যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_২৮ জাওয়াদ জামী জামী

0
307

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী জামী

মাশিয়ার থমথমে মুখ দেখে আয়েশা খানম ঘাবড়ে গেলেন। তিনি সুধাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে মাশিয়ার কি হয়েছে জানতে চাইলে সুধা যতটুকু বুঝতে পেরেছে ততটুকুই বলল। সব শুনে আয়েশা খানম হাসলেন। তিনি মাশিয়াকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেননা।

বিকেলে আরমান বাড়িতে আসল। ওর হাতে কয়েকটা প্যাকেট। বাড়িতে ঢুকেই ও সুধার হাতে প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দেয়।

” এখানে ফুচকা, চটপটি আর বার্গার আছে। চটপটি আর ফুচকার প্যাকেট দুইটা করে আছে। দুইটাতে তোর আর শশীর জন্য ঝাল বেশি দেয়া আছে। আর বাকি দুইটায় মাশিয়ার জন্য আছে। ওর গুলোয় ঝাল কম দিয়ে এনেছি। ”

আরমান প্যাকেটগুলো সুধার কাছে দিয়ে ঘরের দিকে যায়।

মাশিয়া চুপচাপ শুয়ে আছে। ওর কিছুই ভালো লাগছেনা। মাঝে মাঝে সবকিছু ফাঁকা লাগে। দুনিয়ার সবকিছুই বিস্বাদ মনে হয়। কিন্তু কেন এমন হয় সেটা মাশিয়া বুঝতে পারেনা। বুঝতে অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভ হয়নি। কোন এক গোলকধাঁধায় ঘুরে ফিরে বারবার একই জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে ওর চিন্তাভাবনাগুলো। কেন ওর সবকিছু ফাঁকা লাগে? কোন এক অনিশ্চয়তার দোলাচালে হিয়া সর্বদাই উচাটন থাকে? এমনও নয় যে ও আরমানকে ভালোবাসে, তবু কেন আরমানের সামান্য অবহেলায়ও ওর অন্তর দ্বিখণ্ডিত হয় হরহামেশাই? কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনের কোনে উঁকি দেয়, আরমান কিংবা ও, ওরা কেউ কাউকেই এক বিন্দুও ভালোবাসেনা। যেখানে ভালোবাসা থাকেনা সেখানে অবহেলার সামান্য স্থানটুকুও থাকেনা। তবে কেন আরমানের তরে ওর হিয়া বারেবার ভ’স্মী’ভূ’ত হয়? কেন বিরহের অনলে অঙ্গার হয় ওর অন্তর-বাহিরের সর্বসত্তা? নানান চিন্তার মাঝে যে আরমান ঘরে এসেছে সেটা লক্ষ্যই করলনা। আরমানও একবার মাশিয়ার দিকে তাকায়। কিন্তু ওকে অন্যমনস্ক দেখে কিছু না বলে গামছা৷, ট্রাউজার আর টি শার্ট নিয়ে বাহিরে চলে যায়।

কলপাড়ের সামনে যেতেই আয়েশা খানমের মুখোমুখি হয় আরমান।

” এতক্ষন কই আছিলা, বাপ? বউমা, সুধা ওরা আরও তিনঘণ্টা আগে বাড়িতে আইছে। তোমার এত দেরি হইল কেন? ” আজ আয়েশা খানম তার ছেলের ওপর ভিষণ বিরক্ত।

” আমার এক বন্ধুর সাথে ওর বাসায় গিয়েছিলাম, আম্মা। অনেকদির পর ওর সাথে দেখা হলো। সুধা কিছু বলেনি তোমাকে? ” আরমান একটু অবাকই হয়েছে।

” বউমা তোমার সাথে আছিল, তারপরও তুমি কেন তোমার বন্ধুর সাথে গেলে? বউমা কষ্ট পাইতে পারে এইডা তোমার একবারও মনে হয়নি? ” আয়েশা খানম একটু ধমকের স্বরেই বললেন। তিনি আজ আরমানকে কিছু কড়া কথা শোনাতে চাইছেন।

” মাশিয়া কষ্ট পাবে কেন! আমিতো ওর কষ্ট পাওয়ার মত কিছুই করিনি, আম্মা। অনেকদিন পর স্নিগ্ধার সাথে দেখা হলো, একটা সময় ক্যাম্পাসে আমরা অধিকাংশ সময় কাটিয়েছি। অনেক স্মৃতি আছে বন্ধুমহল ঘিরে। ও চাইছিল আরও কিছুক্ষণ আমরা একসাথে কাটাই। ” আরমান বুঝতে পারল আম্মা ওর ওপর রেগে গেছেন। তাই একটু সাফাই দিতে চাইল।

” তোমার কি বউমাকে সাথে নেয়ার কথা মাথায় আছিলনা? ” এবার আয়েশা খানম সত্যিই রেগে গেলেন। তিনি একটু জোড়েই কথাটা বললেন।

” ও কি আমার সাথে কোথাও যেত বলে তোমার মনে হয়, আম্মা? আমাদের সম্পর্ক যদি আর পাঁচটা সম্পর্কের মত স্বাভাবিক হত, তবে ওকে রেখে কোথাও যাওয়ার কথা আমি কখনোই স্বপ্নেও ভাবতামনা। ” আম্মাকে রাগতে দেখে আরমান নিচু গলায় বলল। ও কখনোই আম্মাকে এভাবে রাগতে দেখেনি। ওর ওপর তো নয়ই।

” এতদিন হইছে, তবুও কেন তোমরা স্বাভাবিক সম্পর্কে জাড়াইতে পারোনাই? তোমার দিক থাইকা তুমি কুন চেষ্টা করছিলা? ” আয়েশা খানম নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন।

” আমি এখনও সুস্থ আছি, আম্মা। তাই ঐ আগ্নেয়গিরির আশেপাশে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারিনা। তুমি কি ভেবেছ, আমি সবকিছু স্বাভাবিক করতে চাইলেও মাশিয়া সেটা হতে দেবে? যে মেয়ে আমার সাথে নরম গলায় দুইটা কথা বলতে পারেনা, সেই মেয়ে আমার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কে জড়াতে পারে এটা ভাবলেই আমি চোখে অন্ধকার দেখি। আমিতো ওকে সময় দিচ্ছি। সব সময় চাই সময়ের সাথে সাথে ও একটু একটু করে বদলে যাক। স্বাভাবিকভাবে নিক আমাদের সম্পর্ক। ” আম্মাকে স্বাভাবিক হতে দেখে আরমান হাঁফ ছাড়ল।

” মানুষ এম্নেই বদলায়? তুমি যদি অপরপক্ষকে বদলাইতে সাহায্য না কর, তবে বদল হইবো কেমনে? ” আয়েশা খানমের মুখের পেশি টানটান হয়ে গেছে।

” সাহায্য করছিনা, আম্মা! এই যে তুমি ওকে মেয়ের মত দেখ, সুধা আর শশী ওকে আপন বোনের মতই ভালোবাসে, ওর প্রয়োজনমত সবকিছু পাচ্ছে, সর্বোপরি এই বাড়িতে ও মেয়ের মতই ট্রিট পাচ্ছে এটা কি সাহায্য করা নয় বলতে চাইছ? ” আরমান মিনমিন করে বলল।

” আর স্বামীর ভালোবাসা? তুমি যেগুলা কইলা সেইগুলা কি কারন বদলের কারন হইতে পারে বইলা তোমার মনে হয়? আমার কিন্তু সেইডা মনে হয়না। ” আয়েশা খানম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন চেষ্টাই করলেননা। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন।

” একটা মানুষকে বদলে দিতে শুধু ভালোবাসাই যথেষ্ট। আর সেই ভালোবাসা মাশিয়ার কমতি নেই। একজন মানুষ যখন কোন সংসারে তার প্রয়োজন মত সবকিছু পেয়ে যায় কিন্তু ভালোবাসা পায়না। সে কিভাবে বদলাবে বলতে পার? ভালোবাসাহীনতার মত কঠিন অসুখ দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই, আম্মা। কিন্তু শত অনটনের মাঝেও যদি একটা সংসারে পরিপূর্ণ ভালোবাসা থাকে, ভালোবাসাই সেখানের সবকিছু বদলে দেয় । মাশিয়া এখানে আসা অব্দি ভালোবাসার ভালোবাসার ঘাটতি ছিলনা ওর জন্য। আর রইল স্বামীর ভালোবাসা। একটা মেয়ের জীবনে যেটা সবথেকে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু মাশিয়া আর আমার মধ্যে ভালোবাসা হওয়াটা কি খুব সহজ ব্যাপার? যেখানে আমিই ওর কাছে ঘৃণার পাত্র। দুনিয়ায় ও যদি কাউকে ঘৃণা করে সেটা আমি। সেই আমাকে ভালোবাসতে ওর সময় লাগবে, আম্মা। আর সেই সময়ই ওকে আমি দিচ্ছি। ” আরমান সত্যি কথাগুলোই বলল।

” সবই বুঝলাম। তুমি আমগোর আর বউমার ভালোবাসার কতা কইলা, নিজের কতা একবারও কইলানা যে? ” আয়েশা খানম চোখের তারায় প্রশ্নেরা ছুটোছুটি করছে।

আয়েশা খানমের কথা শুনে আরমান তার দিকে মলিন হয়ে তাকায়।

” মাশিয়া আমাকে চরম ঘৃণা করলেও, ওর জন্য আমার মনে কোনও ঘৃণা নেই। আমি ওকে প্রথমদিনই একটা বেয়াদব মেয়ে হিসেবে অবলোকন করেছি। একটা মানুষের বেয়াদব হতে যা যা গুণ থাকতে হয়, তার সবই মাশিয়ার মধ্যে ছিল। হয়তো এখন সে একটু একটু করে নিজেকে পরিবর্তন করছে। এই পরিবর্তনই একটা সময় ওকে অন্য মানুষে পরিণত করবে। এখন তুমি যদি বলো আমি ওকে ভালোবাসি কিনা? তবে তার উত্তর হবে, আমি চেষ্টা করছি। ”

” আচ্ছা, তুমি গোসল কইরা আসো। আমি খবার দিতাছি। ” আয়েশা খানম হেসে বললেন। তিনি তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।

” আমি খেয়ে এসেছি, আম্মা। স্নিগ্ধার হাজবেন্ড না খেয়ে আসতেই দিলনা। ” আরমান আঁড়চোখে আয়েশা খানমের দিকে তাকিয়ে বলল।

” বউমা মন খারাপ কইরা শুইয়া আছে। তার মন ভালো করার দ্বায়িত্ব কেডা নিব? ” আয়েশা খানম কপাল কুঁচকে জানতে চাইলেন।

” আর কে! আমাকেই নিতে হবে। ” আরমান আর কিছু না বলে কলপাড়ে যায়।

সুধা প্যাকেট থেকে খাবারগুলো বের করেছে। ও মাশিয়ার খাবারগুলো আলাদা বাটিতে রেখেছে। আয়েশা খানম সেগুলো নিয়ে মাশিয়ার কাছে গেলেন।

” বউমা, এইগুলান খাইয়া নেও তো। তোমার জন্য আমার পোলায় নিয়া আসছে। ” মাশিয়াকে শুয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলেন আয়েশা খানম। খাবারের ট্রে এখনও তার হাতে।

” খাবারগুলো আপনার ছেলেকেই গিলতে বলেন, আম্মা। সে বেশি করে গিলুক তার আনা খাবার। ” মাশিয়া খেঁকিয়ে উঠল।

” হেয় তোমার জন্য ঝাল কম দিয়া চটপটি, ফুচকা আনছে। সুধা আর শশী দুই’জনেই ঝাল বেশি খায়, তাই তোমার জন্য আলাদা প্যাকেটে নিয়া আসছে। ” আয়েশা খানম মাশিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।

” এগুলো ঐ অসভ্য মাস্টারকেই খেতে বলেন। তার তো এমনিতেই মাশাআল্লাহ অনেক ঝাল। ঝাল ছাড়া চটপটি, ফুচকা খেয়ে যদি সে এবার নির্ঝাল হয়। ” মাশিয়া ভুল করেও আয়েশা খানমের দিকে তাকায়না।

” মা গো, আমার পোলায় তোমার জন্য ভালোবাইসা খাবারগুলান নিয়া আসছে। তুমি না খাইলে ওর মন খারাপ হইব। উইঠ্যা খাইয়া নেও, মা। ”

” আমি এসব না খেলেও চলবে, আম্মা। আপনার ছেলের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, বান্ধবীমহল আছে তার কেনা খাবার খাওয়ার জন্য। যেসব বান্ধবী ছাড়া সে অচল। ” মাশিয়া রাগে গজগজ করতে করতে বলল।

এতক্ষণ আরমান দরজায় দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিল। এবার ও ভেতরে আসল।

” আম্মা, চারপাশে পো’ড়া গন্ধ ভাসছে খেয়াল করেছ? কি পু’ড়’ছে বলতো? কিছু একটা পু’ড়’ছে কিন্তু দুই-একজন ছাড়া সেটা কেউ বুঝতেও পারছেনা! ” আরমান মিটিমিটি হাসছে।

” আম্মাআআ, এই অসভ্য মাস্টারকে থামতে বলুন। নয়তো ওর মাথা ফাটিয়ে ওকে জাহান্নামে পাঠাবো বলে দিলাম। ”

” ওর কতায় কান দিওনা, মা। তুমি এইগুলা খাইয়া নেও। ”

” আপনি এগুলো বারান্দায় নিয়ে যান, আমি আসছি। ”

আয়েশা খানম সবকিছু নিয়ে আবারও বাহিরে চলে গেলেন।

আরমান ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। মাশিয়া ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। ও আরমানের চেহারায় কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে।

” জানোনা সুদর্শন পুরুষদের এভাবে দেখতে নেই? শেষে কখন প্রেমে পরে যাবে বুঝতেও পারবেনা। আর একবার প্রেমে পরলে আজীবন ভালোবাসার অথৈজলে হাবুডুবু খাবে। এর থেকে নিস্তার নেই কভু। ” মাশিয়াকে তাকাতে দেখে আরমান খোঁচা দেয়ার লোভ সামলাতে পারলনা।

” এ্যাহ্ আসছে আমার সুদর্শন পুরুষ! আবার নাকি তার প্রেমেও পরব! আমিতো অভিসারের পর চেহারায় কোন চিহ্ন থেকে গেছে নাকি সেটাই খুঁজছিলাম। তার প্রেমে পরব আমি! তার প্রেমে পড়ার থেকে দশ তলা বিল্ডিং থেকে ঝাঁপিয়ে পড়াও সহজ। সে নিজেকে টম ক্রুজ মনে করলেও, আসলে সে যে জায়েদ খান এটা যদি জানত। ” মাশিয়া মুখ কালো করে বলল।

মাশিয়ার কথাগুলো বুঝতে আরমানের একটু সময় লাগলো। আর যখনই ও বুঝতে পারল, তখনই রাগে ওর মাথায় র’ক্ত উঠে গেলো৷

” কি বললে ! আমি অভিসারে গিয়েছিলাম! কি চিহ্ন খুঁজছো তুমি? আমার শরীর তো ঢেকে রেখেছি। শরীর ঢেকে রাখলে তুমি চিহ্নগুলো খুঁজে পাবে কিভাবে? টি-শার্ট, ট্রাউজার খুলে দাঁড়াই, তুমি ভালো করে খুঁজে দেখ? নাকি আমার উদোম শরীর দেখার বাহানা খুঁজছ তুমি? আমাকে বললেই নাঙ্গা শরীরের তোমার সামনে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম। তাহলে অন্তত মিথ্যা সন্দেহ তোমার মনে বাসা বাঁধতনা। ফাজিল মেয়ে একটা। ” রাগে আরমানের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।

” তার উদোম শরীর দেখার ঠ্যাকা পরেছে যেন আমার। কাপড় পরা অবস্থায় তাকে যেমন বিশ্রী দেখায়, উদোম শরীরে না আরও কত বিশ্রী দেখাবে! ছ্যাহ্ ছ্যাহ্। তাকে ফ্রেশ অবস্থায় দেখলেও আমার মাথা ঘুরায়। তাকে নাঙ্গা অবস্থায় দেখলে আমি মনে হয় অজ্ঞানই হয়ে যাব। কি লজ্জা, কি লজ্জা। লজ্জাহীন পুরুষের লজ্জা নেই বলে আমারও কি লজ্জা নেই! ” মাশিয়া হাসি আটকে রাখতে পারছেনা অনেক চেষ্টা করেও। অবশেষে ও হো হো করে হেসেই ফেলল।

মাশিয়ার এরূপ সরল স্বীকারোক্তিতে আরমান বেশ অপ্রভিত হয়। ও ফ্যালফেলিয়ে মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। ও এখন বুঝতে পারছে, রাগে একটু আগেই কি বিশ্রী কথা বলে ফেলেছে। এবার রাগের বদলে লজ্জায় ওর শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here