প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩৫-বর্ধিতাংশ] প্রভা আফরিন

0
574

#প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩৫-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন

দুপুরের পর থেকেই থেমে থেমে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টি চোখে লাগলেও গায়ে না লাগার মতোই। গম্ভীর আকাশ দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টিরানি স্বচ্ছ আকাশ হতে ধুলো জড়ানো ভূমিতে নেমে আসতে একটু সাজগোজ করে নিচ্ছেন। আগে দাস-দাসীদের পাঠাচ্ছেন ধূলোদের উড়বার স্পর্ধা স্তিমিত করতে। এরপর তিনি স্বচ্ছ জলের জুতো পায়ে বিশাল সৈন্যসামন্ত নিয়ে নেমে আসবেন। হেমন্তে এমন বৃষ্টিকে বলে শীত নামানো বৃষ্টি। এই বৃষ্টি তার বান্ধবী শীতকে নিমন্ত্রণ করে উত্তরের হিমালয়ের হিম রাজ্য থেকে উড়িয়ে আনে। বান্ধবীর নিমন্ত্রণ রক্ষায় শীতকাল দুই থেকে আড়াই মাস বেড়িয়ে এরপর আবার ঋতুরাজ বসন্ত দ্বারা নির্বাসিত হয়।

আহত যুবকটির কাছে এই মুহূর্তে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিকে ঝামেলা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ, তারওপর অসহ্য যন্ত্রণায় শরীর বিষিয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ ক্ষতের ব্যথায় ঘাই লেগে যেন আত্মা খাঁচা ছাড়া হওয়ার যোগাড় হয়। বু’লেটের ধার এত ভয়ংকর হয় সেটা অ’স্ত্র চালানোর আগেও জানা ছিল না। যাইহোক, জীবনে সবকিছুর স্বাদ নেওয়া উচিত। ভেবে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো সে। তার হাত-পা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। শরীর জুড়ে অবসাদ ও দুর্বলতা। ডাক্তার বলেছে রক্ত দেওয়া লাগবে। কম রক্তক্ষরণ তো হলো না! দুটো রাত ঠিকমতো খাওয়া-ঘুম কিছুই নেই। সিগারেটের ফিল্টারে একটা দুটো সুখটান দেওয়া ছাড়া আর কিছুই স্পর্শ করার উপায় নেই। আগে এই হারামজাদা যন্ত্রণার চিকিৎসা দরকার। ডাক্তার একগাদা ওষুধ দিয়েছে। সেই বড়িগুলো খেতে গেলে ওর অন্য একটা বড়ির কথা মনে পড়ে। যা খেলে নিজেকে অন্য এক দুনিয়ার বলশালী মানুষ মনে হয়। অবস্থার একটু উন্নতি হোক। এরপর সেই লাল বড়ি খেয়ে পুনরায় মন মেজাজ চাঙ্গা করে নেবে। জীবনে এত সমস্যা কই থেকে এলো! শাওন! হ্যাঁ, সব সমস্যার মূলে ওই আজাদ বাড়ির শাওন। শালি তার শান্তি কেড়ে নিয়ে এখন স্বামীর বুকে আদর খেতে ব্যস্ত! আজকে তো বউভাত। এলাহি আয়োজন। নেতা, আমলা থেকে শুরু করে এলাকার কুকুর, বিড়ালের পেটও ভরবে। এদিকে তার মুখে রুচি নেই। নর্দমা থেকে এক খাবলা দুর্গন্ধযুক্ত কাদামাটি খেলে যেই স্বাদ, বিরিয়ানি খেলেও একই স্বাদ মনে হবে। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো এভাবে অকেজো হয়ে যাচ্ছে! নাহ, এবার একটু যত্ন প্রয়োজন।

কাঁধের ব্যথাটা আবারো আত্মা কাঁপিয়ে চিনচিন করে উঠল। কি বু’লেট রে ভাই! সুযোগ পেলে একটা বু’লেট ওই জানো’য়ার আর্মির বুকে ঠুকবে। বেরিয়ে যাবে হিরোগিরি। শালা ইদানীং শিল্পপতির সুন্দরী মেয়েটার আশেপাশে ঘুরত। দুপুরে নাকি ঘোষণা দিয়ে আংটিবদল করে ফেলেছে। একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত! এবার খেলা জমবে, হা হা!

রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দ মাথা ধরিয়ে দিলো। বুড়ো রিকশাওয়ালা চিৎকার করে বলল, “এই মিয়াঁ, মরবার শখ জাগছে? রাস্তার সাইডে হাঁটেন।”

সে মেজাজ সামলে সরে দাঁড়াল। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে রক্তের খোঁজ করেছিল। ওই শালাদের ওপরও ভরসা নেই। রক্তে ভেজাল দিতে পারে। ভেজালের দুনিয়ায় যেখানে নিজের চরিত্রও ভেজালে দূষিত, সেখানে অন্য কিছু পরিশুদ্ধ পাওয়া বিলাসিতা। এরপরেও খোঁজ লাগিয়ে একজন দাতা পাওয়া গেছে। আজ ব্লাড দিতে আসবে।একটা সিগারেট ধরিয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল। বু’লেটের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াও ঝুকিপূর্ণ। কে কখন সন্দেহ করে পুলিশে খবর দিয়ে বসে! একটা চ্যাংড়া ডাক্তারকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা গেছে বলে রক্ষা। টাকার ঘ্রাণের চেয়ে মারাত্মক নেশা দুটি নেই। ফকির থেকে আমির, সভ্য থেকে অসভ্য সবাই টাকার নেশায় বুদ। আর সে একটু গাঁ’জা টানলেই নেশারুর উপাধি পায়! পৃথিবীর ওপর বিরক্তি উগরে খ্যাক করে একদলা থুতু ফেলল পথে।

পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখল। তিনটে বাজে। বৃষ্টিটা আবারো জ্বালাচ্ছে। এবার ক্লিনিকে ঢুকে যেতে হবে। জ্বলন্ত সিগারেটটা ফেলে সে ক্লিনিকে ঢুকল। ডাক্তারের চেম্বার খুঁজে বের করল। ডাক্তার জানাল ব্লাড ডোনার কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে। সে ক্লান্তিতে সারিবদ্ধ ওয়েটিং সিটে বসে পড়ল। নির্ঘুম দেহে আরামের পরশ একটু ঝিমুনিভাব এনে দিয়েছিল। হঠাৎ পেছন থেকে মাথায় পিস্তল ধরে একটি দরাজ স্বর বলে উঠল, “কট ইউ, মাই ডিয়ারেস্ট আমিন! লুকোচুরিটা তুমি ভালোই পারো দেখছি। নাও ইটস মাই টার্ন।”
আমিন ঘাড় ঘুরিয়ে একজন শিকারির আগ্রাসী দৃষ্টি দেখতে পেল।
_______________

সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ। দীপশিখার আলো জ্বলে উঠেছে। বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ের আয়োজন উপলক্ষে দীপশিখা যেন সত্যিকার অর্থেই একটি প্রদীপ রূপে সেজেছে সপ্তাহখানিক ধরে। চারিদিক তলিয়ে যখন আঁধার নামে, প্রকৃতি আলোহীনতায় তরপায়, শহরের বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্রান্ত দীপশিখা মহল তখন রাতের বুকে মিটমিট করে জ্বলা প্রদীপ হয়ে শোভা পায়।

তার উলটো দিককার সাদা মার্বেল পাথর খচিত হোয়াইট হাউজ আজ অন্ধকারে ঠাসা। বাড়ির মালকিন সুলেখা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একজন মানুষ বলেই সাদা বাড়িটাও রঙিন হয়ে থাকে সর্বদা। আজ সুলেখার মনে অসময়ে আষারে মেঘ জমেছে। অভিমানী বালিকার মতোন গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। উনার এই অভিমানকে সম্মান জানাতেই হোয়াইট হাউজ আজ স্বল্প আলোয় শোক পালন করছে।

একটি পরিবারের সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে মিলেমিশে থেকেছে, প্রতিটি মানুষের কাছে আলাদা আলাদা রকমের আদর, শাসন পেয়েছে বলেই বাড়ির একমাত্র নিরীহ সদস্য টফি তার মালকিনের মনোব্যথা বেশ বুঝতে পারছে। সুলেখা আগেও খেয়াল করেছেন টফি অন্যের মন খারাপ হওয়াটা সহজেই অনুমান করতে পারে। এরপর মমতায়ীর মতো পাশে বসে লেজ নেড়ে, গা ঘষে আদর প্রকাশ করে। কেউ কাঁদলে জড়িয়ে ধরতে হয়, পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিতে হয়, এই বিষয়টাও শখ করে দিলশান শিখিয়েছে। বাধ্য ছাত্রের মতো ধবধবে সাদা রঙের ও ধবধবে মনের টফি তা রপ্ত করেছে বলেই এখন সে সুলেখার গায়ে সামনের এক পা তুলে দিয়ে, জিভ বের করে চেয়ে আছে। মাঝে মাঝে মিহি সুরে একটু আওয়াজও দিচ্ছে মনোযোগ পেতে। সুলেখা এই অবলাকে শ্রোতা বানিয়ে বলে চলেছেন,
“আমার কোনো দাম নেই এই সংসারে। আমি বনবাসে চলে যাব, টফি। তুই আমার সঙ্গে যাবি?”

টফি কুই কুই করে ফিরতি কিছু বলল। সেই অনাবিষ্কৃত বর্ণমালার শব্দ শুনে সুলেখা আপ্লুত হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “একটা কুকুরও আমাকে বোঝে। স্বামী, সন্তান বুঝল না। খাঁটি সোনা চিনল না।”

দিলশান কপাল কুচকে বলল, “তুমি আবার শুরু করলে, মা?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, শুরু তো আমিই করি। তোরা আছিস না শেষ করতে! আমার আর কী। তোদের সাতেও আমি নেই, পাঁচেও নেই। এই সংসার এখন থেকে তোরাই সামলাবি।”

দিলশান হতাশ শ্বাস ফেলল। শাওনের বিয়ে খেয়ে এসে উনারও শখ হয়েছে পুত্রবধূ আনবেন। দিলশানকে সে কথা বলা মাত্রই একবাক্যে নাকচ করে বলেছে তার আরেকটু সময় প্রয়োজন। সে পর্যন্ত ব্যাপারটা মা-ছেলের সমঝোতার মাঝে আবদ্ধ ছিল। মাঝখান দিয়ে দস্তগীর সাহেব ঘোষণা দিলেন পাত্রী দিলশান পছন্দ করলে ঠিক আছে, কিন্তু সুলেখার পছন্দে বউ আনা যাবে না। শেষে দেখা যাবে বাড়িতে আরেকটা কার্টুন ক্যারেক্টার চলে আসবে। এরপর থেকে সুলেখা আধুনিক প্রজন্মের ভাষায় যাকে বলে সেন্টি খাওয়া মুড, সেই মুডে চলে গেছেন। এই সেন্টিমুড শব্দটাও তিনি নতুন শিখেছেন শোভার কাছ থেকে।

দিলশান শাওনের গায়ে হলুদের প্রোগ্রামে গেলেও পরের প্রোগ্রামগুলোতে আর যেতে পারেনি। তার ডিউটি পড়ে গেছিল। তাছাড়া মনে মনে সে হয়তো এড়াতেও চাইছিল। গায়ে হলুদের ভয়ংকর রাতটা তার এখনো হজম হচ্ছে না। নিজেকে কেমন অসহায় পুরুষ মনে হচ্ছে। একটা মেয়ে ঝড়ের গতিতে এসে ওর বুকের ভেতর প্লাবন বইয়ে দিয়ে গেছে। সেই প্লাবনে ওর সর্বস্ব বিলীন হওয়ার পথে। এর মাঝে বিয়ের কথায় তার বদহজম হওয়ার জোগাড়। দিলশান তিক্ত মুখে বাড়ি থেকে বের হলো। টফি ছুটে পিছু নিল। তার সন্ধ্যার আদর পাওনা রয়ে গেছে।

দিলশান গেইটের বাইরে এসে দেখল আজাদ বাড়ির ভেতরে গাড়ি ঢুকছে। বউভাতের প্রোগ্রাম শেষ করেই বোধহয় সকলে ফিরছে। দুটো গাড়ি বাইরে থামল। এগুলো ভাড়া করা। পথ থেকেই বিদায় দেবে বলে সকলে নেমে পড়ল। শেষ গাড়িটার প্যাসেঞ্জার সিট থেকে শোভা নামল। আজ তার সাজ স্বভাবসুলভ। ওয়েস্টার্ন পরেছে। অঙ্গভঙ্গিতে পাত্তা না দেওয়া, গা ছাড়া ভাব। দিলশানের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে ব্যাগ থেকে কালো গগলস বের করে চোখে পরল। গলা উঁচিয়ে ডাকল, “মিষ্টি! এই তেতোমুখো মিষ্টি!”

মিষ্টির চোখেমুখে মন ভাঙার ছাপ প্রবল। দুপুরের ঘটনাটা এখনো ওর চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ঘুরেফিরে আসছে। যখন নিশান্ত আংটি পরিয়ে যাবীনের হাতের পিঠে ঠোঁট ছোয়াল। মিষ্টি স্তব্ধ চোখে দেখল তার ক্রাশ কিনা অন্যের উড বি হয়ে গেল! আঠারো বছরের রঙিন জীবনে সুদর্শনা মিষ্টির তুলতুলে মনটা গোপনে আহত হয়ে গেল। ও মুখ ভার করে শোভার সামনে এসে বলল, “ডাকছিস কেন?”

শোভা অন্ধের মতো ওপরে চোখে তুলে, দুই হাত সামনের দিকে দিয়ে বলল,
“আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি না। আমাকে একটু ধরে ধরে বাড়িতে নিয়ে যা।”

ঘটনা বুঝতে মিষ্টির সময় লাগল না। রোডের বিপরীত পার্শ্বে দিলশান তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে শোভার নাটক দেখছে। মিষ্টি এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো সে একা না, শোভাও মনের মানুষ পায়নি। যাক সমব্যথী পেলে মন হালকা হয়। মিষ্টিও নাটকের অংশ হয়ে শোভার হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। যেতে যেতে শোভা গলা উঁচিয়ে বলল, “জীবনটা পুরাই আন্ধার হয়ে গেছে। একটা হারিকেন খোঁজ রে, মিষ্টি। হারিকেন ছাড়া আমার আন্ধার দূর করার উপায় নেই।”

“হারিকেন কই পাব?” মিষ্টি অবাক গলায় বলল।

“আরে ওটা আক্ষরিক অর্থ, বোকা। হারিকেন মানে একটা দুলাভাই খোঁজ। দুইদিনের দুনিয়া, আজ আছি কাল নেই। একটা বিয়ে করেই মরি। দিল্লিকা লাড্ডু খেয়েই পস্তাই। আমার কপালে তো আর মতিচুর নেই। রুচিও নেই।”

শোভা ভেতরে চলে গেল। দিলশান ক্রুদ্ধ মেজাজে চেয়ে রইল ওর গমনপথে। বিড়বিড় করল, “রুচি নেই বলেই যতদূর গিয়েছো তুমি! রুচি থাকলে আর চরিত্র রক্ষা হতো না। ড্রামাবাজ!”
_______________

একটা চুমু! বউভাতের হলজুড়ে আজ তরুণ তরুণীদের আলোচনার মুখরোচক উপাদান ছিল নিশান্তের চুমু। হাজার হাজার মানুষের সামনে, পরিবারের সামনে বাগদত্তাকে চুমু খাওয়া যে সে কথা নয়। তার জন্য স্পর্ধা লাগে, বেপরোয়া বুকের পাটা লাগে। নিশান্ত সেই স্পর্ধা দেখিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে। ফলে আংটি পরানোর পর নিশান্ত চলে গেলেও বাকিটা সময় মেহযাবীন অস্বস্তিতে বুদ হয়ে ছিল৷ তার দিকে চেয়ে সকলের চাপা হাসিটা বেশ বিব্রত করছিল। এক একজন চুমু বিশারদ এসে জিজ্ঞেস করেছে, কতদিনের প্রেম, কীভাবে প্রেমটা হলো? প্রেম ছাড়া কেউ এত যত্ন নিয়ে চুমু খায় নাকি! মেহযাবীন শুধু এড়িয়ে গেছে। বিয়ে করার অধিকারেই যে সেই অশ্লেষ চুমুটা তাকে গৌরবের সঙ্গে দিয়েছে, সেটা আর বলা যায় না।
রাত্রি রহস্যে বিভোর। সকল ব্যস্ততার অবসানে বাড়িটাও ক্লান্ত। মেহযাবীন তখন ঝড় তুলেছে ক্যানভাসে। ব্যক্তি জীবন যেমনই হোক, তার একটি শিল্পী মন আছে। সেই অবাধ্য মনের প্ররোচনায় এই মাঝরাতে বসে সে রঙ তুলি নিয়ে বসেছে। তার মাথায় এখন কয়েকটি উপাদান ঘুরছে। একটি হেমন্তের ভোর, শুভ্র শিশির ও একটি চুমু।

হঠাৎ ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। বেশ কিছুদিন বাদে ইনবক্সে একটি ম্যাসেজ এসেছে।
“কংগ্রাচুলেশনস! ভাইয়ের রিসেপশন পার্টিতে অ্যাঙ্গেজমেন্টটা সেরেই ফেললে!”

মেহযাবীন রিপ্লাই দিলো না। তার কথা বলতে ভালো লাগছে না। সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ক্যানভাসে দিয়ে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করল। এরপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে ছোটো করে রিপ্লাই দিলো, “থ্যাংকস!”

রিপ্লাই এলো সঙ্গে সঙ্গে, “নিশ্চয়ই রিলেশনশিপে ছিলে! তোমার মতো সুন্দরী কেউ সিঙ্গেল থাকবে তা আশাই করা যায় না।”

মেহযাবীন বিরক্ত হলো। সকলের মতো সেই এক কথা! টাইপ করল, “থ্যাংকস ফর দি কমপ্লিমেন্ট! তবে সুন্দরীরা সিঙ্গেল থাকবে না এমন কোনো লিখিত নিয়ম আছে বলে মনে হয় না। আমি কোনো রিলেশনশিপে ছিলাম না। যা হচ্ছে সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবেই হচ্ছে।”

“ইস! তোমার মতো গুণী, সম্ভাবনাময় একটি সম্পদকে এত জলদি বিয়ের বাঁধনে বেঁধে ফেলছে তোমার পরিবার! এটা কাম্য ছিল না। তোমার অনেকটা দূর যাওয়া বাকি। অনেক কিছু অর্জন করা বাকি।”

মেহযাবীন ম্যাসেজটা দেখে মন খারাপ করল। মনে হলো সত্যিই সে কোনো বাঁধনে আটকা পড়ে যাচ্ছে। নিশান্ত কি ওর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে! মেহযাবীন নিজের অনিশ্চয়তা প্রকাশ না করে পরিবারের সাফাই গাইতেই বলল, “আংটি বদল মানেই তো বিয়ে নয়। আমিও কোনো বাঁধনে বন্দি নই। আমার অনেকটা দূর যাওয়া বাকি। অর্জন করা বাকি। আমি সেসব করবই।”

“দ্যটস দ্য স্পিরিট। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি। তুমি একদিন নিজের জৌলুশে শাইন করবেই। কারো সাহায্য ছাড়া, কারো অবদান ছাড়া।”

মেহযাবীন আর রিপ্লাই দিলো না।

সকাল নয়টা বাজে। আজ বাড়ির সকলেই ঘুম থেকে উঠেছে দেরি করে। আলস্যে গা ম্যাজম্যাজ করছে। আগামীকাল জাওয়াদের জার্মানির উদ্দেশ্যে ফ্লাইট। বিজনেস ট্যুরকে হানিমুন ট্যুরে রূপান্তর করতে শাওনও সঙ্গী হচ্ছে। খাবার টেবিলে আপাতত ওদের ট্যুর নিয়েই টুকটাক আলোচনা হচ্ছিল। হঠাৎই জাওয়াদের কাছে একটি ফোন এলো। রিসিভ করে কিছু একটা শুনে ও উত্তেজিত হয়ে পড়ল। হলরুমের বিশাল টিভি সেটটা চালু করতেই নিউজ চ্যানেলের হেডলাইনে সকলের চোখ আটকে গেল।

প্রতিরক্ষা অধিদপ্তরের সুপার স্পেশালাইজড টিম গতকাল মধ্যরাতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একটি অপারেশন চালায়। প্রতিপক্ষের হামলায় একজন সেনা সদস্য নিহত ও তিনজন গুরুতর আহত হয়েছে। হেলিকপ্টারের সাহায্যে তাদের চট্টগ্রাম সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী আহত তিন জনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here