#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ৩০
শেষ রাতে চোখ বুজেছিলো রিদ। শীতল আবহাওয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলো ক্ষণেই। গুনগুন কান্নার শব্দে সুন্দর ঘুমটা ফুস করে ভেঙে গেলো তার। ঘুম জড়ানো চোখে জানালার বাহিরে তাকালো। বৃষ্টি কমেছে। দূর থেকে গাছপালা নড়তে দেখা গেলো। মানে এখনো বাতাস আছে। নির্জন পরিবেশে কান্নার শব্দটা কেমন যেনো ভুতিয়া পরিবেশ সৃষ্টি করছে। রিদ ছোটকাল থেকেই ভৌতিক বিষয়ের প্রতি অনেক ভীত। তার বয়স যখন পনেরো ছিল তখন পরিবারের সাথে দেশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো। সেখানে একজন বৃদ্ধ মহিলাকে ভুত ছাড়াতে দেখেছিলো নিজের চোখে। তিনদিন ভয়ংকর জ্বরে ভুগেছিলো সে। তারপর থেকেই ভুত শব্দের প্রতি তার ভয়ের শেষ নেই। এখনো ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসলো। ঘড়িতে সময় এখন চারটা দুই। ভোরের আজান দেয়নি এখনো। এইসময় ভুতরা বেশি বাহিরে ঘুরাঘুরি করে! মনে মনে ভাবলো রিদ। ধীরে ধীরে কান্নার তীব্র আওয়াজ বেড়েই চলেছে। রিদ বিড়বিড় করে দোয়া পাঠ করে বিছানা থেকে নামলো। লাইট অন করে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে নিজেই বলল,
-আরেহ বেটা তুই রিদ। তোরে কোনো ভুতের ধরার সাহস আছে নাকি! এখন সাহসী পুরুষের মতো দরজা খুল।
কাঁপাকাঁপি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই খানিকটা পিছিয়ে গেলো রিদ। অন্ধকারে ডুবে আছে বারান্দা। রিদ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে এগিয়ে গেলো। ক্রন্দনধ্বনি অনুসরণ করে সামনে এগোচ্ছে। বুক ধক ধক করছে তার। মধ্যের একটি রুমের দরজার সামনে এসে রিদের পা জোড়া থেমে গেলো। ভিতর থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে। রিদ সহসা দরজায় ঠোকা দিতে যাবে তার পূর্বেই পিছন থেকে একটি মেয়েলি আর্তনাদ শোনা গেলো,
-ওমা গো ভুততততততততত!
রিদের ভয় আরো দ্বিগুন বেড়ে গেলো যেনো। পিছনে না ফিরে সেও একই ভঙ্গিতে উঁচু শব্দে চিৎকার করে উঠলো,
-ভুততততততত! আরহাম শা’লা তোগো বাসায় ভুত আছে আমাকে আগে কেনো বলিসনি! ওমা গো তোমার পোলারে মাইরা ফালাইলো ভুতে।
চিৎকারের শব্দে গভীর তন্দ্রা উবড়ে গেলো মাহানুরের। ডিম লাইটের আলোতে বিছানা ছেড়ে নামলো। বাতি জ্বালিয়ে রুম আলোকিত করে দিলো। কোনোরকম গলায় ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলে বের হয়। হাত বাড়িয়ে বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে দিলো। হাতে পানির জগ নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে রুমকি আর হাঁটুগেড়ে চোখ বন্ধ করে মেঝেতে বসে আছে রিদ। মাহানুর কিছুই বুঝলো না এখানে হচ্ছে টা কি। এগিয়ে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে রিদকে ডাকলো,
-রিদ ভাই?
-বাহ্ বাহ্ রিদ! তোকে সবাই কত সম্মান করে। ভুতও তোকে ভাই বলছে!
-কিসের ভুতের কথা বলছেন আপনি? আমি তো মাহানুর।
-ভুত কী মাহানুর হয়ে গেলো নাকি!
বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো মাহানুর। গলা ঝেড়ে চিৎকার করে বলল,
-এখানে কোনো ভুত টুত নেই রিদ ভাই।
রিদ এবার মাথা ওপরে তুললো। পাশ ফিরে মাহানুরকে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেকি হেসে সেও দাঁড়িয়ে গেলো। রুমকিকে দেখে চোখ ছোট ছোট করে বলল,
-কিরে তুই কী ভুত সেজে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলি?
-দুর না না। আমি তো পানি নিতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি আপনি আমাদের রুমের দরজার সামনে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন রিদ ভাইয়া।
মাহানুর বিরক্তিকর স্বরে বলল,
-আমি বুঝতে পারছি না কিসের ভুত নিয়ে কথা হচ্ছে আপনাদের মাঝে?
-আরেহ কার যেনো কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। বাহিরে এসে দেখি এই রুম থেকে আওয়াজ আসছে। তার মধ্যে এই রুমকি এসে চিৎকার করে আমাকে ভয় খাইয়ে দিয়েছে!
-ওহ গড! এতো কাহিনী কিভাবে হয়!
-আপনি ভুল শুনেছেন রিদ ভাই আপু তো ঘুমিয়ে আছে। আর কান্না কে করবে আবার!
-ঐটাই। আচ্ছা যাও ঘুমাও।
রুমকি নিজেদের রুমে চলে গেলো। মাহানুর আশেপাশে পরোক্ষ করে নিলো। রিদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
-আরহামের সাথে শেষ দেখা করেছো ভাবি?
-সে তো এখনো যায়নি।
রিদ স্মিত হাসলো মাহানুরের কথায়। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
-কিছুক্ষন আগেই চলে গিয়েছে তোমার স্বামীমহাশয়। তুমি হয়তো ঘুমিয়েছিলে তাই আর ডাক দেয়নি।
মাহানুর অবিশ্বাস নজরে তাকালো রিদের দিকে। বিস্ময়বিমূঢ় সে। আকস্মিক স্বরে বলে,
-সত্যি চলে গিয়েছে সে?
-হুম। তুমি,,,,
কথা শেষ করতে পারলো না রিদ। তার আগেই ধুরুম ধুরুম পা ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো মাহানুর। তার মুখের ভঙ্গিমাই বলে দিচ্ছে ঠিক কতোটা রেগে আছে সে। রিদ দুইপাশে মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে গেলো। মাহানুর দরজা লাগিয়ে ধপ করে সোফায় বসলো। সে কী আরহামের কাছে এতটাই মূল্যহীন? একবার কী ডেকে বলতে পারতো না সে! অজানা পীড়ায় বুক ফেটে যাচ্ছে মাহানুরের। এখন এই পীড়া আরহাম তাকে বলে যায়নি এর কারণে নাকি আরহামকে সে অনেকদিন দেখতে পাবে না বলে! মাহানুর আশেপাশে চোখ বুলালো। অগোছালো রুম। আরহামের ল্যাপটপ নেই। কেমন যেনো একটা দম বন্ধকর অনুভূতি ছেয়ে আছে। বিষণ্ণ মুখে বিছানার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ছোট টেবিলের ওপরে একটি কাগজ দেখতে পেলো মাহানুর। আগ্রহ নিয়ে হাতে তুলে নিলো সেটা। সাদা কাগজের একটি চিঠি। গোটা গোটা অক্ষরে স্পষ্ট কয়েকটা বাক্য লেখা চিঠিটায়।
“প্রিয় নুর,
জানি আপনাকে বলে যাইনি বলে একটু হলেও আমার ওপর রাগ জমা হবে আপনার। আই এম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট মাই লাভলী ওয়াইফি। তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেক বেশি শ্রী লাগে তাই আর ডাক দিতে মন চাইলো না সেইসময়। সুযোগ পেলে কল করবো। নিজের খেয়াল রাখবে। কোনোরূপ গেঞ্জামে নিজেকে জড়াবে না। শরীরের যত্ন নিবে। মনে রাখবে ঐ শরীর তোমার না যে অবহেলা করবে! তার মালিক এখন আমি। শিবু বাসায়ই থাকবে। যেকোনো দরকারে তাকে বলবে। রাতে বাসা থেকে বের হবে না। আমি তোমাকে মিথ্যে আশা দেবো না নুর। যদি কোনোভাবে আমি আর তোমাদের মাঝে না ফিরতে পারি তাহলে আমাকে কিন্তু ভালো একটি স্মৃতি হিসেবে মনে রাখবে। আর জীবনে আগে বাড়বে। পড়াশোনায় ফোকাস করো আর নিজের স্বপ্ন পূরণ করিও। আজ এই পর্যন্তই থাক। বাকি কথা কল করেই নাহয় বলবো। বিদায়।
ইতি
তোমার একান্ত ব্যক্তিগত
ফৌজি সাহেব।”
চিঠিটা বুকের সাথে চেপে বসে রইলো মাহানুর। কিছু একটা ছিল চিঠিটার মধ্যে। তার মনের সকল অনুভূতি গুলোকে কেমন এলোমেলো করে দিলো। অজান্তেই আরহামকে ভালো লাগতে শুরু হয়েছিলো তার। কিন্ত আরহাম এভাবে চলে গিয়ে তার ক্ষীণ মনকে অস্থির করে গেলো। অপূর্ণতার জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে গেলো।
____________________
সূর্যের কিরণ ছিটফোঁটা মুখে পরতেই পিটপিট করে চোখ খুলে সুনহেরা। মাথার অসহ্য ব্যাথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো। দুইহাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে উঠে বসলো সে। চোখ মেলে পাশে তাকালো। বিছানা খালি আয়াস নেই। সবসময় জানালায় পর্দা দিয়ে দেয় আয়াস যাতে সুনহেরার ঘুম না নষ্ট হয়। তবে আজ দেয়নি কেনো! ঘড়িতে এগারোটা বাজে। সুনহেরার মেজাজ চটে গেলো। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলো সে! সবাই কী না কী ভাবছে! বৃষ্টিতে ভিজলে ছোটকাল থেকেই তার জ্বর আসে, নাহয় অজ্ঞান হয়ে যায়। তার বাসার কেউই তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়না। গতকাল আয়াসকে মানিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিলো বাট এখন জ্বরের কারণে মাথা সোজা করতে পারছে না।
কোনোদিক না তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো সুনহেরা। কাবাড থেকে ড্রেস বের করার সময় নিজের দিকে নজর পরলো তার। আয়াসের টি-শার্ট আর পেন্ট পরা সে। তার মানে রাতে যখন সে অজ্ঞান ছিল আয়াস তার ড্রেস পরিবর্তন করে দিয়েছে! চোখ, মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো সুনহেরা। লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। ছি ছি! কত লজ্জা! এখন আয়াসের সামনে যেতেও লজ্জায় মরে যাবে সে। কাবাড থেকে ড্রেস নিয়ে বড় বড় পা ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো সুনহেরা। কিছু সময়ের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে আসে। পুরুষেরা সকলে অফিসে চলে গিয়েছে বাড়িতে এখন শুধু মহিলাগণ আছে। হাজেরা সুনহেরাকে ডায়নিং টেবিলে বসিয়ে দিলো। ব্রেকফাস্ট করতে করতে সুনহেরা হাজেরাকে জিগ্যেস করলো,
-মা আপনার ছেলে কী মেডিক্যালে চলে গিয়েছে?
-হ্যাঁ। তোমাকে আজকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতে না করে গিয়েছে। রাতে বৃষ্টিতে ভিজে নাকি জ্বর বাঁধিয়েছো?
-ঐ আর কী একটু জ্বর হয়েছে মা।
-জ্বর আবার একটু হয় নাকি! দ্রুত নাস্তা করে মেডিসিন খেয়ে বিশ্রাম করো।
-জি মা।
লুৎফা তৈরি হচ্ছে ফায়াজ আর ফিহাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে যেতে। কিছুদিন আগে দুইজনকে প্লে তে ভর্তি করেছে। বয়স কম হলেও দুইটায়ই পাকনা তাইতো এইটুকু বয়সেই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। সায়রিনও তৈরি হচ্ছে তার এক বান্ধবীর বাসায় যাবে। সুনহেরার খাওয়া শেষ হলে লুৎফাকে বলে,
-চাচী আমিও আপনার সাথে যাই? বাসায় একা বসে থাকতে বোরিং লাগে।
-ঠিক আছে চলে এসো। আমিও একজন সাথী পেয়ে যাবো।
-আমি এখনই ব্যাগ নিয়ে আসছি।
সুনহেরা নিজের রুমে যেয়ে মাথায় হিজাব বেঁধে সাইড ব্যাগ নিয়ে আসে। হাজেরা জোর করে তাকে জ্বরের মেডিসিন খাইয়ে দেয়। সায়রিন একটু পর বের হবে তাই সুনহেরা আর লুৎফা বেরিয়ে পরে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। লুৎফা আর সুনহেরা একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে।
ভার্সিটি এসেছিলো সিয়াম আর মুহিব। অহনা আর মাহানুর নেই যার জন্য তাঁদেরও মন বসছে না এখানে। আজ মাহানুর অফিসে যাবে। প্রথমদিন আজ তার। সিয়াম রাস্তায় দাঁড়িয়ে সি’গা’রেট জ্বালিয়ে মুহিবকে বলল,
-ক্লাস করবি?
-দুর বা’ল ভালো লাগে না। নতুন একটা বে’ডা আইসে একটু ক্লাস ফাঁকি দিলেই কু’ত্তার মতো খেউ খেউ করে! হেই ভুইলা যায় আমরা যে অনার্স এর স্টুডেন্ট।
-হো ঠিক ঠিক। শা’লায় বউয়ের রাগ আমাগো ওপরে উঠায়!
-বেডায় বলে এখনো সিঙ্গেল। দেখস না মাইয়ারা কেমনে উল্টাইয়া পরে!
-ঠিকই আছে এইরকম রাগী বেডারে কেডা বিয়া করবো!
-হো একদম। ক্লাস করুম না চল মাহানুরকে দেখে আসি।
-হুম চল। ঐ অনেক খুশি হইবো একটা ফুলের তোড়া নিয়ে নেই।
-বাহ্! গাধার মাথায়ও দেখি বুদ্ধি ফুটছে!
-তুই গাধা। তোর ১৪ গুষ্টি গাধা শা’লা।
-চল এখন।
রিদ আজ নিজের ফ্লাটে উঠেছে। আরহাম তো আগের থেকেই তার জন্য রুম গুছিয়ে রেখেছে। আজ তার চেলাপেলাদের নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষন পর কাজে যাবে। আরহাম তার ভাই না হলেও ভাইয়ের থেকে বেশি করে। এই যেমন শুধু থাকা না কাজের ব্যবস্থা করেও দিয়ে গিয়েছে! অথচ তার আপন ভাইদের খবর নেই! রিদ তার চাঙ্গোপাঙ্গদের রুম দেখাচ্ছে। একটায় তো বলে উঠলো,
-বস এতো বড় ফ্লাটে আপনি একা কিভাবে থাকবেন? যদি ভুত আসে!
-হা’লা ভুতের কিছু কইস না। এখন একা থাকুম না তোরা আমার লগে এখানেই থাকবি।
-কিন্তু বস পরে ভুতে আমাগো ও তো নিয়ে যাইবো গা।
-হোপ হা’লা। খালি ভুত ভুত!
-সরি বস। অহনা মেডামও কী আপনের লগে এই বাড়িতেই থাকবো বস?
-হো। তোগো মেডাম আর আমার এখানে সুন্দর একটা সংসার হইবো।
-আমরা ঐটা দেখার আশায়ই আছি বস। আপনের মনের আশা পূরণ হইবো।
-ইনশাআল্লাহ।
রিদের কথায় সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিদের মেজাজ গরম হয়ে গেলো। একটার পিছনে লাথি দিয়ে বলল,
-শা’লারা আমিন কো।
-আমিন।
রিদের ধমকের ভয়ে সবাই একসাথে বলে উঠলো। রিদ বড় একটি হাসি দিলো। যেনো সে এখনই অহনাকে পেয়ে গিয়েছে!
মাত্রই নিজেদের অফিসে এসে গাড়ি থামলো মাহানুরের। একটু লেট হয়ে গিয়েছে আসতে। মনে মনে নিজেকে ইচ্ছে মতো বকলো। প্রথমদিনই যদি এইরকম দেরি হয় অন্যদিন যে কী হবে কে জানে! মাহানুর আগেও কয়েকবার তাঁদের অফিসে এসেছিলো তবে এইবার ফিলিংসটা অন্যরকম। এখন সে ঘুরতে আসেনি বরং একজন ওনার হিসেবে এসেছে। প্রথমে একজন সাধারণ এমপ্লয়ী হিসেবে কাজ করতে চাইলেও হামজা খান বারণ করলেন। সে এখন কাজ থেকে অবসর নিতে চাচ্ছেন তাই একপ্রকার জোর করেই মাহানুরকে তার পদ দিয়ে দেন। তাঁদের কোম্পানির সে সাইড হামজা খান গাইড করতেন এখন মাহানুর সেটা করবে। প্রথমে আসীনকে বলেছিলো কিন্তু সে নিজের পদেই থাকবে। আয়াসকে বললে সে একদম ইগনোর করে দেয়। শেষে জোর করে মাহানুরের কাঁধেই তুলে দিলো সম্পূর্ণ দায়িত্ব। গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই মাহানুর দেখতে পেলো সদর দরজার স্মুখীন তার বাবা, বড়বাবা, ভাই সহ তাঁদের পিএরা দাঁড়িয়ে আছেন। মাহানুর বড় বড় নিঃশাস নিয়ে বেরিয়ে আসলো। লং ফ্রক পরেছে আজ তার সাথে হিজাব। মুখে কঠিন্য ভাব। এগিয়ে যেতেই দারোয়ান তাকে সালাম জানালো। মাহানুরও হাসি মুখেই সালামের উত্তর দেয়। হামজা খানের পাশে যেয়ে দাঁড়ায় মাহানুর। হামজা খান গর্বিত চোখে মাহানুরকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
-আমার ছেলে যেদিন প্রথম অফিস জয়েন করেছিলো সেদিনও আমার এতো গর্ব হয়নি যতোটা আজ হচ্ছে!
-বাবা শুধু তোমার একার না আমাদেরও অনেক বেশি প্রাউড ফীল হচ্ছে। আমাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে সেও এখন অফিস পরিচালনা করবে! এর থেকে বড় কোনো খুশির সংবাদ আছে খান পরিবারের জন্য!
-হ্যাঁ হ্যাঁ।
-তোমরা কী কথাই বলতে থাকবে নাকি ভিতরেও যাবে বড়বাবা?
-আয় মা।
মাহানুর বাবা বড়বাবার সাথে ভিতরে পা রাখলো। আটতলার বিরাট বড় ভবন। অনেক মানুষ এখানে কাজ করে। মাহানুররা সামনে এগোচ্ছে সকলে তাঁদের সালাম দিচ্ছে। কেউ কেউ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কেউ বা সকলের আড়ালে মুখ বাঁকাচ্ছে। মাহানুরদের লিফটে উঠতেই একজন যুবক তার পাশের জনকে জিগ্যেস করলো,
-ভাই এই রূপবতী মেয়েটা কে?
-ধীরে বলো জামাল কেউ শুনে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। উনি মেহরাব খানের একমাত্র মেয়ে। শুনলাম আজ থেকে হামজা খান অবসর নিবেন আর তার স্থানে তার ছোট ভাইয়ের মেয়ে মাহানুর খানকে বসাবেন।
-ওহহ! এইরকম সুন্দর এমডি থাকলে তো ছেলেদের কাজে মন বসবেই না!
-হাহাহা। উনি শুধু সুন্দরী নন ভয়ংকর রাগী প্রকৃতির মানুষও। তুমি তো নতুন এসেছো তাই তাকে চেনো না কিছুদিন দেখো তারপর বুঝবে তার সৌন্দর্যের আড়ালের ভয়ংকর রূপ।
-সরিয়াসলি? সে কী সিঙ্গেল?
-এটা কেউ সিউর জানে না। অনেকেই বলে সে মিঙ্গেল আবার অনেকেই বলে সিঙ্গেল। মিঙ্গেল হলেও সে তার হাসব্যান্ড বা বিএফ এর কথা একদম সিক্রেট রেখেছেন।
-অনেক ইন্টারেস্টিং লেডি! আমি তো কাজ রেখে তাকেই দেখবো শুধু।
-শুধু তুমি না অফিসের সকল ছেলেরাই এটা করবে।
-ভেরি ফানি।
-ওকে। এখন কাজে মন দেও।
হামজা খান মাহানুরকে তার নিজের ক্যাবিন দেখিয়ে দিলো। সবাইকে এনাউন্সমেন্ট করে জানিয়ে দিলো মাহানুরের কথা। অনেকেই ভাবছে এতো ছোট ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে বিজনেস কিভাবে সামলাবে। কিন্তু হামজা খানের সম্পূর্ণ ভরসা আছে মাহানুরের ওপর। মেহরাব খান মাহানুরকে ফাইল, অনন্যা ক্লাইন্ট সবকিছু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো। সবকিছু মাহানুরের মন মতো হলেও শেষে তার জন্য সিলেক্ট করা পার্সোনাল পিএকে দেখে মুড নষ্ট হয়ে গেলো তার। একজন যুবক তার পিএ। তাও আবার আরহামদের বয়সী! মাহানুর ত্বরিত বলল,
-বাবা আমার মেয়ে পিএ লাগবে।
-আমরা তো তাকেই সিলেক্ট করেছি তোমার জন্য মাহানুর।।
-কিন্তু আমার মেয়ে পিএই লাগবে।
-ভালো পিএ পাওয়া ভীষণ কঠিন। তুমি একমাস দেখো তার কাজ আমরা নতুন পিএ খুঁজছি।
-ঠিক আছে।
সবাই আরো কিছুক্ষন কথা বলে চলে যায় যার যার কাজে। মাহানুর ল্যাপটপ অন করে আড়চোখে তার পিএ দিকে তাকালো। শান্তশিষ্ট, ভদ্র একটি মুখ। কিন্তু ফেস কাটিং একটু ভিন্ন। ছোট ছোট চোখ আবার মোটামুটি অনেক ফর্সা। অনেকটা চীন দেশের মানুষদের মতোই লাগলো মাহানুরের কাছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। মাহানুর গলা ঝেড়ে রুক্ষ স্বরে জিগ্যেস করলো,
-আপনার নাম?
-শামীর।
-নতুন এসেছেন?
-জি ম্যাম।
-আগে কোনো অফিস বা কোথায়ও জব করেছেন?
-হ্যাঁ। একটা কোম্পানিতে এমপ্লয়ী হিসেবে ছিলাম।
মাহানুর ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে শামীরের দিকে তাকালো। সে যেনো অনেক কষ্ট করে বাংলা বলছে মাহানুরের মনে হলো! তার ভাষা কী তাহলে অন্য? বিদেশ থেকে এসেছে নাকি? মাহানুরের মনে অনেক প্রশ্ন জাগলেও সে কিছুই জিগ্যেস করলো না।
-বেশ ভালো। একজন পিএ এর কাজ সমন্ধে কোনো ধারণা আছে?
-মোটামুটি।
-ওয়েল। আশা করি কিছুদিনে সম্পূর্ণ ধারণা এসে পরবে। এখন আপনার কাজ আমাকে হামজা খান যার যার সাথে ডিল ফাইনাল করেছিলো সে ফাইলগুলো খুঁজে এনে দিন।
-ইয়েস ম্যাম।
মাহানুর সন্দীহান নজরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। পাশেই শামীরের সকল ইনফরমেশনের একটি ফাইল রাখা ছিল। মাহানুর হাত বাড়িয়ে সেটা পাশে রেখে দিলো। বাসায় যাওয়ার সময় এটা নিয়ে যাবে। মাহানুর কাজে মনোযোগ দিলো। কিছু সময়ের মধ্যে মুহিব আর সিয়াম আসলো তাকে কংগ্রেস করতে। বিশাল বড় ফুলের তোড়া দেখে খুশিতে উৎফুল্ল মাহানুর। সবকিছু কত সুন্দর ভাবে হচ্ছে অথচ মাহানুরের এতো স্পেশাল একটা দিনে তার বেস্টফ্রেন্ড নেই। একবারও কল করেনি ঐ মেয়ে। খুশির আড়ালেও একরাশ দুঃখ, অভিমান এসে ভর করে মাহানুরের মনে। মাহানুর যখন সিয়ামদের সাথে কথা বলছিলো সূক্ষ্ম নজরে শামীর তাঁদের পরোক্ষ করছিলো। তার চাহনি শুধু মাহানুরের দিকে নয় মাহানুর কী বলছে, কেমন প্রক্রিয়া করছে সবটাই দৃষ্টি বন্দি হলো শামীরের।
মাহানুরের ক্যাবিনে হাত পা ছড়িয়ে চেয়ারে বসলো সিয়াম আর মুহিব। মাহানুর কিছু কাজে শামীরকে বাহিরে পাঠিয়েছে। সিয়াম কপালে আঙুল ঠেকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-তো এখন নেক্সট প্লানিং কী মাহানুর খান?
-মেয়র সাহেবকে ঘর ছাড়া করা।
-যখন নিজেরটা হারাইবো তখনই হারানোর কষ্ট বুঝবো ঐ শয়’তান বুইড়া বেডা!
মুহিবের কথায় বাঁকা হাসলো মাহানুর। সিয়াম একটু চিন্তিত হয়ে বলে,
-যদি রিদ বাধা দেয়?
-তাকে এইসব বিষয় জানাবে কে! বাট আমার যতটুকু ধারণা সে বাধা দিবে না।
-তারপরও বাপ তো বাপই হয়। তুই যা করবি বুঝে শুনে করবি।
-অফ কোর্স। এখানে কেউই ফাঁসবে না কারণ মেয়র সাহেব নিজেই পঁচা পুকুরে পা ডুবাতে আসবেন।
-তার এই লোভ, অহংকারই তার পতনের মূল কারণ হবে।
-হুম। বেচারা জানেও না কাদের সাথে পাঙ্গা নিয়েছে! আমার বেস্টফ্রেন্ডকে অপমান করার ফল কতোটা ভয়ংকর হবে তার চিন্তার বাহিরে।
__________________
ফায়াজ, ফিহার ছুটি হয়েছে কিছুক্ষন আগেই। সুনহেরাকে দেখে দুইজন খুশিতে নাচানাচি শুরু করেছিলো। তাঁদের বন্ধুদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। তিনজন একসাথে আইসক্রিম কিনে খেলো। লুৎফা ঠান্ডা কিছু খাননা। তাই সে দূরে বসেই তাঁদের তিনজনের দুষ্টামি দেখছে। সুনহেরা এখন বাসায় যাবে না। কিছুক্ষন আগে তার মা কল করেছিলো। বাসায় একা ভালো লাগছে না তার। তাই সুনহেরা একটু মায়ের সাথে দেখা করে তারপরই বাসায় যাবে।। আরো কিছুক্ষন বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়ে তাঁদের বিদায় জানিয়ে রিকশায় উঠে পরলো সুনহেরা। ব্যাগে অনেকক্ষণ যাবৎ তার ফোন বেজে চলেছে। অলসতার কারণে ব্যাগ থেকে ফোন বের করছে না। কিন্তু কোনো দরকার ছাড়া তো এতক্ষন ফোন বাজার কথা নয়! বিরক্তে চ শব্দ উচ্চারণ করলো সুনহেরা। ফোন বের করে স্ক্রিনে অচেনা একটি নাম্বার দেখে কপাল কুঁচকালো। কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরলো।
-হ্যালো। কে বলছেন?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।
-কথা বলছেন না কেনো? কে আপনি?
এখনো অপরপাশ থেকে কোনো শব্দ শোনা গেলো না। সুনহেরা রাগে কিড়মিড় করে কল কেটে দিলো। ফোন ব্যাগে রাখার সময় ডানপাশে নজর যায় তার। অনেক মানুষজন জড়ো হয়ে কিছু একটা দেখছে। সুনহেরারও আগ্রহ বাড়লো। রিকশালাকে জিগ্যেস করলো,
-চাচা ঐখানে কী হয়েছে?
-একটা মাইয়া এক্সিডেন্ট করিছে মা।
-কী বলেন! রিকশা এখানে রাখেন চাচা।
সুনহেরা দ্রুত নেমে পরলো। রিকশালার ভাড়া মিটিয়ে সেখানে এগিয়ে গেলো। ভিড় ঠেলে ভিতরে যেয়ে দেখতে পেলো তার বয়সী একটি মেয়ে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় জমিনে পরে আছে। সবাই দর্শকের মতো দেখছে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। সুনহেরা নিজে মেয়েটির পাশে যেয়ে বসলো। হাতের পালস আর শ্বাস-প্রশ্বাস চেক করে বুঝলো মেয়েটা এখনো জীবিত। সুনহেরা চিৎকার করে বলল,
-কেমন বিবেকহীন মানুষ আপনারা? এখানে একজন মানুষ র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় পরে আছে আপনারা তাকে হসপিটালে না নিয়ে গিয়ে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন! এখানে কোনো সার্কাস হচ্ছে কী?
সুনহেরার কথায় সবাই একটু নড়েচড়ে গেলো। দুইজন লোক এগিয়ে আসলো। কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে একটি অটোতে বসিয়ে দিলো। সুনহেরা মেয়েটিকে আগলে নিলো। মেয়েটির পরিহিত ওড়না দিয়ে তার শরীর পেঁচিয়ে দিলো। কিছু সময়ের মধ্যেই হসপিটাল এসে পৌঁছালো তারা। একজন মধ্যবয়স্ক লোক মেয়েটিকে কোলে করে ভিতরে নিয়ে গেলো। সুনহেরা ডাক্তার, নার্সদের ডাকতে থাকলো। ডাক্তার মেয়েটিকে দেখে এমার্জেন্সি রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বলল। মুহূর্তেই নার্সরা মেয়েটিকে ভিতরে নিয়ে গেলো। সুনহেরা পাশের বেঞ্চে বসলো। একজন নার্স এগিয়ে এসে জিগ্যেস করলো,
-এক্সকিউস মি ম্যাম।
-জি বলুন?
-আপনি একটু কাউন্টারের এখানে আসুন প্লিজ।
-ওকে।
সুনহেরা নার্সের সাথে কাউন্টারের দিকে গেলো। একজন তাকে প্রশ্ন করলো,
-আপনি পেসেন্টের কী হন?
-উনি এক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পরা ছিল। আমি দেখলাম আর তাকে এখানে নিয়ে এসেছি।
-তার অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
-ঠিক আছে। যা যা দরকার হয় করুন এমাউন্ট এর চিন্তা করবেন না।
-ঠিক আছে ম্যাম। আমাদের আপনার ইনফরমেশন লাগবে।
-নিন। যেভাবেই হোক মেয়েটিকে সুস্থ করে তুলুন আপনারা।
-আমরা নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো ম্যাম।
সকল দরকারি কাজ শেষ করে বেঞ্চে বসলো সুনহেরা। তার সাদা রঙের কামিজে জায়গায় জায়গায় লাল ছোঁপ ছোঁপ দাগ লেগে আছে। সুনহেরা বুঝতে পারছে না এই অচেনা একটি মেয়ের জন্য তার কেনো এতো চিন্তা হচ্ছে। কেনো মনে হচ্ছে মেয়েটি তার আপন কেউ! সত্যি কী কোনো কানেক্শন আছে তার মেয়েটির সাথে?
>>>>চলবে।