ল্যাম্পপোস্ট ( ৮ )

0
116

#ল্যাম্পপোস্ট ( ৮ )

ডিনারের সময় ডাক এল বিভার। সারাদিন অ্যাডের রুমেই ছিল। এখনো তার রুম পরিষ্কার হয়ে উঠে নি। আজকের রাতে হয়ত অ্যাডের রুমেই থাকতে হবে। বিস্ময় আটকাতে না পেরে সে বলেই উঠে
“আমি আজ কোন রুমে ঘুমাব অ্যাড?”

“আজকে আমার রুমেই ঘুমাতে হবে তোমায়। আসলে গেস্ট রুম গুলো তোমার জন্য উপযোগী নয়। কয়েক দিন আগে সেখানে পার্টি করা হয়েছে। বুঝোই তো ওয়াইন সহ নানান দ্রব্যের ছড়াছড়ি।”

“কিন্তু!”

“চিন্তা কেন করছো? আমি তো এই রুমে থাকছি না। আমি থিওডোর ব্রো এর রুমেই থাকব, না হলে গেস্ট রুমে থেকে যাব।”

“ওহ আচ্ছা। একটা কথা অ্যাড।”

“হ্যাঁ বলো।”

“আমি আসাতে তোমার ফ্যামিলি কি রাগ করেছে?”

“উফ বিইভা। তুমি সব সময় এক ধাপ বেশি বলো। আসো তো আমার সাথে।”

বিভা কে এক প্রকার টেনে নিয়ে যায় অ্যাড। অস্বস্তি হয় খুব , অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষ জন তা ও আবার ভিনদেশী। মাথা নিচু করে টেবিলে বসে বিভা। মিস্টার হাডসন উঠে যাওয়ার জন্য পথ বাড়াতেই মিসেস হাডসন বাঁধা দেন। পরিশেষে দাঁতে দাঁত চেপে ডাইনিং এ বসেন। থিওডোর হাত বাড়িয়ে বলে
“হ্যালো আম থিওডোর। অ্যাডের বড়ো ভাই।”

“হ্যালো।”

“অ্যাড,ওকে বাকি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দে।”

“ইয়েস ব্রো। মম ড্যাড ওহ হলো বিইভা আমার বন্ধু বলতে পারো। আর বিইভা ওনারা হলেন আমার মম ড্যাড।”

“হ্যালো ডিয়ার।”

“হ্যালো আন্টি।”

মিস্টার হাডসন কোনো কথা বলেন না। বিভা আদুরে কণ্ঠ স্বরে বলে,”হ্যালো আঙ্কেল , আপনি কি কোনোভাবে আমার উপর বিরক্ত? আমি না বুঝে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি হয়ত। ক্ষমা করে দিবেন।”

চক্ষু লজ্জায় পড়েন মিস্টার হাডসন। সকলের মাঝে সামান্য বিব্রত বোধ কাজ করে। কেউ ই আশা করে নি বিভা এতটা আবেগ মাখা কণ্ঠে এমন প্রশ্ন করে ফেলবে। মিস্টার হাডসন সামান্য হাসার চেষ্টা করেন। তারপর বিভা কে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
“নো ডিয়ার। আমি আসলে নতুনদের সাথে তাড়াতাড়ি মিশতে পারি না। তুমি কিছু মনে করো না কেমন?”

মৃদু হেসে মাথা দুলায় বিভা। সকলের চোখ গোল গোল হয়ে গেছে। মিস্টার হাডসন এর এতটা পরিবর্তন চোখে লাগার মতো। অ্যাডের চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠে। বাবার মুখ থেকে এমন কথা আশা করে নি যে। সবাই কে নিয়ে ডিনার শুরু হয়। বিভার জন্য আলাদা হালাল খাবার রান্না করা হয়েছে। বিভার আড়ষ্টতা দূর করতে সেই খাবার ই প্লেটে তুলে নেয় অ্যাড। মিস্টার হাডসন ও একই কাজ করেন। পরিশেষে এই প্রথম হাডসন ফ্যামিলির সকলে হালাল খাবার দিয়ে ডিনার করে। সকলের আচরণে বিভার মনের কোণে সুখ অনুভূতি হয়। বাবার কথা মনে পড়ে যায় হঠাৎ। না জানি কেমন আছেন তিনি।

কেঁটে যায় ছয় ছয় টা দিন। বাসা থেকে এক বার ও বের হওয়া উঠে নি। হাডসন ফ্যামিলির সকলে খুব আপন করে নিয়েছে মেয়েটিকে। অ্যাড সারাদিন কর্ম ব্যস্ততায় ডুবে থাকে। বিভা কে লিগেল ভাবে নেওয়ার ব্যবস্থা চালাচ্ছে। যেহেতু বিভার সমস্ত কার্ড সব অফ হয়ে গেছে তাই বিভার পরিচয় শনাক্ত করতে সমস্যা হচ্ছে। আর সেই জন্য নতুন করে সব তৈরি করতে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আরাজের সব ছবি মুছে দেওয়া হচ্ছে। একে বারে চিরুনি অভিযান যাকে বলে। গায়ক আরহাম আরাজ নামের কেউ যে পৃথিবী তে ছিল তা বোঝার উপায় নেই! আরাজের পূর্ণ ছবি কারো কাছেই কালেক্ট করা নেই। কারন সে সব সময় হ্যাট কিংবা মাস্ক পরে ছবি তুলত। গান গাওয়া হয়েছে নিজেকে আড়ালে রেখে। যার ফলে আরাজ নাম টা পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়া খুব ই সহজ হয়ে গেছে। বিভার দু চোখ জলে ভরে যায়। গলায় দলা পাকিয়ে রাখা কান্না গুলো হিচকি হয়ে বেরিয়ে আসে। তখনি রুমে প্রবেশ করে অ্যাড। ব্যস্ত হয়ে বলে,
“তুমি কাঁদছো কেন? আমি সব ব্যবস্থা করে নিয়েছি। এই দেখো পাসপোর্ট, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যেই অস্ট্রিয়াতে যেতে পারব আমরা।”

সমস্ত কাগজ নিজ হাতে দেখে বিভা। কৃতঙ্গতায় চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। অ্যাড বাঁধা দিয়ে বলে,”ডোন্ট ক্রাই। একদম চোখের জল ফেলবে না। চোখের জল খুব মূল্যবান যখন তখন যার তার জন্য ফেলতে নেই। আই নো সে তোমার বয়ফ্রেন্ড উডবি হাসবেন্ড ও বটে, তবে এখনো সব ক্লিয়ার হওয়া বাকি।”

চোখ মুছে নেয় বিভা। অ্যাড এর বলা শেষ কথা গুলো সে বুঝতে পারে নি। নাক টেনে বলে
“কি ক্লিয়ার হবে?”

“আগে আসো তো অনেক ঠান্ডা পড়েছে। তুষার ও পড়তে পারে। ট্রেরেস এ আগুন জ্বালানো হয়েছে বারবিকিউ ও করা হবে। সাথে ম্যাপল জুস।”

“কিন্তু আমি তো হালাল ফুড খাই।”

গগনবিদারী হাসি তে মেতে উঠে অ্যাড। বিভার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল হাডসন ফ্যামিলি। সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে বিভা। আশে পাশের বাড়ি গুলোতে ও কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চা রা উত্তাপ নেওয়ার জন্য বসে আছে। তার ই পাশে করা হচ্ছে বারবিকিউ। মূলত হালাল নয় এমন মাং স দিয়েই বারবিকিউ করা হচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে নেয় বিভা। হঠাৎ করেই তার কুর্তি তে টান অনুভব করে। নিচে তাকিয়ে দেখে পাঁচ ছয় বছর বয়সী এক বাচ্চা মেয়ে। র ক্ত লা ল হয়ে আছে নাকের ডগা। ফিক করে হেসে উঠে বিভা। মেয়েটি নাক কুচকে ফরাসি ভাষায় কিছু বলে। বিভা বুঝতে পারে না। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাড, বিভার সাথে দৃষ্টি পাত হতেই বিভা বলে
“ওহ কি বললো আমি বুঝতে পারি নি।”

“ওহ বলেছে,তুমি ওর থেকে বেশি সুন্দরী কেন?”

অ্যাডের কথাতে বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকায় সে। নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে। হাঁটু গেড়ে ঘাসের উপর বসে বিভা। মেয়েটির গাল টেনে বলে
“সো কিউট।”

মেয়েটি যেন লজ্জা পায়। মুখে এক আঙুল পুরে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। মৃদু শব্দে অ্যাড বলে।
“ওহ বোধহয় সত্যি ই বলেছে।”

“অ্যাড তুমি ওহ!”

খলবিলিয়ে হাসে অ্যাড। মিসেস হাডসন বিভার পাশে এসে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যান। চার পাশে চোখ বুলিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয় বিভা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে অ্যাড বলে
“বিইভা বারবিকিউ হয়ে গেছে , খাবে চলো।”

“আমি হালাল ফুড খাই। ভুলে গেলে?”

“হালাল ফুড ই আছে। লবস্টার , স্যামন আর চিকেন বারবিকিউ করা হয়েছে।”

কথা টা শুনে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে বিভার। খ্রিস্টান ধর্মের হয়ে ও ভিনদেশীর প্রতি সবার এত ভালোবাসা আশা কর্র নি সে। আচ্ছা সবাই কি এমন হয়?

সকাল সকাল তুষার পাত হচ্ছে। বরফে ঢেকে গেছে চারপাশ। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে টানা দুদিন তুষার পাত হবে। যার জন্য সকল প্রকার ফ্লাইট অফ। মন ম রা হয়ে বসে আছে বিভা। আজকেই অস্ট্রিয়ার উদ্দেশ্যে ফ্লাইট এর কথা ছিল। কিন্তু সকাল থেকে তুষার পাত হয়ে চলেছে। আগামী তিন চারদিন ফ্লাইট অফ থাকবে। প্রতি ঘরে ঘরে অলস সময় কাটছে। কেউ কাজে যেতে পারছে না। স্কুল কলেজ অফ রয়েছে। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে বিভা। আকাশ থেকে মেঘের নেয় বরফের টুকরো গুলো মাটি তে এসে পড়ছে। ঘাস গুলো নেতিয়ে গেছে। একটু একটু করে ঢেকে যাচ্ছে বরফের ভেতর। বড়ো বড়ো গাছ গুলো তে জমে আছে হাজারো বরফের মালা। গাছের পাতা গুলো সাদা বরফে ভরপুর। পুরো শহর যেন বরফ নগরীতে পরিনত হয়েছে। এতটাই মুগ্ধ চাহনি যে অ্যাড কে লক্ষ্য করল না সে। ছেলেটা বাগানের স্টোর রুম থেকে স্কেটিং এর জিনিস পত্র নামাচ্ছে। খানিক বাদে বিষয় টা দেখে প্রচন্ড আগ্রহ জাগে বিভার। ছুটে নেমে আসে গার্ডেন এ। অ্যাড ব্যাগ পত্র নামাচ্ছে, বিভা কে দেখে বলে,
“বরফ পড়ছে নিচে আসলে কেন?”

“তুমি এগুলো কি করছো?”

“বরফ পড়া শেষ হলে স্কেটিং এ যাব।”

“স্কেটিং!”

“তুমি কি যেতে চাও বিইভা?”

“কিন্তু আমি তো পারি না।”

“আমি শিখিয়ে দিব।”

কয়েক সেকেন্ড ভাবে বিভা। যেহেতু অস্ট্রিয়া তে যাওয়া হচ্ছে না। না হয় কানাডায় স্কেটিং টা হয়েই যাক। সম্মতি জানায় সে।
“তাহলে লেক লুইস এ যাব আমরা।”

“ওকে। আমার সমস্যা নেই।”

দুদিন বাদে বরফ পরা বন্ধ হলেই সেখানে রওনা হয় বিভা আর অ্যাড। বনফ ন্যাশনাল পার্কে আলপাইন শিখরের পাদদেশে অবস্থিত, লেক লুইস সহজেই কানাডার অন্যতম সুন্দর আকর্ষণ। স্ফটিক-নীল জল এবং অত্যাশ্চর্য ভিস্তাসের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রচুর পর্যটকদের দেখা মিলে এখানে। গ্রীষ্মে এটি শান্ত গন্ডোলা যাত্রা হলে ও শীতের মাসগুলিতে আইস স্কেটিং এর সেরা। এক আশ্চর্য সুন্দর!

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here