যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_৩৭ জাওয়াদ জামী জামী

0
320

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী জামী

” দোস্ত, একটা কথা বলি কিছু মনে করবিনা বল? ” ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে এসে বসেছে চার বন্ধু। নানান গল্পের মধ্যে হঠাৎ করেই তৃষা কিছু একটা বলার অনুমতি চাইল মাশিয়ার কাছে। মেয়েটা এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল ওদের আশেপাশে ভীড় কতটা।

” কি বলবি বল? এত অনুমতি নেয়ার কি আছে? ”

” দোস্ত, আমরা তোর ভালো চাই। তাই তোকে এমন মনমরা দেখতে ভালো লাগেনা। তুই কি লক্ষ্য করেছিস, গত দুইমাসে তোর কত পরিবর্তন হয়েছে? তুই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিস। আগেরমত হাসিসনা। আমাদের সাথে আড্ডা দিসনা আগেরমত। আমরা বুঝতে পারি তুই স্যারকে মিস করিস। স্যারের অনুপস্থিতি তোকে বদলে দিয়েছে। তুই বদলে গেছিস। ওপরে ওপরে যতই দেখাস তুই স্যারকে চাসনা। কিন্তু ভেতরে ঠিক উল্টো। তুই হয়তো নিজেও জানিসনা, তুই স্যারকে কতটা ভালোবাসিস। মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখিসনা, দোস্ত। ফিরে যা স্যারের কাছে। ” তৃষা কথাগুলো বলছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ও পাচ্ছে। যদি মাশিয়া রেগে যায়!

তৃষার কথায় মাশিয়া চুপচাপ বসে থাকল। যেন কিছু একটা ভাবছে। অনেকক্ষন পর ও মুখ খুলল,

” তোর ধারনা ভুল। আমি কাউকে ভালোবাসিনা। আর ঐ অসভ্য মাস্টারকে তো নয়ই। তার জন্য আমি অনেক অপমানিত হয়েছি। দিনের পর দিন সে আমাকে দিয়ে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করিয়ে নিয়েছে। তার জন্যই আমাকে এক বছরের বেশি সময় ঐ অজপাড়াগাঁয়ে কাটাতে হয়েছে। যে আমার দুর্দশার জন্য দায়ী, তাকে আমি কিভাবে ভালোবাসতে পারি! ” মাশিয়া কথাগুলো মুখে বললো ঠিকই কিন্তু ওর চোখ অন্য কিছু বলছে।

” বেইব, তুমি স্যারের সাথে গ্রামে গিয়ে ভুল কিছুই করোনি। সেখানে স্যারের সাথে থেকেছ জন্যই স্যার তোমাকে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। তার ফলশ্রুতিতেই তোমার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। হয়তো স্যার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তোমাকে জোর করেছে। কিন্তু আখেরে তোমার ভালোই হয়েছে। তুমি কত পাল্টে গেছ, সেই ধারনা তোমার আছে? তুমি আর আগের মত ভার্সিটিতে র্যাগ দিচ্ছনা, ছোট-বড় সকলের সঙ্গে ভালো ব্যাবহার করছ। আগের থেকে অনেক শান্ত হয়েছ, বুঝদার হয়েছ। পড়াশোনায় মনযোগী হয়েছ। এসবকিছু সম্ভব হয়েছে শুধু স্যারের জন্যই। ” মিতুলও মাশিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

” ওরা ঠিক বলেছে, দোস্ত। আগের মাশিয়ার সাথে এখনকার মাশিয়ার আকাশপাতাল তফাৎ। তুই যে স্যারকে ভালোবাসিস, এটা স্বীকার করছিনা ঠিকই কিন্তু বিষয়টা মিথ্যা নয়। তুই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে দেখিস। দেখবি সে-ও একটাই উত্তর দেবে। তুই তাকে ভালোবাসিস। তোর মনে রাগ আর জিদের প্রলেপ পরেছে। তাই তোর ভালোবাসা এখনো দেখতে পাচ্ছিসনা। একবার তোর মন থেকে রাগ, জিদ সব একপাশে সরিয়ে রেখে দেখ। দেখবি সেখানে শুধু স্যারই আছে। ” জয়ও আজ চুপ করে থাকলনা।

” জয় ঠিক বলেছে, মাশিয়া। যে তুই এসি ছাড়া থাকতে পারতিসনা এক মুহূর্তের জন্যও, কিন্তু সেই তুই গত দুইমাস যাবৎ এসি ছাড়া থাকছিস, যে তুই মাছের কাঁটার ভয়ে মাছ খেতিসনা, সেই তুই দিব্যি মাছের কাঁটা বেছে ভাত খাস, যে তুই দামী দামী পোশাকে অভ্যস্ত ছিলি কিন্তু এখন সেই তুই-ই সাধারন শাড়িতেই দিন পার করছিস। জিনস-টপস না পরতে চাইলে সালোয়ার-স্যুট পরতিস কিন্তু তুই সেসব না পরে শাড়ী পরছিস। কেন? আগে যেখানে তুই শাড়ীর নাম শুনতে পারিসনি। নিশ্চয়ই স্যার শাড়ী পছন্দ করেন। আর সেজন্যই তুই শাড়ী পরতে শুরু করেছিস। ”
তৃষা সবদিক দিয়েই মাশিয়াকে চেপে ধরল।

বন্ধুদের এহেন যুক্তিতে দিশেহারা মাশিয়া কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না। ওদের অকাট্য যুক্তির বিপক্ষে কোন শক্ত অযুহাত ওর নেই। তাই মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণের বৃথা চেষ্টা করল। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

” আমি তো বললাম, তাকে আমি ভালোবাসিনা। তবুও তোরা কেন নাছোড়বান্দার ন্যায় আমার পেছনে পরে আছিস? আমি ঐ অসভ্য মাস্টারকে ভালোবাসতেই পারিনা। আমি তাকে ভালোবাসিনা। ” একছুটে মাশিয়া ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়। ও কাঁদছে। গাড়ির কাছে যাওয়ার আগেই কারও সাথে ধাক্কা খেয়ে ওকে থামতে হলো। ঝাপসা চোখে ও দেখল সামনে রিশাদ দাঁড়িয়ে আছে।

” কুল বেইবি, কুল। এত ছুটোছুটি করছ কেন? অবশ্য তোমাকে ছুটোছুটি করলেই বেশি হ’ট লাগে। চলোনা বেইবি, আজ আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি। ”

” সাট আপ, ইউ ফুল। তোমাকে সেদিন বলেছিনা, আমার সামনে না আসতে? তবুও সেইমলেসের মত আমার সামনে এসেছ! পথ ছাড়, আমাকে যেতে দাও। তোমাকে দেখেই আমার রাগ হচ্ছে। ” মাশিয়া রিশাদকে পাশ কাটিয়ে যেতেই রিশাদ ওর হাত ধরে ফেলল।

” এত অহংকার কেন করছ? তুমি কি মনে কর আমার থেকে দূরে থাকতে চাইলেই তুমি সেটা করতে পারবে? হাজার চেষ্টা করলেও দূরে যেতে পারবেনা তুমি। আমার কাছেই তোমাকে আসতে হবে। আমার কতদিনের স্বপ্ন তোমাকে বিছানায় নিব। সেই স্বপ্ন পূরণ না করেই তোমাকে ছেড়ে দেব ভাবছ! এতদিন তোমাকে চোখে চোখে রেখেছি দূরে যাব বলে? ”

রিশাদের কথা শুনে রাগে, ঘৃণায় মাশিয়ার শরীর রি রি করছে। ওর ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে, এই ছেলেটাকে সে নিজের বন্ধু মনে করত! মাশিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে আসল তৃষা, মিতুল, জয়।

” কি ব্যাপার রিশাদ, তুমি মাশিয়ার হাত ধরে রেখেছ কেন? অন্য কারও স্ত্রী ‘ র হাত ধরতে তোমার লজ্জা করছেনা? পারলে কোন মেয়েকে পটিয়ে তার হাত ধর। ” জয় এগিয়ে গিয়ে রিশাদের থেকে মাশিয়ার হাত ছাড়িয়ে নেয়।

” কি রে মেয়েদের চ্যালা, খুব বেড়েছিস দেখছি? তিনজন মেয়ের মাঝে থেকে নিজেকে মেয়ে মেয়ে মনে হয়না তোর? সামলাতে পারিসতো তিনজনকে? ” রিশাদ জয়কে রাগিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু জয় ওর ফাঁদে পা দিলনা। ও শান্ত গলায় বলল,

” সবাইতো তোমার মত নয়। মেয়েদের সম্মান করতে জানি আর সেই সাথে নিজের ওপর যথেষ্ট কন্ট্রোলও আছে৷ আমার কথা চিন্তা না করে নিজেরটা ভাব। ভবিষ্যতে মাশিয়ার আশেপাশে তোমাকে দেখলে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব। ”

” বাব্বাহ্, আমার বেইবির জন্য তোর চিন্তা আমাকে ভাবাচ্ছে। একসাথে দু’জনকেই পেতে চাইছিস নাকি? মিতুল কি তোর ইচ্ছে পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? তাই আবার আমার বেইবির দিকে নজর দিচ্ছিস? ব্যাড ভেরি ব্যাড। আমি.. ”

রিশাদ পরের বাক্য শেষ করতে পারলনা। মিতুল এগিয়ে এসে ওকে কষিয়ে থাপ্পড় মেরেছে। তৃষাও রিশাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

” ইউ সান অব বিচ। তোর এত সাহস হয় কি করে আমাদের নামে বাজে কথা বলার? জুতিয়ে তোর মুখের মানচিত্র পাল্টে দেব হা’রা’মি। এতদিন মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে তোকে কিছু বলিনি। কিন্তু আজ তুই মাশিয়ার সাথে খারাপ আচরণ করেছিস। তুই কি মনে করেছিস, তোকে জুতোপেটা করতে পারবনা? তোর মত নর্দমার কীটকে জুতোপেটা করলে আমার কিচ্ছু হবেনা। তোর বাপের হাত এত লম্বা নয়। আমার টিকিটি ছুঁতে পারবিনা তুই। ” তৃষা রাগে গজগজ করছে।

” তোকে যদি আর একদিন ভার্সিটি চত্বরে দেখেছি, তবে সেদিন তোর মুখে একটাও দাঁত থাকবেনা। যা কু’ত্তা বেরিয়ে যা ভার্সিটি থেকে। মাশিয়ার বাবার ভার্সিটিতে এসে ওর সাথেই মিসবিহেভ করছিস? যা বেরিয়ে যা। ” মিতুল রিশাদের কলার ধরে ওকে ভার্সিটি থেকে বের করে দেয়।

মাশিয়া তখন থেকেই কেঁদে চলেছে। তৃষা, মিতুল মিলে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এরপর ওকে নিয়ে বাসায় যায়।

আরমান বাড়িতে এসেছে। সুধাও কয়েকদিনের ছুটিতে এসেছে। ও চিটাগং যাবে মা-বোনের সাথে। সেখানে দুই-একদিন কাটিয়ে ঢাকা ফিরবে। আয়েশা খানম সব গোছগাছ করে নিয়েছেন। আরমান সব জমিজমা বর্গা চাষীকে দিয়েছে।

গভীর রাত। পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমে মগ্ন। শুধু ঘুম নেই আয়েশা খানমের চোখে। দুইমাস আগেও তার বাড়ি কোলাহলপূর্ণ ছিল। ছেলেমেয়েরা একে-অপরের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকত। সুখে পরিপূর্ণ ছিল তার সংসার৷ কিন্তু একটা মেয়েই তাদের সব সুখ, হাসি, আনন্দ চুরি করে পালিয়েছে। তার ছেলেমেয়েরা আজ হাসতে ভুলে গেছে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত আয়েশা খানম। আরমান গত দুইমাসে নিজেকে বেশ গুটিয়ে নিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে চায়না। খাওয়াদাওয়ায় করছে অনিয়ম। শুকিয়েছে বেশ খানিকটা। ওর সুদর্শন চেহারায় পরেছে বিষন্নতার ছাপ। আয়েশা খানম ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারেননা। বারবার নিজেকে দোষী ভাবছেন তিনি। তার জন্যই আরমান মাশিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু মাশিয়া শেষ পর্যন্ত আরমানকে নিঃস্ব করে চলে গেছে।

আয়েশা খানম ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় চোখের পাতা এক করতে পারেননা। রাতের পর রাত তিনি নির্ঘুম কাটিয়ে দেন। কান্না তার নিত্যসঙ্গী। আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। তিনি নিরবে কাঁদছেন।

গত কয়েকদিন থেকেই আয়েশা খানমের বুকের ব্যথা বেড়েছে। থেকে থেকে বুকে ব্যথা করছে৷ তিনি ঠিকমত ঔষধ খাচ্ছেননা। খাওয়াদাওয়ারও অনিয়ম করছেন। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসলেন। বুকের ব্যথাটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ঘামছেন তিনি। তার পাশেই সুধা, শশী ঘুমাচ্ছে। তিনি হাত দিয়ে কোনরকমে সুধাকে ঝাঁকুনি দিলেন।

ঝাঁকুনিতে সুধার ঘুম ভেঙে যায়। ও উঠে বসল। পাশেই আম্মার দিকে চোখ পরতে ওর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। ওর আম্মা একপাশে কাত হয়ে আছে। তার নাকমুখ দিয়ে গ্যাজলা বের হচ্ছে।

সুধা আম্মার এরূপ অবস্থা দেখে চিৎকার করে শশীকে ডাকল।

আরমান আয়েশা খানমের মাথা নিজের কোলের ওপর রেখেছে। ও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে অনেকক্ষণ আগেই। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আধাঘন্টার মত সময় লাগবে। এদিকে আয়েশা খানমের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হয়ে চলেছে। তিনি টেনে শ্বাস নিচ্ছেন।

” বাপ, তোমার বইনদের দেইখা রাইখ। ভালো পোলা দেইখা ওদের বিয়া দিও। বউমাকে ফিরায় আইনো। হেয় রাগী, জেদি কিন্তু হের মন ছোট মানুষের লাহান। তুমি তার সামনে গিয়া দাঁড়াইলেই হেয় তোমার সাথে আইয়া পরব দেইখা নিও। নিজের জীবনডা এলোমেলো কইরোনা, বাপ। সুধা, শশী, তোমরা ভাইয়ের দিকে খেয়াল রাইখো। ভাইরে কষ্ট পাইতে দিওনা। তিন ভাইবোন মিল্লা-মিশ্যা থাইকো। ভাইয়ের সব কথা শুইনা চইলো। ” শ্বাস আটকে আসায় থামলেন আয়েশা খানম।

” আম্মা, আরেকটু ধৈয্য ধর। অ্যাম্বুলেন্স এসে পরবে। ” আরমান কাঁদছে। কাঁদছে সুধা, শশীও।

আয়েশা খানম ছেলের কথার উত্তর দিতে পারলেননা। একটু হেসে কালিমা পড়তে শুরু করলেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস আরমানের কোলেই ছাড়লেন তিনি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here