#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ২৭
(নিচের বি:দ্র অবশ্যই পড়বেন।)
ভারী বর্ষণে মুখরিত প্রকৃতি। তার সাথে বাতাস আর বজ্রপাত তো আছেই। কিছুক্ষন পর পর চারপাশ আলোকিত করে বিজলি পরছে। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। অন্যমনস্ক হয়ে সোফায় বসে আছে মাহানুর। হাতে তার ফোন আর সামনে তার ল্যাপটপও অন করা। অহনার কোনো খোঁজখবরই পাচ্ছে না সে। চিন্তায় এখন মাথাও ব্যাথা করছে। সে জানেনা অহনার ফুপ্পির বাসা কোথায়। তবুও বিকেলে অহনার হোস্টেলে গিয়েছিলো কিন্তু কোনো খোঁজই পেলো না। সিয়াম, মুহিবও আপ্রাণ চেষ্টা করছে অহনাকে খোঁজ লাগানোর। দুপুরের খাবারের পর ঘুমের ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে রিদকে। শুধুই পাগলামি করছে সে। কারো কথাই মানে না। তাই তো আরহামকে এই কাজটা করতে হয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে মাহানুর এখন কী করবে। কিভাবে অহনার খবর জানবে। আচমকা তার অবচেতন মনে দুর্দান্ত একটা বুদ্ধি আসলো। দ্রুত ফোন নিয়ে খুঁজতে লাগলো অহনার বাবার নাম্বার। যদিও মাহানুরের জানামতে তার কাছে অহনার বাবার যে নাম্বার আছে সেটা বন্ধ তবুও একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! নাম্বার পেয়ে বিজয়ী হাসি দিলো মাহানুর। কল দিলো। ভাগ্য ভালো ছিল নাম্বার খোলা। ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ কল ধরলো না। মাহানুর আশা ছাড়লো না। পুনরায় কল করলো। ভাগ্যক্রমে কল ধরলো অহনার বাবা।
-হ্যালো আসসালামু ওলাইকুম।
-ওলাইকুম আসসালাম আঙ্কেল আমি মাহানুর বলছি।
-মাহানুর মা! কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল ভালো আছি। আপনার শরীরটা ভালো আছে?
-হ্যাঁ মা। এইযে নেও অহনা।
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলো মাহানুর। অহনাকে ইচ্ছে মতো বকবে বলে শপথ করলো। অহনা শান্ত কণ্ঠে বলল,
-মাহানুর বল?
-কোথায় তুই? কোন চুলার দুয়ারে গিয়ে ঠেকেছিস! ফোন কই? এতবার কল করছি আমরা। তুই জানোস আমার চিন্তায় মাথা ঘুরাচ্ছে! বারবার খুদা লাগছে! তোর কী আমাদের ওপর কোনো মায়া হয় না ছেড়ি?
অহনা চুপচাপ শুনলো মাহানুরের কথা। মাহানুরের কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে সে আসলে কতটা চিন্তিত ছিল সারাদিন। অহনা বলল,
-ফোন সাথে নেই। ফেলে দিয়েছি রাস্তায়।
-কী! আগে তুই বল কোথায় এখন? হোস্টেল আসবি কবে?
-আমি এখন বাসে।
-মানে? বাসে কেনো?
-বাসায় চলে যাচ্ছি। পড়াশোনা আর আগের জীবন থেকে বহু দূরে।
অহনার কথা শ্রবণ হতেই মাহানুরের মাথায় বাঁশ ভেঙে পরলো। অভিমান, ক্রোধ, দুঃখ সবটা মিশ্রণ হয়ে ভয়ংকর রুপ নিলো। কোনোরকম নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বলল,
-ঠিক আছে যা কিছুদিন বাবা মার সাথে থেকে আসলে মন ভালো হয়ে যাবে। জলদি আসবি বুঝলি? আর যেদিন আসবি আমাদের বলিস আমরা নিতে যাবো।
-আর আসবো না আমি মাহানুর। একবারের জন্য চলে যাচ্ছি।
মাহানুর হাসলো। ঐপাশ থেকে অহনাও শুনতে পেলো মাহানুরের হাসি। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতেই আঁখিজোড়া বন্ধ করে ফেললো সে। মাহানুর হাসি মুখেই বলে,
-সিরিয়াস সময়ে মজা করার অভ্যাস তোর আর গেলো না বাঁ’দর!
-আমি মজা করার মুডে নেই মাহানুর। তুই বুঝতে পারছিস না আমার ভিতরে অবস্থা। কাঁচের টুকরোর মতো চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গিয়েছে মন।
অহনার ক্রন্দনধ্বনি শুনে থমকে গেলো মাহানুর। কম্পিত কণ্ঠস্বরে বলল,
-আসবি না আর?
-না। আমি ভালো থাকতে চাই। মানসিক শান্তি চাই।
-সারাজীবন জেনে এলাম মানসিক শান্তির ওপর নাম বন্ধু তবে কী আমি ভুল জানি! তুই একবারও আমাকে বলা প্রয়োজন মনে করলি না এতো বড় ডিসিশন নিয়ে নিলি?
অহনা চুপ। মাহানুরের হাত, পা কাঁপছে। অভিমান গুলো পাহাড় সমান হয়ে উঠলো মুহূর্তে। তাহলে কী সে সকাল থেকে অযথাই চিন্তা করে করছিলো? অহনার জীবনে সে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নয়! মাহানুর তাচ্ছিল্যা স্বরে বলল,
-আজ বুঝলাম আমি তোর আপনজন কখনই ছিলামই না! তুই জাস্ট এখানে থাকতি দেখতি কিভাবে তোর মন ভালোর দায়িত্ব আমি একাই নিতাম! ঠিক আছে যেখানে শান্তি পাস যা। যদি কখন আমাদের কথা মনে পরে আসিস নাহলে আর আসার দরকার নেই।
কল কেটে দিলো মাহানুর। বিছানায় ফেলে দিলো ফোন। নিজের ইমোশন লুকানোর হাজারো চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। কাঁপাকাঁপি পায়ে ওয়াশরুমে যেয়ে ঝর্ণা ছেড়ে সেটার নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। অহনা, রিদের জন্য তারও খারাপ লাগছে। কতই না শখ ছিল অহনার রিদের সাথে সংসার করবে! সে পরিবার বেতীত কখন কাউকে ভালোবাসেনি তাই হয়তো অহনার কষ্টটা সঠিক ভাবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু অহনাকে করা রিদের বাবার অপমান মাহানুরের রগে রগে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। তারও বাবা আছে। কোনোদিন এভাবে তাকে কেউ অপমান করলে নিঃসন্দেহে মাহানুর তাকে কে’টে মরিচ লাগিয়ে দিয়ে আসবে! অহনা তার বান্ধবী। রক্তের সম্পর্ক না হলেও আত্মার সম্পর্ক দুইজনের। মাহানুর মনে মনে নিজেকে নিজেই ওয়াদা করলো রিদের বাবার দেমাগ সে ভাঙে। টাকা-পয়সার গরম না তার? এই টাকা-পয়সা সব ছিনিয়ে তাঁদের ভয়ংকর শাস্তি দিবে। আজ তার বেস্টফ্রেন্ডকে অপমান করেছে কাল আরেকজন মেয়েকে করবে!এদের শাস্তি না দিলেই নয়!
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আরহাম তাঁদের বাড়ির পিছনের ছোট ঘরটিতে শিবুকে নিয়ে কিছুটা ডিসকাস করছে। সাধারণত টিনসিটের দুই রুমের একটি ঘর। টিনে বৃষ্টির শব্দ পরিবেশকে আরো ভয়ংকর করে তুলছে। এক রুমে বিছানা পাতা পরিপাটি কামরা। আরেক রুমে বড় বড় দুইটা সোফা, একটি টেবিল, একটা মনিটর, ওয়ালটিভি আর দেওয়ালে বিশাল বড় একটি মানচিত্রের মতো কাগজ লাগানোর। তবে এটা কোনো দেশের মানচিত্র না। তাঁদের নেক্সট মিশন আর শত্রুদের ট্যাগ করে রাখা হয়েছে সেই মানচিত্রে। ভিডিও কলে কোনভার্সেশন হচ্ছে সকল অফিসারদের মধ্যে। শিবু কোনো সাধারণ যুবক নয়। সিক্রেট এজেন্ট সে। তার পুরো নাম শিহাব মির্জা। নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে বডিগার্ড হিসেবে আরহামের সাথে থাকে সে।
-মেজর চৌধুরী হোপ ইউ ওয়েল সুন।
-আই এম ভেরি ওয়েল নাউ স্যার। আমি আগামীকাল রাতেই আসছি।
-আপনার হাত এখনও তো ইনজুরেড!
-ইটস নট এ বিগ থিং স্যার। আই উইল মেনেজ।
-ডেটস গ্রেট। দেন আপনি আসুন তারপরই কথা হচ্ছে। আর আপনাদের ওপর যে আক্রমণ করেছিলো আমরা ধরে নিতেই পারি সে শত্রুদলের লোক।
-আমিও সেটাই ভাবছি। তাঁদের আমি ঠিক খুঁজে বের করবো।
-আমরা সেটাই আশা রাখি।
কল শেষ হলে ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখলো শিবু। আরহামের মুখ ভঙ্গি কঠিন্য। লাল কালি দিয়ে কয়েকজন মানুষকে টার্গেট করছে সে। শিবু কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
-স্যার শত্রুদল যেহেতু ম্যামকে দেখেছে যদি আপনাকে কমজোর করতে তার ওপর আক্রমণ বা তার কোনো ক্ষতি করে?
আরহাম কুটিল হাসলো। রুদ্ধদার নিঃশাস ত্যাগ করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-তোমার কী মনে হয় শিবু তোমার স্যারের মাথায় গো’বর দিয়ে ভরা?
শিবু হকচকিয়ে গেলো। ত্বরিত কণ্ঠে বলল,
-না না স্যার। ছি! আমি এইরকমটা ভাবতেও পারিনা।
-মেজর চৌধুরীর ওয়াফের দিকে নজর তুলে তো দেখুক সেখানেই কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। আর হাত লাগানো তো দূরেই থাক!
-কিন্তু স্যার তারা আসলেই অনেক ডেঞ্জারেস মানুষ!
-হোক ডেঞ্জারেস। বিষয়টা যখন বউয়ের বেপারে তখন আমিও এক বহুরূপী দানব! তার কোমল শরীরে যাতে আঁচ না লাগে তাই আমি হাসব্যান্ড হয়ে তাকে এখনও ছুঁইনি সেখানে অন্যেরটা আমার কিভাবে সহ্য হবে!
শিবু চুপ হয়ে গেলো। আরহাম কলম কিনারে রেখে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
-তাছাড়াও আমার অন্য বডিগার্ডদের ওপর বিশ্বাস নেই তাই তুমি এখানে থাকবে। তাকে দূরের থেকে পাহারা দিবে।
-কিন্ত স্যার,
-কোনো কিন্তু টিন্তু নয় শিবু। আমি এখন যাচ্ছি ডিনার করতে এসো।
_______________________
সকলে একসাথে ডিনার করছে খান ভিলার। সুনহেরা আড়চোখে আয়াসকে দেখছে আর খাবার গিলছে। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি নত করে ফেলে সুনহেরা। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব ঠুকিয়ে হাজেরার সাথে টেবিল গুছিয়ে নিজের রুমে আসলো সুনহেরা। ফায়াজ আর ফিহা দৌড়ে এসে সুনহেরার হাত চেপে ধরলো বারান্দায়। তাঁদের আবদার এখন তাঁদের সাথে লুডো খেলতে হবে। সুনহেরা ভেবেছিলো এখন রুমে যেয়ে আয়াসের সাথে একটু ঝগড়া করবে কিন্তু এই দুই বাচ্চুর জন্য তার প্ল্যান ভঙ্গ হলো। তার থেকেও বড় কথা তারা দুইজনের একজনও লুডো খেলতে পারে না ঠিক মতো। তবুও সুনহেরা তাঁদের নিরাশ না করে হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো। আয়াস বিছানায় আধশোয়া ছিল। ফায়াজ লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে আয়াসের পাশে শুইয়ে পরলো। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-অ্যাই আয়াস ভাইয়া তুমি এতো শুয়ে থাকো কেনো সবসময়?
-তাহলে কী করবো বড় ভাই?
-আমাদের সাথে খেলবে আর কী করবে!
আয়াস শব্দ করে হাসলো। ফায়াজকে নিজের কোলে বসিয়ে সুনহেরার দিকে তাকালো। ফিহা সুন্দর মতো লুডো বিছানায় মেলে ফেললো। আয়াস উপহাস স্বরে সুনহেরাকে বলল,
-বাহ্! আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্যদের সাথে আপনি লুডো খেলবেন!
-হ্যাঁ। তাঁদের আবদার আমি কী আর ফেলতে পারি!
আয়াসও তাঁদের খেলায় যোগ দিলো। চারজন চার কিনারে বসে পরলো। ফায়াজ না বুঝে উল্টোপাল্টা খেলছে সেটা দেখে সুনহেরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। কিছুক্ষন পর পর আয়াসের ওপর ঢলে পরছে। ফায়াজ খেলার এক ফাঁকে বলল,
-আয়াস ব্রো তুমি কী ভাবিকে কখন হাগ করেছো? কেমন লাগে বড়োদের হাগ করলে?
আয়াস, সুনহেরা দুইজনই থমকে গেলো। পিটপিট করে তাকালো আয়াসের দিকে। আয়াস এমন কথা আশা করেনি ফায়াজের থেকে। আমতা আমতা করে বলল,
-আমি জানি না ভাই। তোকে এইসব কে শিখিয়েছে?
-আরেহ! কেউই শিখিয়ে দেয়নি আমি জানি।
-চুপচাপ খেল ভাই আমার।
-আচ্ছা। আরেকটা প্রশ্ন। তুমি কী ভাবিকে কিস করেছো?
অপ্রত্যাশীত কথা কর্ণকুহর হতেই কেশে উঠলো আয়াস। সুনহেরার দুইগাল লাল হয়ে গেলো লাজে। মাথা তুলে তাকানোর সাহস হলো না আর। আয়াস কোনোরকম নিজেকে স্বাভাবিক করে সন্দীহান কণ্ঠে বলল,
-তুই দিনে দিনে পাকনা হয়ে যাচ্ছিস! দাঁড়া আমি চাচীকে বিচার দিচ্ছি। না জানে কেমন পোলাপানের সাথে চলে এইসব শিখিয়েছিস!
-কাউর থেকেই শিখিনি আয়াস ব্রো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি আসীন ভাইয়া আর সায়রিন ভাবিকে কিসসি করতে। সত্যিই!
সুনহেরা পরেছে মহাবিপদে। এদের সাথে থাকলে লজ্জাও নাক কাঁটা যাবে তার! তখনই তীব্র শব্দে তার ফোন বেজে উঠে। সুনহেরা সঠিক সময়ে এতো দারুণ সুযোগ পেয়ে দ্রুত ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো।
আয়াস ফায়াজকে বিরক্তকর কণ্ঠের বলল,
-কারো ব্যক্তিগত বিষয় লুকিয়ে দেখা ভালো হয় ফায়াজ। আবার এমন করলে আমি চাচীকে বিচার দেবো।
-আর দেখবো না ব্রো।
-হুম গুডবয়। এখন অনেক রাত হয়েছে তোমরা রুমে যেয়ে ঘুমাও।
-ঠিক আছে। টাটা। গুডনাইট।
ফায়াজ আর ফিহা চলে যেতেই আয়াস দরজা লাগিয়ে বিছানায় আসে। আড়চোখে সুনহেরার দিকে তাকালো। বিরক্তে চোখ, মুখ কুঁচকে গিয়েছে সুনহেরার। কয়েকবার রিং হচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করলেই ঐপাশ থেকে কেউ কথা বলে না। সে এতো বার হ্যালো হ্যালো করছে, পরিচয় জিগ্যেস করছে কোনো খবরই নেই! শেষের সুনহেরা রাগে নাম্বারটা ব্লক করে দিলো। রুমে আসতেই আয়াস জিগ্যেস করলো,
-কে কল দিয়েছিলো?
-জানি না। অচেনা নাম্বার হয়তো আমার কোনো ফ্রেন্ড মজা করছে।
-হ্যাঁ হতে পারে। লাইটটা বন্ধ করে দিয়েন।
-এখনই ঘুমাবেন!
-তাহলে কী করবো?
-না মানে স্টাডি করবেন না?
-না আজকে ভীষণ খুব পাচ্ছে তাই ঘুমাবো।
-আচ্ছা।
আয়াস বিছানা করে নিজের জায়গায় শুইয়ে পরলো। সুনহেরা ফ্রেশ হয়ে এসে লাইট বন্ধ করে আয়াসের পাশে ঘুমিয়ে পরলো। এক বিছানায় ঘুমালেও তাঁদের মধ্যকার দূরত্ব অনেক। মধ্যে একটা কোলবালিশ। দুই প্রান্তের দুই মানুষ ঘুমানোর প্রয়াস করতে থাকলো।
_____________
বৃষ্টি কমেছে। শীতল হাওয়া বইছে বাহিরে। চেয়ার পেতে আরহাম আর রিদ বেলকনিতে বসে আছে। দুইজনই মৌন। পাশেই অগণিত আধ পোড়া সি’গা’রেটের মেঝেতে পরে আছে। রিদের আঙুলের ফাঁকেও জ্বলজ্বল করছে একটি সিগা’রেট। ডিনারের পর্ব ঢুকিয়েছে বেশ আগেই। রিদের মেডিসেনের পাওয়ার শেষ হয়েছে রাত আটটার দিকে। সে কিছুই খাবে বলে জেদ ধরেছিলো। আরহামের ওপরও ভীষণ রেগে ছিল রিদ। কেনো না সে জানে আরহামই তাকে ঘুমের মেডিসিন দিয়েছিলো। মাহানুর আর আরহাম কোনোরকম জোর করিয়েই খাওয়ায় রিদকে। একদিনের কী করুণ অবস্থাই না হয়েছে ছেলেটার। চোখ ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। শুকনো, ফ্যাকাসে মুখ। সরু নজরে চোখ বুলাচ্ছে আরহাম। এই মানুষটার এইরকম পরিণতি না হলেও পারতো!
-তুই আমাকে ঘুমের ঔষধ কেন খাইয়েছিলি শা’লা? তোর কী এখন আমাকে পাগল মনে হয় যে ঔষধ খাইয়ে দমিয়ে রাখবি?
অগোছালো কণ্ঠস্বর রিদের। আরহাম শার্টয়ের ওপরের একটা বোতাম খুলে আয়েস করে বসলো। স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
-ঘুমের ঔষুধ খেলে শরীর ভালো থাকে তাই খাইয়েছি।
-বা’লের পেঁচাল।
-এখন আর কয়টা শেষ করবি? একদিনে কলিজা পুড়িয়ে ফেলতে চাস?
-কলিজা! ধেৎ সেটা তো বহু আগেই পুড়ছে আমি খালি শান্ত করার চেষ্টা করছি।
তাচ্ছিল্যা কণ্ঠস্বর রিদের। আরহাম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-আরেকটা প্যাকেট এনে দেবো?
-লাগবো না তিনটা আছে।
আরহাম দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। রিদ ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে আনমনে বলল,
-মাহানুর অনেক ভালো মাইয়া।
-হয়তো!
-প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম মনে মনে ভেবেছিলাম এই মাইয়া যার কপালে আছে সে শেষ! আমাকে মারার থেড দিয়েছিলো! কিন্তু এখন আমি ভাবি এই মাইয়া যার কপালে আছে সে সত্যিই একজন কিসমত আলা লোক! ও রাগী, জেদি কিন্তু ওর মনে সবার প্রতি দরৎও অনেক। দেখলি না আমি ওর বেস্টফ্রেন্ডকে হার্ট করেছি তারপরও কিভাবে আমাকে আপনিয়ে নিলো!
আরহাম মুচকি হাসলো। প্রিয় মানুষের সুনাম শুনতে কার না ভালো লাগে! অন্যমনস্ক হয়ে বলেই ফেললো,
-আমিও নিজেকে লাকি মনে করি। মেয়ে হিসেবে লাল মরিচ হলেও স্ত্রী হিসেবে বেস্ট।
এবার রিদও স্মিত হাসলো। একটি জ্বলন্ত সি’গা’রেট এগিয়ে দিলো আরহামের নিকট। আরহাম সেটা নিলো না। রিদকে অবাক করে দিয়ে নাকোচ করে দিলো। রিদ আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
-আমাদের স্মোকিং মাস্টারের হঠাৎ অরুচি কেল্লা?
-সে সিগা’রে’টের গন্ধ সহ্য করতে পারে না তাই বাসায় থাকাকালীন এইসব থেকে দূরে থাকবো ভেবেছি।
-আরেহ বাস্! প্রেমিক পুরুষ হয়ে গিয়েছিস!
-ঐ আর কী। ঘুমা এখন।
-আমি কালকে চলে যাবো। বন্ধুর বাসায় থাকলে মানুষই বা কী ভাববে!
-হোপ। এই অসুস্থ শরীরে আমিও যেতে দিমু না মাহানুরও দিবে না।
-এক দুইদিন থাকলাম কিন্তু তারপর আমার বাসা ভাড়া নিতে হবে।
আরহাম মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
-তুই তো আমার বাসায়ই ভাড়া থাকতে পারিস। ধানমন্ডি লেকের ঐখানে যে বাসা বানিয়েছিলাম সেটায় একটা ফ্লাট খালি আছে।
-সত্যিই?
আরহাম উঠে দাঁড়ালো। রিদের পিঠে চাপর দিয়ে বলল,
-বন্ধু যদি বন্ধুর সাহায্যে না আসে তাহলে কিসের বন্ধু! আগামীকাল তোকে নিয়ে দেখিয়ে আসবো। কয়েকদিন এখানে থাকবি তারপর যাবি। আর হ্যাঁ চাকরির ব্যবস্থাও করে দিবো।
রিদ উস্কোখুস্ক করে বলল,
-চাকরি করতে হবে!
-অবশ্যই। অহনাকে পেতে চাইলে আগে তোকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে বেটা।
রিদ মাথা নাড়ালো। আরহাম চুলগুলো ঠিক করে বাহিরে তাকায়। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি তার মুখে এসে পরছে। রিদ কণ্ঠস্বর খাঁদে ফেলে বলে,
-যা রুমে যা এখন মাহানুর তো একা।
-যাচ্ছি। তুই ঘুমিয়ে পর।
-হুম।
সোফায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে মাহানুর। কিভাবে কী করবে সেটাই ভাবছে সে। ভাবনায় ডুবে থেকেই পাশ ফিরতে একদম মুখোমুখি আরহামকে দেখে হকচকিয়ে গেলো মাহানুর। অনেকটা ঝুঁকে আরহাম দেখছিলো মাহানুরকে। মাহানুর মাথা ঘুরিয়ে কিছুটা দূরে যেয়ে বসলো। অগোছালো স্বরে বলল,
-ভুতের মতো হুটহাট এতো সামনে কেনো চলে আসেন আপনি? আরেকটুর জন্য আমার ছোট প্রাণটা উড়ে যেত!
আরহাম কিছু বলল না। একই ভঙ্গিতে শুধু তাকিয়ে রইলো। মাহানুর উত্তর না পেয়ে আবারও আরহামের দিকে তাকায়। এমন বেহায়া চাহনি দেখে তার একটু লজ্জা লজ্জা লাগছে। ওড়না ঠিক করে পা গুটিয়ে ছোটোখাটো হয়ে বসলো। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
-কী চাই আপনার?
-তোমাকে।
-হোয়াট! আর ইউ গন্যা ম্যাড!
চমকিত কণ্ঠস্বর মাহানুরের। অতিকৃত মুখভঙ্গি। আরহাম যেনো ভীষণ মজা পেলো মাহানুরের রিঅ্যাকশন দেখে। আরেকটু ঝুঁকে গেলো মাহানুরের দিকে। দুইজনের মধ্যখানে মাত্রই এক আঙুলের দূরত্ব। বিমোহিত নজরে তাকিয়ে বলল,
-অ্যাকচুয়ালি রাইট আই এম গন্যা ম্যাড। মাই ফা*কিং মাইন্ড জাস্ট ওয়ান্ট ইউ এন্ড ইউ!
মাহানুর বোকা বনে গেলো। আরহাম মাহানুরের গা ঘেঁষে সোফায় বসে পরলো। মাহানুর আরহামের কার্যকলাপে অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে। দ্রুত বসা থেকে উঠে চলে যেতে নিলে আরহাম তার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে দিলো। মাহানুর বিস্ময়বিমূঢ়। তাল সামলাতে না পেরে একহাত আরহামের পায়ের ওপর রাখলো। একহাত দিয়ে মাহানুরের কোমর বন্দি করে ফেললো আরহাম। আরেকহাত দিয়ে মাহানুরের কাঁধের পাশ থেকে চুল সরিয়ে সেখানে থুতনি রাখলো। কয়েকবার নাক টেনে ঘ্রাণ শুকলো মাহানুরের মেয়েলি কায়ার। মাহানুর কাঁপছে। আরহামের জন্য এর থেকে বড় অবাক করার বিষয় আর কিছুই না। তেজি মাহানুরও পুরুষের সনিকটে আসলে কাঁপে তবে! মাহানুরের কানের সামনে মুখ নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
-আমাকে কী তোমার ভয়ংকর দানব মনে হয়? যখনই কাছে আসি খালি পালাও পালাও করো কেনো?
-ছাড়ুন আগে।
-আয়হায়! আমার সাহসী ওয়াইফি আবার ভীতও হয় বুঝি!
মাহানুর কাঁপাকাঁপি থেমে গেলো। নিজেকে কিছুটা কঠোর করে বলল,
-হুটহাট ধরাধরি আমার পছন্দ না।
-কিছু করার নেই অভ্যাস করতে হবে।
>>>>চলবে।
(বি:দ্র :- আসসালামু ওলাইকুম। তিনদিন ধরে অনেক বেশি অসুস্থ আমি। জ্বরে মাথা উঁচু করতে পারছি না, অস্বাভাবিক গলার ব্যাথা। তারওপর রোজা থেকে আমি প্রায় আধম’রা। ডাক্তার বলল হয়তো ডেঙ্গু হয়েছে তারপর রক্ত পরীক্ষা করেছি। এখন রিপোর্ট আসলে সিউর হতে পারবো। আপনারা প্লিজ আমার ওপর রাগ করবে না গল্প দেরিতে দেওয়ায়। একবার ঈদটা গেলো আর আমি সুস্থ হলে প্রতিদিন গল্প দেবো।
আজকের পর্বে রি-চেক করিনি। ভুলক্রুটি হবে ক্ষমা করবে। আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই। ধন্যবাদ)