#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-২৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
পরিবেশে নিস্তব্ধতা। রোবা নাহার তটিণী-র মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছেন। তটিনী রুদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আর মাথা তুলছে না। বেচারি লজ্জায় শেষ হবে নাকি কষ্টে কাঁদবে বুঝতে পারছে না। রুদ্র তটিণী-র পরিস্থিতি বুঝতে পেরে নিজের ঠোঁট কামড়ালো। ভেবে তটিনীকে সোফায় নিয়ে বসালো। কিন্তু তটিনী ছাড়লো না রুদ্রকে। রুদ্র সেই অবস্থাতেই বসলো। রোবা নাহার পানি এগিয়ে দিলেন। রুদ্র সেটা তটিণী-র মুখের কাছে ধরলো। আস্তে করে বলল, ‘পানি খেয়ে নে।’
তটিনী এক চোখ খুলে তাকালো। রুদ্র চোখ রাঙিয়ে ইশারায় পানি খেতে বললো। রোবা নাহার মুখ চেপে হাসছেন। বাকিরা খেতে বসেছে পুনরায়। ঈশানী খাবার টেবিলে সবাইকে এটা ওটা দিতে ব্যস্ত। রোবা নাহার তটিনী এক পাশে বসলেন। পিঠে হাত ভুলিয়ে বললেন,
‘এতো মন খারাপ করলে হবে? তোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রুদুকে স্বাবলম্বী হতে হবে না?’
তটিনী রুদ্রের বুক থেকে মাথা তুললো। পানি খেয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। রুদ্র হাতের মুঠোয় হাত নিলো।
‘এতো দুশ্চিন্তা কিসের? একেবারের জন্য তো যাচ্ছি না, দু’বছরই তো।’
তটিনী ঠোঁট চেপে কান্না আটকালো।
‘আমি চাই আপনি যান, কিন্তু..
‘কিন্তু?’
‘কিন্তু এমন কেন লাগছে জানিনা।’
‘কেমন লাগছে?’
তটিনী মাথা নিচু করলো। রুদ্র রোবা নাহারের দিকে তাকালো। রোবা নাহার ইশারায় বুঝিয়ে চলে গেলেন।’ নিজের ঘরে তটিনীর পাশে বসে আছে রুদ্র। রোবা নাহার খাবার দিয়ে গেলেন দুজনকে। রুদ্র খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখাতে লাগলো। তটিনী সেটা দেখে নাক ছিটকালো।
‘খাবো না।’
রুদ্র জোর করে মুখে খাবার দিলো। তটিনী কষ্ট করে গিলে ফেললো সেটা। আচমকা লজ্জাবতী তটিনী লজ্জা ভুলে গেলো। রুদ্রের হাত দু’দিকে মেলে দিয়ে রুদ্রের উপর বসে গেলো। রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হেসে নিজের হাসি আটকিয়ে ভাত খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। তটিনী রুদ্রের কাঁধে মাথা রেখে ভাত গিলছে।
‘তুমি এতো লক্ষী কেন ঐশি?’
রুদ্রের আদুরে কন্ঠ, তটিনী আবেশিত হলো।
‘আপনি এতো আদুরে ভাব নিয়ে ডাকেন কেন?’
মুখে ভাত দিয়ে রুদ্র কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো।
‘খাওয়া শেষ এবার যতো খুশি লাফাও। তোমাকে আর আটকাচ্ছি না।’
কিন্তু নেমে গেলো না তটিনী। আগের মতোই বসে রইলো। রুদ্র আড়চোখে তাকালো,
‘আমি খাবো না?’
‘এভাবেই খান না, ধরে রেখেছি নাকি? হাত দুটো তো খোলা-ই আছে।’
রুদ্র মেনে নিলো, খাওয়া শেষ করে দেখলো তটিনী তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। রুদ্র নিজের বিছানাতে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো।
*
সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরলো রুদ্র। নিজের রুমে গিয়ে সবার ভীড় দেখলো। সবাই মিলে তার ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে। তটিনী তখনো বেঘোর ঘুমাচ্ছে। রাজ ও তুরফান তটিণী-র ঘুমের বারোটা বাজানোর জন্য চক কশছে। রুদ্র সেটা বুঝতে পেরে দুজনের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
‘একদম না, ঘুমাচ্ছে ঘুমাতে দে।’
রাজ ও তুরফান মিইয়ে গেলো। রুদ্রের সামনে থেকে দুজন সরে গেলো তৎক্ষনাৎ। রুদ্র ফ্রেশ হয়ে এসে মায়ের সাথে নিজেও ব্যাগপত্রে জামা ঢুকাতে শুরু করলো। রোবা নাহার ছেলের ক্লান্ত মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। রুদ্র না তাকিয়ে হাসলো,
‘এতো কি দেখো মা?’
রোবা নাহার ছেলের গালে হাত রাখলেন,
‘তুই বড় হয়ে গেলি রুদু, আমার থেকে দূরে থাকবি এখন।’
রুদ্রের হাত থমকে গেলো। সে ব্যাগ ফেলে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
‘একদম নয় মা, আমি ফিরবো। আর তোমরা যদি এমন করো তো আমি যাবো না। তোমার মতো আরেকজনও আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমাকে অশান্তিতে রেখে কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দেখো।’
রোবা নাহার চোখের কোণের জল মুছলেন।
‘ওর এখনো সবরকমের জ্ঞান হয়নি রুদু। তুমি যখন আসবে তখন দেখবে একদম বড়ো হয়ে গেছে। আমি আছি তো, সবদিক থেকে তৈরি করবো। সবকিছু শিখিয়ে দিবো। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। তোমার মা যতোদিন আছে চিন্তা কিসের বাবা?’
রুদ্র বাচ্চাদের মতো আচরণ করলো, মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।
‘চুলে হাত রাখো মা।’
রোবা নাহার কাঁদতে চাইছেন না। নাহলে তার ছেলেটা যাবে-ই না শেষে।
*
তটিণী-র ঘুম ভাঙলো আটটার পর। বাড়ির সবাই তখন সোফায় বসে গসিপ করছে। তটিনী ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। রুদ্রের যাওয়ার প্রস্তুতি হচ্ছে। ব্যাগপত্রে খাবার ঠেসেঠুসে দিচ্ছেন ঈশানী। তটিনীর মন খারাপ হয়ে গেলো। রাত পোহালেই রুদ্র রওনা হয়ে যাবে!’
রোবা নাহার তটিনীকে টেনে রুদ্রের পাশে বসালেন। রুদ্র পকেট থেকে চকোলেট বের করে দিলো। তটিনী চকলেট না নিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো।
রুদ্র চোখের ইশারায় চকোলেট নিতে বলল। তটিণী-র কোনো সাড়া না পেয়ে নিজেই হাতে গুঁজে দিলো। তটিণী-র যেনো হুস ফিরলো। সে নিজের হাতের দিকে একবার তো রুদ্রের দিকে একবার তাকাচ্ছে। রুদ্র কাঁধ জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে আলতো করে মিশিয়ে নিলো সবার অগোচরে।
‘এতো মন খারাপ করলে কিন্তু যাবো না।’ তোমরা মা মেয়ে শান্তি দিচ্ছো না আমায় ঐশি।’
তটিনী মুখ গোমড়া করল,
‘বড়ো মায়ের মন খারাপ হবে না? সে তো মা তার মন কাঁদবে স্বাভাবিক।’
‘আর তোমার?’
‘ওমা আমি তো বউ হই, আমার ও তো মন কাঁদবে।’
রুদ্রের কথার জালে ফেঁসে তটিনী নির্লজ্জের মতো কথার তীর ছুঁড়ে দিচ্ছে। রুদ্র ঠোঁট চেপে হাসছে খেয়াল করতেই চুপ হয়ে গেলো সে।
রুদ্র হেসে বলল, ‘থামলে যে?’ আরও কিছু বলো।’
তটিনী বাহুতে আলতো করে ঘুষি দিলো। মুখ গোমড়া করে সামনের দিকে ফিরে গেলো। রুদ্র পেছনের দিকে তাকাতেই তার দুজন ভাইকে দেখতে পেলো। রুদ্র ও তুরফান তটিণী-র পিঠ জড়িয়ে থাকা রুদ্রের হাতের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। রুদ্র সেটা বুঝতে পেরে হাত তো সরালোই না বরং গভীর করলো সেটা। তুরফান ও রাজের চোখ বড় হতে লাগলো। এদিকে তটিনী ফিসফিস করছে,
‘সবাই বসে আছে কি করছেন?’
রুদ্রের সহজ উত্তর,
‘দুপুরে সবার সামনে জড়িয়ে ধরার সময় সেটা মনে ছিল না?’
মুখের উপর জবাব পেয়ে তটিনী চুপ হয়ে গেলো৷ নির্লজ্জ পুরুষ তাকে এভাবে লজ্জা দিতে পারলো?’
*
রাতের খাবার টেবিল আরও জমজমাট। রুদ্রের প্লেটে খাবারের স্তুপ। বেচারা নিজের পেটে কিভাবে জায়গা করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে অসহায় চোখে নিজের দুই মা ও সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছে। মায়েরা তো পাত্তা দিচ্ছেই না, তার বউটা তো তাকাচ্ছেই না। এই মেয়েটার ভাব আর গেলো না। সারাজীবন এই ভাব নিয়েই পড়ে থাকবে। রুদ্র মুখ ছোট করে রোবা নাহারের দিকে তাকালো। রোবা নাহার মাংসের প্লেট নিয়ে এগিয়ে এলেন।
রুদ্র নিজের প্লেট আগলিয়ে নিলো,
‘আর দিও না মা, প্লিজ। খেতে পারবো না এতো।’
রোবা নাহার ধমক দিলেন,
‘আগামীকাল চলে যাবে, আজ ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না করলে কিভাবে হবে? লম্বা জার্নি করবে শরীর ঠিক রাখতে হবে তো?’
রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো,
‘আগে এগুলো ফিনিশ করে নেই প্লিজ?
রোবা নাহার রুদ্রের পাশের চেয়ারে বসলেন।
‘তুমি খেতে শুরু করো, আমি আছি এখানেই।’
রুদ্রের আজ বাঁচার পথ নেই। সে বুঝে গেছে তার মা আজ তাকে খাইয়ে আলু পটল সব বানিয়ে ছাড়বেন। বেচারা অসহায়ের মতো খেতে আরম্ভ করলো।
রুদ্রের অসহায়তা দেখে তটিণী-র দারুণ মজা লাগলো। তখন তাকে দুপুরের ঘটনার জন্য খুচাচ্ছিলো না? এবার মজা বুঝুক। তটিনী সবার অগোচরে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। বউ হয়ে কোথায় স্বামীর দুঃখে দুঃখী হবে তা না ভেংচি কেটে যাচ্ছে, নির্দয় মহিলা!
(চলবে)