#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-৫)
————-
আহসান মঞ্জিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম। চার বছর পর আজ আবার সে তার নিজের বাড়িতে পদার্পণ করতে চলেছে। যে বাড়িতে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর। জড়িয়ে আছে নানারকম স্মৃতি। বাবা, মা,ভাই এর আদর,স্নেহ, শাসন। সমর্পণ এতক্ষণে কাঁচি গেট ওভারটেক করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে। নিঝুমকে পাশে না পেয়ে সে হতাশ হয়ে পেছনে তাকায়। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলো তাই নিঝুম এখনো গাড়ির কাছেই দাড়িয়ে। সমর্পণ এগিয়ে যায়। নিঝুমের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে বাড়ির মধ্যে। নিঝুম চতুর্দিকে চোখ বুলায়। বাড়িটায় বেশ পরিবর্তন লক্ষণীয়। হবে নাই বা কেন চার বছর তো আর কম সময় নয়। গেটের দারোয়ানও চেঞ্জ করা হয়েছে। আগের দারোয়ান কাকা হলে তাকে এক দেখাতেই চিনে ফেলত। নিঝুম সমর্পণের পেছন পেছন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। সদর দরজা পেরিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করে যেখানে খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বসে পত্রিকা পড়ছেন আহসান সাহেব। নিঝুমের থমকায়। সমর্পণ ফের তাকে খোঁচা দেয়। নিঝুম চকিত দৃষ্টিতে পুনরায় অগ্রসর হয়।
“হ্যালো মি.আহসান।”
সমর্পণের কথা শ্রবণ হতেই আহসান সাহেব পত্রিকা থেকে চোখ তুলে ওপরে তাকায়। সমর্পণকে দেখে তড়িঘড়ি করে পত্রিকা বন্ধ করে উঠে দাড়ায়। হাসোজ্জল মুখে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
“হ্যালো মি.চৌধুরী।”
দু’জনে হ্যান্ডশেক পর্ব শেষ করতে না করতেই আহসান সাহেবের চোখ আটকায় নিঝুমের ওপর। তিনি চমকায় খানিক। অন্তর গলে আসে কিন্তু কিছু একটা মনে পড়তেই কাঠিন্য রুপ ধারণ করে। রাগী মুখশ্রীতে শক্তপোক্ত কন্ঠে কেবলই যখন বললেন, “ও…. “। দেখা যায় তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সমর্পণ বলে, ” ও আমার জুনিয়র অফিসার নিঝুম।” অতঃপর নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলে, “নিঝুম মিট করো মি.আহসানের সঙ্গে।”
।।
নিঝুম ভেতর থেকে ইতস্তত বোধ করছে কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করতে নারাজ। সাবলীল ভঙ্গিতে সে তার বাবার নিকট হাত বাড়িয়ে দেয়।
“হ্যালো মি. আহসান। নাইস টু মিট ইউ।”
আহসান সাহেব একবার সমর্পণের দিকে দৃষ্টি দিলেন। অতঃপর বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিঝুমের সঙ্গে হাত মেলালেন। নিঝুম খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রাখল। অতঃপর তারা একত্রে বসে কিছু আলাপ আলোচনা করতে লাগলো। নিঝুম অবশ্য তেমন কিছুই বলছে না। সমর্পণের কথা গুলোতে শুধু হু,হা করছে। তার দৃষ্টি তো মা, ভাইকে এক নজর দেখার জন্য তৃষ্ণার্থ। একটু পরেই তাদের জন্য নাস্তা দেওয়া হলো। সমর্পণ সামান্য কিছু খেলেও নিঝুম শুধু পানিটুকুই খেলো। আরও কিছু সময় পর সেখানে উপস্থিত হলো তার ভাই নুহাশ আহসান। নিঝুমকে দেখে বাবার মতো নুহাশও চমকে উঠলো। এই বোনটি তার বড়-ই আদরের ছিল। কিন্তু প্রয়োজনে সে তাকে শাসনও করেছে প্রচুর। তবে ভালবাসায় ও কোনো কমতি রাখেনি। কিন্তু চার বছর আগে বোনের সেই অপমান তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। এক রাতের বিয়ে করা বরের জন্য সে তার বাবা,ভাইকে প্রত্যাক্ষ্যান করল কীভাবে? মুহূর্তেই চেহারার রঙ পাল্টে যায় নুহাশের। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য সে এখন। কাঠিন্য চেহারায় যখনই সে নিঝুমের কাছে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হচ্ছিল ঠিক তখনই তার বাবা তাকে কৌশলে আটকে নেয়। এই দৃশ্য নজর এড়ায় না নিঝুম, সমর্পণ কারোরই। তবুও সকলে চুপ। নুহাশের হিতাহিত জ্ঞান আসতেই সে চুপ মে’রে যায়। নিঝুমকে পরে দেখে নেবে আপাততঃ সমর্পণকে হাত করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই লাইন ক্লিয়ার। তাদের সমর্পণকে নিমন্ত্রণ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, ‘তার মন খুশি করে তাকে হাত করা।’ তবেই তাদের পক্ষে এই কালো জগতের শেখরে পৌঁছানো সম্ভব। কিছু সময় পর নুহাশ সেখান থেকে উঠে ভেতরে চলে গেল। পরক্ষণেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে আবার ফিরে এলো। তারপর তাদের জন্য ভারী খাবারের আয়োজন করা হলো। নিঝুম খুব যত্ন করে খাবারটা শেষ করল। কারণ এটা তার মমতাময়ী মায়ের হাতের রান্না। যে স্বাদ নিঝুম আজও ভুলতে পারেনি।
খাবার শেষে এবার তাদের যাবার পালা। নিঝুম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মাকে এক নজর দেখার আসায় ওত পেতে ছিল কিন্তু সে তো আর জানে না তার ভাই সবার অগোচরে অনেক আগেই তার মাকে ঘরবন্দী করে রেখে এসেছে।
নিঝুম, সমর্পণ চলে যায়। ওপরের ঘরের জানালা থেকে একজোড়া অশ্রু সিক্ত চোখ ঠিকই তাদের দেখতে পায়। এক একাই হাঁসফাঁস করে। কিন্তু তা চোখে পড়ে না নিঝুমের। ওরা চলে যেতেই নুহাশ আহসান সাহেবের পাশে এসে দাড়ায়।
“আটকে দিয়েছ?”
“হুম”
“বেশ ভালোই করেছ।”
“হুম”
“দুধ কলা দিয়ে কী তবে কা’ল’সা’প পুষলাম?”
“হয়তো।”
——————-
একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সম্মুখে আছে ইরা। আজ তার ইন্টারভিউ ছিলো এই কোম্পানিতে। খুব ভালো ভাবেই ইন্টারভিউ সম্পন্ন করেছে সে। আশা রাখে চাকরিটা তার হয়েই যাবে। বাড়ির কেউ তার চাকরি করার বিষয়টা পছন্দ করছে না কিন্তু ইরা চায় নিজের পায়ে দাড়াতে।
শেষমেশ ইরার জেদের কাছে সকলে হার মানতে বাধ্য হয়।
রিকশার জন্য ওয়েট করছে ইরা। ইদানীং সে গাড়ি-টাড়ি বেশি একটা ইউজ করে না। সবরকম ভাবে সাবলম্বী হতে চায়। সবরকম অভ্যেস করে নিচ্ছে। তবে রিকশায় চড়তে তার মন্দ লাগে না অবশ্য। সূর্য এখন মাথার ওপর প্রায়। রোদের তাপে শরীর ঝলসে যাওয়ার উপক্রম সকলের। ইরারও একই দশা। গায়ের জামাটা জায়গায় জায়গায় ঘেমে ভিজে উঠেছে। কোমর বরাবর চুল গুচ্ছ উন্মুক্ত ভাবে বিচরণ করছে তার পৃষ্ঠদেশে। এই উন্মুক্ততা যেন দ্বিগুণ তেজ বাড়িয়ে দিয়েছে শরীরের। সকালে শাওয়ার নেওয়ার ফলে চুলগুলো ভেজা ছিল তাই তো ছেড়ে এসেছিল। কে জানতো এই খোলা চুলই তার গরমের কাল হবে।
যখনই একটা খালি রিকশাকে হাতের ইশারায় ইরা ডাক দিতে যাবে ঠিক তখনই কোত্থেকে এক সুবিশাল গাড়ি এসে তার সম্মুখে উপস্থিত হলো। ইরা ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চাইল। মনে মনে রাগ হলো। এই গাড়িটার জন্যই তার এতো অপেক্ষায় পাওয়া রিকশা টা হাত ছাড়া হয়ে গেল। এখন এ দুপুরে রোদে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে হয় কে জানে? ইরার ভাবনার মাঝেই শোনা গেল এক স্নিগ্ধ কন্ঠ,
“এই যে ম্যাম এখানেই থাকা হবে নাকি গাড়ির দিকে অগ্রসর হবেন।”
ইরা চমকে উঠে সামনে থাকা সুদর্শন যুবকটির দিকে দৃষ্টি ভেড়ায়। মুহূর্তেই তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় যেন। শরীরে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক শূন্য। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবল গরম তরলের বিচরণ শুরু হয়। খুব সন্তপর্ণে সামলে নেয় সে নিজেকে। পিছু হটতে নিলেই শক্তপোক্ত একটি হাত তার এক হাত টেনে ধরে তাকে নিজের একদম নিকটে এনে ফেলে। ইরার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। আপাততঃ দুই মানব মানবী এখন গভীর অনুভূতিতে ডুবে যেতে ব্যস্ত। এই অনুভূতি নয়নে-নয়নে, হৃদয়ে-হৃদয়ে, পুনর্মিলনে।
“কেমন আছো?”
“যেমন রেখে গেছেন তেমন।”
“তুমিই তো চাইতে যেন আমি দুরে চলে যাই।”
“মুখের কথা আর মনের কথা কী এক? যদি বিশ্বাস করবেন তবে আবার কেন ফিরে আসা? বারংবার কষ্ট দেওয়ার মধ্যে কী পৈশাচিক আনন্দ নিহিত?”
নিহান মুচকি হাসে। দু-হাতে আবদ্ধ করে নেয় ইরার ঘামার্থ মুখশ্রী। খুব সন্তপর্ণে চুমু এঁকে দেয় ললাটে। অতঃপর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলে,
“পুরোপুরি আপন করে নিতেই তো হারিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে করে আর কেউ কখনো হারানোর সুযোগ না পাই। না তুমি আর না আমি।”
“ভীষণ কষ্ট দিয়েছেন। একটা নয় দুটো নয় চার চারটা বছর।”
“ভালবাসা দিয়ে সব পুষিয়ে দিবো।”
ইরা মুহূর্তেই লজ্জা পেয়ে যায়। নিহানের দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নিহান মুচকি হাসে। তার লজ্জাবতীকে কতদিন পর দেখছে। এ দেখার যেন কোনো শেষ নেই।
———————
চলবে,
নামিহা নিশি