প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [১৭-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন
দিলশানের মাঝে কোনোকিছুরই আধিক্য নেই। উচ্চস্বরে হাসে না, রাগে চিৎকারও করে না। সবকিছুতেই দারুণ পরিমিতবোধ। ধৈর্যশীলতা নামে একটি চমৎকার গুণ আছে তার। আর এই গুণটারই ফায়দা তুলছে শোভা। উৎপাতের শুরুটা খুব বেশিদিনের নয়। প্রতিবেশী হিসেবে ছোটোবেলা থেকে দিলশান শোভাকে চিনত চরম দুষ্টু একটা মেয়ে হিসেবে। অত্যন্ত চঞ্চলা ছিল বলে প্রায় প্রতিদিনই মায়ের শাসন জুটত। অনেকদিন এমনও হয়েছে মারের হাত থেকে বাঁচতে দিলশানদের বাগানে এসে লুকিয়ে থেকেছে। সুলেখা মেয়েটিকে মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন বহুবার। দিলশানের সঙ্গে কখনোই ওর তেমন সখ্যতা ছিল না। দিলশান যেবার কলেজ পাশ করে মেডিকেল হোস্টেলে চলে গেল, শোভা তখন একটি অপক্ক ফুলের কলির মতো কিশোরীতে পরিণত হয়েছে। ছুটিছাটা মিললে দিলশান বাড়ি আসত কিছুদিনের জন্য, তখনই কিশোরী চোখের তীর তার দিকে নিশানা করেছিল। দিলশান পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের প্রেমে মশগুল ছিল বলেই অন্যের চোখের খবর রাখত না। কিংবা বুঝলেও পাত্তা দিতো না। এরপর সময়ের পরিক্রমায় শোভা নামের কলিটি ফুল হলো। দিলশানও এ বছরের শুরুতে বাড়ি ফিরে ক্লিনিকে যোগ দিল। তখন থেকেই শুরু হলো মেয়েটির উৎপাত। শুরুতে নিজের প্রতি শোভার এ ধরনের উদ্ভট কাণ্ড দিলশানকে আনন্দ যে দিতো না তা বললে ভুল হবে। কিন্তু ক্রমেই শোভার বেপরোয়া স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত হয়ে দিলশান এখন অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে।
কবী শোভানন্দ আজাদের কথা শুনে দিলশানের রাগের মাঝেও হাসি পেল। মৃদু কাশি দিয়ে নিজেকে আবার গম্ভীরতার শক্ত খোলসে আবদ্ধ করে বলল,
“তোমার কবি শোভানন্দ এটা বলেনি যে, যাকে পছন্দ করো তাকে কষ্ট দিয়ো না? নাকি সে ঘাড়ত্যাড়া কবি?”
শোভা হুডির হাতা গোটাতে গোটাতে বলল, “কবি হবে কোমল, কবি ভাববে ফুল, পাখি, আকাশ, বাতাস নিয়ে সেসব ভুলে যান। যুগের সঙ্গে কবির ধরনও বদলায়। সে হচ্ছে মনস্টার কবি। তার মাঝে সরলতা, ভালো মানুষী খুঁজে লাভ নেই।”
শোভা দুষ্টু, অবাধ্য, ঘাড়ত্যাড়া হলেও একটি ভালো মন যে তার আছে, এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। প্রমাণস্বরূপ পথের কালো বিড়ালটা এখনো শোভার পায়ে গা ঘষছে। ওরাও জানে মেয়েটির মন কতটা উদার। তাই দিলশানও একবাক্যে ওকে খারাপের দলে ফেলতে পারে না। মেয়েটির বাবা নেই, মাও চাকরিজীবী। তাই ওর প্রতি বাড়ির সবাই একটু নমনীয়। অতিরিক্ত আদরে হয়তো উশৃংখল বনে গেছে। দিলশান বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
“লিসেন শোভা, তোমার কী স্ট্রং একটা ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে ইচ্ছে করে না?”
“করে তো। কীভাবে স্ট্রং ব্যক্তিত্ব তৈরি করব আইডিয়া দিন।”
“কেউ তোমার ওপর বিরক্ত হচ্ছে বুঝলে তোমার উচিত নিজেকে রেসপেক্ট করে তার ত্রিসীমানায়ও না যাওয়া। নিজেকে ছোটো হতে না দেওয়া।”
শোভা ওর সরু থুতনিতে হাত বুলিয়ে কিছু ভাবল। এরপর বলল,
“ঠিকই বলেছেন। আমার উচিত সবার আগে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। ও বাড়ির সবাই আমার ওপর বিরক্ত। কিন্তু সেকেন্ড কোনো হোম তো আমার নেই। আপনি চাইলে আমাকে আশ্রয় দিতে পারেন। তাহলে আজই বাড়ি ছাড়ব। দেখিয়ে দেব স্ট্রং ব্যক্তিত্ব।”
দিলশান কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে ওর কথা অনুধাবন করতে চেষ্টা করল। একটা ব্যর্থ শ্বাস ত্যাগ করে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলল,
“তোমার স্ট্রং ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন নেই। বাড়িতেই থাকো। আমাকেও রেহাই দাও। মনস্টার লেডি!”
দিলশান আর একটা কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উলটো পথে হাঁটা ধরল। শোভা হাসতে হাসতে পথের ওপর বসে পড়ল।
_____________
কর্মব্যস্ত সকাল। সময়ের গতিশীল পথ ধরে সূর্যকিরণ চঞ্চল পদে ছুটছে গাছের পাতায় পাতায়। কবোষ্ণ রোদ গায়ে মেখে ঘুমের আলস্য ভাঙল মেহযাবীন। এ বাড়িতে শরীরচর্চার একটা সুস্থ অভ্যাস আছে। শেখ বাড়িতে নেই। জাওয়াদ মাঝে মাঝে জিমে যায়। তাছাড়া আর কেউই তেমন শরীরচর্চায় এক্টিভ না। মেহযাবীন দোতলার খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছিল। এমন সময় চেনা পদধ্বনি ওর ফুরফুরে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাল।
তেতলা থেকে ঘেমে-নেয়ে নামছে নিশান্ত। পরনের পোলো শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে বলে সেটা খুলে কাঁধের ওপর রেখেছে। সকালের কসরতের প্রমাণস্বরূপ গলা, ঘাড় ভিজে একাকার। সিড়ির সামনের লম্বা জানালার কাছে যাবীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিশেষ ভাবান্তর হলো না ওর। পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিল, কী ভেবে দুকদম পিছিয়ে আবার মুখোমুখি হলো। ডাকল,
“মেহযাবীন?”
যাবীন যেন অনিচ্ছায় পিছু ফিরল। চঞ্চল চোখটা একবার পুরুষালি পেটানো শরীরে উঠে আবার নেমে গেল। ঘন ঘন আঁখিপল্লব ঝাপটে প্রশ্নসুচক শব্দ করল, “হু?”
“আজ ফিরছো তো?”
“অবশ্যই।”
“জাওয়াদকে চলে যেতে বলো। আমি পৌঁছে দেব। প্রয়োজন আছে।”
যাবীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিশান্ত চলে গেল। যাবীন ভ্রু বাঁকা করে। মনে মনে একটু শঙ্কাও জাগল। আবার রাতের বিষয়টা নিয়ে জেরা করবে বোধহয়। চিন্তার সমান্তরাল রেখা ফুটল ওর মসৃণ ললাটে।
অনন্ত ঘুম ভেঙে বেরিয়েই যাবীনের সামনে পড়ল। হাই তুলে বলল,
“কীরে! তোকে করলা কে খাইয়েছে?”
যাবীন ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “আমি তো করলা খাচ্ছি। তুমি বাঁশ খেতে প্রস্তুত হও।”
অনন্ত ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“কার এত্ত বড়ো সাহস আমাকে বাঁশ দেবে?”
“যে বাঁশ বাগানের মালিক। তোমার একমাত্র ভাই। সে জেনে গেছে বিয়ের রাতে তেতলায় কী হয়েছে আর তুমি কী কী ঘটিয়েছো।”
অনন্ত ঘাবড়ে গেল। দাঁতে নখ কেটে বলল,
“কীভাবে দোস্ত? হাউ!”
“সে তোর ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। মাঝখান দিয়ে আমি তোদের মাঝে পড়ে ফেসে গেলাম। কাল রাতে আমাকে জেরা করেছে।”
“আর তুই কী বললি?”
“যা জানি সব।”
“হে আল্লাহ!” অনন্ত ওপরের দিকে দুহাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে ঘরের দিকে গেল, “এই মেয়েকে তুমি উঠিয়ে নাও।”
যাবীন রগড় করে বলল, “একের পর এক ব্লান্ডার করবে আর ধরা খেলে অন্যের অনিষ্ট চাইবে? ওঠালে তো তোকে ওঠানো উচিত।”
অনন্ত দরজা ধরে দাঁড়িয়ে যাবীনের দিকে ফিরে বলল,
“কে আপনি? আমি আপনাকে চিনি না। আজ আমি কাউকে চিনি না। অতীতের সব কথা ভুলে গেছি। আজ সারাদিন ঘুমাব।”
যাবীন অবাক গলায় বলল, “তুই না ইনভেস্টিগেট করবি বলেছিলি?”
“বললাম না অতীত ভুলে গেছি। আমার কিছুই মনে নেই। যার কানে গেছে তাকে একটু রিকুয়েষ্ট করিস এসব যেন বাবা অবধি না পৌঁছায়।”
অনন্ত শব্দ করে দরজা আটকে দিল।
যাবীন একবার ভেবেছিল নিশান্তের সঙ্গে যাবে না। কিন্তু যদি আমিনের ব্যাপারেই কথা থাকে তাই ভেবে রাজি হলো। যে করেই হোক ক্রিমিনালটাকে ধরা দরকার। আমিনের আগেকার একটা ছবি ও ফেইসবুক থেকে সংগ্রহ করেছে, আমিনের বন্ধুর টাইমলাইন থেকে। সেটাও দেওয়া প্রয়োজন। যাবীন নীল জিন্সের সঙ্গে একটা হলুদ রঙের কামিজ পরে তৈরি হয়ে নিচে নামল। বের হবার মুখে সামনের বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখল এনা হার্কনেস ফুলগাছটা নেই। ও শাওনকে প্রশ্ন করল,
“গাছটা কই গেল রে? আমার বাড়িতে একটা আনাব ভাবছিলাম।”
শাওন ঠোঁট উলটে বলল, “বড়ো ভাইয়া সকালে নিয়ে গেছে ওটা। ক্যান্টনমেন্টে ফেরার আগে অবধি ভাইয়ার ঘরেই নাকি রাখবে ওটা।”
যাবীন ভ্রুকুটি করে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে,
“তোর মিলিটারি ভাই ফুলের কী বোঝে? সে তো আস্ত কাটা!”
“কাটা আছে বলেই গোলাপকে চাইলেই স্পর্শ করা যায় না। গোলাপের সুরক্ষা কবজ তার কাটা। তেমনই এই মিলিটারিরা কাটা হয়ে গোলাপের মতো দেশকে সুরক্ষা দেয়।”
ভারী কণ্ঠের আওয়াজে যাবীন থতমত খেয়ে গেল। নিশান্ত ওদের পেছনেই এসেছিল। ওরা কথা বলতে বলতে খেয়াল করেনি। যাবীন একপলক চোখ তুলে চেয়েই নজর বাঁচিয়ে গাড়ির দিকে ছুটল। নিশান্ত দুকদম এগিয়ে এসে শাওনের সামনে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল,
“বাড়ি থেকে অপ্রয়োজনে বের হবে না। প্রয়োজনে বের হতে চাইলেও কাউকে জানাবে। জাওয়াদ ফ্রি না থাকলে ভাইদের জানাবে। ফিরে এসে কথা বলব তোমার সঙ্গে। দরজা আটকে ভেতরে চলে যাও।”
শাওনের বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে। উদ্বেগের শ্বাসকে চাপা দিয়ে আলতো মাথা নেড়ে ও সদর দরজা আটকে ভেতরে চলে গেল।
চলবে…