প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২৪-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন
শোভা তার ইভেন্টে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে স্পেশাল পারমিশন আদায় করেছে। এই স্পেশাল পারমিশনের জন্য তাকে কঠিন শর্তে রাজি হতে হয়েছে। পারিবারিক উকিল কাকুকে ডাকিয়ে একটা অঙ্গিকারনামা তৈরি করেছেন জাদরেল বুড়ি। তাতে ধারালো বাক্যে লেখা শোভা এ বছর মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। সামনের সেমিস্টারে সিজিপিএ ৩.৫০ এর উপরে আনতে হবে, চুল কেটে ছোটো করা যাবে না, বাঁদরামো ছেড়ে ভদ্রভাবে চলতে হবে এবং স্কুটি চালানো ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ। শোভা শর্তসমূহ শোনা মাত্রই বিদ্রোহী ভঙ্গিতে ঘোষণা দেয়,
“অসম্ভব! আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতনি। আমার শরীরে বীরের র’ক্ত বইছে৷ আর তুমি আমাকে পরাধীনতার শেকল পরাতে চাও? রাজাকার বুড়ি! সময় এসেছে বি’দ্রো’হ করার। তুমি এই দ্বীপশিখাকে পরাধীন করে রেখেছো। আমি বীরের বেশে সং’গ্রাম করে দ্বীপশিখাকে স্বাধীন করব।”
চাঁদের বুড়ি হাই তুলে বলেন, “পেটে ভাত নেই, সে করবে সং’গ্রাম! ঘরে তালাবন্দ হয়ে যত পারিস সং’গ্রাম কর। রাই’ফেল, ব’ন্দুক লাগলে বলিস। কিনতে তো আর পারবি না। আমিই নাহয় কিনে দেব। ঘরে বসে সং’গ্রাম সং’গ্রাম খেলবি।”
শোভা বুঝল এভাবে কাজ হবে না। তাকেই কৌশলে আপোসে আসতে হবে। ও দুঃখী মুখ করে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
“আমার পাখা কেটে নিতে চাও, আচ্ছা দিয়ে দেব। কিন্তু পাখা কেটে দিলে আমার যে পিঠে ক্ষত হবে, সেই ক্ষত কি দিয়ে সারাব? ট্রিটমেন্টের খরচা কোথা হতে আসবে? আফটার অল আমি গরীব। পেটে ভাত জোটে না। চিকিৎসা কী করে করাই?”
“সব কথার এক কথা সেই টাকা তো!”
“এভাবে বলছো কেন? আমি কী টাকা দিয়ে গাঁ’জা কিনে খাই? ডোপ টেস্ট করে দেখতে পারো। আমার একটাই এডিকশন। অ্যানিমেল এডিকশন।”
চাঁদের বুড়ি চোখ গরম করে চেয়ে বললেন,
“তোমার এডিকশনের পাওয়ার দেখব আমি। যদি শর্ত পূরণ করতে পারিস তবে আগামী এক বছরের সকল ডোনেশন আমার একাউন্ট থেকে লেনদেন হবে। খুব খুশি করতে পারলে বোনাস হিসেবে তোর সংস্থার জন্য পার্মানেন্ট হেড অফিস বানিয়ে দেব।”
মেঘ না চাইতে যেন জলের বান ডাকল শোভার মনে। প্লাবিত হয়ে গেল সকল দুষ্টু বুদ্ধি। শুনছে কী! পার্মানেন্ট অফিস! এ যে তার বহুদিনের লালিত আকাঙ্খা। ডোনেশন ও ব্যক্তিগত ব্যয়ের ওপর ভরসা করতে হয় বলে তা আর হয়ে উঠছিল না। একটা অফিস পেলে সংগঠনের কাজ আরো মজবুতভাবে প্রসার করা যাবে। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। চাঁদনি বেগম জানতেন নাতনির দুর্বলতা কোথায়। সেখানেই সুড়সুড়ি দিয়েছেন। হেয়ালি করে গম্ভীর গলায় বলেন, “কী? চুপ কেন? ইচ্ছে নেই? তাহলে আর কি করা…”
শোভা কথার মাঝে ব্রেক করল। চাঁদনি বেগমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উল্লাসে বলল, “মানব না মানে! আমি মানব, আমার বাপের মা শুদ্ধু মানবে। কোথায় সই করতে হবে বলো? তোমার বুকে ট্যাটু করে সই করে দেব? নাকি ফ্রেমে বাঁধিয়ে তোমার শোবার ঘরের দেয়ালে আটকাব?”
চাঁদনি বেগম ধমকে উঠলেন, “চুপ বে’য়া’দব। তোর এই বাচালিপনাকেও শর্তে ইনক্লুড করা প্রয়োজন ছিল। যাইহোক, এই স্ট্যাম্পে সই করবি। কোনো শর্ত ভাঙলেই শাস্তি পেতে হবে। একটা একটা করে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে। এরপর সত্যি সত্যিই এক মাছুয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব। বর মাছ বেচবে, তুই মাছ কুটবি। তখন যত পারিস বিড়ালকে খাওয়াস।”
মাছুয়াকে বিয়ে! উঁহু, শোভার মনে যে একজন চোখের ডাক্তার ঢুকে বসে আছে। যে সবার চোখের রোগ ধরতে পারে একমাত্র শোভার চোখ ছাড়া। এই ডাক্তার যদি তার প্রফেশন বদলে মাছুয়া হয় তবে শোভার মাছুয়া বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই।
অতঃপর শোভা সই করল। শর্ত মানার নমুনাস্বরূপ সকালে পড়তে বসল। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে এই প্রথম সে বই ছুঁয়েছে। স্কুলের বাচ্চাদের মতো উচ্চস্বরে উচ্চারণ করে করে পড়ল। ওর পড়া দেখে বাড়ির সবাই রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসল। শিরীনের চোখ ছলছল করে উঠল। আঁচলে চোখ মুছে আবেগ সামলে বললেন,
“আমার ছোটো মেয়েটার এতদিনে বুদ্ধি হলো! আমার আর চিন্তা নেই৷ কারো যন্ত্রণার কারণ হতে হবে না। এবার নিশ্চিন্তে ম’রতে পারব।”
চাঁদনি বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “হ্যাঁ, সব ম’রে সাফ হও। সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমি বেঁচে থাকি। আমার তো আর ম’রার জো নেই! স্বামী গেল, ছেলে গেল… সব চলে যাও।”
চাঁদনি বেগম ক্রো’ধে জ্ব’লতে লাগলেন। চশমার আড়ালে চোখদুটো কেমন চিকচিক করে উঠল উনার। আফিয়া চাপা গলায় ধমক দিলেন ছোটো জা-কে,
“তোর কি এতকালেও আক্কেল-জ্ঞান হবে না?”
“আমি কী বললাম?”
“ম’রার কথা বলবি কেন? বুড়ো মানুষটা শক্ত করে কথা বলে দেখে কি উনার মনও শক্ত? ওটা তো মনের ব্যথা ঢাকার বর্ম মাত্র। এসব বলে দুঃখ দিস কেন?”
শিরীন দমে গেলেন। আলতো করে গিয়ে বসলেন শাশুড়ির পাশে। চাঁদনি বেগম ফিরেও চাইলেন না। শিরীন আপ্লুত স্বরে ডাকলেন, “আম্মা? আপনি কী আমার ম’রার কথা শুনে মন খারাপ করলেন?”
চাঁদনি বেগম মুখ ঝামটে বললেন, “একদমই না। মনে মনে হিসেব কষছি কুলখানিতে কত মানুষকে খাওয়াব আর কত খরচা হবে।”
শিরীন রাগ করলেন না। গা ঘেঁষে বসলেন আরো। বললেন, “আপনার কত্ত টাকা! আপনার বাবা তো সেই পাকিস্তান আমলের মস্ত ব্যবসায়ী। একমাত্র মেয়ে হিসেবে বিরাট সম্পত্তি পেয়েছেন। ব্যবসার উত্তরাধিকার হয়েছেন। শোভার বাবা বেঁচে থাকতে সে-ই দেখত সব। সেই ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে বিশাল বিশাল এমাউন্ট আসে আপনার একাউন্টে। আমাকে একশবার মে’রে একশবার কুলখানি করলেও আপনার রাজকোষে ঘাটতি হবে না।”
চাঁদনি বেগম সরে বসে বললেন, “গায়ে পড়ছো কেন? সরো। খেয়ে খেয়ে শরীরটাকে তো চর্বির ফ্যাক্টরি বানিয়েছো। বুড়ো বয়সে শরীরের গাটে গাটে ব্যথা হবে তোমার।”
শিরীন আহত চোখে চেয়ে বললেন, “আপনি কি আমার সঙ্গে একটু ভালো করে কথা বলতে পারেন না? সব সময় এমন ক্যাটক্যাট করেন কেন?”
“বেশ করেছি। অত দরদ দেখাচ্ছো কেন? ভেবেছো তেল দিয়ে আমার সম্পত্তি লিখে নেবে? সে আশার গুড়ে সমুদ্রের ভেজা বালি।”
শিরীন আশ্চর্য হয়ে গেলেন, “আমি আপনার সম্পত্তির লোভ করি? এত বড়ো কথাটা বলতে পারলেন? তাহলে শুধু শুধু বাইরে চাকরি করে জীবন, যৌবন ক্ষয় করলাম কেন? আপনার পা টিপে দিতাম দুইবেলা। ঘুমের ঘোরে টিপছাপ হাতিয়ে নিতাম। আমি কি তা করেছি? আমার বাপের বাড়ি কি ফকিন্নি? আপনার মতো অঢেল না থাকলেও গর্ব করার মতো আছে। আমার ভাই আসছে আগামীকাল। বিকেলের ফ্লাইটে ল্যান্ড করবে। থাকব না আর আপনার বাড়িতে। বড়ো মেয়েটার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা মিটে গেলেই চলে যাব আমি।”
শিরীন অশ্রু ছলোছলো চোখে চলে গেলেন। যেন কিছুই হয়নি এমন ভান করে চাঁদনি বেগম বললেন, “এক কাপ চা দিয়ো তো বড়ো বউ। মা-মেয়ে মিলে মাথাটা ধরিয়ে দিয়েছে একেবারে। ওই বেক্কল মহিলাকেও কড়া করে এককাপ চা দিয়ো। খেয়ে ঠান্ডা হোক। নয়তো ভাইয়ের কাছে বদনাম করবে এ বাড়িতে তিনি নি’র্যা’তিতা!”
আফিয়া কপাল চাপড়ে বললেন, “আপনারা কোনোদিন শোধরাবেন না!”
চলবে…
গল্প চলমান অবস্থায় পড়ে ফেলার অনুরোধ রইল। এরপর আর বলব না।
‘নিশাবসান’ এখন বইমেলায় এভেইলেবল। অনলাইনে সর্বোচ্চ ছাড়মূল্যে অর্ডার করতে পারবেন আগামীকাল পর্যন্ত। এ সপ্তাহের মাঝেই সকলের বই ডেলিভারি দেওয়া হবে।