#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৪)
গত কয়েকদিনের ঘোরাঘুরিতে অভিনবর কথা একদমই ভুলে বসেছিল ঝিল। মেয়েটির সমস্ত ব্যকুলতা আকুলতা জল হয়ে গড়িয়ে পড়ল মাঝ রাত্রিতে। অতিরিক্ত গরম লাগাতে ঘুম আসছিল না। ব্যলকনিতে এসে বসে ছিল। মৃদু আলোতে চারপাশের পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর। ঠিক সে সময়ে চোখ যায় এক জোড়া কপোত কপোতির দিকে। খুব সম্ভবত লুকিয়ে দেখা করছে ওরা। একে অপরকে জড়িয়েও ধরলো। এসব দেখে মেয়েটির হৃদয় ধক করে উঠে। হঠাৎ করেই অভিনবর কথা ভীষণ মনে পড়ে। এদিকে ফোন নষ্ট হয়ে আছে। ঠিক করতে দিবে দিবে করে আর দেওয়া হয় নি। ঘটনাটার পর থেকে মেয়েটির চোখে একদমই ঘুম নেই। অশান্তিতে ছেয়ে গেছে শরীর। দেহের বাঁক বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঘামের স্রোত। এত অশান্তি এর আগে অনুভব হয় নি। আচ্ছা ছেলেটা কি ওর খোঁজ নিয়েছে? নাকি ভুলে বসেছে। এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করে মেয়েটি বিব্রত হয়ে পড়ল। সকাল হওয়ার আগ অবধি ওর নিশ্বাস আটকে ছিল গলায়। খাবার টেবিলে দ্রুত খাবার খাওয়াতে নাকে উঠে গেল। রজনী পানি এগিয়ে দিল। আয়ুষ ঠিক দুটো চেয়ার দূরে। ভালো করে লক্ষ্য করেছে।
“তোর কি মন খারাপ?”
“না তেমন কিছু না।”
“এত দ্রুত খাবার খাচ্ছিলি কেন? খুব ক্ষিধে পেলেও তো কেউ এভাবে খায় না। এত তাড়া কিসের?”
ঝিল অধৈর্য হয়ে পড়ল। খাবারের টেবিলে থাকা প্রায় সকলেই আয়ুষের কথা শুনেছে। ছোট মামী সুমতি বেগম বললেন, “ওমা কি রে ঝিল। এত তাড়াহুড়ো করছিলে কেন?”
“এমনি ছোট মামী। কোনো সমস্যা নেই।”
“সমস্যা হলে অবশ্যই বলবে মামুনি। যত দিন আছ অন্তত নিজের মায়ের বাড়ি মনে করে থেকো। সবাই তোমার ভীষণ আপন।”
“জী বড় মামা।”
খাবারে মনোযোগ দেয় ঝিল। ধীরে স্বস্তে খাবার খাচ্ছে এবার। কিন্তু এক জোড়া চোখ গভীর ভাবে দেখছে ওকে। বোঝার চেষ্টা করছে এত ব্যকুল হওয়ার কারণ।
হাত ধোঁয়ার সময় আয়ুষ বলল, “কথা আছে উপরে আয়।”
মনে মনে খুশি হলো মেয়েটা। এই একটা মানুষ ওর সব অনুভূতি বুঝতে পারবে। গত কয়েকদিনে আয়ুষ ওকে এমনটাই ভরসা দেখিয়েছে। মেয়েটি দেরি না করে তৎক্ষণাৎ উপরে এলো। আয়ুষ চা তৈরি করছে। ছেলেটা ভীষণ ভালো চা বানায়। ঝিল এক পলক দেখে চোখ নামালো। আয়ুষের ঘরটা বেশ পরিপাটি। এক পাশের দেয়ালজুড়ে আলমারি। আলিশান খাটের উপরের পাশটায় রয়েছে নানান ছবি। এসব ছবির মূল্য নাকি কয়েক লক্ষ্য টাকার উপরে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে ঝিল। এর আগে এই ঘরে আসা হলেও তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় নি। অল্প সময় নিয়ে চা বানায় আয়ুষ। দুটো কাপে চা ঢেলে নিয়ে প্রশ্ন করল, “চিনি কতটুকু?”
“এক চামচ।”
আয়ুষ দেড় চামচ চিনি দিল। ঝিল চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল, “এ ছবি গুলো কোথা থেকে এনেছ?”
“বাবা এনে দিয়েছেন। সম্ভবত বিদেশ থেকে ক্রয় করা।”
সবে চা মুখে দিয়েছে। ঝিল বুঝতে পারে চিনির মিষ্টতা। এর কারণ জিজ্ঞাসা করতেই হেসে জবাব দেয় আয়ুষ।
“তোর মনের ভেতর একটা তিক্ততার জন্ম হয়েছে। এই তিক্ততা দূরের জন্যই আধা চামচ চিনি বেশি দিয়েছি। আশা রাখছি এ বাড়ির অন্যদের মতো আমার প্রতি বিতৃষ্ণা আসবে না।”
ছেলেটার এমন লজিকে হেসে উঠে ঝিল।
“বাহ, এই ট্রিকটা কোথা থেকে শিখলে?”
“নিজ থেকেই। এখন বল,তোর কি হয়েছে।”
একটা শ্বাস ফেলল ঝিল। ওর মুখের উপর হঠাৎ কালো মেঘের আগমন বুঝতে পারে আয়ুষ। একটু নরম কণ্ঠে ভরসা দেয়।
“তুই আমায় বিশ্বাস করতে পারিস।”
“আসলে আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। এটা ঠিক করা প্রয়োজন। কাউকে বলতে ইচ্ছে করছিল না।”
“ও এই ব্যপার। এটার জন্য কেউ এমন করে? পাগলি মেয়ে।”
আয়ুষ চায়ের কেটলিটা সরিয়ে রাখল। ঝিল একটু উসখুস করেই বলল, “আয়ুষ ভাইয়া আমি আসলে অন্য বিষয় নিয়ে বিরক্ত।”
মৃদু হাসল আয়ুষ। বিষয়টা আগেই ধরেছিল। তবে ঝিল কিছু বলছিল না বিধায় প্রশ্ন করে নি। ঝিল ধপ করে দোলনায় বসে পড়ল। আয়ুষের ঘরে এই দোলনা লাগানোর পেছনে একটি কারণ রয়েছে। গত কয়েক বছর আগের কথা। আয়ুষদের এক প্রতিবেশি মেয়ে ওকে ভীষণ পছন্দ করত। মেয়েটার পরিবার খুব বেশি ধনী নয়। তাছাড়া মেয়েটি অন্য ধর্মের। এসবের কারণে নিজের ভালোবাসা ব্যক্ত করতে পারে নি মেয়েটা। তবে বিয়ের কার্ড দেওয়ার সময় বলেছিল ঘরের খালি জায়গাটায় দোলনা লাগালে নাকি ভীষণ সুন্দর হবে। এটা মেয়েটির দাবি কিংবা অনুরোধ ছিল না। আর না আয়ুষের মনে ওর জন্য ভালোবাসা ছিল। তবু কেন যেন ওর কথাটার পূর্ণতা দিয়েছে আয়ুষ। একটা অব্যক্ত অনুভূতির সম্মানেই হয়ত।
পুরো সকাল জুড়ে অভিনবর গল্প করেছে ঝিল। গল্পটা শুরু হয়েছে অভিনব পাগলামি নিয়ে। ছেলেটা সম্পর্ক খুব বেশি তথ্য কিংবা ঘটনা বলতে পারে নি মেয়েটি। তবে একই কথাই হাজার বার বলছিল। সবটাই চুপ করে শুনছে আয়ুষ। এখন সে বেরিয়েছে ঝিলের ফোন নিয়ে। মেয়েটির চোখ মুখ বার বার বলছিল অভিনবর প্রতি কতটা অনুভূতির জন্ম হয়েছে। মোবাইলের দোকানটায় এসে বসেছে আয়ুষ। দোকানদারকে বলেছে এখনি ঠিক করে দিতে। দোকানদার তাই করছিল। ওমন সময় একটি ছেলে এসে বলল, “মামা পুরনো ফোন হবে?”
“হবে মামা।”
ছেলেটা দুটো পুরনো ফোন নিয়ে চলে গেল। আয়ুষ ভাবছিল অভিনব আর ঝিলের বিষয়টা। ছেলেটা যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে এতক্ষণে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার কথা। তাছাড়া এর আগের পাগলামি গুলো তেমন কিছুরই আভাস দেয়।
.
সিগারেটের নেশাটা বরাবরই বেশি তরুণের। ওর জীবনে এই জিনিসটা একটু বেশিই জায়গা করে নিয়েছে। অভিনবর দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে তিনটে সিগারেট শেষ করল। ঘটনাটা এমন যে অভিনব দ্বিতীয় বারের মতো ব্যর্থ। ঝিলের মামা বাড়ির সর্তকতা ভেদ করা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। এর প্রধান কারণ গ্রামের অনুগত কর্মচারী। ওদের টাকা দিয়ে কেনা যায় না। তরুণের ভাবলেশপানা অভিনবকে বিরক্ত করছে।
“শুনছিস আমার কথা?”
“হু।”
“তাহলে আইডিয়া দে। এভাবে বসে আছিস কেন?”
“ভাবছি।”
“কি?”
“কি করে কি করা যায়। তুই দেখ অভিনব, ঝিলকে হঠাৎ করেই কেন মামা বাড়ি পাঠানো হলো।”
“সেটার কারণ তো ওর কাজিনের বিয়ে।”
“হু কিন্তু আমার মনে হয় আরও কিছু কারণ রয়েছে।”
“সেটা তো রয়েছেই।”
“কিন্তু কি?”
“খুবই সহজ আর পরিষ্কার। আমি শুরু থেকেই খোলামেলা ছিলাম। প্রথম দিনই ওদের সামনে ঝিলকে জড়িয়ে ধরেছি। এমনকি আমার পরিচয় ও গোপন করি নি। যেহেতু পুরনো রেষারেষিটা আছে আর আমি ভীতু প্রকৃতির ও নই, সেহেতু ওনারা ভরসা পাচ্ছিল না। তাছাড়া ঝিল যতই লুকোচুরি করুক না কেন, কোনো না কোনোভাবে ওনারা বুঝেছে ওনাদের মেয়ে প্রেমে পড়েছে। একটু নয় গভীর ভাবে। তাই আমাদের আলাদা করার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে।”
ঘটনাটা সত্য। তরুণ অভিনবর কষ্টটা বুঝতে পারছে। মৌনতাকে ডেকেছে ওরা। মূলত মেয়েটি ওদের নানা ভাবে সাহায্য করতে পারবে। বিশেষ করে ঝিলের সাথে কথা বলিয়ে দিতে। সাড়ে চারটার দিকে এলো মৌনতা। হাপাচ্ছে রীতিমতো। তরুণের দিকে রাগী ভাবে তাকালো।
“কতবার কল দিয়েছেন? আমার জান বেরিয়ে আসছিল। আমি তো রকেট নই। আর রাস্তায় কি পরিমানে জ্যাম।”
“রাগ করছ কেন? তুমি তো গুড গার্ল।”
“যত্তসব ঢং।”
অভিনবর আর সহ্য হচ্ছিল না। ওদের কথোপকথন শেষ করার জন্য এক বোতল পানি এগিয়ে বলল, “পানি খাও আপু।”
“থ্যাংকস।”
“তোমাকে কি বলব আমার জানা নেই। হয়ত তুমি না থাকলে আমাকে আরও বিপাকে পড়তে হতো।”
“উহু, বিপাকে পড়তে হতো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই কোনো উসিলা পাঠিয়ে সাহায্য করতেন।”
মৃদু হাসল অভিনব। মৌনতা পুনরায় বলল,
“কয়েকদিন ধরে ঝিলের ফোনটা নষ্ট। এমনটাই বলল ওর ফ্যামেলি থেকে। ওর কাজিনের ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছি। ঝিলকে দিলেই আমি আপনাকে ধরিয়ে দিব।”
সায় দেয় অভিনব। মৌনতা রজনীর নাম্বারে ডায়াল করে। কিছুক্ষণ বাজতেই কল রিসিভ হয়।
“আপু আমি ঝিলের বান্ধবী মৌনতা। ওর ফোন তো নষ্ট হয়ে আছে। ওকে একটু দেওয়া যাবে।”
“ও আচ্ছা। কিন্তু আপু ঝিল তো বাসায় নেই। আমাদের এক রিলেটিভের বাসায় গিয়েছে।”
“ও আচ্ছা।”
“ঝিল আসলে আমি বলব তোমায় কল করতে।”
“ঠিক আছে আপু। থ্যাংকস।”
কল কেটে সংবাদটা দিল মৌনতা। অভিনবর মুখের ভঙ্গিমা বদলে গেল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। মাথায় যন্ত্রণা লেগেই আছে। মৌনতা তরুণের দিকে তাকালো। তরুণের ও চোখ মুখ অন্ধকার। ওরা দুজনেই অভিনবর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছে। খারাপ লাগছে খুব। কিন্তু হাত পা ও যে একেবারেই বাঁধা।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি