ওর মা’কে কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছে। আয়েশা খানম প্রথমে আঁইগুই করলেও ছেলের জেদের কাছে তাকে হার মানতে হয়।

বাহিরে যাওয়ার আগে আরমান মাশিয়াকে ফোন সুইচড অন করতে বলেছে। কিন্তু মাশিয়া ওর কথা না শুনে ফোন লুকিয়ে রেখেছে। এমনভাবে লুকিয়েছে যেন আরমান খুঁজে না পায়। ও পণ করেছে বাবা-মা’র সাথে আর কখনো কথা বলবেনা।

” ভাবি, কি করছ? ” মাশিয়া সুধার কাছ থেকে একটা উপন্যাস এনে পড়ছিল। শশী কোথাও গিয়েছিল তাই একা একা বোর হচ্ছিল। আর সেজন্যই বইটা এনেছে সুধার ঘর থেকে । শশীকে ভেতরে আসতে বলে বই বন্ধ করল ও।

” তুমিও কি ভাইয়ার মত বইপোকা? ”

” কেন হিটলারও বুঝি বই পড়ে? সে বই পড়লে সবার মাথায় ছড়ি ঘোরায় কখন! ”

মাশিয়ার কথা শুনে শশী খিলখিল করে হেসে উঠল।

” আপুর ঘরে যত বই দেখেছ, সবই ভাইয়ার বই। ভাইয়ার প্রায় তিন হাজারের বেশি বই আছে। তুমি আমাদের পশ্চিমের ঘরে যাওনি? সেখানে একটা লাইব্রেরি করে রেখেছে ভাইয়া। চল তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। ”

” বল কি হিটলারের এত বই আছে! এতো দেখছি জ্ঞানী হিটলার! ”

” আমার ভাইয়া মোটেও হিটলার নয়। তার মত ভাই সারা দেশ ঘুরলেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমার ভাইয়া বেস্ট বুঝলে? ”

” বুঝেছি। সে শুধু হিটলার নয়, অসভ্য হিটলার। ”

” ভাইয়ার সামনে একবার কথাটা বলতো। দেখব তোমার সাহস কত। ”

” তার সাথে কথা বলতে সাহস লাগবে নাকি? বাহিরে থেকে আসুক তখন বলব। ” মাশিয়া একগুঁয়ে গলায় বলল।

” থাক বলতে হবেনা। তুমি মেয়ে জন্য ছাড় পাবে। ছেলে হলে দাঁত ফেলে দেবে নির্ঘাত। ” শশী হাসছে।

” এত সাহস ঐ হিটলারের! ” মাশিয়া ব্যাঙ্গ করে বলল।

” তুমি জানোনা ভাইয়ার সাহস কত। আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ছেলে আপাকে বিরক্ত করত। সেটা ভাইয়া জানার পর, তাকে সাবধান করে দেয়। কিন্তু ছেলেটা শোনেনি। আপাকে লাগাতার বিরক্ত করেই যাচ্ছিল। ভাইয়া দুইমাস পর গ্রামে এসে যখন শুনেছে, ছেলেটা এখনও আপাকে বিরক্ত করে, তখন ভাইয়া চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে চেয়ারম্যান, আর উনার স্ত্রী’কে জানায়। তিনদিন পর ভাইয়া ঢাকা চলে যায়। কিন্তু এতেও কাজ হয়না। পরেরবার ভাইয়া ঢাকা থেকে এসে সেই ছেলেকে বাজারের মধ্যে ক্যালানি দিয়েছিল। ক্যালানির চোটে ছেলেটার দুইটা দাঁত ভেঙে গেছিল। এবার বুঝলে ভাইয়া কি? ”

” বলো কি! চেয়ারম্যানের ছেলের দাঁত ফেলে দিয়েছিল! চেয়ারম্যান কিছু বলেনি? হিটলারের কিছুই হয়নি? ” মাশিয়া অবাক হয়ে জানতে চাইল।

” কি হবে! আমার বড় মামা এখানকার এমপি। ছোট চাচা এসপি। খালাতো ভাই এসপি। ভাইয়াকে কিছু বলার সাহস কারও আছে! আর তাছাড়া এলাকায় ভাইয়ার একটা প্রভাব আছে। ”

” সেজন্যই তোমার হিটলার ভাই এমন ভাব দেখায়। চল লাইব্রেরি দেখে আসি। ”

” একটু অপেক্ষা কর, আম্মার কাছ থেকে ঐ ঘরের চাবি নিয়ে আসি। ঐ ঘরে বাহিরের কাউকে ঢুকতে দেয়া নিষেধ আছে। ”

” কে নিষেধ করেছে? ”

” ভাইয়া। বেশ কিছু বই চুরি হওয়ার পর ভাইয়া ঐ ঘরটায় তালা দিয়েছে। ”

মাশিয়া আলমারি ভর্তি বই দেখে হা হয়ে গেছে। কয়েকটা আলমারি ভর্তি গাদা গাদা বই। ওদের ভার্সিটির লাইব্রেরীর থেকে কম বই এখানে নেই।
মাশিয়া আরও অবাক হয়, যখন শুনে গ্রামের প্রাইমারি এবং হাইস্কুলের লাইব্রেরী আরমানের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। এবং লাইব্রেরীতে অধিকাংশ বই আরমান দিয়েছে।

লাইব্রেরী থেকে ওরা বাগানে আসল। বাড়ির পেছনে পুকুর আর পুকুরের পাড় ঘেঁষে থাকা বাগানে হরেকরকমের গাছ। মাশিয়া ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে বাগানের আনাচকানাচে। গাছ ভর্তি সফেদা দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়।

” শশী, এগুলো নিব কিভাবে? ”

” তুমি একটু দাঁড়াও, আমি পাশের বাড়ি থেকে একজনকে ডেকে নিয়ে আসছি। ওকে দিয়েই সফেদাগুলো পেড়ে নেই। ”

চোখের সামনে এতগুলো সফেদা দেখে মাশিয়া ভিষণ খুশি। ছোটবেলা থেকেই সফেদা ওর পছন্দের ফল। সেজন্য প্রতি সিজনেই কল্পনা মোর্তাজা সফেদা কিনতেন। বাসায় সফেদা দেখে যেমন খুশি হত মাশিয়া, আজ তার থেকেও বেশি খুশি হয়েছে। আজকের মত অভিজ্ঞতা অতীতে কখনোই হয়নি ওর।

আয়েশা খানম ছেলের বউয়ের বাচ্চামো দেখে হাসছেন। আরমান বাড়িতে এসে মাশিয়াকে সফেদা খেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মাশিয়াও ওকে দেখে বরাবরের মত মুখ বাঁকালো।

” আম্মা, এই হিটলারকে আমার দিকে তাকাতে নিষেধ করে দিন। এমনভাবে তাকালে আমার পেটে অসুখ করবে। আর আমার পেট খারাপ হলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে এই হিটলার। তাই আগেভাগেই তাকে সাবধান করে দিন। ”

মাশিয়ার কথা শুনে আয়েশা খানম মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন মেয়েটাকে সামলানো কঠিন হবে। আর তাছাড়া তার ছেলেও মনে হয় ছেড়ে কথা বলবেনা।

এদিকে আরমান ওর মা’য়ের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here