#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ২৪
মধ্যরাত। ঝড়োয়া বাতাসে জানালার পর্দাগুলো অস্বাভাবিক ভাবে নড়ছে। পিটপিট করে আঁখিজোড়া মেলে তাকায় মাহানুর। বাতির আলো চোখে পরতে স্পষ্ট ভাবে তাকাতে পারছে না। মাথা প্রচন্ড ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। ঘোলাটে নয়নে আশেপাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো সে এখন নিজের রুমের বিছানায়। মাথা চেপে ধরে সকালের কথা মনে করতে থাকলো। তাঁদের ওপর কেউ হামলা করেছিলো। আরহামের হাতে তো গু’লি লেগেছিলো! তারা বাসায় কখন পৌঁছালো তবে! আলগোছে উঠে বসে মাহানুর। তার পাশেই হাজেরা শুইয়ে আছে। মাহানুর মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
-বড়মা। ও বড়মা।
মাহানুরের অস্পষ্ট স্বরে ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেলো হাজেরার। উঠে বসলো। বিধ্বস্ত মাহানুরকে দেখে বুক মোচড় দিয়ে উঠলো তার। কতটা মলিন দেখাচ্ছে। আদুরে ভঙ্গিতে মাহানুরের গালে হাত দিয়ে বললেন,
-মা শরীর এখন কেমন লাগছে?
-ভালো কিন্তু মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ। আমরা কখন এসেছি?
-রাত একটার দিকে এসেছিস।
-ওহ! আরহাম কোথায়?
অবচেতন মনে প্রশ্ন করে বসলো মাহানুর। তার রাগ, জেদ নিমিষেই মুছে গেলো আরহামের ওপর থেকে। সেইসময়টা সে দেখেছে আরহাম কেমন। নিজের থেকেও বেশি তার চিন্তা করছিলো সে। এতটাও পাষান হতে পারলো না মাহানুর। একটু হলেও আরহামের মহত্ব ছড়িয়ে পরেছে মাহানুরের চিত্তে। হাজেরা শান্ত কণ্ঠে বলল,
-সে থাকেনি বাসায় চলে গিয়েছে। আরহামের মুখে শুনলাম তোদের ওপর কেউ আক্রমণ করেছিলো নাকি। অজ্ঞান অবস্থায় আরহাম তোকে বাসায় এনেছে।
-অজ্ঞান না ঘুমন্ত অবস্থায়। বিকেলে আমার জ্ঞান ফিরেছিলো কোন সময় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম নিজেও জানি না।
-ওহ। এখন উঠ ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার নিয়ে আসছি। তারপর ঔষধ খেলে সুস্থবোধ করবি।
-সে কেমন আছে বড়মা?
-আরহাম?
-হ্যাঁ। তার তো হাতে গু’লি লেগেছিলো!
-সেটা জানি না। তোকে বাসায় দিয়েই চলে গিয়েছে ও। আমরা এতো বসতে বললাম আমাদের কথা শুনলো না।
মাহানুর আর কিছু বলল না। হাজেরা বের হতেই রুমে এসে উপস্থিত হয় মেহরাব খান আর হামজা খান। রাগী, গম্ভীর মুখ ভঙ্গি মেহরাব খানের। হামজা খান মাহানুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলো,
-আম্মা ঠিক আছিস?
-আছি বড়বাবা।
-ইসসস! মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে!
-আদিখ্যেতা বন্ধ করুন ভাই। এই বেয়াদব আমাদের মাহানুর হতেই পারে না!
শক্ত কণ্ঠে বলল মেহরাব খান। মাহানুর মাথা তুলে বাবার দিকে তাকালো। হঠাৎ বাবার রেগে যাওয়ার কারণ খুঁজে পেলো না সে। মেহরাব খান পুনরায় চেঁচিয়ে বলল,
-আয়াসের মুখে শুনলাম তোমার বেয়াদবির কথা। আরহামকে বকা দিয়েছো!
-ও বলেছে!
মাহানুরের রাগ হলো আয়াসের প্রতি। সে বন্ধু ভেবে আয়াসকে দুঃখের কথা শেয়ার করেছিলো আর এই আয়াইসা তাকে ফাঁসিয়েছে! হামজা খান শান্ত কণ্ঠে বললেন,
-আরহাম তোর স্বামী। ওর সাথে তুইতুকারি বা বকা দিতে পারিস না আম্মা।
-আয়াস শুধু আমার দোষ বলেছে তারটা,,,
-একদম চোপ বেয়াদব মেয়ে।
ধমকে উঠলো মেহরাব খান। মাহানুর কেঁপে উঠলো। বাবার রাগী রুপ দেখে ভীত হলো সে। মেহরাব খান উঁচু স্বরে বলল,
-আসলে দোষ আমাদের। মেয়েকে অনেক বেশি ভালোবেসে মাথায় তুলে ফেলেছি আমি। ছোটকাল থেকে শাসন না করায় বেয়াদবের হাড্ডি হয়ে গিয়েছে। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এতটুকু জ্ঞানও তার মধ্যে নেই!
মাহানুর ছল ছল নজরে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। হাজেরা খাবার নিয়ে আসলো। মেহরাবকে বললেন,
-থাক মেজো ভাই আর কিছু বলিয়েন না মেয়েটা এমনেই অসুস্থ।
-আপনার মেয়ে বড় তো হয়েছে কিন্তু বিবেকবুদ্ধি হয়নি। তাকে বোঝান ভাবি।
ধপধপ পা ফেলে চলে গেলো মেহরাব খান। হাজেরা সান্ত্বনা স্বরে বললেন,
-কষ্ট নিস না মা তোর বাবা অনেক রেগে আছে তাই এইসব বলেছে।
মাহানুর কিছুই বলল না। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুম চলে যায় সে। মনে মনে শপথ করলো যেভাবেই হোক নিজেকে পরিবর্তন করবে সে। আয়াসের সাথে আর কথা ও বলবে না। এখন নিজেকে এইরকম ভাবে আরহামের স্মুখীন প্রদর্শন করবে আরহাম নিজেও অবাক হয়ে যাবে। চোখের অশ্রু মুছে ফেললো মাহানুর।
সকালে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে মাহানুর। সবাই তখন ব্রেকফাস্ট করছিলো। মাহানুর চেয়ার টেনে বসলো। মেহরাব খান কথা তো দূরে থাক তার দিকে তাকালোও না। সারারাত হাজেরা তাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। একজন মেয়ের কাছে স্বামী সংসার কী সেটাও বলেছে। অনেক ভেবেচিন্তে মাহানুর বিশাল বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুস খেতে খেতে আয়াস বলল,
-শরীর কেমন এখন?
মাহানুর কোনো উত্তর দিলো না। আয়াস বুঝলো মাহানুর তার ওপর ক্ষেপেছে। পা ধরে এখন বোনকে মানাতে হবে। আসীন জিগ্যেস করলো,
-গতকাল হয়েছিল টা কী?
-গাড়ি চলছিল আচমকা জিপে করে কিছু মানুষ এসে আমাদের ওপর আক্রমণ করলো।
-কী ডেঞ্জারাস! আরহামের হাতে গু’লি লেগেছে।
-হ্যাঁ। সুনহেরা তুমি তোমাদের বাসায় যাবে না?
-যাবো ভাবি। কেনো?
-না মানে এমনেই।
-আপনি যাবেন?
মাহানুর কিছু বলতে পারলো না। আরহামের জন্য সেও একটুআরেকটু চিন্তিত। এতবড়ো দুর্ঘটনায় এখন কেমন আছে আরহাম সেটা জানার ইচ্ছে জাগলো তার। মেহরাব খান বসা থেকে উঠে চলে গেলো। হামজা খান যেতে যেতে বললেন,
-তোমার স্বামী অসুস্থ আম্মা। কে গেলো বা না গেলো সেটা দেখার বিষয় নয় তোমার যেতে মন চাইলে যাও।
মাহানুর থমথমে বসে রইলো। সুনহেরা এতক্ষণে বুঝলো মাহানুরের মনের কথা। খানিকটা সময় নিয়ে বলল,
-তৈরি হয়ে আসেন ভাবি আমরা যাবো।
মাহানুর মাথা নাড়ালো। আয়াস সুনহেরাকে বলল,
-আমি দিয়ে আসি?
-না আমরা পারবো। আপনি মেডিক্যালে যান।
-ঠিক আছে।
______
মাত্রই চৌধুরী ভিলায় পা রেখেছে মাহানুর আর সুনহেরা। সুনহেরা দৌড়ে ভিতরে চললো। সনিয়া শশুর বাড়িতে বাসায় শুধুই জয়া বেগম আর ভৃত্যরা। সুনহেরা মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-আম্মু কেমন আছো? ভাইয়া এখন কেমন আছে?
-আমি ভালো আছি কিন্তু তোর ভাই ভালো নেই। ঘাড়তেরামি শুরু করেছে।
-আমি ভাইয়াকে দেখে আসছি।
মাহানুরকে রেখেই চলে গেলো সুনহেরা। মাহানুর উস্কোখুস্ক করতে লাগলো। জয়া বেগম মাহানুরের গালে হাত দিয়ে বললেন,
-তুমি কেমন আছো মা?
-ভালো আছি আন্টি। আপনার শরীরটা ভালো আছে?
-এখনও আন্টি? আরহাম আমাকে মা বলে তুমিও সেটা বললে আমি ভীষণ খুশি হবো।
-ঠিক আছে মা।
-খুব সুন্দর! ঠোঁটে কী হয়েছে মা?
-পরে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিলাম মা।
-দেখেশুনে চলাফেরা করবে। যাও তোমার ছিট মেজাজি স্বামীকে দেখে এসো।
-আচ্ছা।
মাহানুর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। একটু একটু সরম করছে তার। আরহাম কী ভাববে। এখনও হয়তো তার ওপর রেগে আছে। মাহানুর নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলল,
-থাকুক গা রেগে আমি আমার শশুরবাড়িতে এসেছি তার কী! কথা না বললে আমিও বলবো না। ইসসস কতখানি ব্যাথা দিয়েছিলো আমাকে!
হাঁটতে হাঁটতে আচমকা নিজেকে পরিবর্তন করবে এটা মনে পরতেই নিজের মাথায় চাপর দিয়ে আবারও বলল,
-ধ্যাৎ! আমি না নিজেকে চেঞ্জ করবো! দুর বা’ল ভুলেই যাই। বি পেশেন্স মাহানুর খান বি পেশেন্স। সংসার বাঁচাতে হলে আর বাবার রাগ থেকে বাঁচতে হলে তোকে এটা করতেই হবে। সকলের সামনে নিজেকে একদম আদর্শ প্রমান করেই ছাড়বো না। জাস্ট আমার ছু’রির মতো যুবান সামলিয়ে রাখতে হবে।
মাহানুর আবারও ভাবলো আরহামের সামনে সে ছোট হয়ে যাবে। কী না কী ভাববে আরহাম তাকে। ভাবনায় বুদ মাহানুর আরহামের রুমের সামনে এসে পরলো। দরজার সামনে আসতেই ভিতর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ শুনতে পেলো মাহানুর। ওড়না শক্ত করে চেপে ধরে ভিতরে প্রবেশ করে। সুনহেরা মাহানুরকে দেখে বলল,
-এতো সময় লাগলো আসতে! এখানে আসেন ভাবি।
মাহানুর মাথা তুলে তাকালো। নগ্ন বুকে বিছানায় বসে আছে আরহাম। তার পাশেই বিছানায় শুইয়ে আছে রিদ। সুনহেরা সোফায় বসা। বিবস্ত আরহামকে দেখে একটু অন্যরকম অনুভূতি হলো তার। লাজে আড়ষ্ঠ হয়ে আরহামের দিকে তাকালো। রিদ বড় একটি হাসি দিয়ে বলল,
-প্রথমবারের জন্য হাসব্যান্ডের রুমে আপনাকে স্বাগত শালিসাহেবা উপস সরি ভাবিজি।
মাহানুর জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসলো। সে আগেও একবার আরহামের রুমে এসেছিলো কিন্তু আজ কেনো অন্যরকম ফিলিংস হচ্ছে! রিদ বলল,
-ভাবিজি হানিমুন সরি ট্যুর কেমন ছিল? আর উমমম আপনার ঠোঁটের দাগ কিন্তু সব কিছুই বলে দিচ্ছে।
সুনহেরা জানে রিদ লাগাম ছাড়া। তাই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সে। মাহানুর আর যেতে পারলো না। হাত, পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আরহাম কপাল কুঁচকে রিদকে বলল,
-ঐ শা’লা মুখে লাগাম টান। সুনহেরা বসা ছিল এখানে।
-ওহ হো সরি।
-তুই যে আমার থেকে মাইর পাওনা সেটা ভুলে যাস না!
-মানুষের ভালো করতে যেয়েও খারাপ হয়ে যাই!
আপসোস কণ্ঠে বলল রিদ। মাহানুরকে বলল,
-থাক তোমাকে আর সরমে ফেলতে চাই না ভাবিজি। আবার মাইন্ড করিও না তোমার জায়গা দখল করে নিয়েছি।
-সমস্যা নেই রিদ ভাই।
-গতকাল রাতে তোমার হাসব্যান্ডকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। গু’লি বের করে বেন্ডেজ করে দিয়েছে ডাক্তার। এখন বেন্ডেজের কাপড় পরিবর্তন করতে হবে কিন্তু সে ঘাড়তেরামি শুরু করেছে। এখন তুমিও চেঞ্জ করে দেও।
-আমি!
-হ্যাঁ তুমি। আমি একটু আসছি।
রিদ চলে গেলো। আরহাম কয়েকবার ডাকলো রিদকে কিন্তু রিদ শুনেও শুনলো না। মাহানুর কিছুক্ষন কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো। আরহাম সন্দীহান নজরে আগাগোড়া পরোক্ষ করে নিলো মাহানুরকে। মাহানুরের প্রতি সুক্ষ্ম চাপা রাগ জমে আছে তার মনে। আরহাম শান্তশিষ্ট পুরুষ বটে তবে তার রাগ, জেদ আকাশ চুম্বে। তার পরিবারের সবাই অবগত তার রাগের প্রতি। শুধু মাহানুরই চিনতে পারলো না এই রাগী, কঠিন্য পুরুষটিকে! আর আরহামও চাচ্ছে না মাহানুরকে নিজের বীভৎস রুপ দেখাতে। যদিও সেদিন এক ঝলক দেখিয়েছিলো!
মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসলো মাহানুর। আরহামের পাশে বসতেই আরহাম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-প্রয়োজন নেই।
মাহানুর কিছু বলল না। টেবিল থেকে গরম পানির বোল এগিয়ে আনলো সামনে। টিসু বের করতে থাকলো। আরহাম ক্ষিপ্ত হলো। বিছানা থেকে নেমে পরলো সে। পরিহিত টাউজার পেন্ট টেনে কিছুটা ওপরে তুলে নিলো। সে মানুষ দেখানো ভালোবাসা চায় না কারো থেকে। যেদিন সত্যিই ভালোবেসে কাছে আসবে সেদিনই মাহানুরের যত্ন উপভোগ করবে সে। মাহানুরের ভ্রু কুঁচকে গেলো। নরম স্বরে বলল,
-উঠলেন কেনো? আমি মুছে দিতে পারি তো।
-রিদ চলে গিয়েছে এখন নিজেকে ভালো সাজানোর প্রয়োজন নেই।
কঠিন কণ্ঠস্বর আরহামের। মাহানুরের রাগ হলেও মনে মনে নিজেকে অনেক কিছু বুঝিয়ে শান্ত করলো সে। ত্বরিত উঠে দাঁড়ালো। আরহাম ওয়াশরুমে যেতে উদ্যত হলে মাহানুর পাশ থেকে তার আরেক বাহু নিজের হাত ধারা চেপে ধরলো। আরহাম সরু চোখে ঘাড় বাকিয়ে মাহানুরের হাতের দিকে তাকালো। মাহানুর আরো কাছে চলে আসলো আরহামের। ধীরে ধীরে বলল,
-আপনি জানেন আমি কতটা বেয়াদব। শুধু শুধু আমার কাজে বাধা কেনো দেন?
একপ্রকার জোর করে আরহামকে বিছানায় বসালো মাহানুর। মাহানুর মনে মনে একটু বেকুব বনে গেলো। সে কী সত্যিই ভালো সাজার জন্য এসব করছে নাকি আরহামের প্রতি সত্যিই তার কোনো ফিলিংস আছে! আরহাম আশ্চর্য। শ্যামবর্ণ মুখে চমকিত ভাব ফুটে রয়েছে স্পষ্ট। মাহানুর নরম হাতে আরহামের বেন্ডেজ খুললো। বেশ ভালোই জখম হয়েছে। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আরহাম চুপচাপ মাহানুরের কাজ দেখছে তো একবার মাহানুরকে দেখছে। পছন্দের মানুষকে দেখার মধ্যেও অন্যরকম শান্তি থাকে। মাহানুর নিজের কাজ করতে করতে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
-সেইদিন আপনাকে গালি দেওয়ার জন্য সরি। কিন্তু আপনিও ভুল করেছিলেন।
আরহাম বিস্মিত হলো কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-তুমি মাহানুর খান তো? নাকি তার মুখোশ করে অন্যকেউ?
-শাট আপ।
মাহানুর কিছুক্ষনের জন্য চোখ বন্ধ করে হাজেরার কথা মনে করলো। সে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে অনেক হাদিস শুনিয়েছে তাকে। মাহানুরও ভেবে দেখলো বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। আরহাম মন্দ লোক না। হাসব্যান্ড হিসেবেও চলে। এখন সে যদি ডিভোর্স না চায় তাহলে নিজেদের সম্পর্ককে সুযোগ দিতে হবে। আরহাম যদি বিয়েটা এতো ইজিলি মেনে নিতে পারে তাহলে সে কেনো পারবে না। মাহানুর খান পারে না এমন কোনো কাজই নেই। ঠান্ডা মাথায় পরিবারের কথা ভেবেচিন্তে একটা ফাইনাল ডিসিশন নিয়েছে মাহানুর। সর্বপ্রথম তার প্রচেষ্টা নিজের রাগকে দমানো।
-তোমার আমাকে সহ্য হয়না তাহলে কেনো এসেছো এখানে? বাবার কথা রাখতে?
আরহামের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলো মাহানুর। শান্ত কণ্ঠে বলল,
-আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো।
-মানে? তোমার বাসা রেখে এখানে কেনো?
-এটা আমার শশুরবাড়ি। সবাই সবার শশুরবাড়িতে থাকে তাই আমিও থাকবো।
-সরি টু সে এটা আপনার শশুরবাড়ি না মিসেস জামাইর বাড়ি।
“জামাইর বাড়ি” জামাই শব্দটায় কিছু একটা ছিল। যখনই মাহানুর কানে এসে পৌঁছালো সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠলো তার। চিত্ত লাফিয়ে উঠলো। মনের ভাবনা বেসামাল হয়ে গেলো। মাহানুর শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-গতরাতে অনেক ভেবেছি আমি। এই সম্পর্কে সুযোগে দিতে চাই। একটা সাধারণ সম্পর্কের মতো করতে চাই আমি।
-ভেবে বলছো? নাকি কারো জোর জবরদস্তিতে?
-আমি কোনো ছোট বাচ্চা নই যে কেউ আমার ওপর জোর ঘাটাবে!
-ওকে। এমনেও আমি তিন কী চারদিন এখানে আছি তারপর তুমি আর আম্মু থাকবে।
-জানি আমি।
-লিসেন্ট নুর, আমার কাউকে জোর করার ইচ্ছে নেই। তুমি এইসব মন থেকে বলছো। তোমার যেদিন মন থেকে আমার সাথে সংসার করতে মন চাইবে সেদিনই এসো।
-আপনার এই বেশি বোঝা আমার পছন্দ না ফৌজি সাহেব। আমি এখনও মন থেকে এসেছি। আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।
-ফৌজি?
-হুম। জিরাফ বাদ দিয়াম যান।
-ঠিক আছে। তোমার যা ভালো লাগে করো।
মাহানুর বেন্ডেজ করতে করতে আরেকটু নিকটে আসলো আরহামের। আরহাম প্রগাঢ় নজরে চোখ বুলাতে থাকে মাহানুরকে। মাহানুরের ডান গালে একটা তিল আছে। আবার থুতনির একটু নিচেই একটা বড়োসড়ো তিল। সেটা ভীষণ এট্রাক্টিভ লাগলো আরহামের কাছে। ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো। মাহানুর আরহামের পুরুষালি বক্ষের দিকে তাকালো। লোমের আড়ালে অগণিত ক্ষতের চিহ্ন। মাহানুর জড়োসড়ো কণ্ঠে বলল,
-এইগুলো কিসের দাগ?
-মেয়েরা আমাকে লাভবাইট দিয়েছিলো সেটারই দাগ এগুলো।
-মেয়েদের রুচি এতো খারাপ না আপনাকে লাভবাইট দিতে আসবে!
-যাদের রুচি মানসম্মত তারাই মেজর আরহাম চৌধুরীকে পছন্দ করবে। কুখাদ্য রুচিকর মানুষরা না!
আরহাম অনেকটা মাহানুরকে ইঙ্গিত করেই বলল উক্ত উক্তিটি। মাহানুর শক্ত চোখে তাকালো। আরহাম নজর সরিয়ে ফেললো। মাহানুর মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ শেষ করছে। আরহাম নিস্পলক মাহানুরকে দেখছে। সে একদম এইরকম মাহানুরকেই চায়। কয়েকটা চুল মাহানুরের মুখে এসে ভীষণ বিরক্ত করছিলো তাকে। আরহাম ফুঁ দেয়। চুল না সরলেও মাহানুর কেঁপে উঠলো মৃদু। কাজে মন থাকায় কখন সে আরহামের এতটা কাছে চলে এসেছে বুঝতেও পারেনি। মাহানুরের নজর পরে তামাটে পুরু পুরুষালি ওষ্ঠজোড়ায়। অনেকটা কালচে খয়েরি রঙের। মাহানুর নজর সরিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ত্বরিত দেখিয়ে বলে,
-আমি আয়াসকে বলি আমার ড্রেস দিয়ে যেতে।
-ঐবাসার কাউকে বলোনি?
-না। এখন বলবো।
-আচ্ছা।
মাহানুর রুম থেকে বের হয়। বড় বড় নিঃশাস ত্যাগ করে সে। বুক লাফাচ্ছে তার। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচে চললো। রিদ আর সুনহেরা বসে কথা বলছে। মাহানুর তাঁদের সাথে যোগ দিলো। জয়া বেগম ফল কেটে নিয়ে আসলেন তাঁদের জন্য। মাহানুরের পাশে এসে বসলেন তিনি। এতক্ষণে সে খেয়াল করলেন মাহানুর খালিহাতে এসেছে। আমতা আমতা করে বললেন,
-মাহানুর জামাকাপড় নিয়ে আসোনি?
-না মা।
-ভাবি তো চলে যাবে তাই নিয়ে আসেনি আম্মু।
সুনহেরার কথায় মুখ ছোট হয়ে গেলো জয়া বেগমের। নরম কণ্ঠে বললেন,
-নিজের বাড়িতে সারাজীবনের জন্য কবে আসবে মাহানুর? আমার একা একা সময় কাটে না।
মাহানুর মনে মনে খুশি হলো নিজের ডিসিশনে। হয়তো এবার সে সঠিক ডিসিশন নিয়েছে। রিদ জয়া বেগমের সঙ্গ দিয়ে বলল,
-ভাবিজি শুভ কাজে দেরি করতে নেই। এসেছো যেহেতু আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
-হ্যাঁ রিদ ঠিক বলছে। থেকে যাও মাহানুর।
-ঠিক আছে মা। আপনি যেহেতু বলছেন আমি কী না থেকে পারি?
জয়া বেগম খুশি হয়ে গেলেন। মাহানুরের কপালে চুমু খেলেন। সুনহেরাও খুশি হলো। মাহানুর সুনহেরাকে বলল,
-সুনহেরা তুমি বাসায় যেয়ে কাউকে দিয়ে আমার ড্রেস পাঠিয়ে দিও।
-ঠিক আছে ভাবি। আমি কিছুক্ষন পরই চলে যাবো।
রিদ সেখান থেকে উঠে আরহামের রুমে আসে। বিছানায় লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আরহাম বিরক্তিকর নজরে তাকিয়ে রইলো। রিদ সুর টেনে বলল,
“আজ দ্বিতীয় বাসর করবে আমার দোস্ত,,,
অথচ আমি এখনও সিঙ্গেল,,
মনে রঙিন রঙিন লাড্ডু ফুটছে আমার বন্ধুর
কখন আসিবে রাত প্রহর গুনছে জনাব,
ওগো বেলাবোস কেনো আমি আজও সিঙ্গেল
বন্ধু আমার বাপ হয়ে যাবে
যে আমারই আগে,
তবে কী বাসর করার স্বপ্ন আমার
স্বপ্নই রয়ে যাবে,,,
আরহাম সপাটে লাথি মারলো রিদকে। রিদ হাসছে আর হাসছে। কিছুটা ঝুঁকে জিগ্যেস করলো,
-দোস্ত ফুল দিয়ে সাজাবো?
-একদম বাজে বকবি না রিদ।
-বলি কী যা করবি একটু আস্তেধীরে । বুঝিসই তো অসুস্থ তুই!
আরহাম বালিশ ছুঁড়ে মারলো রিদের দিকে। রিদকে আর কে পায় তখন।
__________________
সন্ধ্যার পর রাস্তায় ঘুরছিলো রিদ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিছিলো। এমন সময় প্রচন্ড শব্দ করে বেজে উঠলো রিদের ফোন। কথার ফাঁকে রিদ ফোন হাতে নেয়। স্ক্রিনে আব্বা লেখাটা দেখে ছোট ছোট চোখে তাকালো সে। কল রিসিভ করলো।
-কোনদিকে চাঁদ উঠলো আবার! কেনো কল করেছো?
-কোথায় তুমি রিদ?
-জাহান্নামে। আসবে তুমি?
-কথা কম বলে বাসায় এসো বেয়াদব ছেলে।
-কেল্লা? কী কাম?
-দরকার আছে। আসো।
রিদ কল কাটলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলো। মেইন গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আশেপাশে তাকাচ্ছে সে। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো ড্রইংরুমে তার আব্বা, বড়ভাই আর মা বসে কথা বলছে। রিদ এটিটিউড দেখিয়ে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসে পরলো। রিদের মা ছুটে এসে রিদের পাশে বসলো। রিদের গালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-কেমন আছিস আব্বা? কোথায় ছিলি তুই আমি কত চিন্তা করতেছিলাম।
-ঠিক আছি আম্মা। কিসের জন্য ডাকা হয়েছে আমাকে?
রিদের আব্বা গম্ভীর মুখে বসলেন। রিদ বিরক্তকর নজরে পরোক্ষ করলেন তাকে। পুনরায় বলল,
-মৌন থাকার জন্য ডেকেছো?
-তুমি না কোন মেয়েকে পছন্দ করো?
-তোহ? এখন আবার সেটা নিয়ে হরতাল করতে চাচ্ছ?
-চুপ থাকো বেয়াদব। ঐ মেয়েকে নিয়ে আসবে আগামীকাল আর তার পরিবারকে আসতে বলবে।
-কেনো?
-বিয়ের কথা বলবো।
রিদ চোখ গোলগোল করে তাকায়। বিস্মিতবিমূঢ় সে। অবাক কণ্ঠে বলল,
-সত্যি? হঠাৎ মেয়র সাহেবের দাপট এতো নিচে কেনো নামলো? আবার কোন ষড়যন্ত্র চলছে মনে?
রিদের আব্বা শক্ত মুখে রিদকে মনে মনে বকলেন। রিদের বড়ভাই বললেন,
-আব্বা যেহেতু বিয়েতে মত দিয়েছে এতে তোর খুশি হওয়ার কথা নাকি এভাবে কথা ধরার!
-না আমার তো আবার এনার ওপর বিশ্বাস হয় না।
-দিনশেষে আমিও একজন পিতা। সবকিছুর উর্ধে আমার সন্তান। তুমি যেহেতু ওকেই বিয়ে করতে চাচ্ছ তাই ওর সাথেই হবে।
রিদ বসা থেকে উঠে গেলো। খুশিতে আত্মহারা সে। আব্বাকে যেয়ে জড়িয়ে ধরলো। খুশি মিশ্রিত কণ্ঠে গদগদ করে বলল,
-আমি জানতাম আব্বা তুমি রাজি হয়ে যাবে। অনেক অনেক থ্যাংকু।
আচমকা আব্বার গালে চুমু খেলো রিদ। রিদের এইরকম কান্ডে রিদের বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসলো। এতোটাই খুশি রিদ সবার সামনেই নাচানাচি শুরু করছে। ঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলছে তার বিয়ে। রিদ মনে মনে ভাবলো আগামীকালই অহনাকে আসতে বলবে। এখন তার বাবাও আছে। অহনাকে এতো সহজেই পেয়ে যাবে ভেবে রিদ না হার্টএট্রাক্ট করে।
>>>চলবে।
(সকলের মন্তব্য আশা করছি। ❤)