আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে #পর্ব_৩৪ #লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
421

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৪
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ধীরপায়ে হেঁটে সুজানা অভিকের পিছু পিছু গেল। লোকটা থলে দুটো নিয়ে ওদিকে কোথায় চলে যাচ্ছে। সুজানাকে জ্বালানাের জন্য যেখানে সেখানে হাজির হবে।

সুজানা বেশ কিছুদূর গিয়ে তাকে ডেকে থামাতে চাইলো। কি বলে ডাক দেবে বুঝে পেল না। তাই কিছু ডাকলো না। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল অভিকের কাছে। অভিক ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে বলল

আপনি মাছ কিনতে পারেন?

পারব না কেন?

ওহ হ্যা আপনি তো সবই পারেন। কি পারেন না সেটা বলেন।

সুজানা কপাল ভাঁজ করে বলল

আমার থলে দিন। ওটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

মাছের বাজারে যাচ্ছি।

কেন?

মাছের বাজারে মানুষ ঘুমাতে যায়?

সুজানার কপালে আরও ভাঁজ পড়লো। থলে কেড়ে নিতে চেয়ে বলল

দেরী হলে আম্মা বকবে। আপনি আপনার বাজার করুন। আমাকে আমার থলে দিন।

অভিক থলেটা বাড়িয়ে দিল। সুজানা থলে নিয়ে উল্টোপথে পা বাড়ালো। অভিক হেসে ডাক দিল। বলল,

থলে বদল হয়ে গিয়েছে সু-জা-না।

সুজানা চট করে ফিরে চাইলো। নিজের হাতের থলেটা দেখে বলল,

আপনি সবসময় এমন করেন কেন?

অভিক হাসলো আবারও। বলল

আপনি আমাকে ফেলে যাচ্ছেন কেন? ওটা তো ভুলই, ওই ভুল করতে গিয়ে থলে বদলের মতো ভুল করে ফেলেছেন।

আমার থলে দিন।

আমার থলে দিলেই দেব।

সুজানা ওর কাছাকাছি গিয়ে থলেটা বাড়িয়ে দিল। বলল

আমার থলে।

অভিক ওর হাত থেকে চট করে থলেটা কেড়ে নিয়ে বলল

সবাই দেখছে। চুপচাপ আমার সাথে চলুন। আপনাকে মাছ কেনা শেখাবো। ফিউচারে কাজে লাগতে পারে।

সুজানা বলে উঠলো

অ্যাহ আমি মাছ কিনতে জানি।

তাই নাকি? তাহলে তো আরও ভালো। আপনি আমাকে শেখাবেন। শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়ার দায়িত্ব তো আপনার।

সুজানা বিড়বিড়িয়ে বলল

কচু।

অভিক শুনে বলল

পটিয়ার মেয়েদের এই এক স্বভাব। কথায় কথায় কচু।

সুজানা বলল

থলেটা কি দেবেন?

আপনি কি আমার সাথে যাবেন? আসুন। আর বলব না কিন্তু।

অভিকের পিছু পিছু গেল সুজানা। মাছের বাজার আগের চাইতে খানিকটা হালকা হয়েছে। দুজনেই মাক্স টেনে নামালো নাকে। এত হৈ হৈ আওয়াজে মাথা ধরে যাচ্ছে সুজানার। অভিক ঘাড় ঘুরিয়ে সুজানাকে আরেকবার দেখে নিল। চার পাঁচ দোকান দেখার পর বড় লাল লাল নাইলোটিকা মাছ দেখার পর অভিক বলল

ওগুলো কিনব। আসুন।

সুজানা তার পিছু পিছু গেল। অভিক মাছগুলো নেড়েচেড়ে নিতে গেল। সুজানা বলল

ওগুলো তো মরা মাছ। এত তাজা মাছ থাকতে এগুলো কেন নিচ্ছেন?

মা এসব পছন্দ করে।

তাই বলে মরা মাছ?

মাক্স থাকায় সুজানার হাসি দেখা গেল না। তবে চোখদুটো তো হাসলো। অভিক মুখ গোমড়া করলো। সুজানা বলল

আমি কিছু জানিনা। আপনার ইচ্ছে । পাশের রুইমাছগুলো দেখতে পারেন। ওগুলো ঠিক আছে।

দোকানদার বলল

ভাবি ভাইজান ভালা মাছ পছন্দ করছে। এক্কেবারে খাঁটি। লইয়্যা যান। ঠকবেন না।

অভিক নিচু হয়ে পাশের রুইমাছ গুলো দেখতে দেখতে বলল

এখান থেকে দু কেজি দিন। ভালো হলে পরের বার থেকে আপনার কাছ থেকেই মাছ কিনবো। মাছ না চিনলেও খাঁটি মানুষ আমি চিনি।

দোকানদার ফোকলা হেসে দাঁড়িপাল্লা হাতে নিল। বলল

ভাইজান দেখি ভাবির কথার পাত্তা দেয়। আমারও আমার বেডির কথামতো চলতে হয়। নাইলে তো আমার ভাত আমি খাইতে পারুম না।

অভিক হেসে ফেলল।

হোয়াট ইজ বেডি টেডি? ভালোবেসে বেডি ডাকেন নাকি?

সুজানা খলখলিয়ে করে হেসে উঠলো। সাথে অভিকও। দোকানদার তাদের চাইতেও জোরে হেসে উঠলো।

____________________

মাছ কেনা শেষে ওরা দু’জন বেরিয়ে এল। সুজানা বলল

আপনি দু থলেতে মাছ নিয়েছেন কেন? আম্মা সামুদ্রিক মাছ খেতে পছন্দ করে।

দাদু আর জেম্মাও সামুদ্রিক মাছ খায়। কেনা যায়।

আম্মা জানতে চাইবে সবটা।

আমি বলে দেব। আপনার আম্মার সাথে আমর ভাবসাব একটু বেশিই।

সুজানা ভুরু কুঁঞ্চন করে বলল

কিভাবে?

খবরদার! ওখানে পঁচা নাকটা গলাতে যাবেন না। ওটা আমার আর উনার ব্যাপার।

সুজানা মৃদু হাসলো। মাছের দোকান দেখতে দেখতে বলল

ওই-দূরে তাজা লইট্যা মাছ দেখা যাচ্ছে। ওগুলো ভালো হবে।

অভিক সেইদিকে চোখ তাক করে বলল

পটিয়ার মেয়ে শেষমেশ লটিয়া খুঁজে পেল। সাবাশ পটিয়া!

সুজানা নাকফুলিয়ে তাকালো কিন্তু সেসব দেখে কে? সে তো সুজানাকে একটু পঁচাতে পারলেই হলো।

অভিক মাছ কিনে নিয়ে এল। থলের মুখ খুলে সুজানাকে দেখিয়ে বলল,

দু থলেতে দুইকেজি নিয়েছি।

আম্মা ফ্রিজে রেখে খেতে পছন্দ করেনা। আধাকেজি তিনজনের জন্য যথেষ্ট।

না না পটিয়ার মেয়েদের লটিয়া বেশি বেশি করে খেতে হবে।

সুজানা থলে দুটো কেড়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল

ধ্যাত।

অভিক ডেকে বলল

সুজানা আপনি যান। আমি এখনি আসছি।

সুজানা ঘাড় ফিরিয়ে বলল

কেন? কোথায় যাচ্ছেন?

মাছওয়ালাকে একটা থ্যাংকস দেয়া হয়নি। উনাকে কি বলব উনার ভাবিজানও উনাকে একটা থ্যাংকস দিয়েছে?

সুজানা আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না। লজ্জা তো দেয় তারউপর ফাইজলামি!

____________

অভিক ফিরে এসে দেখলো সুজানা দু-থলের ভর্তি করে ফেলেছে। মাছের টোকলা গুলো কাঁচা তরকারির উপর রেখে পিছু ফিরতেই অভিককে দেখলো। অভিক বলল

কি হচ্ছে এসব?

কিছু হচ্ছে না।

অভিক থলে দেখে বলল,

শোধ করে দেয়া হচ্ছে?

আপনিও কিছুর শোধ দিয়েছেন?

সেটা কেন হবে? আমি কিনে দিতে পারি না?

আমিও তো পারি।

আপনি কামাই করেন না।

সুজানা তাকাতেই অভিক হাসলো।

ওহ সরি আপনিও তো কামাই করেন।

হুম। কম হোক। করি তো। আপনার মাছ কিনে দেয়ার সামর্থ্য থাকলে আমার সবজি কিনে দেয়ার সামর্থ্য আছে।

অভিক মাথা দুলিয়ে বলল

তথাস্তু।

সুজানা হাসলো। অভিক বলল

মাছওয়ালা বলেছে…

সুজানা দ্রুত পা বাড়িয়ে বলল

আমি শুনতে চাই না।

অভিক তার পেছন পেছন পা বাড়িয়ে বলল

না না শুনতে হবে।

না, আমি শুনব না।

না শোনা জরুরি সু–জা–না।

তন্মধ্যে অভিকের ফোন বেজে উঠলো। সে ফোন তুলে বলল

আপনার আম্মা ফোন করেছে।

সুজানা থমকে দাঁড়ালো। অভিক কানে ফোন ধরতেই সাজিয়া বেগম ওপাশ থেকে বললেন

হ্যালো আমি সুজানার আম্মা বলছি।

হ্যা চিনতে পেরেছি। নাম্বার তো সেভ করেই রেখেছি।

আজ তো বাজার। তুমি বাজারে যাওনি? তুমি ষোলশহরে থাকো না?

আমি ষোলশহরেই থাকি। সরিষাবাড়ি সেখানকার রাজধানী।

সুজানা চোখ পাকিয়ে চাইলো। সাজিয়া বেগম ওপাশে হেসে উঠে বললেন

পাজি ছেলে।

অভিক হাসলো।

তুমি কি আজ বাজারে যাওনি বাবা?

অলরেডি।

বলছিলাম যে সুজানাও তো বাজারে গেল। তুমি যদি একটু দেখতে। অন্য দিন ফোন থাকে তাই চিন্তা হয় না। আজ তো ফোনও নিয়ে যায়নি। তারউপর দেরী হচ্ছে।

সুজানা তো আমার পাশেই আছে।

যাহ মজা করে না। টেনশন হচ্ছে তাই তোমাকে ফোন করলাম।

আরেহ মজা করব কেন? সুজানার সাথে কথা বলুন।

সুজানার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিতেই সুজানা ফোনটা কানে দিল।

হ্যালো আম্মা আমি পৌঁছে যাব কিছুক্ষণের মধ্যে।

আল্লাহ কি টেনশন হচ্ছিল আমার। তোর বন্ধুটার নাম ও তো জানা হলো না। কি নাম যেন? খুব ভালো ছেলে।

অভিক চট করে ফোন কেড়ে নিল। মিউট করে বলল

একটা নাম বলেন। সত্যিটা বলা যাবে না। কুইক। কি নাম বলব?

সুজানা মজা করে বলল

করিম।

অভিক আনমিউট করে বলল

আমার নাম করিম। করিম বলে ডাকবেন।

বলা শেষে সুজানার দিকে চোখ লাল করে তাকালো। সুজানা খিকখিক হেসে উঠলো।

সাজিয়া বেগম ওপাশ থেকে বললেন

অনেক সুন্দর নাম। করিমুউল্লাহ আমার আব্বার নাম।

সুজানা ফিক করে হেসে বলল

স্যার থেকে ডিরেক্ট নানাজান! বাহ বাহ!

অভিক গালফুলিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। বলল,

অভিক করিম হলে সুজানা জরিনা।

অতঃপর দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো।

______________

বাজার শেষ করে গাড়িতে চলে এল তারা। সুজানাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অভিক বলল

আপনি কিছু খাবেন?

না সোজা বাসায় যাব।

ঠান্ডা?

না। মাছ ধরেছি। হাতে গন্ধ।

ওকে।

অভিক গাড়ি ছেড়ে দিল। পনের মিনিটের পথ ফুরিয়ে গেল এক নিমেষেই। সেই পনের মিনিটে তাদের মধ্যে পনের দু গুনে ত্রিশ মিনিটের গল্প সেড়ে ফেলা হয়েছে। তাদের গল্পগুলোতে ভালোবাসারা থাকে না কভু।
কিন্তু ভালোবাসা মানেই তো কথা বলতে বলতে হেসে উঠা। একে অপরের হাসিমাখা মুখ আড়ালে পরখ করে না দেখার ভান ধরা।

সরিষাবাড়ির সামনেই সুজানা নেমে গেল। থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল

আসি। আপনি গাড়িটা ধুঁয়ে নেবেন। মাছের পানি পড়েছে মনে হচ্ছে।

ঠিক আছে। ওহ আরেকটা কথা, মাছওয়ালা কি বলেছে শুনবেন না?

সুজানা বলল

ইনননা।

সে চলে যেতে উদ্যত হতেই অভিক ডেকে বলল

সু-জা-না।

সুজানা ফিরে তাকালো। অভিক গাড়ির জানালায় হাত ঠেকিয়ে ভাবুক হয়ে বলল

সুজানা আপনার পাঁচ টাকার পাশে আমার পঞ্চাশ টাকার জায়গা হলে বাজারে ক্রেতা ঘাটতি পূরণ হবে। আপনি নাইলেটিকাকে টা টা বলে দিন। লটিয়া মাছ আর রুইমাছ ভালো বন্ধু হতে পারে।

সুজানা হাসলো। আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে মিলিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিল।

হোক।

_____________________

অভিককে থলেভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফিরতে দেখে সবাই ছুটে এল। আনিকা বলল

সত্যি সত্যি বাজার এনেছিস? এত কি এনেছিস?

অনেককিছু।

সালমা বেগম খুশি হলেন। শাড়ির আঁচল টেনে ছেলের কপাল মুছে দিয়ে বললেন

ওমা এটুকুত ঘেমে গিয়েছিস অভি। এগুলো তো কোনো কষ্ট না বাবা।

অভিক বলল

কখন বলেছি কষ্ট হয়েছে। গরম পড়ছে। ঘেমে যাব না? কি বলো মা?

সালমা বেগম বাজার থলে নিয়ে যেতে চাইলো। অভিক বাঁধা দিয়ে বলল

অনেক ভার। আমি দিয়ে আসছি।

সালমা বেগম ছেলের পিছু পিছু ছুটলেন। মনে মনে আওড়ালেন

সব বাজার যেন ভালো পড়ে। নাকি থলে ভর্তি পঁচা আলু টমেটো নিয়ে এসেছে কে জানে?

অভিক বড় থালায় সব ঢেলেও দিল। বেসিনে হাত ধুঁতে ধুঁতে বলল

সব ঠিকঠাক?

ওমা কি সুন্দর গুছিয়ে বাজার করেছিস অভি? যাক তোর বাবাকে আজ আর বাজার আনতে হবে না। তুই তো সব ভালো ভালো পারিস।

এসব সুজানাই কিনেছে মা।

সালমা বেগম চমকে গেলেন? হা করে তাকিয়ে বলল

সু–জা–না। ওখানেও সুজানা?

অভিক বাচ্চাদের মতো স্বীকার করলো।

হুমমম। সবখানেই সুজানা।

একটা কথা বলতো ওই মেয়ে তোকে জ্বালাচ্ছে? নাকি তুই ওকে জ্বালাচ্ছিস?

অভিক ভেজা হাত মায়ের গালে লাগিয়ে বলল

সেটা বড় কথা নয়। আজ লটিয়া আর রুই একসাথে খাওয়া হবে। সেটাই বড় কথা।

সে দরজার দিকে পা বাড়াতেই সালমা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের ভেজা গাল মুছতে মুছতে বললেন

লইট্যা মাছ বলে অভি। কি লটিয়া লটিয়া বলিস?

অভিক হেসে উঠে বলল

লটিয়া পটিয়ার ভাইরাস মা।

চলবে…….

শুভ বসন্ত পাঠক ❤️❤️
ব্যস্ত মানুষটাকে ক্ষমার চোখে দেখবেন এত অপেক্ষা করানোর জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here