#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২২
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পৃথা পিছন ঘুরে তাকালো তুর্যের পানে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-“আপনি আমাকে ছেড়ে গিয়ে বুঝলেন আমাকে ভালোবাসে ফেলেছেন। আমার বাবা মা বুঝলো তারা ভুল করেছেন। আফসোস শুধুমাত্র আমিই বুঝলাম না আমার অগোচরে আমার কাছের মানুষগুলোর নিকট তাদের সম্পর্ক রক্ষায়, স্বার্থ রক্ষায় আমি ভীষন বাজেভাবে ঠকে গেছি।”
তুর্য এগিয়ে এসে দাঁড়ালো পৃথার সম্মুখে। কিছুটা অস্থির কন্ঠে বলল,
-“আমি ভুল করেছি এর জন্য তুমি আমাকে অবশ্যই দোষী সাব্যস্ত করতে পারো। কিন্তু তাই বলে ঠকবাজ উপাধি দিতে পারো না। আমি তোমাকে ঠকাইনি। তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো তোমার আর আমার বিয়ের সময়ে আমার বয়স ছিল ২০ বছর আর তোমার মাত্র ১০। একজন ২০ বছরের তরতাজা যুবকের সাথে যদি জোর জবরদস্তি করে, তেজ্য পুত্র করার হুমকি দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সী এক শিশু কন্যার বিয়ে দেওয়া হয় তবে ঐ যুবকের এমন প্রতিক্রিয়া কিংবা রাগ করাটা কি অস্বাভাবিক কিছু? আমার স্থানে তুমি থাকলে কি করতে? প্রশ্নটা না হয় নিজেকেই করো।”
পৃথার দৃষ্টি শীতল হলো। বুঝলো সে ঐ বয়সে তুর্যের তাকে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তুর্যের স্থানে সে থাকলে হয়তো সেও মেনে নিতে পারতো না। কিন্তু পরের সাত বছর! ভালোবাসলে সেই সাত বছরে কেন ফিরে এলো না? কেন একটা বার খোঁজ নিল না? এত বছর পর এসেছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে। হতে পারতো এত বছরে পৃথা অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে অন্য কারো মায়ায় আবদ্ধ হয়েছে। যদিও ভাগ্যগুনে এসবের কিছুই হয়নি কিন্তু হতে তো পারতো। আচ্ছা এত বছর পর তুর্য কি সত্যিই ভালোবাসে তার কাছে ফিরে এসেছে নাকি এর পিছনেও কোনো স্বার্থ আছে? হতেই পারে স্বার্থ আছে। এই মুহূর্তে কাউকে আর বিশ্বাস হচ্ছে না পৃথার। মেয়েটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। ঠান্ডা কন্ঠেই বলল,
-“আমাদের সংসার হয়নি, একসাথে থাকা হয়নি, গভীর প্রণয়ে নিজেদের সিক্ত করা হয়নি। আর এত বছরে আমাদের মাঝের সেই বয়সের পার্থক্যটাও কিন্তু ঘুচে যায়নি। সেদিন যেহেতু আমাদের বয়সের পার্থক্যের কারনে আপনি আমাকে মেনে নিতে পারেননি, বিয়ের আসরেই ত্যাগ করেছিলেন সেহেতু আজও মেনে নিতে পারার কথা নয়। তার চেয়ে বরং তালাক দিয়ে দিন আমাকে। মুক্ত হয়ে যান এমন অনিশ্চিত তেতো একটি সম্পর্ক থেকে।”
তুর্য অস্থির হলো। ঠিক এই ভয়টাই সে পেয়েছিল এতদিন। যার দরুন একটু সময় নিয়ে আগে পৃথার মনে নিজের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তারপরে ধীরে ধীরে সবটা বুঝিয়ে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু রা’জা’কা’র শ্বশুরটা আর তা হতে দিল কই? মাঝ খান থেকে একটা শিয়াল জোগাড় করে তার কাছে বেঁচে দিতে চাইলো তার মুরগির বাচ্চার মতো ছোট খাটো বউটাকে। তুর্য আর একটু এগিয়ে গেল পৃথার পানে। মেয়েটার এক হাত টেনে পুরে নিল নিজের দুই হাতের ভাঁজে। ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
-“এমন কথা বলো না পৃথা। আমি তোমাকে কখনও তালাক দেব না, ম’রে গেলেও না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভীষন ভালোবাসি।”
পৃথা তুর্যের হাতের ভাঁজ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-“তা এই সাত বছর আপনার ভালোবাসা কোথায় ছিল? বিয়ের আসরে আমাকে ত্যাগ করার কথা না হয় বাদই দিলাম। ধরে নিলাম আপনি পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু পরের সাত বছর! আমি না হয় বিয়ের সময়ে ছোট ছিলাম আপনার সাথে সংসার করার বয়স হয়নি তাই বলে কি একটু খোঁজ নিতে পারেন সেটুকু বয়সও কি আমার ছিল না?”
-“আমি মানছি আমি ভুল করেছি। আমি নিজের অনুভূতি বুঝতে দেরী করেছি আর তারপর….”
এইটুকু বলেই থামতে হলো তুর্যকে। পিয়াল তেড়ে এসে সম্মুখে দাঁড়ালো তার। ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
-“আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না এটাকে এখনও এখানে কেন সহ্য করা হচ্ছে? এটাকে আমাদের বাড়ি থেকেই বের করে দেওয়া উচিৎ।”
তুর্যের দৃষ্টি কঠিন হলো। আগের কথা ভুলে শক্ত কন্ঠে সে বলল,
-“তোদের বাড়িতে আমি থাকতেও আসিনি। রা’জা’কা’র, আল’বদর, আল শা’মসদের সাথে ভালো মানুষেরা একসাথে এক ছাদের তলায় থাকে বলে শুনেছিস কখনও? আমি এসেছি আমার বউ নিতে। আমার বউকে আমাকে দিয়ে দে আমি চলে যাই।”
পিয়াসও তেড়ে এলো। দুই হাতে তুর্যের শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
-“কিসের বউ? সাত বছর আগে ছেড়ে যাওয়ার সময় বউয়ের কথা স্মরণে ছিল না তোর? তারপর এত বছরেও তো বউয়ের কথা স্মরণে আসেনি। এখন এসেছিস নাটক করতে? বের হ আমাদের বাড়ি থেকে।”
তুর্যের চোখ মুখ শক্ত হলো। শক্ত হাতে সে নিজের কলার থেকে হাত ছাড়িয়ে দিল পিয়াসের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আমার বউকে ছাড়া আমি কোথাও যাচ্ছি না। অনেক সময় ব্যয় করেছি আর নয়। প্রয়োজনে যুদ্ধ করবো, পুলিশ ডাকবো তারপর বউকে সাথে নেব। তবুও বউ ছাড়া এক পাও নড়বো না আমি।”
এতক্ষনে মুখ খুললেন পলাশ শিকদার। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“তোমাদের বিয়েটা আইনত বৈধ নয়। বিয়ের সময়ে তোমার বয়স ২০ হলেও পৃথা ছিল নাবালিকা এক শিশু কন্যা। আর বিয়ের তেমন ডকুমেন্টও নেই। পুলিশের নিকট গেলে তোমাকেই ঝামেলায় পড়তে হবে, হয়তো পৃথাকে ছেড়েও দিতে হতে পারে।”
তুর্য বাঁকা হাসলো। পলাশ শিকদারের পানে তাকিয়ে বলল,
-“তুর্য আর তুর্যের ভাইয়েরা কখনও কাঁচা করে না। আমি সেদিন ক্রোধের বশে বিয়েতে কোনো উৎসাহ না দেখালেও আমার ভাইয়েরা বিয়ের প্রতিটি মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে রেখেছিল। পুলিশের কাছে আমার বিয়ের প্রমান দিতে একটা মুহুর্তও সময় লাগবে না। আর বাকি রইলো ঝামেলায় পড়া তা আমি ঝামেলায় পড়লে আপনারাও পড়বেন। একটা নাবালিকা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার অপরাধে এই বুড়ো বয়সে জেলের ঘানি টানতে হবে।”
পিয়াল তেতে উঠলো। গলা বাড়িয়ে বলল,
-“ভয় দেখাচ্ছিস? দেখা তবুও আমার বোনকে তোর সাথে যেতে দেব না।”
তুর্য বলতে চাইলো কিছু। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই পৃথা বেশ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
-“কিন্তু আমি যাব।”
উপস্থিত সবাই অবাক হলো পৃথার কথায়। পিয়াস চকিত কন্ঠে বলল,
-“কি বলছিস এসব তুই? মাথা ঠিক আছে তো? এই ছেলেটার সাথে তুই যেতে রাজি হচ্ছিস? যে কিনা সাত বছর আগে বিয়ের আসরে তোকে ত্যাগ করেছিল।”
পিয়াসের কথার মধ্যেই পিয়াল বলল,
-“যে পুরুষ তোর কথা একটা বারের জন্যও ভাবেনি। বিয়ের আসরে তোকে ছেড়ে গিয়েছিল তার সাথে যাবি তুই?”
পৃথা বাবা মায়ের পানে তাকালো একবার। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“তা তো আমার পরিবারও আমার কথা ভাবেনি। ভাবলে কি আর নিজেদের সম্পর্ক গাঢ় করার উদ্দেশ্যে মাত্র ১০ বছরের এক নাবালিকা কন্যাকে বিয়ে দিতে পারতো।”
থামলো পৃথা। আবার বলল,
-“বাবা মা ১০ বছর বয়সে বিয়ে তো আমাকে সংসার করার উদ্দেশ্যেই দিয়েছিলেন। সে তো আমার কপাল ভালো ছিল বলে ঐ বয়সে সংসারের ঘানি টানতে হয়নি। এখন যখন সুযোগ পেয়েছি তখন না হয় বাবা মায়ের ইচ্ছাকেই প্রধান্য দেই, সংসার করি।”
সুফিয়া বেগম এবং পলাশ শিকদার বেশ ভালোভাবেই বুঝলেন মেয়ের তাদের উপর অভিমান জমেছে বেশ। আর সেই অভিমান থেকেই এসব কথা বলছে মেয়েটা। সুফিয়া বেগম এগিয়ে এলেন মেয়ের পানে। মেয়েকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তুই আমাদের ভুল বুঝছিস মা। হ্যা আমরা তুর্যের পরিবারের সাথে সম্পর্ক গাঢ় করার জন্য তোকে তুর্যের সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম ঠিক কিন্তু তখনই তোর সংসার করার কথা ছিল না। আমাদের দুই পক্ষের মধ্যে কথা হয়েছিল বিয়ে হলেও তখনই ও বাড়িতে যাবি না তুই। তোর ১৮ বছর পূর্ণ হলে ধুমধাম করে তুলে নিবেন তারা।”
পৃথা কন্ঠের জোর বাড়ালো। শক্ত কন্ঠে বলল,
-“তাহলে বিয়েটাও না হয় ১৮ বছর হলেই দিতে। অল্প বয়সে ঐ সময় বিয়েটা না দিলে তো আর আমার জীবনে এতসব ঘটনা ঘটতো না।”
-“আমরা ভয় পেয়েছিলাম বড় হয়ে তোরা যদি দুজন দুজনকে না মানতে চাস। তাছাড়া তুর্যও বখে যাচ্ছিলো তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দিয়েছিলাম।”
পৃথা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের পানে। মলিন হেসে বলল,
-“তোমরা তোমাদের সম্পর্ক গাঢ় করতে এতটাই তৎপর হলে যে বখে যাওয়া একটা ছেলের সাথে নিজের ১০ বছরের শিশু কন্যার বিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করলে না। আমি জানতাম মেয়ের বাবা মা মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বখে যাওয়া ছেলেদের এড়িয়ে চলে আর আমার বাবা মা উল্টো সম্পর্ক গাঢ় করার উদ্দেশ্যে বখে যাওয়া ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আচ্ছা মা আমার থেকে তোমাদের সম্পর্ক গাঢ় করার নিশ্চয়তাটা কি বেশি হয়ে গিয়েছিল তখন?”
সুফিয়া বেগম চুপ হয়ে গেলেন। এ পর্যায়ে মেয়ের কথার কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তিনি। কি উত্তরই বা দিবেন? সত্যিই তো ভুল করেছেন তারা, মেয়েটার সাথে অন্যায় করেছেন যার জন্য মেয়ের জীবনে আজ এত জটিলতা। পৃথা মায়ের চুপ হয়ে যাওয়া মুখ পানে তাকিয়ে মলিন হাসলো। চোখ দুটো ভিজে উঠেছে তার। ভেজা চোখেই সে এগিয়ে গেল তুর্যের পানে। নিজেকে শক্ত করে বলল,
-“আমাকে নিয়ে চলুন আপনার সাথে।”
তুর্য এতক্ষন চুপচাপ দেখছিলো সবটা। পৃথা যে এত তাড়াতাড়ি তার সাথে যেতে রাজি হবে কল্পনাও করতে পারেনি। সে ভেবেছিল পৃথা তাকে ভুল বুঝবে, তাড়িয়ে দিবে। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বউকে নিজের কাছে নিতে হবে। অথচ এত তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেল? তাই তো সবটা শুনে একটু থম মে’রে গিয়েছিল আর কি। তবে পৃথার কথায় এবার ঘোর কাটলো তুর্যের। আনন্দের সহীত নিজের হাত বাড়িয়ে ধরলো পৃথার এক হাত। সম্মুখ পানে যেতে যেতে বলল,
-“চলো।”
পিয়াস এবং পিয়াল উদ্যত হলো তুর্যকে আটকাতে। তারা জানে তাদের অভিমানী বোন পরিবারের উপরে অভিমান করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই বলে তারা তো বোনকে এভাবে চলে দিতে পারে না। পিয়াস এবং পিয়াল তুর্য, পৃথাকে আটকতে যেতে নিলেই তাদের থামিয়ে দিলেন পলাশ শিকদার। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“ওদের যেতে দাও।”
পিয়াস এবং পিয়াল অবাক হলো। পিয়াস অবাক কন্ঠেই বলল,
-“তুর্য তো পৃথাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে বাবা আর তুমি ওদের আটকাতে বারন করছো?”
পলাশ শিকদার কোনো উত্তর দিলেন না ছেলের প্রশ্নের। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তার আনা পাত্র পক্ষের পানে। যারা এতক্ষন খুব নিগুঢ়ভাবে দর্শকের ন্যায় দেখছিলো সবটা। পলাশ শিকদার ঠান্তা কন্ঠেই তাদের বললেন,
-“আপনাদের কাজ শেষ নজরুল ভাই। আপনাদের ধন্যবাদ এখানে আসার জন্য।”
পাত্রপক্ষ নামধারী আসা জনমানবের মধ্যে একজন বলল,
-“আরে ঠিক আছে। আচ্ছা আমরা এখন আসছি। আপনারা পারিবারিক ভাবে মিটিয়ে নিন সবটা।”
কথাটা বলেই চলে গেলেন তারা। পিয়াস, পিয়াল এবং সুফিয়া বেগম অবাক হলেন। সুফিয়া বেগম অবাক কন্ঠেই শুধালেন,
-“এসবের মানে কি?”
পলাশ শিকদার একবার তাকালেন স্ত্রী সন্তানদের পানে। অতঃপর থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“আমি এতটাও নির্বোধ নই যে আমি আমার তালাকহীনা মেয়ের বিয়ে দেব অন্যত্র….
চলবে…..