প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩২-বর্ধিতাংশ] প্রভা আফরিন

0
461

#প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩২-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন

কাচ নামানো উইন্ডো দিয়ে হুহু করে প্রবেশ করছে উন্মাতাল হাওয়া। যাবীনের পিঠে এলানো আধভেজা চুলগুলো উড়ছে। সে একহাতে চুল সরিয়ে ডানপাশে ফেলতে ফেলতে পাশের ব্যক্তিটির দিকে চাইল। নেভি শার্ট ও গ্রে কালারের প্যান্ট পরিহিত সুদর্শন পুরুষটি আস্তিন গোটানো একহাতে স্টিয়ারিং আঁকড়ে আছে। চোখের কালো চশমাটির জন্য দৃষ্টির গভীরতা পরিমাপ করা মুশকিল, কিন্তু ঠোঁটের দুর্বোধ্য হাসিটা যাবীনকে বিব্রত করছে ক্ষণে ক্ষণে। তার করা ছোট্ট একটা মন্তব্য এভাবে নিশান্তের কান অবধি পৌঁছে যাবে ভাবতে পারেনি। শেষে শাওনও বেইমানি করল! মেজাজের পারদটা মাত্রা ছাড়ালেও বাইরে সে বেশ শান্ত রইল। ঘাবড়ে যাওয়া চলবে না। অবিচল সুরে বলল,
“আপনার কী মনে হচ্ছে না এই কনভারসেশনটা বিয়ের আগে হওয়া উচিত ছিল?”

নিশান্ত প্রস্তুত ছিল এমন অভিযোগ শোনার জন্য। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“পরে হলেও দোষের কী? আলোচনা কতটা সফল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।”
“দোষ নেই বলছেন?”
“থাকলেও বা। বিয়ে ভেঙে দিতে? একদিনে নিশ্চয়ই পাত্র খুঁজে বের করতে পারত না তোমার পরিবার! নাকি তোমার পছন্দ করা আছে?”

মেহযাবীন বিমর্ষ হলো। বিয়ের একদিন পর এসে তার উপলব্ধি জাগল একটা প্রেম করার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। দরকারে কাজে লাগত। সুন্দরী হয়ে কী লাভ জীবনে যদি একটা সফল প্রেমই না হলো! অল্পবয়সে যাও একটা হবে হবে ভাব করেছিল তাও এই বদ লোকের খপ্পরে পড়ে বিসর্জন গেছে।

জবাব না পেয়ে নিশান্ত বউয়ের দিকে চাইল। নতুন বউয়ের কোনো আভাসই নেই মেয়েটির মাঝে। না আছে হাত ভরা চুরি আর না শরীরে কোনো গহনা। নিশান্তের মা-চাচিরা বিবাহের চিহ্নস্বরূপ নোসপিন ব্যবহার করেন। যদিও আধুনিককালে এসবের প্রচলন নেই। ধর্মীয় বিধিনিষেধও নেই। মেহযাবীনের মা-ও চুড়ি বা নাকফুল ব্যবহার করেন না সাজগোজ ব্যতীত। নিশান্তও বউকে এসব ব্যবহারে কোনোকিছুই বলবে না। তবুও মনে হলো মেয়েটির মোমের মতো হাতে দুগাছি স্বর্নের চুড়ি থাকলে দেখতে ভালো লাগত। যেমনটা গতকাল সন্ধ্যায় লেগেছিল। নতুন বউয়ের হাতে রিনিঝিনি চুড়ি বাজবে এটাই তো বাঙালি রীতি। সেই চুড়ির শব্দ স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণ করবে। রচনা করবে অনুরাগী আবহ। গাড়িতে বসেও নিশান্ত শব্দ শুনতে পেল। সেটা চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ নয়, বউয়ের চোখের ধারালো চাহনিতে ফুটে ওঠা তলোয়ারের ঝংকার তোলা ঝনঝন শব্দ। সে কটমট করে বলল,
“আমার সঙ্গে কথা বলার সময় চোখের চশমা খুলে কথা বলবেন। মাঝে কোনো অবস্ট্যাকল আমার পছন্দ না।”

এতক্ষণে একটা বউসুলভ ব্যবহার ফুটে উঠল মেয়েটির মাঝে। ঝারি মারল নিশান্তকে! রেগে না গিয়ে বরং ঠোঁটের দুর্বোধ্য হাসিটা এবার আরেকটু গাঢ় হলো ওর। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পথের বাক নিয়ে বলল,
“কথা হচ্ছে মুখোমুখি। চশমায় কী সমস্যা?”

“মুখোমুখি কথায় চোখ অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চোখ দেখেই মনের অবস্থা বোঝা যায়।”

“ওহ রিয়েলি, মেহযাবীন! তুমি চোখ দেখে মনের অবস্থাও বুঝতে পারো? আমি তো জানতাম বুলেট চেরা চোখ দেখলে তোমার প্যানিক অ্যাটাক হয়।”

মেহযাবীন থতমত খেয়ে গেল। কথা কিঞ্চিৎ সত্যি হলেও এখন তার মাঝে অসীম সাহস এসে ভর করেছে। বলা যায় শাওনের বিয়ের পর থেকে নিশান্তের ঘন ঘন সান্নিধ্যই তার মাঝের জড়তাকে অনেকটা কাটিয়ে দিয়েছে। আর এখন তো সে বউ। বউ! নিজের ভাবনায় নিজেকেই কষে একটা চড় দিতে ইচ্ছে হলো ওর। এক রাত না পেরোতেই নিজেকে বউ ভাবতে শুরু করেছে বেইমান মন! আর স্বামী! সেই বদের কথা ভাবলেই বউ হবার শখ মিটে যাচ্ছে একদম। এই ছিল কপালে!
‘ঢঙের বিয়ে মানি না।’ মনে মনে স্লোগান দিয়ে কথা সাজাল যাবীন।
“কাম টু দ্য পয়েন্ট।”
“শিওর ম্যাম।”
“আপনি আমায় বিয়ে করলেন কেন?”
“সংসার করতে।”
“আমার নাহয় পরিবারের প্রেশার ছিল। আপনার তো ছিল না। শিলার সঙ্গে কমিটেড থেকেও কেন আমাকে বিয়ে করলেন?”

নিশান্ত গম্ভীর হয়ে গেল। বলতে লাগল,
“ফার্স্ট অফ অল, শিলার সঙ্গে আমি কমিটেড এটা তোমার ভ্রান্ত ধারণা। তার সঙ্গে আমি কোনোদিনই কমিটেড ছিলাম না। ইনফ্যাক্ট কারো সঙ্গেই না। তবে হ্যাঁ, পারিবারিকভাবে শিলার সঙ্গে বিয়ের কথা উঠেছিল। আমি মত দেইনি।”
কথার মাঝে ফোড়ন কাটল যাবীন, “এবার কেন দিলেন?”

যাবীন উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। যেন এ কথার উত্তরে অনেককিছু নির্ভর করছে। নিশান্ত তা বুঝলও। শ্রাগ করে বলল,
“নিজেকে এতটা ইম্পোর্ট্যান্ট ভাবার কিছুই নেই। তোমাকে তোমার বাবার আদেশ মানতে হলো, আমিও সবদিক বিবেচনা করে দেখলাম তোমার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত।”

মেহযাবীনের রাগ হলো। শাওনের কথোপকথনের ইঙ্গিতে তার মনে হয়েছিল নিশান্ত বুঝি তাকে পছন্দ করে। তাই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু না। এই লোক তো শুরুতে বলে দিলো নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ না ভাবতে। অর্থাৎ দয়া দেখালো! যাবীন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বিদ্রুপ করল, “বাহ! তাই দয়া দেখিয়ে বিয়ে করে নিলেন? কেন? আমি কী বানের জলে ভেসে যাচ্ছিলাম?”
“তুমি নিজেই তো বানের জল। কোনদিকে প্রবাহিত হও ঠিক নেই।”
“মানে?”
“এতদিন জানতাম রাগটা আমার বেশি। এখন দেখি তুমি আস্ত বদমেজাজি। রাগছো কেন? তুমি বিবাহযোগ্যা। তোমার বাবা অসুস্থাবস্থায় আশা করেছেন তোমাকে পাত্রস্থ করবেন। তোমার কোনো পছন্দও ছিল না। কাজেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারো না। অভিযোগ করতে পারো আরেকটু সময় দেওয়া যেত। লুকিয়ে-চুরিয়ে না হয়ে ধীরেসুস্থে হতে পারত। হয়নি যেহেতু, তোমাকে বুঝতে হবে তোমার বাবা, ভাই কেউ অবিবেচক নয়। নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর আমার প্রতি যে অভিযোগ আনলে তার ব্যাপারে বলতে হয়, বিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দয়া দেখিয়ে মানবসেবা করা যায়। সংসার নয়। আমারও কোনো পছন্দ ছিল না যে আপত্তি তুলব। বিয়েটা কোনোরকমে হলেও সংসারটা ভালোমতোই করব আমরা।”

মেহযাবীন জানে বিয়েটা হবার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণটা সাধারণ কিছু নয়, গুরুতর। তবুও বিয়ের সিদ্ধান্তটা ও মানতে পারছে না। মাও তাকে ধোঁয়াশায় রেখেছেন। তবে আশ্বাসও দিয়েছেন। নয়তো এত সহজে নিশান্তকে সে বিয়ে করে নেয়!

নিশান্ত জিজ্ঞেস করল, “অভিযোগ শেষ?”
“শুরুই তো করলাম না।”
“বলে ফেলো। সংসার করার আগে দুজনের মনকেই প্রস্তুত হতে হবে।”
“আপনি ধরেই নিচ্ছেন আমরা সংসার করব?”
“তুমি কী ডিভোর্স দেওয়ার ফন্দি আঁটছো?”
মেহযাবীন কোনো জবাব দিলো না। নিশান্তের চোয়াল শক্ত হলো। জেদরেল কণ্ঠে বলল, ‘ক্লিন ইমেজ আমার। কোনো ব্যর্থতা নেই। একটা ডিভোর্সের ট্যাগ তুমি লাগাতে পারবে না।”
মেহযাবীনের দুচোখ জ্বলে উঠল, “জোর করে রাখবেন?”
“চেষ্টা বিনা ছেড়েও দেব না।”
“শুভকামনা।” বলেই জানালার দিকে মুখ ফেরালো যাবীন।
“তোমার জন্যও।” থমথমে গলায় জানাল নিশান্ত।

নীরবতা নেমে এসেছিল দুজনের মাঝে। ব্যস্ত সড়কের যানবাহনের শব্দ ও কোলাহল চারিদিকে। সিগন্যালে আটকেছে গাড়িটা। সিগন্যাল ছাড়তেই নিশান্ত পুনরায় বলল,
“বললে না তো।”
“কী?”
“আমাকে কেন জংলী মনে হয়? কী ওয়াইল্ডনেস দেখলে আমার মাঝে?”
“কিছু হলেই শিকারীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হুংকার ছাড়েন। কথায় কথায় চড় মারার হুমকি দেন। সজারুর মতো খোঁচা মারা তো আপনার প্রিয় স্বভাব। ধূর্ত ঈগলের মতো চোখে চেয়ে থাকেন। কণ্ঠ তো সিংহের গর্জনের মতোই। এসব জংলীপনা নয়?”

নিশান্ত উত্তর শুনে কৌতুকবোধ করল। বাঁকা একটা চাহনি দিয়েও দৃষ্টি সোজা করে ফেলল। রয়েসয়ে বলল,
“নিশান্তের রিয়েল ওয়াইল্ডনেস দেখার সৌভাগ্য শুধু তার শিকারদের হয়েছে। তুমিই বোধহয় একমাত্র শিকার হতে চলেছো যে নির্মমতা সয়েও টিকে থাকবে।”
“তার মানে?” মেহযাবীন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দুর্বোধ্য মুখটার দিকে।
“পথ শেষ। পার্লার এসে গেছি। এটি একটি অসফল আলোচনা ছিল। বাকি অভিযোগ তোলা থাক। পরেও শোনা যাবে। তোমাদের কাজ শেষ হলে জানাবে। এসে নিয়ে যাব। একা বের হবে না কেউ।”
মেহযাবীন ত্যক্ত মনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “হুকুম করছেন?”
নিশান্ত চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলল। গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল, “ইয়েস। ইটস এন অর্ডার।”

চলবে…
অসময়ের পোস্ট। সাড়া দেওয়ার আর্জি রইল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here