গহন_কুসুম_কুঞ্জে ৩২.

0
330

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩২.

মাকে কোনোরকমে সামাল দেয়া গেলেও মায়ের প্রশ্ন আর শেষ হয় না। রাতের খাবারের জন্য তেমন কিছুই বাকি ছিল না৷ স্বরূপ কিছু একটা রাঁধতে রান্নাঘরে ঢুকল। মাছ মাংস রাঁধতে দেরি হবে৷ দ্রুত হবে কোনটা? ডিম? ডিম ভাজি নাকি ভুনা? স্বরূপ মাথা চুলকে ভাবছে, এমন সময় মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “তনয়ার জামাকাপড় এই ঘরে কেন?”

স্বরূপের মনে পড়ল তনয়া তার জামাকাপড় মিলিকে পরতে দিয়েছিল। সব গেস্টরুমেই রয়ে গেছে। হায় হায়!

মাকে মিলির কথাটা বুঝিয়ে বলল স্বরূপ। মা প্রশ্ন করতে থাকলেন, “মিলি কবে গেছে? তনয়া কবে গেছে? একই দিনে কেন?” ঘাপলাটা বোধহয় ধরার চেষ্টা করছেন। শেষে বললেন, “মিলিকে এখানেই থাকতে হবে কেন? পৃথিবী থেকে ওর আত্মীয়স্বজন, মেয়েবন্ধু সব গায়েব হয়ে গেছে নাকি?”

স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে গেল।

খাওয়াদাওয়া শেষে মা মিতাকে নিয়ে শুতে চলে গেলে স্বরূপ নিজের ঘরে ঢুকল। মোবাইল হাতে নিয়ে এলোমেলো ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তনয়া একটু আগেই নিজের প্রোফাইলের ছবিটা বদলে দিয়েছে। সেখানে এখন টলটলে চোখের ঠোঁট উল্টানো এক বাচ্চার ছবি। স্বরূপ কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইল। তনয়ার ছোটোবেলার ছবি নাকি এটা? কত কষ্টেই না আছে মেয়েটা! স্বরূপের মনটা আরও একবার আর্দ্র হলো। খুব ইচ্ছে করছে এখন তনয়ার সাথে কথা বলতে।

সে মেসেজ পাঠাল, “তনয়া..”

সীন হয়ে গেল সাথে সাথেই। তবে উত্তর এলো না।

সে উৎসাহ পেয়ে আবার লিখল, “কেমন আছ?”

“প্লিজ রিপ্লাই দাও!”

“চলে এসো। আর কতদিন এভাবে থাকবে?”

“তনয়া!”

“কল করি?”

“ধরো না কেন?”

“আই অ্যাম স্যরি! আর কোনোদিন ওরকম ভুল হবে না। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি কী করেছিলাম।”

“আমি ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না, কোনোকিছুতেই মনোযোগ দিতে পারি না। তোমাকে ভীষণ মিস করছি! একটা রিপ্লাই অন্তত দাও।”

“আমি তোমাকে কাল আনতে যাব। আসবে তো? মা এসেছেন। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছেন।”

স্বরূপের প্রথম মেসেজটা দেখে তনয়ার একটা হার্টবিট মিস হয়েছিল। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পরের মেসেজ দেখতে থাকল। সত্যিই কি সে স্যরি? এতদিন পর মনে হলো ভুল করেছে?

কিন্তু শেষ দুটো মেসেজ দেখে তার গা জ্বলে গেল। এর মানে সবকিছু তার নিজের জন্য! মা এসেছে বলে এখন তনয়াকে দরকার হয়ে পড়েছে। প্রথমদিন থেকে সে যে ফোন হাতে তীর্থের কাকের মতো বসেছিল তখন তো কারো মনে হয়নি মেসেজ দিয়ে কেমন আছ জিজ্ঞেস করার। এখন ঠেকায় পড়ে সবই সম্ভব হচ্ছে। তিক্ত হয়ে গেল তনয়ার মন। সে উত্তর দেবে না ভেবেও উঠে বসে টাইপ করতে শুরু করল।

স্বরূপ কোনো রেসপন্স না দেখে মোবাইল রেখে শুয়ে পড়েছিল। মিনিট দশেক পর মেসেজের টুং শব্দ হতেই সে তড়াক করে উঠে বসল। তনয়াই পাঠিয়েছে।

“তোমার ঘুম, তোমার খাওয়া, তোমার মনোযোগ, তোমার মা, সবই তো তোমার। আমার কোনটা বলতে পারো? তুমি আপাদমস্তক স্বার্থপর ছিলে, এখনো আছ। আমার ফিলিংসের মূল্য তুমি কখনোই দাওনি। নিজে ভালো ছিলে বলে একসাথে ছিলে। তোমার কাছে আমি কখনোই কি কিছু ছিলাম?

তুমি বাজি ধরেছলে দু’বছর পর তোমাকে বিয়ের জন্য আফসোস করব। কিন্তু আমি এখনই আফসোস করছি। তুমি বাজিতে জিতেছ। Congratulations!”

স্বরূপ মেসেজটা দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তনয়া সবসময় এত মিষ্টি করে কথা বলে যে তার কাছ থেকে এরকম বাক্য সে কখনোই আশা করেনি। তনয়াকে সে একটু বেশিই সহজভাবে নিয়ে ফেলেনি তো?

সে নিজের মেসেজগুলো পড়ল আবার। খুবই হাস্যকর লাগছে। এভাবে রাগ ভাঙাতে যাওয়ার মতো বোকামি আর হয় না। তার ওপর সে মনের কথা প্রকাশ করতে পারছে না। উল্টোপাল্টা বলায় কথগুলো ভীষণ পলকা মনে হচ্ছে।

সারারাত সে দুচোখের পাতা এক করতে পারল না৷ মনে হলো পৃথিবীতে সবাই তনয়ার পক্ষে চলে গেছে। তাকে একা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করছে না। কেউ একবারও ভাবছে না সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। কষ্টটা প্রকাশ করতে পারছে না, কাউকে বোঝাতে পারছে না, নিজের কাছেও এতদিন স্বীকার করেনি। কিন্তু কষ্টটা হচ্ছে তো!

তনয়ার মেসেটাও তার কাছে বড় কঠিন মনে হয়েছে। তার এটা প্রাপ্য ছিল, সে নিজেও কঠিন হয়েছে। তবুও একটা আঘাত তো পেল!

আচ্ছা সে যে ভাবত, প্রেম হবে উত্তাল, প্রবল, প্রচন্ড বেদনার; ঠিক সেই অনুভূতিগুলো কি তার এখন হচ্ছে না? নিজের সব আত্মগর্ব, সব অহংকার, কাঠিন্য ত্যাগ করে তার কি ইচ্ছে করছে না তনয়ার কাছে চলে যেতে? কেন তবে? স্বরূপের চোখে পানি চলে এলো। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!

সে ভালোবাসায় জড়াতে চায় না। ভালোবাসায় অনেক কষ্ট। একই কষ্ট বারবার সে কেন পাবে?

*

তনয়া কুশনের কভারে সুতার কারুকাজের ওপর হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। তার মন বিক্ষিপ্ত, অন্যমনষ্ক। বাবা মা আজকে চেপে ধরেছেন৷ এতদিন তারা হয়তো ভেবেছিলেন ওরা নিজেরাই ঠিক করে ফেলবে সবকিছু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে দেখতে হবে।

বাবা আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ভয় কিসের? বলতে চাচ্ছো না কেন কী হয়েছে?”

তনয়া চুপ করে রইল।

“তোমার সাথে কি ওর কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ?”

তনয়া মাথা নিচু করে ফেলল।

বাবা হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, “ফাজলামো নাকি? এতদিন হয়ে গেল সে তার স্ত্রীর খোঁজ নিতে এলো না একবারো। যোগাযোগও নেই! তার বউ যে অসুস্থ সে খবরও রাখে না। তার কী এমন রাজকার্য? কী এমন হয়েছিল তোমাদের মধ্যে?”

তনয়া এবারো চুপ করে রইল।

“তাকে নতুন খবরটা দিয়েছ?”

“না।”

বাবা এবার তনয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “স্বরূপ কি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে মা?”

আদর পেয়ে তনয়া আর নিজেকে আটকাতে পারল না। বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল।

বাবা ওকে শান্ত করে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে সে? আমাকে বলো? বাবা সব ঠিক করে দেবে।”

তনয়ার এবার মনে হলো বলে দেয়াই ভালো। স্বার্থপর লোকটাকে সে কেন ডিফেন্ড করে যাবে? সে সবটাই বলল একটু একটু করে।

বাবা ভেতরে ভেতরে তপ্ত হয়ে উঠলেও মেয়ের সামনে প্রকাশ করলেন না। বললেন, “থাক, তুমি কষ্ট পেও না। নতুন মানুষটার কথা ভাবো। তুমি কষ্ট পেলে তো তারও কষ্ট হবে তাই না? আমরা আজ রাতে বের হবো কেমন? আইসক্রিম খাব, ঘুরব, শপিং করব, তারপর কাল তোমার খালামণির বাসায় বেড়াতে যাব। অনেক আনন্দ হবে। বাকি সব ভুলে যাও।”

তনয়া এত দুঃখের মাঝেও হেসে ফেলল। বাবার কাছে সে এখনো ছোট্ট স্কুলগার্ল রয়ে গেছে। যাকে আইসক্রিম কিনে দিলে সে সব কষ্ট ভুলে যায়।

*

বাবা অফিসের জন্য বেরিয়ে যাবার পরপরই স্বরূপের মা উপস্থিত হলেন তনয়াদের বাসায়। সাথে মিতা। তার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। ছেলে কিছু বলছে না দেখে নিজেই পুত্রবধূর সাথে দেখা করতে চলে এসেছেন।

তনয়ার মায়ের সাথে কুশল বিমিময় শেষে তিনি তনয়াকে দেখতে চাইলেন। তনয়া শুয়েছিল। স্বরূপের মা এসেছে শুনে ছুটেই এলো। মাকে দেখে কেন যেন খুব কষ্ট হলো তার। শাশুড়ী হলেও খুব ভালো এই মানুষটা৷ তনয়া জড়িয়ে ধরল তাকে। মা তাকে খুব যত্নে ধরে রাখলেন। তার অভিজ্ঞ চোখ তনয়াকে দেখেই বুঝে ফেলল সুখবরের আগমনবার্তা। তবে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস না করে খবরাখবর জানতে চাইলেন।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর সেখান থেকে ফিরলেন মা আর মিতা। ততক্ষণে মায়ের সবটা জানা শেষ। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন৷ তবে সবার আগে ছেলেকে কানে ধরে ওই বাড়িতে পাঠাতে হবে। এই সময়ে কেউ রাগারাগি করে? এত আলগা রাগ ছেলেটা রাখে কোথায়?

তনয়ার কথা শুনে মনে হলো না সে এত সহজে মানবে৷ এই সময়টাতে খুব নরম মেয়েরাও কঠিন হয়ে ওঠে। অবহেলা সহ্য করতে পারে না৷

তারও বেশি কিছু বলার ছিল না৷ দোষ তার ছেলেরই। তিনি তবুও ওর হয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছেন। তনয়ার মাকে আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে দ্রুত।

*

স্বরূপ আজও কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিল না। বসের ঝাড়ির ভয়ে তবু কাজ করে যাচ্ছিল৷ কিন্তু এরপরের ঘটনা তাকে বেশ নার্ভাস করে দিল। তার মোবাইলে তনয়ার বাবার নাম্বার থেকে কল এলো।

“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি কোথায়?”

“অফিসে।”

“আজ লাঞ্চ টাইমে আমার অফিসে এসো। কথা আছে।”

“আঙ্কেল আজ অফিসের পর আমি তনয়াকে আনতে যাব। তখনই কথা বলি?”

বাবা অসম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন, “তনয়া এখন কোথাও যাবে না৷ তোমার তাকে আনতে যেতে হবে না। তুমি আমার অফিসের সামনে ঠিক দুপুর একটায় উপস্থিত থাকবে।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here