#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_২৯
জাহিন, শারাফ আর রুমা নামের মেয়েটি মুখোমুখি হয়ে বসে আছে জিজ্ঞাসাবাদ রুমে। পুরো কক্ষ জুড়ে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। জাহিন দু হাত বুকের উপর আড়াআড়ি করে রেখে তীক্ষ্ণ চোখে রুমার দিকে তাকিয়ে আছে। রুমা জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে। তার সামনে দুজন সুদর্শন পুরুষ মানুষ বসে আছে আর সে আড় চোখে বার বার দুজনকে দেখে যাচ্ছে। একটা অস্থিরতা কাজ করছে মেয়েটা মাঝে। বার বার হাত কচলাছে, এই ঠান্ডার মাঝেও মনে হচ্ছে যেন ঘামছে, বার বার কপালে, গালে, গলায় হাত রাখছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ভয়ে ভয়ে আছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে চাইছে না ওদের সামনে। শারাফ ওয়াটার বোতলটা রুমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে।
“চাইলে পানি খেতে পারেন।”
রুমা জিহ্বা দ্বারা নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে জড়ানো কন্ঠে বলে, ”না না পানি খাওয়া লাগবে না। কেন ডেকে পাঠিয়েছেন সেটা বলেন?”
জাহিন দু হাত টেবিলের উপরে রেখে একটু এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে, “আপনাকে এই কাজটা করতে কে হায়ার করেছে জানতে পারি?”
রুমা আতকে উঠে বলে, “কি বলছেন আপনি এসব আমি বুঝতে পারছি না।”
জাহিন নিঃশব্দে হেসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে, “না বুঝার মতো তো আমি কিছু বলে নি আপনাকে। আপনি যে নুহাশকে ফাঁসিয়েছেন সেটা তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।”
রুমা থমথমে গলায় বলে, “আমি কাউকে ফাঁসাইনি।”
জাহিন কঠিন গলায় বলে, “অবশ্যই আপনি নুহাশকে ফাঁসিয়েছেন।”
“আমি বলছি তো আমি ফাঁসাইনি।”
জাহিন এবার গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে, “আপনি নুহাশকে ফাঁসিয়েছে আর তার প্রমাণ আমার কাছে আছে।”
জাহিনের চিৎকার শুনে রুমা ঈষৎ কেঁপে উঠে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে, “প্রমাণ! কি… সের কিসের প্রমাণ?”
জাহিন বাঁকা হেসে বলে, “গাড়িতে হিডেন ক্যামেরা লাগানো আছে আর তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আপনি কি করে নুহাশকে ফাঁসিয়েছেন।”
রুমা হতভম্ব হয়ে বলে, “গাড়িতে হিডেন ক্যামেরা লাগানো ছিল কই আমি তো দেখে নি।”
“হিডেন ক্যামেরা নিশ্চয়ই কাউকে দেখানোর জন্য লাগিয়ে রাখবে না। আর এই হিডেন ক্যামেরাতে সবটা ধরা পড়েছে আপনি আচমকাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিলেন। আর এখন ভিডিও ফুটেজটা যদি পাবলিক করি তাহলে বুঝতে পারছেন কেসটা কোন দিকে মোড় নিবে।”
জাহিনের কথাটা শোনার সাথে সাথে মেয়েটা গড়গড় করে বলতে শুরু করে, “বিশ্বাস করুন আমি ওনাকে ফাঁসাতে চাই নি। প্লিজ ভিডিওটা ভাইরাল করবেন না।”
শারাফ হতবাক হয়ে জাহিনের দিকে তাকায়। গাড়িতে ক্যামেরা তো দূরে থাক কোনো হিডেন ক্যামেরার ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু শারাফ জাহিনের প্ল্যানটা বুঝতে পারল। মেয়েটাকে মেনুপুলেট করে পেট থেকে সত্য কথা বের করার প্রচেষ্টা এবং এতে সফলও হয়েছে। জাহিন শারাফকে ইশারা করল কিছু বলার জন্য। শারাফ মাথা নাড়িয়ে রুমার দিকে ফিরে বলল।
“তার মানে আপনি স্বীকার করছেন যে আপনি নুহাশকে ফাঁসিয়েছেন।”
রুমা মেয়েটা এক প্রকার কান্না করতে করতে বলে, “বিশ্বাস করুন আমি বাধ্য হয়ে কাজটা করেছি।”
শারাফ পুনরায় প্রশ্ন করল, “আপনি আগে এটার উত্তর দিন, নুহাশ কি আপনাকে কোনো রকম ভাবে সে*ক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করেছে নাকি করে নি?”
“না ওনি আমাকে সে*ক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করেন নি বরং আমি ওনাকে ফাঁসাতে চেয়েছিলাম।”
“কেন ফাঁসাতে চেয়েছিলেন জানতে পারি আর কার কথায় কাজটা করেছেন?”
রুমা ওয়াটার বোতলের ক্যাপ খুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলতে শুরু করে, “আমার মা অসুস্থ তার চিকিৎসা করানো জন্য অনেক টাকা দরকার….. ।”
জাহিন হাত উঁচিয়ে রুমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “উহু এখন আর মিথ্যা কথা বলবেন না প্লিজ। আপনার মা অনেক আগেই মারা গেছেন। আপনার বিষয়ে সব খবর আমার কাছে আছে। তাই প্লিজ মরে যাওয়া মাকে নিয়ে মিথ্যা কথা না বললেই নয় কি। নিজের গর্ভধারী মাকে অন্তত এই সম্মানটুকু দেন।”
রুমা ঢোক গিলে বলে, “আসলে আমি যাত্রাপালার একটা দলে কাজ করি। আমি দলের ছেলে মেয়েদেরকে মেকাপ করিয়ে দেই। দল থেকে যেই টাকাটা হাতে আসে তা দিয়ে আমার ঠিক চলত না। একদিন হঠাৎ করেই একটা লোক আমাকে এই কাজটা করে দেওয়ার জন্য অফার করে আর বলে মোটা অংকের টাকা দিবে আর আমিও টাকার লোভে পড়ে কাজটা করতে রাজি হয়ে পড়ি।”
জাহিন চুপচাপ মেয়েটার কথা শুনে যাচ্ছে। শারাফ বলল, “তো তারা আপনাকে টাকা দিয়েছে।”
“অর্ধেক টাকা দিয়েছে আর কাজটা পুরোপুরি ভাবে হলে পুরো টাকা দিবে বলেছে।”
“তার মানে তারা এখনও পুরো টাকাটা আপনাকে দেয় নি।”
“না দেয় নি।”
“টাকা কি হাতে হাতে দিয়েছে আপনাকে?”
“হুম হাতে দিয়েছে।”
“যেই লোকটা আপনাকে কাজটা করতে বলেছে তার সাথে আপনার নিশ্চয়ই যোগাযোগ হতো ফোনে সেই ফোন নাম্বারটা দিন।”
শারাফ ফোন নাম্বারটা নিয়ে কল করল কিন্তু এই নাম্বারের কোনো অস্তিত্ব নেই। শারাফ বলল, “নাম্বারের তো কোনো অস্তিত্ব নেই।”
রুমা বলল, ”ওনি আমাকে বিভিন্ন নাম্বার থেকে কল করত।”
”এই পর্যন্ত কয়টা নাম্বার থেকে কল করেছে?”
”পাঁচ ছয়টা তো হবেই।”
প্রত্যেকটা নাম্বারে কল করা হলো কিন্তু সেই একই কথা কোনো অস্তিত্ব নেই নাম্বার গুলার। এর মাঝে জাহিন রুমাকে প্রশ্ন করল, “যে আপনাকে কাজ করতে বলেছে তার চেহারা দেখতে কেমন ছিল?”
“মুখে মাক্স পড়া ছিল তাই ওতটা খেয়াল করি নি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন ভিডিওটা যদি ভাইরাল করে দেন তাহলে সবাই আমাকে অপমান করবে।”
জাহিন কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “আপনার অপমানটা অপমান আর আমাদের অপমানটা অপমান নয়। বুঝতে পারছেন কতটা ফেইস লস হয়েছে এই ফালতু ঘটনাটার জন্য। আর এমনিতেই আপনি ভাইরাল। বলতে গেলে এই ঘটনাটা এখন অনলাইনে হট টপিক হয়ে রয়েছে এখন না হয় আরেকটু ঘি ঠেলে দেই তাতে।”
রুমা চিৎকার করে বল, “আমি তো বলছি আমি লোভে পড়ে কাজটা করেছি।”
“লোভে পড়ে যখন করেছেন এর সমাধানও আপনি করবেন।”
রুমা অবাক হয়ে বলে, “মানে।”
জাহিন পায়ের উপরে পা তুলে বলে, “আপনাকে জবানবন্দী দিতে হবে সেটাও লাইভে গিয়ে। পুরো দেশ দেখবে যে আমার ভাই নির্দোষ তাকে একটা নোংরা এলিগেশনে ফাঁসানো হয়েছে।”
“কিন্তু।”
“দেখুন মিস রুমা এই কাজটা করার আগে আপনার দশ বার ভাবা উচিত ছিল। আপনার এটা ভাবা উচিত ছিল কাজটা করার পর কি হতে পারে কিন্তু আপনি কোনো বিবেচনা না করেই একটা নোংরা খেলায় মেতে উঠলেন তাও একজন অপরিচিত মানুষের কথায়। অবশ্য সে মানুষটা যে আমার শত্রু সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। কারো ক্ষতি করে নিজের ভালো হয় না মিস রুমা।”
রুমা চুপচাপ কথা গুলা শুনে গেল। তার বড্ড ভুল হয়ে গেছে। সে ঝোঁকের বশে কাজটা করে ফেলেছে। তার আগেই বোঝা উচিত ছিল প্রতিপক্ষ দল শক্তিশালী দল। কিন্তু তাকে তো বলা হয়েছিল গাড়িতে কোনো হিডেন ক্যামেরা ছিল না তবে কি জাহিন তাকে মিথ্যে কথার জালে ফাঁসিয়েছে। আর সেও তাতে পা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাকে আগে এই কয়েদি থেকে বের হতে হবে তার জন্য তাকে এদের কাছ থেকে সিমপ্যাথি পেতে হবে। রুমা ধরা গলায় বলে।
”প্লিজ আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিন আমি আর কোনো দিন কারো ক্ষতি করব না।”
শারাফ কঠোর গলায় বলে, “ছেড়ে দেওয়া হবে আপনাকে কিন্তু তার আগে আপনাকে লাইভে গিয়ে সবটা স্বীকার করতে হবে।”
রুমা হঠাৎ করেই উচ্চ বাক্যে বলল, “আমি লাইভে যাব না আর আপনার আমাকে মিথ্যা কথার জালে ফাঁসিয়েছেন তাই না গাড়িতে কোনো হিডেন ক্যামেরা ছিল না তা আমি জানি। তাই ওই নুহাশকেও নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবেন না। আর ফাঁসাতে তো চেয়েছিলাম আপনাকে কিন্তু ফেঁসে গেছে ওই বেচারা নুহাশ।”
শেষের কথাটা জাহিনকে উদ্দেশ্য করে বলে রুমা। জাহিন হতবাক হয়ে বলে, “আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন মানে?”
“হ্যাঁ আপনাকে ফাঁসাতে চেয়েছিলাম।”
জাহিন বিমূর্ত, স্তব্ধ হয়ে গেল কথাটা শুনে। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল আর তাতে নুহাশ ফেঁসে গেছে। জাহিন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “গাড়িতে যে হিডেন ক্যামেরা নেই এটা, এটা কি করে জানেন?”
“যে আমাকে কাজটা করতে বলেছে সেই বলেছিল কিন্তু আমার হটকারীতার জন্য আমি নিজেও ফেঁসে গেলাম। কিন্তু সত্যটা তো শুধু আপনার দুজনে ছাড়া কেউ জানে না আর কেউ জানবেও না।”
জাহিন শব্দ করে হেসে বলে, “এতটাও কাঁচা খেলোয়ার আমি নই এতক্ষণ যা যা আপনি বলেছেন সবটা রের্কড হয়েছে এই কলমটার মাঝে। এই কলমটাে মাঝে হিডেন ক্যামেরা লাগানো আছে।”
বুক পকেটে থাকা কলমটা দেখিয়ে কথাটা বলে। জাহিন পুনরায় বলে, “তাই আপনার লাইভে যাওয়ার কোনো দরকার নেই আপনার এই সবটা স্বীকারোক্তি সবাই দেখবে আর এটাও জানবে নুহাশ কোনো দোষ করে নি ওকে ফাঁসানো হয়েছে।”
রুমাকে এরেস্ট করা হয়েছে নুহাশকে মিথ্যে এলিগেশন দিয়ে ফাঁসানোর জন্য। নিউজের মাধ্যমে সবটা সবার সামনে এসেছে। নুহাশ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু জাহিনের মাথায় ভর করল অন্য দুশ্চিন্তা তার আপনজনের মাঝেই কেউ একজন আছে যে এই ঘৃণ্য কাজটার সাথে জড়িত কিন্তু কে সে? এতো আপনজনের ভীড়ের মাঝে তাকে কি করে খুঁজে বের করবে?
_______
বত্রিশ ইঞ্চি এলইডি টিভির পর্দায় নুহাশ যে নির্দোষ সেই খবরই পাঠ করছেন সংবাদ পাঠিকা। রুমার স্বীকারোক্তিটা শোনার সাথে সাথে টিভির পর্দায় একটা ফুলদানি ছুঁড়া হল মুহূর্তের মাঝে টিভির ডিসপ্লে চলে যায়। খলিল তালুকদার আর চেয়ারম্যান মিজান সাহেব চোখ বন্ধ করে কানে হাত দিয়ে অন্য দিকে ফিরে যায়। যবুকটি সেন্টার টেবিলে সজোরে লাথি মেরে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বলে।
“ওই শা*লীকে আগেই বলে রেখেছিলাম আমি, গাড়িতে কোনো হিডেন ফিডেন ক্যামেরা নেই কিন্ত তারপরও ওই শা*লী ওই জাহিনের কথার জালে ফেঁসে গেছে। সবটা প্ল্যান নষ্ট করে দিল। আমি আগেই বলেছিলাম এই শা*লীকে দিয়ে কাজটা হবে না।”
খলিল তালুকদার রেগে বলে উঠলেন, “তোমার প্ল্যান প্রথম থেকেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যখন জাহিনের জায়গায় নুহাশ ফেঁসেছিল।”
যুবকটি গর্জে উঠে আঙ্গুল তাঁক করে খলিল তালুকদারকে বলে, “এই বুড়ো বেশি কথা বলবি না। প্ল্যানটা শুধু একার আমার ছিল না।”
খলিল তালুকদার চোখ বড় বড় করে রেগে বলেন, “কি বললে তুমি আমাকে?”
যুবকটি তেড়ে এসে বলে, “বুড়ো বলেছি তোকে আমি বুড়ো কি করবি তুই আমাকে বল কি করবি?”
মিজান সাহেব দুজনের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে দুজনকে থামিয়ে বলে, “উফফ কি শুরু করলে তোমরা দুজনে। নিজেদের মধ্যে কেন কোলাহল শুরু করলে? একটা প্ল্যান নষ্ট হয়েছে তো কি হয়েছে অন্য আরেকটা প্ল্যান ভাবা যাবে। আর জাহিন এটা খুঁজে বের করতে পারবে না কে এই কাজের সাথে জড়িত ছিল। তবে হ্যাঁ জাহিন খলিল সাহেবকে সন্দেহ করবে এটা আমি জানি। তাই বলছি মাথা ঠান্ডা করো দুজনে। নিজেদের মাঝে বিবাদ বাঁধিয়ে কোনো লাভ নেই।”
যুবকটি গিয়ে নিজের স্থানে বসে। মিজান সাহেব চোখের ইশারায় খলিল তালুকদারকে শান্ত হতে বলেন। মিজান সাহেব নিজের জায়গাতে বসে গিয়ে বলেন, “এখন একটাই প্ল্যান ভোট কিনতে হবে আমাদের। আর কিছু দিন পরেই প্রতীক বারাদ্দ হবে আর এরপরেই প্রচারণার কাজ শুরু হবে। জাহিনকে কিছুতেই মেয়র পদে বসতে দেওয়া যাবে না।”
যুবকটি গম্ভীর কন্ঠে বলল, “কে মেয়র পদে বসল আর কে বসল না তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না কিচ্ছু না। আমি শুধু আপনাদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলাম ওকে নিঃস্ব করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে। তবে এভাবে নয় অন্য ভাবে ওকে আঘাত করতে হবে শুধু নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা। আপনাদের সাথে থেকে কিচ্ছু হবে না কিচ্ছু না। আর আপনি ফেইল করবেন তালুকদার সাহেব এটা আমি এক কলম লিখে দিলাম।”
খলিল তালুকদার রেগে কিছু বলতে যাবেন সাথে সাথে মিজান সাহেব খলিল তালুকদারের হাত ধরে থামিয়ে দিল। চোখের ইশারায় বলল শান্ত থাকার জন্য।
_________
জারা ফেসবুক স্ক্রল করছে। নুহাশের খবরটা বাড়ির সবাই জানার পর যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে সকলে। বিশেষ করে জারা। সে ভীষণ খুশি হয়েছে তার নুহাশ ভাই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে বলে। ইচ্ছে করছে নাচতে কিন্তু আপাতত এই পা নিয়ে নাচা সম্ভব না তাই মনের বসনাটাকে সংযম করল। নেটিজেনরা এবার নুহাশের পক্ষ নিয়ে নানান কথা বলছে। জারার হঠাৎ করেই একটা পোস্টে নজর পড়ল নুহাশের একটা ছবি দিয়ে পোস্ট করছে আর ক্যাপশনে লেখা, “আমি জানতাম আমার জানু এমনটা করতেই পারে না। আমার জানুটাকে শুধু শুধু হ্যারেস করল ওই শয় তান মেয়েটা। তুমি চিন্তা করো না জানু আমরা সকলে তোমার পাশে আছি। আই লাভ ইউ জানু।”
জারা চোখ, মুখ কুঁচকে বিতৃষ্ণা নিয়ে পোস্ট পড়ল। ইচ্ছে করছে কমেন্ট বক্স গিয়ে লিখতে, “তোর জানুর একটা জান আছে তাই এসব লেইম মার্কা পোস্ট করে নিজেকে ছোটলোক প্রমাণ করবি না, যত্তসব।” জারা ফোনটা ঢিল মেরে বেডে ফেলে দিয়ে একরাশ বিরক্ত নিলে বলে।
“শাকচুন্নির দল। এখন এক্কেবারে দরদ উথলে উথলে পড়ছে আবার আই লাভ ইউ জানু বলছে। এই আই লাভ ইউ বানান পারিস যে লিখেছিস। ও সরি পারিস বলেই তো লিখতে পেরেছিস।”
অয়ন্তি জারার রুমে এসেছে হাতে একটা প্লেট তাতে চার রকমের ফল কাটা। জারাকে একাএকা বকবক করতে দেখে থমকে যায়। ভ্রু কুঁচকে জারাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “জারা কাকে বকছো?”
জারা দরজার পাশে অয়ন্তিকে দেখে বলে, “ওও ভাবি তুমি এসো ভেতরে এসো।”
অয়ন্তি জারার পাশ গিয়ে বসে বলে, “কাকে বকছো?”
জারা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “আর বলো না ভাবি ফেসবুক কত গুলা শাকচুন্নি আছে যারা সুন্দর সুন্দর পোলা দেখলেই দরদ এক্কেবারে উথলে উথলে পড়ে।”
“কার উপরে দরদ উথলে পড়ছে?”
“আরে নুহাশ ভাইয়ের উপরে আর পোস্ট করে কি বলে জানো “আই লাভ ইউ জানু”।”
জারা ভেঙিয়ে কথাটা বলল। অয়ন্তি সোজাসুজি বলে, “তুমি কি তাতে জেলাস ফিল করছো জারা?”
“অবশ্যই…।”
মুখ ফসকে কথা বলে ফেলে জারা। যখন বুঝতে পারল কি বলছে সাথে সাথে জারা অয়ন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে, “না ভাবি আমি আসলে।”
“তুমি কি নুহাশ ভাইকে পছন্দ করো জারা।”
অয়ন্তির কথার কোনো উত্তর দিল না জারা চুপচাপ সাদা টাইলসের দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। অয়ন্তি পুনরায় বলল, “গতকাল রাত্রে তোমাকে আর নুহাশ ভাইকে দেখেছি। তুমি নুহাশ ভাইয়ের কোলে ছিলে। আমি কি জানতে পারি এই ব্যাপারটার বিষয়ে।”
জারা হকচকিয়ে উঠে ভাবির দিকে তাকায়। তার মানে ভাবি সবটা দেখেছে ভাইয়াকে বলে দেয় নি তো আবার। জারা উৎসুক গলায় বলে, “ভাবি তুমি কি সবটা ভাইয়াকে বলে দিয়েছো।”
“না বলে নি।”
জারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। ভাইয়া যদি জানে তাহলে হয়ত একটা ঝড় উঠবে এই শেখ বাড়িতে। জারা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে, “ভাবি প্লিজ এই কথাটা কাউকে বলো না তোমার দুটি হাতে ধরি। আসলে গতকাল রাত্রে।”
জারা গতকাল রাত্রের ঘটনাটা ভাবিকে বলে। অয়ন্তি কিছু বলতে যাবে সাথে সাথে সাথে জারা বলে, “যদিও আমি নুহাশ ভাইকে ভালোবাসি কিন্তু নুহাশ ভাই আমার সেই ভালোবাসায় ধরা দেয় না। যদিও আমি জানি নুহাশ ভাই আমাকে ভালোবাসে কিন্তু স্বীকার করে না।”
অয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে বলে, “কেন স্বীকার করে না।”
জারা ম্লান কন্ঠে বলে, “নুহাশ ভাই যে এই বাড়ির আশ্রিত তাই হয়তো স্বীকার করে না। যে বাড়ির নুন খেয়েছে সেই বাড়ির মেয়ের উপরে কি করে নজর দিবে তুমি বলো। কিন্তু আমি নুহাশ ভাইকে খুব ভালবেসে ফেলেছি ভাবি খুব।”
শেষের কথাটা জারা ধরা গলায় বলে। অয়ন্তি বোঝানোর স্বরে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে জারা একটু ধৈর্য ধরো আল্লাহ যদি তোমার কপালে নুহাশ ভাইকে লিখে রাখেন তাহলে নুহাশ ভাই তোমার হবে আর যদি না লিখে রাখে তাহলে শত চেষ্টা করলে সে তোমার হবে না।”
জারা ঢোক গিলে বলে, “ভাবি তুমি আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও এই কথাটা যেন বাড়ির কেউ না জানে এমন কি ভাইয়াও না।”
অয়ন্তি জারার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, “ঠিক আছ ননদিনী কেউ জানবে না কথাটা প্রমিজ।”
জারা ভাবির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার মিষ্টি ভাবি।”
“হয়েছে হয়েছে এবার ফল গুলা খেয়ে নাও।”
জারা একটা আপেলের টুকরা মুখে নিয়ে বলে, “তুমিও খাও।”
অয়ন্তি মুচকি হেসে বলে, “তুমি খাও আমি খেয়েছি।”
________
রিহান আজ তাদের বন্ধুদের সাথে নাইট পার্টি করবে তা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বন্ধুদের মাঝে গ্রুপ চ্যাটে। রিহানের বন্ধু সৈকত মেসেজ করে।
“কিরে বন্ধু তোর ফুলের পাপড়ির কি অবস্থা? মেয়েটাকে একা রেখে চলে এলি এবার যদি সেই পাপড়ি ঝরে নিচে পড়ে যায় তখন?”
রিহান মেসেজটা দেখে মলিন হাসল। তার আবার কবে হল ফুলের পাপড়ি? রিহান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মেসেজ করে, “হয়ত আমি চলে আসাতেই ফুলের পাপড়ি ভালো আছে। বরং আমি এত দিন ছিলাম বলেই সে বিরক্তবোধ করত।”
এর মাঝে পিয়াস বলে, “আচ্ছা এসব কথা বাদ দে একটা মেয়ে গেছে তো কি হয়েছে হাজারটা মেয়ে এসে ধরা দিবে আমাদের রিহানের কাছে বুঝলি।”
সুরেশ বলল, “এই প্লে বয় চুপ কর। তুই রিহানকে তোর মতো ভাবিস নাকি যে বিড়ালের মতো এ বাড়ির হাড়িতে তো ওই বাড়ির হাড়িতে গিয়ে মুখ দিবে।”
পিয়াস রাগের ইমুজি দিয়ে বলল, “এই শোন আমি পাগল নই মেয়েরা আমার জন্য পাগল বুঝলি।”
“হুমম জানি কে পাগল?”
রিহান ওদের ঝগড়া দেখে অফ লাইন হয়ে যায়। চিত হয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে পাপড়ির কথা। মেয়েটির কি এক মুহূর্তের জন্যও
তার কথা মনে পড়ছে না। হয়তো পড়ছে আবার নাও পড়তে পারে কিন্তু তার মস্তিষ্ক জুড়ে যে বিরাজ করছে পাপড়ি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকতে পারছে না। রিহান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শুয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
_______
অবন্তি ওরফে পাপড়ি মেয়েটি রাস্তার চারিপাশ সন্তপর্ণে নজর বুলাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে কাউকে খুজে বেড়াচ্ছে তার দু চোখ। কিন্তু যাকে খুজে বেড়াচ্ছে দু চোখ সেই মানুষটা নেই আজ। মানুষটা কি সত্যি চলে গেছে। অবন্তির মনটা যতনায় ভরে গেল। এতদিন লোকটা সামনে আসলে রাগ উঠত কিন্তু আজ যখন নেই তখন কেন এতটা বিষাদময় লাগছে তার। অবন্তির পাশে থাকা ইভা খোঁচা দিয়ে বলে।
“যাকে খুজে বেড়াচ্ছিস সে নেই তাই সামনের দিকে নজর রেখে হাঁট না হলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পেরে।”
ইভার কথা শুনে হকচকালো অবন্তি। মিথ্যে মিথ্যে বিরক্তি আর রাগ মেশানো গলায় বলে, “আজব আমি আবার কাকে খুজবো?”
“সে তুই ভালো করেই জানিস কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস আর যদি না জানিস তাহলে আমিই বলে দিচ্ছি তোর সুবিধার্থে রিহান ভাইয়াকে খুঁজছিস তুই তাই তো।”
অবন্তি চুপ মেরে যায়। সত্যি সে রিহানকে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু লোকটা নেই সত্যি লোকটা চলে গেছে এই শহর ছেড়ে। লোকটা কি তাকে ভুলে গেছে এই একদিনের মাঝে। অবশ্য ছেলেদের মন একজন চলে গেলে আরেকজনকে নিজের মনে ঠাঁই দিতে বেশি সময় নিবে না। অবন্তি এসব চিন্তা করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
#চলবে