#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-১৪)
————–
“হও যদি তুমি নীল আকাশ আমি মেঘ হবো আকাশের
হও যদি অথৈ সাগর আমি ঢেউ হবো সাগরের
হও যদি ওই হিমালয় তোমাকে করব আমি জয়
তোমাকে চাই তোমাকে
তুমি যে আর কারো নওওওও
বলতে পারি আমি নির্ভয়ে তুমি আছো হৃদয়ে”
(বাকিটা নিজ দ্বায়িত্বে শুনে নেবেন)
,,,,,,,,,
নিঝুমের নিরবতা দেখে ইহান নিজেই গান ধরে।
গান শেষ করে ইহান বন্ধ চোখের পাতা মেলে। নিঝুম এতক্ষণ সেই চোখেই তাকিয়ে ছিলো। ইহান চোখ খুলতেই তার ধ্যান ভাঙে। একটু নড়েচড়ে বসে সে। ইহান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “কেমন হয়েছে বললে না তো?”
নিঝুম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এই মানুষটাকে আজ তার বড্ড বেশিই অচেনা লাগছে। এই ইহানের সঙ্গে সে পরিচিত নয়। নিঝুম কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
— “খুব সুন্দর হয়েছে। অতুলনীয়।”
নিঝুমের ইচ্ছে ছিলো আরও অনেক কিছু বলার কিন্তু কন্ঠনালী যে বিরোধিতা করবেই। ইহান কিঞ্চিৎ হাসল। ট্রাউজারের পকেট হতে সিগারেট বের করে তাতে আগুন জ্বালাতে নিয়ে বলল,
— “অনেক রাত হয়েছে এবার ঘরে যাও।”
নিঝুম নতমস্তকে উত্তর দিলো, “হুম”। অতঃপর চুপচাপ উঠে চলে যেতে চাইল কিন্তু কিছু একটা ভেবে দাড়িয়ে গেলো। পেছন ফিরে আমতা আমতা করতে করতে বলল,
— ” আপনি ধুমপান করেন?”
ইহান সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল,
— “মাঝে মধ্যে।”
নিঝুম কিছু বলল না আর। চুপচাপ নিচে চলে গেল। ইহান সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে দুপুরে অহেতুক কষ্ট দিয়েছে। তার কী দোষ ছিল সে তো আর অতসব ঘটনা জেনে নেই। তবুও তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। সেই অনুশোচনা থেকেই এতক্ষণ নিঝুমের মন ভালো করার সামান্য প্রচেষ্টা করেছে মাত্র। কিন্তু এদিকে নিঝুম তো তার এই সামান্য চেষ্টাকেই অসামান্য ভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে তা কী সে জানে? তার এই সামান্য অভিনয় তৈরি করেছে নিঝুমের মনে অনেক বড় ভালো লাগার অনুভূতি।
————–
নিঝুমের মনটা আজ বেশ ভালো। ইরার সঙ্গে একটু আড্ডা দিলে মন্দ হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ, ওরনাটা গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ল ইরার ঘরের উদ্দেশ্যে। দু’বার টোকা দিতেই ইরা দরজা খুলে দিলো। নিঝুমকে দেখে সে দ্রুতই ভেতর আসতে বলল।
ইরার চোখ জোড়া ফোলা ফোলা। চেহারাটাও লালচে বর্ণ। মুখশ্রী থমথমে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেঁদেছে ভীষণ। নিঝুম খেয়াল করল ইরা আজ বেশ চুপচাপ। কথা বলছে না তেমন। শুধু হু হা করছে। নিঝুম অনেক মোচড়া মুচড়ি করে অবশেষে মনের মধ্যে দমিয়ে রাখা প্রশ্নটা করেই ফেলল,
— “কী হয়েছে তোমার ইরা। কেঁদেছো নাকি?”
— “ক কই না তো। কেন কাঁদব?”
— “তোমায় দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে।”
— “আসলে শরীর টা ভালো নেই তাই হয়তো।”
ইরা ইনিয়ে বিনিয়ে চলে যেতে নেয় তখনই নিঝুম খপ করে তার হাত ধরে বসে। ইরা নিঝুমের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। নিঝুম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,
— “আমি জানি ইরা কাল অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলো আমায়। ওই ছেলেটার সঙ্গে কী এমন আছে তোমার। তোমাদের মধ্যে কোনো অ্যাফেয়ার্স নেই তো?”
ইরা আঁতকে ওঠে। লুকায়িত অনুভূতি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে যেনো। তবুও সে নিশ্চুপ। কোনো মতেই ভেঙে পড়বে না এমন। কিন্তু নিঝুম! সে ও তো নাছোড় বান্দা। যেন পণ করে নিয়েছে সত্যিটা শুনবেই। অবশেষে ইরা মুখ খুলতে বাধ্য হয়। নিজের সমস্ত কাঠিন্যতা নিমেষেই ভেঙে গুড়িয়ে যায় নিঝুমের সম্মুখে। অস্বাভাবিক ভাবে কেঁদে উঠে নিঝুমের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। নিঝুম আঁতকে ওঠে। এ কোন ইরাকে দেখছে সে। বরাবরই ইরাকে বেশ শক্ত সামর্থ্য নারী হিসেবেই দেখে এসেছে সে কিন্তু আজ ইরা এমন কেনো করছে? নিশ্চিত বড় কোনো কারণ আমি। ইরার কান্নার মাত্রাটা এতটাই অস্বাভাবিক যে নিঝুম পাল্টা কোনো প্রশ্নও করতে পারছে না। ধ্যান মে’রে বসে থাকা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। হঠাৎই কান্না মিশ্রিত কন্ঠের আকুতি,
— “আমি আর পারছি না বউমনি। সে কেন আসে আমার সামনে। আমি আর নিজেকে আটকাতে পারছি না। তার এমন হঠাৎ আগমন আমার হৃদয়ে প্রবল ঝড়ের কারণ। আমি ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছি। শত চেষ্টায়ও তাকে আপন করতে পারছি না আবার চিরতরে দুরে ঠেলে দিতেও পারছি না। সে খনে খনে আমায় চরম বিপাকে ফেলছে। এখন কেমন আছে আমার জানা নেই। গতকাল ভাইয়া ভীষণ রেগে গিয়েছিলো। না জানি কী থেকে কী করেছে। জিজ্ঞেস করারও সাহস নেই।”
খুব মনোযোগ দিয়ে ইরার প্রতিটি কথা শুনল নিঝুম। তাতে করে বুঝল ইরা ভীষণ কষ্টে আছে। আচ্ছা সত্যিই তো নিঝুমও তো একবারও এটা ভাবে নি যে কাল ওখানে হলো টা কী। ইহানের সঙ্গে কী তার এ ব্যাপারে কথা বলা উচিত? ইরার যে পরিস্থিতি তাতে করে ওর থেকে এখন কিছুই জানতে চাওয়া যাবে না। ইহানের থেকেই জানতে হবে হয়তো।
—————
ইহানের সামনে কফি নিয়ে দাড়িয়ে আছে নিঝুম। উদ্দেশ্য কিছু প্রশ্ন করা। নিঝুমকে ইতস্তত করতে দেখে ইহান বলে,
— কিছু বলবে?
নিঝুম কফিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
— আসলে হয়েছে কী! ইরার কী হয়েছে? গতকাল থেকে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আচ্ছা ওই ছেলেটা কে? কী হয়েছিল গতকাল?
ইহান খুব সুক্ষ্ম ভাবে কিছু একটা চিন্তা করে নিল। অতঃপর বলল,
— ওসব কিছু নয়। তুমি তোমার কাজে যাও। এসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। ইরা ঠিক হয়ে যাবে।
ইহানের কন্ঠের কাঠিন্যতা নিঝুমের মনটা বিষাক্ত করে তুলল। গতরাত থেকে মনে যে ফুরফুরে আমেজ ছিল তা মুহূর্তেই বিষাদে পরিণত হলো। এই লোকটা এমন কেন? এই কাছে টানে তো এই ছুড়ে ফেলে দেয়। নিঝুম দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল যে। নিঝুম চলে যেতেই ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মনে মনে ভাবে, “উহ! মেয়েটা বড্ড সেনসিটিভ। একটুতেই ভেঙে পড়ে। কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল। ইরা নিহানকে এখনো চায় তবে এখন সেটা স্বীকার করার অপেক্ষা।
————-
রাতে ইহান ঘুমতে যাওয়ার জন্য বের হলেও নিঝুমও আজ তাকে ফলো করতে থাকে। দেখা গেল ইহান পশ্চিম পাশের একটি কক্ষে ঠুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। নিঝুম আলতো হাতে ঠেলা দেয় দরজা টা কিন্তু নাহ খোলে না। বুঝতে পারে ভেতর থেকে সিটকিনী লাগিয়ে দিয়েছে। নিঝুম একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে চলে যায়। সিদ্ধান্ত নেয় আগামী কাল ইহান বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলে এই কক্ষে ঢুকবে সে। ভেতরটা দেখার তীব্র ইচ্ছে জেগেছে তার কৌতুহলী মনে।
অনিলা খান একটি ফটো ফ্রেম হাতে বসে আছেন। এখানে তাদের পুরো পরিবারের ছবি একত্রে আছে। তিনি বেশ পরখ করে দেখছে সকলকে। একটা ছবিতে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকে গেল। চোখের কার্ণিশে ভিড় জমালো নোনাজলেরা। কয়েকবছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার কাছে।
—————
সকাল সকাল নাস্তা করে ইহান বেড়িয়ে গেছে। ইশানও চলে গেছে কলেজে৷ ইরা, নিঝুম কেউই আজ কলেজে যায় নি। ইরা তো শরীর খারাপের অজুহাতে যায় নি। ইরা যাবে না তাই নিঝুমও যায়নি সকলে এটাই জানে কিন্তু নিঝুমের আসল উদ্দেশ্য তো অন্য কিছু। আজ সে ওই ঘরটা দেখবেই ওখানে কী এমন আছে?
—————–
চলবে,
®নামিহা নিশি
(প্রিয় পাঠকমহল, খুব শীঘ্রই রহস্য খোলাসা হতে চলেছে। আগামী পর্বে কিছুটা এগোবে।)