#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৪৪
জাওয়াদ জামী জামী
কেটে গেছে সাতদিন। মাশিয়ার অবস্থা এখনও অপরিবর্তিত। আরমানের কুড়িগ্রাম যেতে হবে। ও দুই-তিনদিনের জন্য কুড়িগ্রাম যাচ্ছে। মেয়েদের রেখে যেতে ওর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ও নিরুপায়।
মেয়েদের রেখে ও কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
তিনদিনের জন্য কুড়িগ্রাম গেলেও, চারদিন পেরিয়ে গেছে আরমান ঢাকা ফিরতে পারছেনা। কলেজের কাজে আটকে গেছে। কবে আসতে পারবে সেটাও বলতে পারছেনা। ও নিয়মিত মেয়েদের খোঁজ রাখছে।
আরমানের যাওয়ার সাতদিন পর মাশিয়ার জ্ঞান ফিরল। ওর জ্ঞান ফিরতে দেখে সবাই খুশি। আরও কয়েক ঘন্টা অবজারভেশনে রাখার পর মাশিয়াকে কেবিনে দেয়া হয়।
কেবিনে এসেই হতবাক হয়ে গেছে মাশিয়া। ও ভাবতেই পারেনি আবারও সুধা, শশীকে দেখতে পাবে। ওদের দেখেই মাথা নিচু করল মাশিয়া। ও ভুলে গেল সন্তানের কথা।
” আমাদের সাথে কথা বলবেনা, ভাবি? গত কয়েকদিন যাবৎ তোমার চিন্তায় আমাদের পাগল হওয়ার দশা। আর সেই তুমিই সুস্থ হয়ে আমাদের দেখে মুখ লুকাচ্ছ! তোমার মেয়েদের দেখবেনা? ” সুধা মাশিয়ার কাছে এগিয়ে এসে বলল।
সুধার কথা শোনামাত্র ফুপিয়ে কেঁদে উঠল মাশিয়া। নিজেকে শান্ত করতে ওর অনেকটা সময় লেগে যায়।
” আম্মা আসেনি, সুধা? আম্মা কি আমার ওপর খুব বেশি রেগে আছে? ” ফোপাতে ফোপাতে বলল মাশিয়া।
মাশিয়ার কথা শুনে সুধা, শশীর চোখে পানি আসল। আরও একবার সম্মুখীন হলো তিক্ত প্রশ্নের।
” আম্মা তোমার কখনোই রেগে ছিলনা, ভাবি। সে তোমাকে আমাদের থেকে কম ভালোবাসতোনা। সারাটাদিন সে তোমার কথা ভেবেছে, তোমার জন্য কেঁদেছে। এমনকি মৃ’ত্যু’র আগেও আম্মা তোমার চিন্তাই করেছে। ভাইয়াকে রিকুয়েষ্ট করেছে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আম্মা বেঁচে থাকলে সে আইসিইউতে তোমার পাশেই থাকত। ” সুধা চোখ মুছে বলল।
সুধার কথা শুনে মাশিয়ার বুক ফেটে যাচ্ছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আম্মা নেই এই কথা ভাবতেই ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখন মনে হচ্ছে ও নিজে কে’ন মরে গেলনা? নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও অন্তত আম্মা বেঁচে থাকত। আর কোনদিন সেই মাতৃসমা শ্বাশুড়িকে দেখতে পাবেনা ভেবেই ওর শ্বাস আটকে আসছে। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে।
আরেকটা কথা মনে আসতেই মাশিয়ার বুক কেঁপে উঠল। আম্মা ছিল আরমানের জীবন। আম্মার মৃ’ত্যু’তে সে কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে? সে কি মাশিয়াকে দোষী করেছে আম্মার মৃ’ত্যু’র জন্য? এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মাশিয়া। ওকে শান্ত করতে অনেক সময় লাগল।
মেয়েদের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে মাশিয়া। ওদের চেহারার মাঝে আয়েশা খানমের মিল খোঁজার চেষ্টা করছে। থেকে থেকেই ওর দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুতেই ভুলতে পারছেনা আম্মার কথা, আম্মার সাথে কাটানো দিনগুলো, হাজারো স্মৃতি। দুই মেয়ের সুসংবাদ ওকে আলোড়িত করতে পারলনা মোটেও।
গত ১৮ ঘন্টায় মাশিয়া সবাইকে দেখলেও আরমানকে দেখলনা। ওর মন আরমানের খবর জানার জন্য আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু লজ্জায়, ভয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা। দরজায় নক শুনলেই ওর মন আন্দোলিত হচ্ছে, আরমান এসেছে ভেবে। কিন্তু যখনই অন্য কাউকে দেখছে, তখনই ওর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
সুধা আরমানকে মাশিয়ার খবর দিয়েছে। আরমান জানিয়েছে দুই-একদিনের মধ্যেই ও ঢাকায় যাবে।
মেয়েদের কান্না শুনে মাশিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। ও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। কারো সাহায্য ছাড়া নিজ থেকে উঠতে বসতে পারছেনা। সুধা আর শশী মিলে দুই বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। বড় মেয়েটা সুধার কোলে সুন্দরভাবে খাচ্ছে। কিন্তু ছোটটা ভিষণই জিদ করছে। কল্পনা মোর্তাজা শশীর কাছ থেকে ছোট নাতনিকে নিয়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, তার এই নাতনিটি সহজেই থামবেনা। তবুও তিনি চেষ্টা করতে থাকলেন। মাশিয়া অসহায় চোখে তার মেয়েকে থামাতে মম আর শশীর যুদ্ধ দেখছে। এই মেয়েটাযে বড্ড জিদ্দি সেটা মাশিয়া আঠারো ঘণ্টায় হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে।
দরজায় নক শুনে শশী এগিয়ে গিয়ে খুলে দেয়। হন্তদন্ত হয়ে আরমান কেবিনে ঢুকল। মেয়ের কান্না শুনে ও সরাসরি মেয়ের কাছে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এটাই যে, মেয়েকে কোলে নেয়ার সাথে সাথে ওর কান্না থেমে যায়। আরমান পরম আদরে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখল।
মাশিয়া আশ্চর্য হয়ে বাবা-মেয়ের অকৃত্রিম বন্ধন দেখছে। ওর মাথায় ঢুকলনা, এই পিচ্চি মেয়ের বাবার কোলে গিয়ে থেমে যাওয়ার কারণ। তবে ও মাথাও ঘামালোনা। ও আরমানকে দেখতে ব্যস্ত। মানুষটা অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। চেহারার মাঝে আগের সেই কমনীয়তা নেই, কেমন যেন উসকোখুসকো হয়ে গেছে। ছোট মেয়ের কান্না থামিয়ে আরমান এখন বড় মেয়েকে আদর করছে। মাশিয়া লক্ষ্য করল, একটিবারের জন্যও আরমান ওর দিকে তাকায়নি। ওর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। মাশিয়া বুঝতে পারছে ওর সামনের দিনগুলো খুব সহজ হবেনা।
সারাদিন জার্নি করে এসেও আরমান রাত প্রায় পুরোটাই জেগে থাকল। মেয়েরা কাঁদলেই ওদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। সুধা বাচ্চাদের খাবার তৈরী করে দিলে আরমানই খাওয়াচ্ছে। মাশিয়া এই মানুষটাকে যতই দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে।
দুইদিন ঢাকায় কাটিয়ে আরমান সুধাকে নিয়ে গ্রামে গেল। মেয়েদের আকিকা সেখানেই হবে। আকিকা করিয়ে ওরা দুইদিন পরই আবার ঢাকায় ফিরল।
আরমান কোন একটা কাজে বাহিরে গেছে। বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। শশীও বাচ্চাদের সাথেই ঘুমাচ্ছে। কল্পনা মোর্তাজা বাসায় গেছেন। তিনি খাবার নিয়ে আবারও আসবেন। সুধা মাশিয়ার চুল চিরুনী করে দিচ্ছে।
” ভাবি, ভাইয়াকে এমন কঠোররূপে দেখে হয়তো তোমার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। তুমি একবার ভাইয়ার দিকটাও বিবেচনা করে দেখ। তুমি চলে আসার পর ভাইয়া প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। আমি ভাইয়াকে কয়েকবার কাঁদতে দেখেছি। ভালোবাসা হারানোর আগুনে দিনের পর দিন দগ্ধ হয়েছে ভাইয়া। তাই হয়তো সে তোমার প্রতি আজ এত কঠোর আচরণ করছে। হয়তো আদতেই ভাইয়া এতটাও কঠোর নয়। হয়তো তার বুকে অভিমান বাসা বেঁধেছে। কিন্তু তোমার অসুস্থতার কথা শুনে ভাইয়া তার রাগ ভুলে ছুটে এসেছে। তাই আমি বলতে পারি, এখন ভাইয়ার ভেতর অভিমান ছাড়া আর কিছুই নেই। এই অভিমানকে তুমি আর বাড়তে দিওনা, ভাবি। সবকিছুরই একটা সমাপ্তির প্রয়োজন থাকে। তোমাদের এই মান-অভিমানেরও সমাপ্তি আছে। আর এর চাবিকাঠি তোমার হাতে। ”
মাশিয়া মন দিয়ে সুধার কথা শুনল। ওর প্রতিটি কথাই ওর অন্তরে গেঁথে যায়। কৃতজ্ঞতায় ওর অন্তর শীতল হয়ে গেছে। ওর এত অন্যায়ের পরও সুধা কিংবা শশী ওকে একটা বাঁকা কথাও শোনায়নি কিংবা একটাবারের জন্যও ওর ওপর বিরক্ত হয়নি। নিজের করা অপরাধের জন্য ওর অনুশোচনা হয় আরেকবার। আম্মার কথা মনে হতে থাকল। বারবার মনে হচ্ছে, আম্মার সন্তানরা কখনোই খারাপ হতে পারেনা, ভুল কোন কথা বলতে পারেনা। চোখে পানি জমেছে ওর। সুধাকে লুকিয়ে ওড়নার কোনে চোখ মুছল। ফ্যাসফেসে গলায় বলল,
” তোমার কথাগুলো আমার আজীবন মনে থাকবে, সুধা। এতদিন একটা বোনের অভাববোধ করতাম। আজ সেই অভাবও তুমি মেটালে। আমি পাপী তোমাদের চিনতে পারিনি। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তোমাদের বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্যই নই। ”
” এভাবে আর বলবেনা। তুমি ভুল করেছিলে একদিন, তাই বলে তুমি পাপী নও। দুনিয়ায় এমন একজন মানুষকেও পাবেনা যে ভুল করেনা। হয়তো কেউ কম ভুল করে, আর কেউ বেশি। পার্থক্য এতটুকুই। ভুল করে স্বীকার করাটাই সবচেয়ে বড় প্রায়শ্চিত্ত। এটা কয়জন করতে পারে? কিন্তু তুমি পেরেছ। সে হিসেবে তুমিই একজন খাঁটি মানুষ। বাদ দাও এসব কথা, মেয়েদের নাম তোমার কেমন লেগেছে বল? ভাইয়া নিজে তার মেয়েদের নাম পছন্দ করেছে। ”
” অন্নেক পছন্দ হয়েছে নামগুলো।
আদিয়াত বিনতে আরমান
আরহা বিনতে আরমান। একদম ফাটাফাটি নাম। তোমার ভাইয়ার পছন্দের তারিফ করতে হয়। কিন্তু একটা অভিযোগ আছে তার নামে। ”
সুধা অভিযোগের কথা শুনে ছোট ছোট করে তাকায় মাশিয়ার দিকে।
” অভিযোগ! কিসের অভিযোগ? ”
” তোমার ভাইয়া মেয়েদের আকিকা দিল, পুরো গ্রামের মানুষকে মিষ্টি খাইয়ে আসলো। আমাকেতো মিষ্টি খাওয়ালোনা। তার মেয়েদের উপলক্ষ্যে বিলি করা মিষ্টি আমিও তো ডিজার্ভ করি। কতদিন মিষ্টি খাইনা। ”
” একেই বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। ভাইয়া আসলে তাকে বলো তোমার মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে। আমি নিশ্চিত ভাইয়া তোমাকে হয় নিম পাতার মিষ্টি খাওয়াবে, নয়তো তিনতলার জানালা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারবে। এবার বল তুমি কোনটা চাও? আমি সেটাই বরাদ্দ করার ব্যবস্থা করব। আমার আবার দয়ার শরীর। কারও চাওয়া অপূর্ণ থাকতে দেখলে কষ্ট হয়। ” শশী হাই তুলতে তুলতে বলল।
” সুধা, তুমি আমার এই হিংসুটে ননদে থামতে বল। সে কোথায নিচে গিয়ে আমার জন্য মিষ্টি আনবে, সেটা না করে তার ভাইয়ার পক্ষে কথা বলছে! ” মাশিয়া হাসিমুখে বলল।
” এটা তোমার অপদার্থ ননদ, ভাবি। কি করবে বল, এই অপদার্থকেই আর কয়েকটা বছর সহ্য কর। আমাদের ছোট পুতুল এই অপদার্থের ডুপ্লিকেট হয়েছে। এটাও আগে সারাদিন এমন করে কাঁদত শুনেছি। আম্মাকে জ্বালিয়ে মারত। ”
সুধার কথা শুনে শশী হৈ হৈ করে উঠল।
” আমাকে যা বলছ বল। কিন্তু খবরদার আমার পুতুলের নামে কিছু বলবেনা। ও আমার মত ভালো হয়েছে জন্য তোমার হিংসা হয় সেটা আমি বুঝি। তোমার বিয়ের ব্যবস্থা না করলে দেখছি আমাকে আর আমার পুতুলটাকে পঁচাবে। ওয়েট ঐ শুকনা ঢেঁড়সের বাপের সাথে খুব তারাতারি কথা বলব। ”
শশীর মুখে শুকনা ঢেঁড়স শব্দ শুনেই মাশিয়া হেসে উঠল। ও শশীকে জিজ্ঞেস করল ঘটনা কি। শশী একে একে ওকে সবটা বলল।
হসপিটালে ঢুকেই আরমান থমকে দাঁড়ায়। রিশাদ রিসিপশনে দাঁড়িয়ে আছে। রিশাদকে পাশ কাটিয়ে যেতেই রিশাদও আরমানকে দেখতে পায়।
” হ্যাল্লো মাশিয়ার এক্স হাসবেন্ড? ”
আরমান রেগে এগিয়ে যায় রিশাদের কাছে। ওর কাছে গিয়েই ঘুঁষি মারে নাক বরাবর।
চলবে…