#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী জামী
মুর্হুমুহু বজ্রপাতে প্রকম্পিত ধরনী। আয়েশা খানম মাশিয়াকে নিজের সাথে ধরে রেখেছেন। ধরিত্রী কাঁপিয়ে প্রভঞ্জন দামামা বাজিয়ে নিজের অস্তিত্বের প্রমান দিতে তৎপর। সেই সাথে টিনের চালে করকাপাত আঘাত হেনে চলেছে অবিরাম।
আয়েশা খানম আল্লাহকে ডাকছেন। থেকে থেকে কেঁদে উঠছেন তিনি। সুধা, শশী চিন্তিত বদনে ঘরময় পায়চারী করছে। মাশিয়া বুঝতে পারছেনা ওর শ্বাশুড়ি কেন কাঁদছেন।
” আম্মা, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনিও কি ঝড়বৃষ্টিকে ভয় পান? ” মাশিয়া একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।
” না গো, মা। আমি ভয়ে কাঁনতাছিনা। আমি কাঁনতাছি আমার ছেলের কথা ভাইবা। ছেলে আমার এই প্রথমবার ধান চাষ করছে। মাঠের ধানগুলান আর পনের দিন পরই কাটন লাগব। ইমুন ঝড়বৃষ্টি হইলে আধাপাকা ধানগুলান সব শেষ হইয়া যাইব। আমার আরমান পথে বসব গো, মা। ও আল্লাহ তুমি আমার ছেলেরে বাঁচাও। তুমি ঝড়বৃষ্টি থামায় দেও। দুনিয়াডারে শান্ত কর। ও সুধা, তুই আমার মা’য়ের কাছে আইসা বস। আমি আমার ছেলেডার কাছে যাই। আমার ছেলেডার চিন্তায় না কিছু হইয়া যায়। ”
মাশিয়ার চিৎকার শুনে আয়েশা খানম বাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়াতেই শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। মনে হচ্ছে ঝড়ের তাণ্ডবে বুঝি বাড়িটাই ভেঙে পরবে। তখন থেকেই আয়েশা খানম মাশিয়াকে নিয়ে নিজের ঘরে বসে ছিলেন। ঝড়ের তাণ্ডব বাড়তেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। টেনশন সইতে না পেরে তিনি এক সময় কেঁদেই ফেললেন।
ঘরের বাহিরে এসে আয়েশা খানম দেখলেন, আরমান চিন্তিত মুখে বারান্দায় বসে আছে। সে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। তার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে শঙ্কার ছায়া। ঝড়বৃষ্টির দাপটে তার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছাট এসে শরীর ভিজিয়ে দিয়েছে। ভিজে জুবজুবে আরমানের মন থেকে ভয়ডর যেন গায়েব হয়ে গেছে। নয়তো কেউ এই তাণ্ডবের সময় বাহিরে বসে থাকতে পারেনা।
” ও বাপ, তুমি এখানে এম্নে বইসা আছো কেন? ঘরে চল, বাপ। তুমি চিন্তা কইরনা, তোমার ফসলের কোন ক্ষতি হইবনা। আম্মার দোয়া তোমার সাথে আছে। ”
” ও আম্মা, শিলাবৃষ্টিতে যদি সব ধান নষ্ট হয়ে যায়, তবে আমাদের কি হবে! আমার বোনদুটো জীবন শুরুই করতে পারলনা। ওদের পড়াশোনা করাতে হবে, ওদের স্বপ্ন পূরণের সারথি হতে হবে আমাকেই। আজ মনে হচ্ছে, আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ওদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। জব ছেড়ে দিয়ে আমি কি ভুল করলাম, আম্মা? ” আরমান টেনশন সইতে না পেরে বলল। ওর গলা ভারী শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে কান্না চেপে রেখে কথা বলছে।
” তুমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেও নাই, বাপ। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি, আমার বাপে কোন ভুল করবান পারেনা। একটা কথা মনে রাইখো, আল্লাহ তার বান্দার ভালোর জন্যই সবকিছু করেন। আর তোমার আব্বা তোমাদের জন্য যা রাইখা গেছে, সেইগুলান দেইখাশুইনা খাইলেও তোতোমার কুনদিন অভাব হইবনা। তোমার দুই বোনরে লেখাপড়াও শিখাইতে পারবা, এমন ব্যবস্থা তোমার আব্বা কইরা রাইখা গেছে। তুমি এখন ঘরে চল। ভিজা কাপড় বদলায় নেও। ভিজা কাপড়ে এম্নে থাকলে, তুমিও অসুখে পরবা। ” আয়েশা খানম ছেলেকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।
কাপড় পাল্টে আম্মার ঘরে আসল আরমান। মাশিয়া তখনো জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে আছে। ওর দুই পাশে সুধা আর শশী বসে আছে।
মন ভালো না থাকায় মাশিয়াকে এই অবস্থায় দেখেও কিছু বললনা। সটান হয়ে শুয়ে পরল বিছানার এক পাশে। আরমানকে শুতে দেখে সুধা সরে গিয়ে শশীর পাশে বসল। সুধা সরে যেতেই আরমান আরেকটু জায়গা নিয়ে শোয়। ও প্রায় মাশিয়ার পাশ ঘেঁষে শোয়৷ মাশিয়া আরমানকে এভাবে দেখেও কিছুই বললনা।
আধাঘন্টা পর ঝড়বৃষ্টি থামলে আরমান কাজের ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ওর গন্তব্য ধানের ক্ষেত।
দুই ঘন্টা পর আরমান বাড়িতে আসলে আয়েশা খানম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন ছেলের কাছে। মা’কে দেখে আরমান মলিন হাসল।
” আম্মা, যতটুকু ক্ষতির চিন্তা করেছিলাম, তত ক্ষতি হয়নি। এখন শুধু দোয়া কর সামনের পনের দিন যেন কোন দুর্যোগ না হয়। তাহলে আর কোন চিন্তা থাকবেনা। ”
ছেলের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আয়েশা খানম।
রাতে বিছানায় গিয়ে মাশিয়াকে দেখে আরমান ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
” তুমি আজ থেকে সুধার ঘরে থাকবে। ঝড়বৃষ্টি দেখে তোমার যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে আমার ভয় হচ্ছে। রাতে আবার যদি ঝড়বৃষ্টি হয়, তাহলেতো পুরো রাত তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে হবে। যেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে জড়িয়ে ধরা আর কিং কোবরা কিংবা ব্ল্যাক ম্যাম্বাকে জড়িয়ে ধরা একই কথা। ”
” অসভ্য মাস্টার, মুখ সামলে কথা বলুন। বিকেলে চেহারা হয়েছিল আমসত্তের মত। যেই বিপদ উৎরে গেছে অমনি আমার পেছনে লেগেছে। আমি যদি কিং কোবরা কিংবা ব্ল্যাক ম্যাম্বা হই তবে আপনি ছুঁচো। আর ছুঁচো জন্যই সব সময় আমার সাথে ছুঁচোবাজী করেন। ”
” থা’প’ড়ে দাঁত ফেলে দেব, বেয়াদব মেয়ে। আমি অসভ্য হলাম কিভাবে? এতদিন ধরে আমার সাথে এক ঘরে থাকছ, কখনো তোমার সাথে অসভ্যতা করেছি? আর একদিন যদি তোমাকে অসভ্য বলতে শুনেছি, তবে সেদিনই তোমার সব দাঁত মুখের মায়া ত্যাগ করবে। ”
” বেশ করেছি অসভ্য বলেছি। আবারও বলব, একশোবার বলব, হাজারবার বলব। অসভ্য মাস্টার, অসভ্য মাস্টার, অসভ্য মাস্টার। একবার থা’প্প’ড় মে’রে দেখুন আম্মার কাছে আপনার নামে বিচার দেব। আমাকে বলে কিং কোবরা, ব্ল্যাক ম্যাম্বা! ছুঁচো একটা। কথায় কথায় থা’প্প’ড় দেয়ার ভয় দেখায়! আমাকে অবলা নারী পেয়ে যা খুশি তাই করতে চায়। ” মাশিয়া প্রচন্ড রেগে গেছে।
” কি বললে, তুমি অবলা! তুমি যদি অবলা হও, তবে আজ থেকে অবলার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে যাবে। তুমিও অবলা আর কিং কোবরাও নির্বিষ! ”
মাশিয়া পদে পদে আরমানের কাছে হেনস্তা হচ্ছে ও সেটা বেশ বুঝতে পারছে। আরমানকে কিছুতেই শায়েস্তা না করার আফসোস ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এবারেও ও তেমনি আরমানের কাছে চরম হেনস্তা হয়ে শাস্তির খাতায় আরমানের নাম আরেকবার টুকে রাখল। যে খাতার হদিস ও ছাড়া কেউ জানেনা, আর জানতেও পারবেনা। যে খাতাটি সংরক্ষিত আছে ওর স্মৃতির গোপন কুঠুরিতে।
আকাশে এখনও মেঘের ঘনঘটা। যখনতখন দুনিয়া ভাসিয়ে আবারও বৃষ্টি নামবে। বিকেল ভর বৃষ্টি হওয়ায় শীতল আবহাওয়া বিরাজমান। মাশিয়া একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। তবে ওর মন-মস্তিস্ক আরমানকে গালি দিচ্ছে অবিরাম। আরমানকে গালি দিতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মাশিয়া। হঠাৎই ধরনী কাঁপিয়ে মেঘের গর্জন শোনা যায়। এমন আগ্রাসী গর্জনে মাশিয়া চমকে গিয়ে আরমানকে জড়িয়ে ধরল। আরমান মাশিয়ার পেছন ফিরে শুয়ে আছে। আচমকাই মাশিয়া ওকে জড়িয়ে ধরায় ও চমকে গেছে। ফলশ্রুতিতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল।
” এই তুমি আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরছ কেন? ফাজিল মেয়ে, দিন দিন নির্লজ্জের খাতায়ও নাম লিখাচ্ছ দেখছি! ছাড় আমাকে। তিন হাত দূরে গিয়ে শোও। ” আরমান মাশিয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
” এভাবেই থাকতে দিন, প্লিজ। আমার ভয় করছে। ” মাশিয়া কাঁপতে কাঁপতে বলল।
” তোমার যেখানে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে সেদিন রাতে আমাকে সাবধান করে দিলে! নাটক বাদ দিয়ে দূরে গিয়ে শোও। ”
” এমন ভাব করছেন যেন আমি আপনাকে রে’প করতে চাচ্ছি! নেহাৎই মেঘের গর্জনে ভয় পাই, তাই আপনার মত ফাজিল মাস্টারকে চিপকে আছি। কান খুলে শুনে রাখুন, রে’প করা মেয়েদের কাজ নয়। তাই নির্ভয়ে জড়িয়ে ধরতে দিন । ” মাশিয়ার কথা শুনে আরমান তব্দা খেয়ে গেছে।
” বেয়াদব মেয়ে এসব বলছে কি! এখানে রে’প করার কথা আসছে কোথায় থেকে! তুমি কি জানো, তোমার মন-মস্তিস্ক নষ্ট হয়ে গেছে? সন্দেহ তো আমার হচ্ছে তোমার ওপর। ”
” আমার মন-মস্তিস্ক নষ্ট হয়েছে তো কি হয়েছে, আপনারটা ঠিক থাকলেই হবে। আর তাছাড়া আমি ভালো করেই জানি, আর যাই করুন না কেন, কাউকে রে’প করার ক্ষমতা বা সাহস আপনার নেই। নয়তো কবেই আমি রে’প হতাম। শুধু থা’প্প’ড় মা’রা’তে’ই আপনার বিরত্ব, অন্য কিছুতে নয়। আমি আর যাই করিনা কেন কাউকে রে’প করার ক্ষমতা রাখিনা। সেই ক্ষমতা থাকলে আপনি এতদিন ভার্জিন থাকতেননা। অবশ্য আপনি ভার্জিন কিনা সেটা আমি জানিওনা। ”
মাশিয়ার কথা শুনে আরমানের শরীর অবশ হয়ে আসছে। মেঘের গর্জনে মাটির দোতলা ঘর থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে। দক্ষিণের জানালা খোলা থাকায় হুহু করে শীতল মলয় আছড়ে পড়ছে ঘরের অভ্যন্তরে। বাতাসে এলোমেলো হয়ে যায় মাশিয়ার দীঘল কালো কেশরাশি। মলয়ের দাপটে তারাও মাতাল হয়ে ছুটোছুটি করছে। নিজের চোখেমুখে চুলের স্পর্শ পেতেই আরমান চোখ বন্ধ করল। ঠিক তখনই মাশিয়া নড়ে উঠল। আরমানের নাক দেবে গেছে চুলের ভেতর। একটা মিষ্টি গন্ধ দখল করে নিয়েছে আরমানের সত্তা। কারও চুলের ঘ্রানও যে এত অদ্ভুত হতে পারে তা জানা ছিলনা আরমানের। অজান্তেই ওর হাত মাশিয়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরেছে।
অম্বরে ঘনঘন বিজলির চমকে থেকে থেকেই ঘর আলোকিত হচ্ছে। অম্বরে যেন আলোকবাজির প্রদশর্ন চলছে। দূরে কোথাও বজ্রপাত হলো। ধরনীর সাথে সাথে কেঁপে উঠল মাশিয়া। আরমান ওকে আগলে নেয় বুকের ভেতর। মাশিয়া নিশ্চিন্তে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে আরমানের ওপর।
চলবে..