একটি_সাঁঝরঙা_গল্প #তানিয়া_মাহি #পর্ব_১৯

0
206

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১৯

“বাড়ির ভেতরে যাবে না, বাবা?”

বাড়ির সামনে এসে বাবা থামলে মেয়েও থামলো। দুই ভাইয়ের বাড়ির মাঝে খুব একটা দূরত্ব না থাকায় দুজন গল্প করতে করতেই হেঁটে এসেছে। বাবাকে নতুনভাবে ইদানীং পাচ্ছে তোয়া। কত পাল্টেছে মানুষটা!

বাড়ির সামনে এসে জাফর সাহেব বললেন,“তুমি ভেতরে যাও। ভেতরে পৌঁছে একটা কল দাও তারপর আমি চলে যাচ্ছি।”

তোয়া বাবার কাছে জানতে চাইলো, তিনি বাড়ির ভেতরে যাবে কি না। জাফর সাহেব ফোনে সময় দেখে বললেন,

“তুই ভেতরে যা, মা। আমি বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমাই।”

তোয়া আর কথা বাড়ালো না। বাবাকে রেখে সে ভেতরের দিকে রওয়ানা দিল। জাফর সাহেব মেয়ের কলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তোয়া ব্যাগটা নিয়ে বাসার দিকে এগিয়ে চলল। বিল্ডিংয়ের সামনে এসেই পিছন ফিরে তাকালো সে। ফোনটা হাতে নিয়ে বাবার নম্বরে কল দিল। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই সে বলল,

“বাবা, আমি চলে এসেছি। তুমি এবার বাড়িতে ফিরে যাও।”
“ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস, মা। আর শোন দুই বাড়ির সবার সিট এক কামরাতেই নেওয়া হয়েছে। বের হওয়ার আগে একবার আমাকে বা নিশোকে কল করিস।”
“ঠিক আছে, বাবা।”
“আমি চললাম তাহলে।”
“ঠিক আছে।”

তোয়া বাসায় ঢুকতেই দেখল ড্রয়িংরুমে সোফায় আবির, ফালাক আর তাদের মা রাবেয়া বেগম বসে বসে গল্প করছেন। রাবেয়া বেগম তোয়াকে দেখেই সহসা বলে উঠলেন,

“ওই যে, তোয়া চলে এসেছে। এবার দুইবোন গিয়ে ঘুমাবি তাড়াতাড়ি। ভোরবেলা কিন্তু উঠতে হবে। রাত জাগবি না। অনেক দূরের পথ।”

আবির কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলল,“দুজন একসাথে থাকবে আর তারা ঘুমাবে এটা চিন্তা করছো? বড্ড বেশি আশা করে ফেলেছ, মা।”

তোয়া এগিয়ে এসে নিজের ব্যাগটা থপ করে নিচে ফেলল। রাবেয়া বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। অভিযোগ করার ভঙ্গিতে বলল,

“দেখেছ, ছোটমা! তোমার ছেলে আমাকে সহ্য করতে পারে না। তোমার ছেলের আমি কী ক্ষতি করেছি বলতে বলো তো? যখন সামনে আসবে তখনই ঝগড়া করবে। এটা বোধ হয় তোমার মেয়ে হয়ে আসতে চেয়েছিল ভুলে ছেলে হয়ে এসেছে কিন্তু ঝগড়া করার বদগুণটা সাথে করে নিয়েই এসেছে।”

আবির তোয়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,”যার কথা তার গায়ে তো লাগবেই। দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললাম যার গায়ে লাগার তার গায়েই লেগে গেল। কে ঝগড়া করে তাহলে? কী প্রমাণ হলো?”

ফালাক কোন কথা না বলে দুজনের কান্ড দেখছে। রাবেয়া বেগম দুই হাত সামনে নাড়িয়ে দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“থাম তো দুজন। সতীনের মতো ব্যবহার কেন তোদের দুজনের? কেউ যেন কাউকে দুচোক্ষে দেখতে পারিস না।”

আবির উঠে দাঁড়ালো। তোয়ার দিকে আঙুল উঠিয়ে রাবেয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,“মা, ওকে নিষেধ করে দেবে। আমি যেখানে থাকব সেখানে যেন ও না থাকে।”

তোয়াও উঠে দাঁড়ালো। কোমরে হাত দিয়ে জোরগলায় বলে উঠল,“আমি যেখানে থাকব তুইও সেখানে থাকবি না। গেইট আউট। আমি এ বাড়িতে চলে আসছি, তুই এখন বাহির হ। বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। এখনই যাবি।”

আবির চোখেমুখে বিস্ময় ফুঁটিয়ে বলল,“আমার বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে যাব? লাইক সিরিয়াসলি! পাগল হয়েছিস বাড়ির লোক জানে? জানাবো? গাধী কোথাকার!”

তোয়া রাগের উত্তাপ বাড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে আবিরের দিকে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে বলল,

“তুই কিন্তু বেশি বেশি বলছিস। তোকে কিন্তু আমি এবার মে*রে নেব বলে দিলাম।” বলেই এদিক ওদিক দেখতে থাকলো তোয়া।

রাবেয়া বেগম তোয়ার হাত ধরে টেনে বসালেন। ওদিকে দুজনের কান্ড দেখে ফালাক হেসেই চলেছে। তোয়া বিরক্ত হয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। রাবেয়া বেগম তোয়ার গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,

“তোয়া, আবির তোর বড় না? বড় ভাইয়ের সাথে এমন করে না, মা। তুই না ভালো মেয়ে। তুই যা। ফালাকের সাথে যেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। ফালাক যা তো তোয়াকে সাথে নিয়ে রুমে যা। ”

শেষের কথাটা ফালাককে উদ্দেশ্য করে বললেন রাবেয়া বেগম। ফালাকের হাসি থামছে না। হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়ালো সে। আবিরের দিকে এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বলল,

“ভাইয়া, তুই এই তোয়াকেই পছন্দ করিস তো? তোয়া নামের অন্যকেউ নয় তো? আমার কিন্তু তোদের দেখে সন্দেহ হচ্ছে।”

ফালাকের কথা শুনে রাগে কটমট করে তাকালো আবির। ফালাক জোর করে হাসি আটকে তোয়ার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে তোয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

“এই যে মহারানী চলে আসুন। আমার মা আপনাদের দুজনকে কীভাবে যে সহ্য করবে সেটাই ভাবছি আমি। আপনাদের সামলাবে নাকি সংসার সামলাবে কে জানে!”

ফালাক কিছু বলে ফেলবে সেই আশংকায় আবির ধমকের স্বরে ফালাককে রুমে যেতে বলল। নিজেও নিজের রুমের দিকে চলে গেল। রাবেয়া বেগম বসে বসে ফালাকের কথা ভাবতে লাগলেন। ফালাক সেদিন তোয়ার কথা জানিয়েছিল। রাবেয়া বেগমের কোন কিছুতেই আপত্তি নেই। ছেলে যাকে পছন্দ করে তাকেই ছেলের বউ করে আনতে তিনি রাজি কিন্তু দুজনের সম্পর্ক এমন সাপে নেউলে হলে আবির পছন্দ করল কীভাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
_____

ভোর চারটা।

দুই বাড়ির সবাই রেল স্টেশনে এসে প্লাটফর্মে বসে আছেন। আবির আর নিশো এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে সবার চোখের আড়ালে সিগারেট খেতে একে একে সিগারেট ধরালো৷ আবির একবার টান দিয়ে ধোয়া বাহিরে ছেড়েছে। নিশো এবার সিগারেটটা ঠোঁটে স্পর্শ করাবে তখনই ফালাকের কথা মনে হতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে। ফালাক সিগারেট পছন্দ করে না। গন্ধ তার কাছে অসহ্যকর লাগে। মেয়েটা তার জন্য এতকিছু করেছে আর সে সামান্য সিগারেটটুকু ছাড়তে পারবে না! ফালাকের কথা ভেবে সিগারেট নামিয়ে নিল সে। হাত থেকে নিচে ফেলে জুতো দিয়ে ঘষে আগুন নিভিয়ে দিল সে৷

নিশোর এই অদ্ভুত কাজ দেখে আবির বলে উঠল,”কী রে! সিগারেট এভাবে নষ্ট করলি কেন?”

নিশো মৃদু হেসে বলল,“তোর বোন সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না।”

গলা খাঁকাড়ির আওয়াজে পিছনে তাকালো নিশো। আবিরও সেদিকে নজর দিতেই দেখল ফালাক দাঁড়িয়ে। আবির তাড়াতাড়ি করে সিগারেট ফেলে দিয়ে ফালাককে উদ্দেশ্য করে বলল,

“কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ, ফুপার নম্বরটা দে। বাবার ফোন থেকে নাকি ডিলিট হয়ে গেছে।”

আবির পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই ট্রেন আসার বার্তা ঘোষণা হলো। নম্বর খুঁজতে খুঁজতে সবার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

“আয়, আমি দিচ্ছি বাবাকে।”

আবির আগে আগে চলে গেল। হেঁটে নিশোর সাথ ধরলো ফালাক। চলার গতি ধীর হলো। নিশো সামনের দিকে দেখিয়ে বলল,

“সময়টা সুন্দর না?”

ফালাক ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,“হুম। আপনি প্রতিদিন ফজর পর আমাকে নিয়ে বের হবেন৷ আমরা এরকম হাঁটবো।”
“প্রতিদিন না বের হয়ে মাসে তিন চারদিন বের হওয়া যায় না?”
“উমম, হুম যায়।”
“আর কী করতে হবে?”
“ওই তো মাসে তিন চার দিন আমার জন্য ফুল আনতে হবে।”
“আর? ”
“আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতে হবে।”
“ব্যস এটুকুই?”
“হ্যাঁ। আপাতত এটুকুই। বাকিটা মনে পড়লে পরে অ্যাড করে নেব।”

দুজনে সবার কাছে পৌঁছতেই ট্রেনের উপস্থিতি বোঝা গেল। সবাই একসাথে বসে থাকলেও জাফর সাহেব একা একা বসে ছিলেন। ট্রেন এসে থামতেই চারদিকের মানুষজন এগিয়ে এলো ট্রেনে উঠার জন্য। জাফর সাহেবও এবার এগিয়ে আসলেন৷ ট্রেন এসে থামতেই নিশো আর আবির মিলে মহিলা চারজনকে তুলে দিয়ে নিজেরা ব্যাগপত্র তুলে নিতে থাকলো। মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। জাভেদ সাহেব ট্রেনে কোনক্রমে উঠতে পারলেও জাফর সাহেব কিছুতেই পারছেন না। জাফর সাহেব উঠার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই পারছেন না। জাভেদ সাহেব ভাইকে দেখতে না পেয়ে দরজার দিকে এগিয়ে এলেন। নিশো দরজার কাছে এসেছিল বাবাকে তুলে নিতে কিন্তু ছোট চাচাকে দেখে একটু আড়াল হলো সে। এমনভাবে রইল যে তিনি কোনভাবে তার বাবাকে উঠিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে নিশো নিজেই বাবাকে তুলে নেবে।

ভাইকে নিচে দেখে জাভেদ সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন। ডেকে উঠে বললেন,“ভাই, হাত বাড়িয়ে দে।”

জাফর সাহেব কিছুক্ষণের জন্য থমকালেন। জাভেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন একপলকে৷ বেশ অন্যমনস্কের মতোই নিজেও হাত বাড়িয়ে ভাইয়ের হাতটা ধরে ট্রেনে উঠে ভারি একটা শ্বাস ফেললেন।

দুই ভাইকে একসাথে দেখে নিশো মৃদু হেসে দরজার বাহিরের দিক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,“আলহামদুলিল্লাহ।”

#চলবে…

গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here