হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম #Nusrat_Jahan_Bristy #পর্ব_৩৫

0
547

#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৫

শারাফের আজ অফ ডে। সে কায়দা করে ছুটি নিয়েছে যাতে করে প্রতীক বরাদ্দ হওয়ার দিন তাকে ডিউটিতে না পড়তে হয়। এত এত নেতাদের আর মানুষের ভিড়ের মাঝে থাকতে তার একদম ভালো লাগে না। কিন্ত নির্বাচনের দিন কিছুতেই ছুটি পাবে না সে এটা সিউর। প্রতীক বরাদ্দ হওয়ার বিশ দিন পরেই নির্বাচন। এই নির্বাচনের দিন কি যে হবেই সেটাই সে ভাবছে। গত পাঁচ বছর আগে যা ঘটেছিল তা ভেবেই শারাফ ভয়ে শিউরে উঠে। যদিও পাঁচ বছর আগে সে পুলিশ ছিল না, ছিল একজন সাধারণ জনগন। কিন্তু এবার তার উপর দিয়ে সবটা ধকল যাবে সবটা। শারাফ এসব ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। মনে পড়ে গেল লিজার কথা। লিজার সাথে প্রায় অনেক দিন কথা হয় না মাঝে একবার ফোন দিয়েছে তখন জানতে পেরেছিল লিজার পরীক্ষা তাই আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করে নি। কিন্তু এখন তো পরীক্ষা শেষ এবার একটু আধটু বিরক্ত করাই যেতে পারে তাতে ক্ষতি কি? শারাফ চেয়ারে শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে লিজার নাম্বারাে কল করল। কিন্তু ফোন থেকে ভেসে আসলো নাম্বারটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। শারাফ এটা শুনে সাথে সাথে সোজা হয়ে বসে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে।

“ব্যস্ত আছে মানে?”

শারাফ পুনরায় ফোন করল এবারও একই কথা নাম্বারটি ব্যস্ত আছে। পরপর দু বার ফোন করল না নাম্বার ব্যস্ত আছে বলছে। তার নাম্বারটা কোনো ভাবে লিজা ব্লক করে দেয় নি তো। শারাফ ফোনে থাকা অন্য সিম দিয়ে লিজার নাম্বার ডায়েল করতেই বিনা বাঁধায় কল ঢুকে পড়ে। শারাফ বুঝলো তার নাম্বারটা আসলেই এই মেয়ে ব্লক মেরে দিয়েছে। কত্ত বড় সাহস নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে তার। আজ এই মেয়ের একদিন কি তার একদিন? লিজা ফোন ধরে মিষ্টি গলায় বলে।

“হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”

শারাফের রাগ গলে বাষ্প হয়ে গেছে। যতটুকু ক্রোধ জন্ম নিয়েছিল মনের মাঝে লিজার মিষ্টি গলার স্বর শুনে সব ভেনিস হয়ে গেছে। মেয়েরা এটা খুব ভালো জানে ছেলেদের কি করে বশে আনা যায়? হয় নিজের রুপের জাদু দিয়ে নয় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। শারাফ মৃদু হেসে বলে।

“তোমার ভবিষৎ তিন অক্ষরের জামাই বলছিলাম।”

লিজা তিন অক্ষরের জামাই কথাটা শুনা মাত্রই শুয়া থেকে তড়াক্ করে উঠে বলে, “আপনি আবার আমায় ফোন করেছেন?”

শারাফ ভারী গলায় প্রশ্ন করল, “আমার ওই নাম্বারটায় ব্লক দিয়েছো কেন?”

লিজা ঝাঁঝালো গলায় বলে, “একশো বার দিব হাজার বার দিব। আমার ফোন আমি যাকে খুশি তাকে ব্লক দিবো তাতে আপনার কি প্রবলেম?”

শারাফ রসিয়ে রসিয়ে বলল, “ভবিষতের দুই অক্ষরের বউ আমার, এভাবে কথা বলে না।”

“এই কি কখন থেকে জামাই বউ করছেন আপনি? আমি আপনার বউ কবে হলাম আর আপনি আমার জামাই কবে হলেন?”

শারাফ আরাম করে বসে গলার স্বর টেনে টেনে বলে, “হবে হবে! ভবিষতে আমার বউও হবে তুমি আবার সাথে বাচ্চার মাও হবে।”

লিজা হতবাক হয়ে যায় লোকটার কথা শুনে। চেঁচিয়ে বলে, “এই আপনি কে বলুন তো? আপনার সাথে আমি দেখা করতে চাই। আপনার নাম আর ঠিকানা বলুন।”

“ওমা ওই দিন তো বললে দেখা করবে না। আজ দেখা করতে চাইছো যে ব্যাপার কি?”

“এই এত আজাইরা কথা না বলে বলুন কবে দেখে করতে পারবেন?”

শারাফ কবি কবি ভাব নিয়ে বলল, “হবে তো দেখা আমাদের। যখন দেখা হবে তখন তোমায় পালকিতে করে ঘরে তুলে আনার ব্যবস্থা করে রেখে আসব। এখন রাখি ভবিষতের দুই অক্ষরের বউ। তোমার মাথা গরম হয়ে গেছে। পরে কথা হবে আর সাবধান নাম্বার ব্লক করবে না একদম।”

বলেই কল কেটে দেয়। লিজা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। এই‌ লোক কি বলল তাকে? কে এই লোক? কন্ঠটা কেমন জানি চেনা চেনা লাগে কোথায় যেন শুনেছে মনে হয় কিন্তু ঠাওর করতে পারছে না।

________

লন্ড্রি থেকে আসা জাহিনের কাপড়গুলা এক এক করে অয়ন্তি যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখছে। সব কাপড়গুলা তুলে রাখা শেষ হলে অয়ন্তি আলমারির নিচ থেকে উপর পর্যন্ত নজর বুলাল। পুরো আলমারিটা সাদা রঙের কাপড় দিয়ে ভরপুর। জাহিনের শার্ট, পাঞ্জাবি, পাজামা সব সাদা রঙের। শুধু প্যান্টগুলা কালো রঙের মধ্যে। অয়ন্তির নজর পড়ে একটা তাকের কোণায় একটা প্যাকেটের উপরে। অয়ন্তি হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে তাতে কি আছে দেখার জন্য কাপড়টা বের করতেই তা দেখে চোখ দুটো বড় বড় হয়েছে। মনে পড়ে যায় সেই রাতের ঘটনা যেই রাতে জাহিন ভুল করে তার জন্য একটা নাইটি নিয়ে এসে পড়েছিল। কি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল দুজনকে ওই সময়। অয়ন্তি এসব মনে করে হেসে উঠে। অয়ন্তি প্যাকেটটা আগের জায়গাতে রেখে আলমারি লক করতেই মেসেজ আসার শব্দ হয় ফোনে। অয়ন্তি ফোন হাতে নিয়ে চেক করে দেখে জাহিনের মেসেজ।

“অয়ন্তি ঠিক পাঁচটা দিকে আপনাকে একজন পিক করতে আসবে বাড়ি থেকে। প্লিজ একটু রেডি হয়ে থাকবেন আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

অয়ন্তির ভ্রু কুঁচকে আসে জাহিনের এমন মেসেজ দেখে। জাহিন তাকে হঠাৎ রেডি হয়ে থাকতে বলছে কেন? আর কি সারপ্রাইজ দিবে তাকে? কিন্তু আজ তো জাহিন অনেক ব্যস্ততার মধ্যে থাকার কথা তাহলে তাকে হঠাৎ এমন মেসেজ দেওয়ার অর্থ কি? এমন সময় জারা ভাবি বলতে বলতে রুমে ঢুকে। ভাবিকে এমন চিন্তিত হয়ে বসে থাকতে দেখে জারা বলে।

“ভাবি কি হয়েছে?”

অয়ন্তি চমকে উঠে জারার কথা শুনে। জারা এগিয়ে এসে বলে, “কিছু কি হয়েছে ভাবি?”

“কিছু হয় নি কিন্তু তোমার ভাইয়া এমন একটা মেসেজ কেন দিল বুঝতে পারছি না।”

“কি মেসেজ দিয়েছে?”

অয়ন্তি ফোনটা জারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই‌ যে দেখো।”

জারা মেসেজ পড়ে বলে, “ভাইয়া তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাইতাছে আর তুমি মনমরা হয়ে বসে আছো ভাবি।”

“না তেমনটা নয়। হঠাৎ করে।”

“আরে ভাবি সবকিছু হঠাৎ করেই হয়। হয়ত ভাইয়া ফ্রি হয়ে যাবে চারটার দিকে আর এই সময়টা তোমার সাথে কাটাতে চায়। এরপর তো সময় পাবে না, সারাদিন ভোট চাইতে চাইতে ভাইয়ার দিনকাল যাবে। তাই হয়ত ভাইয়া একটু রোমান্টিক সময় কাটাতে চায় তোমার সাথে আর হয়তো তোমাকে কিছু বলতেও চাইবে যেটা তুমি এখনও ভাইয়ার কাছ থেকে শুনো নি।”

অয়ন্তি বোকার মতো প্রশ্ন করে, “কি বলতে চাইবে?”

“আমার বোকা ভাবি কিচ্ছু বুঝে না। উপন্যাসে পড়ো নি নায়ক যখন নায়িকা সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা বলে তখন কি বলে বা কু করে? একটু গভীরে গিয়ে ভাবো কি বলতে পারে ভাইয়া?”

অয়ন্তি কিছু একটা ভেবে লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে যায়। জারা অয়ন্তির লজ্জারাঙা মুখখানা দেখে বলে, “থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। চলো তোমাকে আজকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেই।”

“কিন্ত এখনও তো পাঁচটা বাজে নি।”

“আরে প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে না।”

“কিন্তু তার আগে তোমার ভাইয়াকে একটা কল করো।”

“ঠিক আছে।”

জারা কল করল ভাইকে কিন্তু জাহিন কল কেটে দিল। জারা বলল, “ভাইয়া মনে হয় ব্যস্ত তাই কল কেটে দিচ্ছে।”

কথাটা বলে জারা অয়ন্তিকে নিয়ে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলমারি থেকে একের পর এক শাড়ি নিয়ে অয়ন্তির গায়ে দিয়ে দেখছে অয়ন্তিকে কোনটাতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে আর অয়ন্তি দাঁড়িয়ে জারার করা পাগলামি গুলা দেখছে।

______

প্রতীক নির্ধারণ করা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সবাই নির্বাচন অফিস থেকে বের হতে শুরু করেছে। জাহিন আর খলিল তালুকদার মুখোমুখি হয়েছে। তবে কেউ কোনো কথা বলে নি। খলিল তালুকদার শুধু বাঁকা হেসে জাহিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যান। জাহিনের কেন জানি খলিল তালুকদারের এই বাঁকা হাসিটা ভালো লাগল না, কেমন জানি রহস্যময় লাগল তার কাছে। এই‌ হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে অন্য কিছুর আভাস যেটার আভাস জাহিন বুঝতে পারলেও, কি হতে চলেছে বুঝতে পারছে না। জাহিন পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করল, অন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে আরেকটা ফোন খুঁজার প্রচেষ্টা করল কিন্তু না ফোন নেই কোনো পকেটে। গেলো কোথায়? কোথাও হারিয়ে ফেলে নি তো। কিন্তু না তার স্পষ্ট মনে আছে সে দুইটা ফোনেই পকেটের মধ্যে রেখেছে তাহলে গেল কোথায়? নুহাশ বলল।

“কি হয়েছে ভাই?”

“আরেকটা ফোন পাচ্ছি না।”

“মানে।”

“মানে একটা ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি আমি।”

“আমি কল করছি দাঁড়াও।”

নুহাশ কল করল। কল ঢুকল কিন্তু কেউ ধরল না। নুহাশ বলল, “ভাই কারো হাতে যদি পড়ত তাহলে তো ধরত কিন্তু কেউ ধরে নি।”

সব জায়গাতে ফোন খোঁজা হলো কিন্তু পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে সবাই গাড়িতে উঠে বসল। গাড়িতে উঠে বসতেই জাহিনের নজর পড়ে সিটের নিচে পড়ে আছে ফোনটা। জাহিন ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবলো হয়তো কোনো ভাবে পকেট থেকে পড়ে গেছে।

কাইফ বলল, “কই যাবেন বাড়িতে নাকি পার্টি অফিসে।”

“পার্টি অফিসে চল। প্রচারণা কাজ শুরু করতে হবে।”

_______

ঘড়ির কাঁটায় চারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। অয়ন্তিকে সুন্দর করে জারা সাজিয়ে দিয়েছে। লেভেন্ডার কালারটা যেন অয়ন্তির গায়ে খুব সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। সাজ বলতে শুধু চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়েছে, আর ঠোঁট জোড়া গোলাপি লিপস্টিক দিয়ে রাঙিয়েছে তাতেই অয়ন্তিকে অপূর্ব লাগছে। খোপার এক সাইডে দুইটা বড় লাল গোলাপ গুঁজে দিয়ে জারা অয়ন্তিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে।

“আহ! ভাবি তোমাকে‌ সত্যি আজ অপূর্ব লাগছে দেখতে। ভাইয়া নিশ্চিত আজ ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক করবে।”

অয়ন্তি লাজুক হাসল। সত্যি কি আজ তার নেতা মশাই তাকে দেখে হার্ট অ্যাটাক করবে। আজকের রাতটা কি তার জীবনে বিশেষ একটা রাত হতে চলেছে যেই রাতটা সারা জীবন মনের মনিকোঠায় রেখে দেওয়া যাবে। জারা তাঁড়া দিয়ে বলে।

“ভাবি এবার জলদি চলো নিচে হয়তো গাড়ি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”

অয়ন্তি মুচকি হেসে ফোন আর হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পড়ল। শেখ বাড়ির মেইন গেট থেকে বের হয়ে দেখে জাহিনের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জারা এসেছে অয়ন্তিকে এগিয়ে দিতে। অয়ন্তি জারাকে হাত নাড়িয়ে টাটা দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। কিয়ৎক্ষণ পরেই গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়িটা চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেলে জারা বাড়ির ভেতরে চলে আসে।

________

অয়ন্তি চুপচাপ পেছনের সিটে বসে আছে। যে ড্রাইভ করছে তার দিকে একপলক তাকালো মুখে কালো মাস্ক পড়ে আছে লোকটা। অয়ন্তি ফোনের পাওয়ার অন করে টাইমটা দেখল। আধ ঘন্টা হয়ে গেছে এখনও জাহিনের দেখা পাচ্ছে না। লোকটা কত্ত দূরে আছে যে এত সময় লাগছে যেতে। অয়ন্তি ড্রাইভারকে প্রশ্ন করল।

“আর কতক্ষণ লাগবে?”

“এই তো ভাবি চলে এসেছি আর কিছুক্ষণ।”

আরো বিশ মিনিট অতিক্রম হওয়ার পর গাড়ি থামল।‌ অয়ন্তি বুঝল তার মানে সে এসে গেছে। যখনই‌ গাড়ি থেকে নামতে উদ্ধত হতে নিবে তখনই গাড়ির দু সাইডের দরজা খুলে দুজন কালো পোশাকদারি লোক উঠে বসলো অয়ন্তির দু পাশে। অয়ন্তি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। কি হচ্ছে এসব? এরা কারা আর জাহিনেই বা কোথায়? অয়ন্তির মস্তিষ্ক সাড়া দিয়ে বলল কি হতে চলেছে এই মুহূর্তে তার সাথে? সে কারো পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে নি তো আবার। অয়ন্তি ভর্য়াত গলায় বলে।

“কারা আপনার?”

তিন জনের মধ্যেই কেউ কোনো উত্তর দিল না। গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করল। ভয়ে অয়ন্তির হাত পা ঈষৎ কাঁপছে। তারপরও চিৎকার করে বলে।

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা আমাকে? গাড়ি থামান আমি নামবো।”

ড্রাইডিং সিটে বসা লোকটা ধমকের স্বরে অন্য ছেলে দুটোকে বলে, “আরে গাঁদার বাচ্চারা মেয়েটাকে অজ্ঞান কর। মা’রা খাওয়াবি নাকি।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ করছি।”

অয়ন্তির বুকটা ধ্বক করে উঠল। ভয়ে চিৎকার করতে নিলে একটা ছেলে সাথে সাথে রুমাল দিয়ে অয়ন্তির নাক মুখ চেপে ধরে। ধীরে ধীরে অয়ন্তির শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলো। কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। চোখের সামনের নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। চোখের পাতা হাজার চেষ্টা করেও অয়ন্তি খুলে রাখতে পারল না। অয়ন্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ছটফট করার কারণে খোপায় গুঁজে রাখা গোলাপ ফুল দুটো থেকে কয়েকটা পাপড়ি অনাদরে ঝরে পড়ল অয়ন্তির কাঁধে।

__________

জাহিন রাত আটটার দিকে বাড়ি ফিরে। সদর দরজা কাজের লোক খুলে দেয়। জোহরা বেগম ছেলেকে একা আসতে দেখে পেছন থেকে ছেলেকে ডেকে বলেন, “তুই একা যে অয়ন্তি কোথায়?”

জাহিন তাজ্জব বনে গেল মায়ের এহেন কথা শুনে। অয়ন্তি কোথায় মানে? জাহিন মায়ের দিকে ফিরে হতভম্ব হয়ে বলে, “অয়ন্তি কোথায় মানে?”

জোহরা বেগম চিন্তিত স্বরে বলেন, “অয়ন্তি কোথায় মানে? কি বলছিস কি তুই? অয়ন্তির তো তোর সাথে থাকার কথা।”

মায়ের এহেন কথা শুনে জাহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অয়ন্তির তার সাথে থাকার কথার মানে। সে তো সারাদিন এই নির্বাচনের কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত ছিল। জাহিন অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল মায়ের পানে। কি বলা উচিত তার এই মুহূর্তে? জোহরা বেগম পুনরায় বলেন।

“মেয়েটাকে তুই মেসেজ করে বলিস নি যে পাঁচটার দিকে তৈরি হয়ে থাকার জন্য কি সারপ্রাইজ দিবি তুই।”

জাহিন কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেছে। সে কখন অয়ন্তিকে এমন মেসেজ করল। জোহরা বেগমের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে বাড়ির সকলে ড্রয়িং রুমে এসে জড়ো হয়েছে। মায়ের সাথে বোনও সবটা খুলে বলল। জাহিন সব শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। তার ফোন থেকে কখন মেসেজ গেল? সে তো কোনো মেসেজ করে নি অয়ন্তিকে। মনে পড়ে গেল ওই মুহূর্তের কথা যখন জাহিনের সাথে ওই অচেনা লোকটার ধাক্কা লেগেছিল তখন কি কোনো ভাবে লোকটি তার ফোন চুরি করেছিল। আর সে পরে ভেবেছিল ফোনটা হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু চুরি করলেও বা তার ফোনে পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে, তাহলে ফোনের পাসওয়ার্ড খুলে কি করে মেসেজ করল? ফোনের পাসওয়ার্ড সে ছাড়া তো কেউ জানে না। জাহিন দ্রুত হাতে যেই ফোনটা হারিয়েছিল সেই ফোনটা পকেট থেকে বের করে মেসেজ অপশনে ঢুকে, না অয়ন্তিকে করা কোনো ধরনের মেসেজ নেই তার ফোনে। তাহলে কি করে অয়ন্তির কাছে এমন মেসেজ আসলো? কোনো ভাবে কি ফোন থেকে সিম খুলে অন্য ফোনে ঢুকিয়ে মেসেজটা করেছে। জাহিন সেটিং অপশন ঢুকে দেখে তার সিম দুটো উল্টা পাল্টা হয়ে আছে তার ভাবনাটাই ঠিক হল এমনটা করেই অয়ন্তিকে মেসেজ করা হয়েছে আর পরে সেটা ডিলেট করে, তার ফোনে পুনরায় সিম দুটো ঢুকিয়ে ফোনটা গাড়িতে রেখে দিয়েছে। কিন্তু গাড়িতে কি করে রাখলো গাড়ি তো লক করা ছিল? জাহিনের মাথা কাজ করছে না। এতোটা বোকামি কি করে করল তার পরিবার, তার সাথে কথা না বলে অয়ন্তিকে বাড়ি থেকে বের হতে দিল এই সামান্য একটা মেসেজের উপর ভিত্তি করে। জাহিন গম্ভীর গলায় বোনকে প্রশ্ন করল।

“মেসেজটা পাওয়ার পর আমাকে কল করলি না কেন?”

জারা ভয়ে ভয়ে বলে, “ভাইয়া আমি কল করেছি কিন্তু তুমি কেটে দিয়েছিলে। তাই আমরা ব্যস্ত ভেবে তোমাকে আর বিরক্ত করে নি।”

জাহিন আর কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ে। সময় নষ্ট করা যাবে না যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ওলরেডি চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অয়ন্তির নিখোঁজ হওয়ার।

জাহিন বাড়ি থেকে বের হয়ে চিলেকোঠার ঘরটাতে আসে। সেখানে বাড়ির চারপাশের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ ভেসে আছে পাঁচটা কম্পিউটারের স্ক্রিনে। জাহিন বিকাল পাঁচটার দিকের ভিডিও ফুটেজ দেখা শুরু করল চোখ মুখ শক্ত রেখে। অয়ন্তি বাড়ি থেকে বের হয়েছে। অয়ন্তির এমন সাজসজ্জা দেখে জাহিনের চোখ মুখের শক্ত ভাবটা মিলিয়ে যায়, মুগ্ধ চোখে কম্পিউটারের দিকে চেয়ে রইল। ধীরে ধীরে সবটা ভিডিও ফুটেজ দেখল জাহিন। যেই গাড়িটা করে অয়ন্তিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে সেই গাড়িটা সেইম জাহিনের গাড়ির মতো। কিন্তু গাড়ির কোনো নাম্বার প্লেট নেই। সম্পূর্ণ সিসি টিভি ফুটেজ দেখে গায়ের কটিটা খুলতে খুলতে চিলেকোঠার ঘর থেকে জাহিন বের হল। বের হয়েই হাতের কটিটা রাগে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। এই ঠান্ডার মাঝেও তার শরীর ঘামছে।‌ ভিডিওতে দেখা অয়ন্তির হাসি খুশি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে বার বার। কত্তটা খুশি ছিল মেয়েটা আর সেই হাসি খুশি চেহারার মেয়েটা কি অবস্থায় আছে এখন? এসব ভেবেই জাহিনের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নিজেকে শান্ত রাখা যেন বড্ড দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে তার জন্য। কি করে অয়ন্তিকে খুঁজে বের করবে? বড্ড ক্লান্ত লাগছে নিজেকে আজকে। চিলেকোঠার ঘরটার সিঁড়ির মাঝেই জাহিন ধপ করে বসে পড়ল। জাহিনের দিকে সকলেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জাহিন জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে, ক্রোধে তার শরীর কাঁপছে। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে রেখে চেয়ে রইল লাইটের আলো পড়া সবুজ ঘাসের দিকে। মনে মনে বার বার বলছে।

“কোথায় খুঁজব আপনাকে অয়ন্তি কোথায় খুঁজব আপনাকে এই এতো বড় শহরে।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here