#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১১)
ঝিলের দুটি চোখে একরাশ বিষণ্নতা। এই দিনটি ওদের পরিবারের জন্য সবথেকে কষ্টের। ৬ বছর আগে এই দিনেই ঘটেছিল ঝিলের জীবনের বড় দুটি পরিবর্তন। সেসব ওকে আজও কষ্ট দেয়। মেয়েটি নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়ল। কষ্ট আর যন্ত্রণায় বুকের ভেতর ক্ষতের সৃজন হয়। আর তারপর তৈরি হয় নোনা জল। দুটি চোখ যেন আজ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বরাবরের মতো এ দিনটিতে ঝিলকে আগলে নিল ওর পাঁচ ভাই। ভাইদের জড়িয়ে মেয়েটি যেন আরেকটু কাঁদতে চায়। মাহিন একটু রাগের স্বরে বলল, “এভাবে কাঁদলে কিন্তু আর কথা বলব না।”
পাশ থেকে সজল বলল, “বোনু, তোকে কি অনাদরে রেখেছি আমরা?”
ঝিল কথা বলতে পারছে না। ওর কান্নারত মুখটি দু হাতে আগলে নিল রাফাত। হাতের তালুতে চোখ মুছাতে মুছাতে বলল, “আচ্ছা, আমাদের কারোই তো মা নেই। প্রতিটা মেয়ের মাঝেই নাকি মায়ের ছায়া থাকে। ওরা খুব শক্ত হয়। আগলে রাখতে জানে। তুই কেন আমাদের আগলে রাখতে পারছিস না বোনু?”
রাফাতকে জড়িয়ে ধরল ঝিল। ওর এত এত যন্ত্রণায় পাঁচটি তারা সঙ্গী হয়েছে। অথচ ওদের সবার ভেতরটা একইভাবে যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। সেসব তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র বোনকে আগলে রাখার প্রয়াস করছে। রোহন আর আহনাফও একই ভাবে আগলে নিল মেয়েটিকে। ওদের জীবনে ঝিল মানে হৃদয়ের একটি বিশাল অংশ। পরিবারটা টিকে আছে একটি বাঁধনে। কখনো কারো মনে হয়নি এরা কাজিন। সর্বদা একে অপরের প্রতি ছিল অপরিমেয় ভালোবাসা।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অভিনবর মনে হলো ঝিলের সাথে দেখা করা জরুরী। মেয়েটি নিশ্চয়ই আজ ভেঙে গেছে। এদিনটি তো মেয়েটির জীবনের সবটাই বদলে দিয়েছিল। পরিবারের তিনটি সদস্য একই দিনে হারিয়ে গেলে কোনো সাধারণ মানুষই ঠিক থাকতে পারে না। আর ঝিলের বয়স তো তখন সবে বারো!
ইববান শিকদার অভিনবকে ডাকলেন, “এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছিস ইহান?”
“কাছেই যাব মামা।”
“শোন,মির্জাপুরের দিকটা একটু এরিয়ে চলবি।”
“জী মামা।”
“ইহান আমি তোকে আরও কিছু বলতে চাই।”
“আমি তো শুনছিই মামা।”
“এখানে নয়। আয় আমার সাথে।”
অভিনব চলতে লাগল। ওর মনের ভেতরটা খচখচ করছে। পুরনো ক্ষতটা আবার তাজা হবে কি?
.
প্রায় তিনদিন পর অভিনবর কলটা এলো। ঝিল অনেকটা বিস্মিত হয়ে বলল, “এত দিন পর কোথা থেকে এলেন আপনি?”
“বাহ,মিস করছিলেন বুঝি।”
“মিস করার বিশেষ কোনো কারণ নেই।”
“সত্যি?”
“মিথ্যে বলে লাভ আছে নাকি।”
“থাকতেও পারে।”
“যেমন?”
“এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।”
ঝিলের ভ্রু দ্বয় বেঁকে বসল। অভিনব শব্দহীন হাসছে। ফোনের ওপাশ থেকেও বুঝে নিল মেয়েটির অবস্থা।
“একটা কথা শুনবেন?”
মেয়েটি উত্তর করছে না। অভিনব অপেক্ষা না করে বলল, “প্রজাপতি, আপনি কি জানেন মনের অজান্তে আপনি আমার সাথে প্রেম করে যাচ্ছেন।”
মেয়েটির হৃদয় ধক করে উঠল। আসলেই কি তেমন? উত্তর এলো না। অভিনব পুনরায় বলল, “এই যে আমার জন্য এত টেনশন, আমায় মিস করা, এমনকি পরিবারের সবাই কে মিথ্যে বলা সবটা জানান দেয় আপনি আমার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন।”
ঝিলের লজ্জা লাগছে। এটা আসলেই সত্য। তবে ও স্বীকার করবে না এসব। তাই অনেকটা তাচ্ছিল্য করে বলল, “কারো ভালো চাওয়া যদি হয় প্রেম, তবে ম র ণ হোক আমার।”
“বাহ একদিনেই আমার জন্য এত পাগল হয়ে গেছেন। আই লাইক ইট।”
“ঘোড়ার ডিম। আপনার মাথা গেছে। রাখছি।”
“ঝিল, কল রাখবেন না প্লিজ। একটা কথা বলব।”
মেয়েটি কল ধরে রইল তবে মুখে কিছু বলল না। অভিনব আচানাক বলে উঠে, “বৃষ্টির সময় সুঘ্রাণ তৈরীর পেছনে বজ্রপাতেরও ভূমিকা রয়েছে। বিদ্যুৎ চমকানোর কারণে বায়ুমন্ডলে বৈদ্যুতিক আবেশ তৈরি হওয়ায় প্রকৃতিতে ওজোন গ্যাসের একধরণের গন্ধ প্রতীয়মান হয়। মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যারিবেথ স্টোলযেনবার্গের মত অনুযায়ী, বিদ্যুৎ চমকানোর পাশাপাশি ঝড় এবং বিশেষত বৃষ্টির কারণে বাতাস পরিষ্কার হয়। যার ফলে বৃষ্টি পরবর্তী সুঘ্রাণও সহজে ছড়িয়ে পড়ে।”
কথাটা শুনে ঝিলের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। ফোনটা ফেলে ধরমরিয়ে উঠল প্রায়। পুরো ঘর খুঁজে এসে ফের ধরল ফোন। হেসে ফেলল অভিনব।
“হাসছেন কেন আপনি?”
“কারণ আপনার ধারণা সঠিক।”
“মানে, আপনি কেন আমার ডায়েরী নিয়েছেন!”
“কেন দোষ হলো বুঝি?”
“অবশ্যই দোষের। একজন মানুষকে না বলে পার্সোনাল জিনিস নিয়ে নিয়েছেন। এমনকি সেটা পড়েছেন ও।”
“রাগ করছেন কেন প্রজাপতি? আপনার ছোট বেলায় জাগা এমন সব প্রশ্ন জেনে ফেললাম বলে?”
ঝিল স্থির হলো। একটু সময় নিয়ে বলল,
“জানেন আমি এই প্রকৃতির সবটা জানতে চাইতাম। ভেঁজা মাটির ঘ্রাণ নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ ছিল না। আর সেটা টুকে রেখে দিতাম ডায়েরীতে। সেদিন যখন আপনি ভেঁজা মাটি নিয়ে বললেন আমার খুব ভালো লেগেছিল। মনে পরে গিয়েছিল ডায়েরীটার কথা। বের ও করেছিলাম। আর সেটাই সুযোগ বুঝে নিয়ে নিলেন। এটা কি ঠিক হলো?”
“উহু খুব ভুল হয়েছে। এখন বলেন কি শাস্তি দিবেন?”
“কিছুই না।”
“আচ্ছা, তবে ডায়েরী ফেরত নিবেন কবে?”
“যেদিন আমার ছেলে বেলায় জাগা সব প্রশ্নের উত্তর জানাতে পারবেন সেদিন।”
তৎক্ষণাৎ কলটা কেটে দিল ঝিল। অভিনব ডায়েরীটা খুলে বসল। ঝিলের মস্তিষ্কে জাগা প্রশ্ন গুলো বিজ্ঞানসম্মত। অথচ একটা ঘটনা মেয়েটির জীবন বদলে দিয়েছে। নতুবা মেয়েটি জীবনে অনেক বড় হতো।
অভিনবর কথা মনে হলেই ঝিলের মন ভালো হয়ে যায়। ছেলেটার প্রতি ওর ঝোঁক রয়েছে। এর কারণ নিয়ে মেয়েটি আপাতত ঘাটাতে চায় না। তবে ছেলেটার কথা স্মরণ করতেও ভালো লাগে। ঠকঠক আওয়াজে ধ্যান ভাঙে। উঠে আসে মেয়েটি। জাফর মির্জা দরজার নিকট দাঁড়িয়ে। পাপা কি কিছু শুনে নিয়েছেন? ওর ভয় হলো। তবে প্রকাশ করল না। খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টায় বলল, “আজ অফিস যাও নি পাপা?”
“না। শরীরটা ভালো লাগছিল না।”
“সেকি, তোমার চেকাপ গুলোর প্রতি বড্ড অবহেলা। আজই ডক্টর দেখাবে।”
“ঠিক আছে মামুনি। আগে শোনো,তোমার মামা বাড়ি থেকে লোক আসবে কাল।”
একরাশ আঁধার নেমে এলো ঝিলের মুখে। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ওদের সাথে মিশতে চাই না পাপা।”
“বাট মামুনি একবার ভেবে দেখ, ওরা তোমার আপনজন।”
“এটাই আমার দূর্ভাগ্য।”
মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন জাফর মির্জা। ঝিলের চোখ দুটো বিষণ্ণ। কোমল ঠোঁট দুটি শুকিয়ে এসেছে।
পরদিনই ঝিলের মামারা এলেন। বড় মামার মেয়ের বিয়ে। সেইজন্যেই ঝিলকে নিতে এসেছেন। তবে ঝিল যেতে চাইছে না। ওর মামা বাড়ির সাথে তেমন স্বক্ষতা নেই। মা মা রা যাওয়ার পর কখনো থাকা হয় নি। প্রায়শই যাওয়া হলেও বেশিক্ষণ থাকত না। জাফর মির্জা মেয়েকে বুঝালেন। না পেরে যেতে হলো ওকে। ওর মনের ভেতর অদ্ভুত সব অনুভূতি হয়। একটা সময় মনে হয় কিছু ঠিক নেই। ঝিলের বড় মামা রাশিদ চৌধুরী। একমাত্র ভাগ্নির প্রতি বেশ স্নেহশীল।
“মামুনি মন খারাপ?”
“উহু।”
“কিন্তু মুখ তো তেমন কিছুই বলে।”
মৌন রইল ঝিল। রাশিদ চৌধুরী নড়েচড়ে উঠলেন।
“আসলে মামুনি আমি জানি আমাদের কে বিশেষ পছন্দ নয় তোমরা। তবে এটা সত্য তুমি আমার বোনের এক মাত্র চিহ্ন। সবাই তোমাকে স্নেহ করে।”
এবার ও মেয়েটি উত্তর করল না। ঝিলের মামা বুঝলেন বিষয়টা। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন গাড়ির গতি বাড়াতে। কিছু মুহুর্তেই পৌছে গেল ওরা। ঝিলকে দেখে সবাই অবাক হয়েছে। ওর মামাতো বোন রজনী বলল, “যা এত দিন পর মনে পড়ল বোনের কথা? ভালোই হয়েছে এবার এক মাস থেকে যাবে। আমরা খুব মজা করব।”
“তুমি তো এক সপ্তাহ বাদেই চলে যাবে। আমি অতো দিন থেকে কি করব?”
রজনী হেসে ফেলল। ঝিলের বাহুতে হাত রেখে বলল, “আমি আবার কোথায় যাব?”
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি