প্রেমের প্রদীপ জ্বলে [১৬]
লেখা: প্রভা আফরিন
বিমূঢ় রজনী নিগূঢ় আঁধারের বুকে তলিয়েছে। কাঁঠালিচাঁপা ফুলের সুবাসে আচ্ছন্ন মৌন সমীরণ। শরতের শেষের শীতল বায়ু প্রকৃতির নিটোল দেহের খাঁজে স্নিগ্ধতা ঢেলে দিয়েছে পরম আদরে। এমনই আরামদায়ক ক্ষণে মেহযাবীনের চিত্ত অস্থির হলো। তার সদা শান্ত মন, সুস্থির স্বভাবে চঞ্চলতা ছড়ায় যে ব্যক্তি, তার নিকট হতে এহেন আচরণ পেয়ে যাবীন কিছুটা বিভ্রান্ত। কী বলা বা শোনার প্রয়োজনীয়তা আছে তার ও নিশান্তের মাঝে? মস্তিষ্কে অহেতুক বল প্রয়োগ করেও তেমন কোনো বিষয় সে সন্ধানে সক্ষম হলো না। বরং অস্বস্তি বাড়ল নিমেষহীন দৃষ্টির কবলে পড়ে। যাবীন হেলে বসে ছিল। সোজা হয়ে বসে নোটপ্যাডটা গুছিয়ে রাখল তেপায়ার ওপর। কৌতুহলী স্বরে বলল,
“এত রাতে? কোন বিষয়ে?”
নিশান্ত নিঃসংকোচে ওর মুখোমুখি বসে আছে। তীক্ষ্ণ চোয়াল, টানটান শিরদাঁড়া। কণ্ঠমণির ওঠা-নামায় জবাবের বিপরীতে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ল সে,
“এত রাতে কথা বলতে আপত্তি আছে তোমার?”
নিশান্তের আচরণ এখন অতি মাত্রায় শীতল। এর কারণ কী হতে পারে! মনে মনে কেন জানি সুক্ষ্ম একটা ভয় কাজ করল। অতিরিক্ত ভেবে নিজেকে পিষ্ট না করতে ইচ্ছে হলো না। তবুও প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন পেয়ে নাক কুচকালো সে। বলল,
“আপত্তি বললে শুনবেন?”
“ভ্যালিড রিজন না থাকলে শোনা উচিত নয়।”
“এতই গুরুত্বপূর্ণ কথা!”
“গুরুত্বের চেয়েও বেশি সুরক্ষার কথা।”
যাবীনের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিশান্ত পুনরায় বলল,
“শাওনের বিয়ের দিন তিনতলায় কী হয়েছিল, মেহযাবীন?”
যাবীন আঁতকে উঠল। ঢোক গিলে অপ্রস্তুতভাব সামলাতে চেষ্টা করল। অহেতুক কানের পিঠে চুল গুজে আমতা আমতা করে বলল,
“তিন তলায় আবার কী হবে? আমি তো বিয়ের আসরেই ছিলাম।”
নিশান্ত মাথা নাড়ল। তার কোনো তাড়াহুড়া নেই, উত্তেজনা নেই। শুধুই ঠাণ্ডা মাথায় সম্পূর্ণ ঘটনা বের করার প্রয়াস আছে। বলল, “ছিলে। তবে বিয়ের রিচুয়াল শুরুর আগ মুহূর্তে তুমি নিচতলাতেই উপস্থিত ছিলে না।”
যাবীন চোখ ছোটো করে বলে, “আমাকে নজরে রেখেছিলেন?”
নিশান্ত হেলে বসল চেয়ারে। গা ছাড়া ভাবে বলল, “যারা আগেপিছে না ভেবে নিজেদের বিপদে ফেলতে ওস্তাদ তাদের একটু নজরে রাখতে হয় বৈকি। নয়তো জেদের বশে গা ভর্তি গহনা পরে কে বের হয় রাতের সুনসান রাস্তায়?”
যাবীন গম্ভীর হয়ে গেল। দৃষ্টি নামিয়ে আনল কোলের ওপর। একবার বলতে ইচ্ছে হলো, “জেদের কারণ তো আপনিই ছিলেন।” কিন্তু শব্দ জুটল না কণ্ঠে। এই ধূর্ত পুরুষের সঙ্গে আর যাই হোক সে তর্ক করতে পারবে না। তাছাড়া যাবীন তর্কে পারদর্শী নয়। কিন্তু নিশান্ত তাকে নজরে রেখেছে ব্যাপারটাও তার ঠিক হজম হলো না। প্রচ্ছন্ন ব্যাঙ্গের স্বরেই বলল,
“বিপদে পড়া সব মানুষকেই নজরে রাখেন বুঝি?”
চোখা একটি হাসি বয়ে গেল নিশান্তের ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে,
“এত ক্ষমতা বা সাধ্য কোনোটাই নেই। দুটো চোখই আছে আমার। এই চোখের সামনে যারা আছে তারা আপনাতেই নজরে চলে আসে। শাওনের বিয়ের রাতে একই সময়ে তুমি, অনন্ত, শাওন ও শোভা অনুপস্থিত ছিলে। তিন তলায় থেকে বেশ উদ্বেগের সঙ্গে ওঠানামা করেছো। আমি জানতে চাই সে রাতে সবার আড়ালে কী ঘটেছিল।”
যাবীন চোখ তুলল না। এ বিষয়টা নিয়ে তার সত্যিই কথা বলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নিশান্তের সঙ্গে নয়। এই লোক নিজের ভাই-বোনকে ছেড়ে তাকেই কেন পাকড়াও করল! মনোভাবটা যেন বুঝে ফেলল নিশান্ত। হেলান ছেড়ে সামনে ঝুঁকে এসে নরম গলায় বলল,
“অনন্ত, শোভা আমাকে বলতে কম্ফোর্ট ফিল করছে না বুঝতে পারছি। বড়ো ভাইদের কাছে ছোটোরা সবকিছু বলতেও পারে না। কিন্তু ব্যাপারটা আমি এবার আর অগ্রাহ্য করতে পারছি না। তুমি নিশ্চয়ই জানাতে পারবে আমাকে। সে রাতের স্পেসিফিক কিছু টাইমের সিসিটিভি ফুটেজ নেই। অনন্তের বন্ধুর পরিবারের মাধ্যমে জানলাম ওদের নতুন বাড়ির দারোয়ানের হদিশ নেই। আর নিখোঁজের দিন রাতে অনন্ত গেছিল সেখানটায়। দারোয়ানের পক্ষে কেউ কোনো কেইস ফাইল করলে কিন্তু অনন্তের নাম চলে আসবে অনায়াসে। একই দিনে এতগুলো সন্দেহজনক ঘটনা নিছকই কাকতালীয় হতে পারে না। আমি সত্যিটা জানতে চাই। তোমরা কোনো ঝামেলায় জড়াওনি তো?”
যাবীন জানত এই ব্যক্তি একবার সন্দেহের গন্ধ পেলে সহজে ছাড়বে না৷ সে আর লুকানোর চেষ্টা করল না। কাউকে তো জানাতে হতোই। বিগত ঘটনাগুলো তাকেও উদ্বিগ্ন করছে। প্রথমে আমিনের নিখোঁজ হওয়া, এরপর শোভার এক্সিডেন্ট, আর আজকে তো ভয়াবহ একটা কাণ্ড ঘটে গেল। বিকৃত মস্তিষ্কের ভাবনা এ ধরনের কাজ করা সহজ নয়। অনেক দিনের চেপে রাখা রুদ্ধশ্বাসটি মুক্ত করে ও বলল,
“ওয়েল! আমরা আসলেই একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি। ভাইয়াকে জানানোর সুযোগ খুঁজছিলাম। এই ওই ঝামেলায় সামহাউ হয়ে উঠছিল না। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে আমাদের কাউকে বকাঝকা করা যাবে না।”
যাবীন মুঠো করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ছুঁয়ে কথা দিতে হবে। কথা দেওয়া নেওয়ার সময় ছুঁয়ে বললে সেটা বিপরীত ব্যক্তিটি অমর্যাদা করে না এমন একটা মনোভাবের বিশ্বাসী বলেই অভ্যাসের বশে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এই ছেলেমানুষী কাণ্ডটি দেখে নিশান্তের চোখে কৌতুক ফুটে উঠল।
যাবীন অপ্রস্তুত হয়ে হাত সরিয়ে নিতে চাইল। অবকাশ না দিয়ে নিশান্ত ওর হাতটা ধরে ফেলল। মেঘমন্দ্র কণ্ঠের সর্বাধিক কোমল স্বরের আশ্বাসে বলল,
“বকব না, কথা দিলাম।”
যাবীন লম্বা একটি দম ফেলে সংক্ষিপ্ত পথে সম্পূর্ণ ঘটনার সারাংশ পেশ করে। সে যখন আমিনের নিখোঁজ হওয়া পর্যন্ত বিবৃতি দিয়ে শেষ করল সঙ্গে সঙ্গে বেতের তেপায়ার ওপর একটি পেশিবহুল হাতের থাবা পড়ল। নিশান্ত সামনের দিকে হেলে এসে বলল,
“আর ইউ ইনসেইন? একটা ক্রি’মি’নালকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছো!”
আচমকা প্রতিক্রিয়ায় ক্ষণিকের জন্য যাবীন হরিণ শাবকের ন্যায় ভীতির খোলসাবৃত্ত হয়। ধাতস্থ হয়ে অসন্তোষের সঙ্গে বলল,
“আপনি আমার ওপর চড়াও হচ্ছেন কেন? আমি সম্পূর্ণ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী মাত্র।”
“দেখেছো তো। জানানো উচিত ছিল না তোমার?”
“আমি নিশ্চয়ই চাইব না বিয়ের দিন আমার ভাই তার বউয়ের প্রাক্তন প্রেমিককে ডিল করুক? জানাজানি হলে শাওনের দোষ না থাকলেও কাদা ছোঁড়াছুড়ি হতো দেদারসে। গুরুত্বপূর্ণ দিনে দুই পরিবারের সম্মান ডোবাব না বলেই চুপ ছিলাম। তৎক্ষনাৎ যা ঘটানোর, করানোর সব আপনার গুণধর ভাই-বোন ঘটিয়েছে, করিয়েছে। পদ্ধতিতে ভুল থাকলেও উদ্দেশ্য সঠিক ছিল। সবটা ভেস্তে গেছে আমিন পালানোর পর। এরপর থেকেই জানানোর সুযোগ খুঁজে চলেছি আমি। কিন্তু ঝামেলা কী পিছু ছাড়ছে যে ভাইয়ার সঙ্গে একান্তে একটু আলাপ করব? ইনফ্যাক্ট আমরা প্রথম দিনই থানায় জিডি করিয়েছি।”
নিশান্তের বিপরীতে পালটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে যাবীনের কণ্ঠ উঁচুতে উঠে গেছিল। ও দম ফেলতেই নিশান্ত বলল,
“আমাদের নিচু স্বরে কথা বলা উচিত।”
“সেটা আপনারও খেয়াল রাখা উচিত।” যাবীন মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেয়। এনা হার্কনেস গোলাপটা একদমই ওর নিকটে। কৃত্রিম আলোর উজ্জ্বল আভায় যাবীনের উত্তেজনায় ঈষৎ রক্তাভ হয়ে ওঠা কোমল মুখশ্রীটা যেন এনা হার্কনেসেরই আরেক রূপ দেখায়। নাকি এ মায়াবী রাতের রহস্যময়ী ছলনা!
নিশান্তের কপালে চিন্তার ভাজ। সে প্রসঙ্গে ফিরে বলল, “তুমি বুঝতে পারছো আমার মনোভাব? আমার বাড়িতে ঢুকে একজন আমারই বোনের ক্ষতি করতে চেয়েছে। আমার ভাই-বোনরা তাদের বুদ্ধির জোর দেখাতে গিয়ে সেই ক্রি’মিনালকে পালাতে হেল্প করেছে। ইটস নট আ জোক রাইট? জীবনটা একশন সিনেমার মতো স্মুথ না যে হিরোগিরি করে ভিলেনকে টাইট দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে। এটা আমার পরিবারের সুরক্ষার প্রশ্ন, মেহযাবীন। আজকের ঘটনাটা সামহাউ ওই ক্রি’মি’নালটার হয়ে থাকলে সে যে চূড়ান্ত পর্যায়ের ডেস্পারেট হয়ে আছে আর বুঝতে বাকি নেই।”
যাবীন চুপ করে থাকে। একটু সময় পর বলে, “আরেকটা কথা। এটা আজই জেনেছি।”
“কী?”
“শোভার এক্সিডেন্টটা আসলে ইচ্ছাকৃত ঘটানো হয়েছে।”
শোভার দুর্ঘটনার বিবৃতি শুনে নিশান্ত থম মেরে গেল। একটা ঘটনা লুকানোর নিমিত্তে ওরা কতগুলো ঘটনায় জড়িয়ে গেছে ভেবেই মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হলো তার। কিন্তু এই নারীর তো বিন্দু পরিমাণ দোষ থাকলেও কথা শোনানো যাবে না। সংবেদনশীল দেহ তার। ফোসকা পড়ে যাবে! অতিশয় গম্ভীর স্বরে শুধু এটুকু বলল,
“আমিনের একটা ছবি জোগাড় করে দিতে পারো আমায়?”
“নেই। তবে চেষ্টা করব।”
হঠাৎ বসার ঘরের আলো জ্বলে উঠল৷ নিশান্ত-মেহযাবীন একত্রে চাইল সেদিকে। চাঁদনি বেগম এসেছেন। তিনি দুজনকে একসঙ্গে বসে থাকতে দেখে অবাক গলায় বললেন,
“তোরা এখানে কী করিস?”
যাবীন বিব্রত হয়। নোটপ্যাডটা হাতে তুলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
“একটু আঁকিবুঁকি করছিলাম, দাদি।”
চাঁদনি বেগম নাতির দিকে চেয়ে বলেন,
“আর তুই কী ওকে পাহারা দিচ্ছিলি? নাকি হাওয়া খাচ্ছিলি?”
নিশান্ত নিরুদ্বেগ স্বরে বলল, “তুমি কখন গন্ধ শুকে বিড়ালপায়ে এসে প্রশ্ন করবে তার প্রতিক্ষায় ছিলাম। মেহযাবীন এখানে একা বসেছিল তাই এসেছি। নাথিং সিরিয়াস।”
চাঁদনি বেগম যে সে কথা বিশ্বাস করলেন না সেটা উনার মুখভঙ্গিই বলে দিল। যাবীন নোটপ্যাডটা শক্ত করে বুকে চেপে ওপরে চলে গেল৷ এই বাড়িতে আসার পর থেকে তার কপালে শুধু বিব্রত হওয়াই লেখা আছে।
চলবে…
নতুন বছরের প্রথম দিনের শেষ ক্ষণে একটুখানি প্রেমপ্রদীপ।