সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৭)

0
103

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৭)

ঝিলকে দু হাতের সাহায্য নিজ বক্ষে চেপে ধরেছে অভিনব। যেন একটুখানি নড়চড় হলেই মেয়েটি কোথাও পালিয়ে যাবে। ঝিলের নরম দুটি হাত অভিনবর কোমর জড়িয়ে ধরা। মেয়েটি কতদিন পর মানুষটার সাথে দেখা করতে পেরেছে! ফুলের মৃদু ঘ্রাণে খুব সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে। এদিকে লোক সমাগম নেই বিধায় এত সময় ধরে মেয়েটিকে বক্ষে স্থান দিতে পারল অভিনব। খানিক বাদে পায়ের শব্দ শোনা গেল। বিরক্ত মুখে ঝিলকে ছাড়ল অভিনব। ওর ইচ্ছে করছে অসভ্য হতে। মানুষ আসলে আসুক তাতে ওর যায় আসে না। কিন্তু বুদ্ধিমান, ভদ্র গোছের অভিনব অসভ্য হতে পারল না। মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে খানিক দূরত্ব বজায় রেখেছে। ঝিল ও নিশ্চুপ। লোক সমাগাম কমে এলে অভিনবর কাছে এসে ঘেঁষে।
“কি দিন এসেছে বলেন তো। আপনি আমার জন্য শুদ্ধ অথচ লোকের চোখে অশুদ্ধ।”

চমৎকার এক হাসির মাঝে নিজের ব্যথা লুকায় অভিনব। পুনরায় মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। আশ্বস্ত করে বলে, “কখনো প্রেম করেছেন ঝিল? করেন নি তো। আমি ও তাই। প্রেম এল না এ জীবনে। অথচ দেখেন প্রকৃতি আমাদের প্রেম করার সুযোগ দিয়েছে। বিয়ের পর প্রেম করার মধ্যে যে অনুভূতি এটা আমি আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। ভাবুন কতটা সুন্দর এটা।”

বুকের ভেতর এসে লাগল কথাটা। প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর অনুভূতি ঝিল পেলেও প্রেমের স্বাদ তো পায় নি। এই স্বাদ দিতেই বুঝি প্রকৃতি ওদের এমন পরিস্থিতি দিল?

রুদ্রম,নিয়ন,মায়রা আর মৌনতা পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে ঝিলকে কল করল। মেয়েটি আজ একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। মৌনতা বুঝতে পারল ঝিল অভিনবর সাথে দেখা করবে। তাই ও ইনিয়ে বিনিয়ে বলে দিল ঝিল চলে গেছে। ওরা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে একটা ফুড কার্ডে এসেছে। ছোট্ট স্টলের পাশে অনেকগুলো চেয়ার রাখা। সেখানেই বসেছে ওরা। আড্ডা চলছিল। ওমন সময় তরুণের সাথে দেখা।
“হায়।”

“হায়। আপনি এখানে কি করেন?”

“তোমরা যা করছো।” কথাটা বলেই ফুচকার প্লেট দেখাল। মৌনতা হাসল। তরুণ ওর সিট থেকে উঠে এসে ওদের পাশে বসল। রুদ্রম আর নিয়ন হাত মিলিয়েছে। মায়রা ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে স্বাগতম জানায়। একটা সময় পর মায়রা বলে উঠে, “আজকের ট্রিট নিশ্চয়ই তরুণ ভাইয়ার পক্ষ থেকে আসবে।”

“একদম, আফটার অল তোমাদের সিনিয়র আমি।”

ওরা গল্প করছিল। এক ফাঁকে মৌনতার খুব ঝাল লাগে। মেয়েটি ব্যগ্র হয়ে উঠে। পানি এগিয়ে দেয় তরুণ। দ্রুত পানি পান করছে বিধায় মাথায় ইষৎ স্পর্শ করে বলে, “ধীরে ধীরে।”

পানিটা কয়েক নিশ্বাসে শেষ করে ফেলে মৌন। তারপর পুনরায় বসে যায় গল্পে। রোহন এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। জ্যাম লেগেছে, রাস্তার পাশে মৌনতা কে দেখে চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। কিন্তু দৃশ্যটা মাথা থেকে যাচ্ছে না। তরুণের সাথে মৌনতার আলাপচারিতা এর আগেও দেখেছে সে।

ঝিলের পরীক্ষা শেষ হতেই জাফর মির্জা বললেন শশুর বাড়ি যাওয়ার কথা। রজনীর ঘটনার পর কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তবে যাওয়া হয় নি। এসব শুনে ঝিলের মন খারাপ হলো। ওর বন্ধুরা ট্যুরের প্ল্যান করেছে। সেখানে গেলে অভিনবর সাথে দেখা হতো। কিছুদিন পাশাপাশি থাকতে পারত। মন খারাপ নিয়েই বাবার সাথে মামা বাড়ি গেল সে। এবার সাথে এসেছে আহনাফ। ভরসা দিয়েছে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে পুরোটা সময় এল মেয়েটি। মামা বাড়িতে প্রবেশ করতেই শরীরটা কেমন খারাপ লাগতে শুরু করল। মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ভেতরে চলে এসেছে। আয়ুষের সাথে কথা হলো না সেদিন। কক্ষে এসেই ঘুম দিল মেয়েটি। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আয়ুষের সাথে দেখা। একটা হাসি দিয়ে ঝিল বলল।
“কেমন আছ আয়ুষ ভাইয়া?”

“ভালো আছি। খোঁজ নিলি এত সময় পর।”

“আমি ক্লান্ত ছিলাম।”

“হুম। বিকেলেই নাকি চলে যাচ্ছিস।”

ঝিল আমতা আমতা করে বলল, “হুম। ট্যুর প্ল্যান আছে তো।”

“আচ্ছা। যাওয়ার আগে দেখা করিস কিন্তু।”

আহনাফ সব ব্যবস্থা করে নিয়েছে। জাফর মির্জার সাথে কথা বলে ঝিলের রুমে এল।
“ট্যুরে অভিনব ভাই যাবে?”

“বলেছে যাবে।”

লজ্জা মিশ্রিত স্বরে বলল ঝিল। আহনাফ একটু চিন্তা করে বলল, “রোহন সাথে যাবে। কোনো সমস্যা নেই তো?”

“না। ভাইয়া গেলে বরং বেশি ভালো হবে।”

“ঠিক আছে। আমি সব দিক ম্যানেজ করে নিব। তৈরি হয়ে নে।”

ঝিল টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। অভিনবর সাথে সুন্দর সময় কাটানোর কথা স্মরণ হতেই হাসল মেয়েটি। সন্ধ্যার মধ্যেই ওরা সবাই একত্র হলো। অন্যদিকে অভিনব তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে তাকে নিউইয়র্ক যেতে হচ্ছে। যাওয়ার আগে ঝিলের নাম্বারে কল করল কিন্তু কাজ হলো না। মেয়েটি নিশ্চয়ই ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে। ওদের কথা হলো দুদিন পর। ঝিল কিছুটা অভিমান করেছিল। অভিনব ভীষণ লজ্জিত। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে নি যে। কিন্তু যখন বলল বাবার শরীর ভালো নেই তখন ঝিল যেন একদম নুইয়ে গেল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল খবর নিতে। অভিনব বলল, “পাপা এখন ঠিক আছে। ছোট একটা অ্যাটার্ক হয়ে গিয়েছিল।”

“যাক আল্লাহ অল্পতেই রক্ষা করেছেন।”

“হুম।”

“আমি যদি যেতে পারতাম।”

“মন খারাপের কিছু নেই। আমি আছি মানেই আপনি আছেন।”

“আঙ্কেলের সাথে কথা বলা যাবে?”

“হ্যাঁ।”

অহেদ সরকার চোখ বন্ধ করে আছেন। অভিনব ধীর কণ্ঠে ডাকল।
“পাপা, পাপা তোমার মেয়ে কল করেছে।”

ভদ্রলোক হাসলেন। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলেন।
“কেমন আছ মামুনি?”

ঝিলের ভেতরটা ধক করে উঠল। কতটা সুন্দর করে ডাকলেন তিনি। ঝিল সরল গলায় বলল, “জী ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো নেই শুনে খুব খারাপ লাগল। যদি আমি আসতে পারতাম।”

“চিন্তার কিছু নেই মামুনি। আমি ঠিক আছি এখন। আর খুব দ্রুত তোমাকে বাড়ি নিয়ে আসবে আমার অভিনব।”

ঝিলের সাথে আরও কিছু সময় কথা বলল। পুরোটা সময় অভিনব বাবার পানে তাকিয়ে ছিল। ভদ্রলোকের শ্বেত রঙা মুখশ্রী কেমন হয়ে আছে। সাদা মুখটায় র ক্ত জমে আছে যেন। কিছু সময় পর ইহরিমার সাথেও কথা হলো ঝিলের। মেয়েটির খুব কান্না পাচ্ছে। ভদ্রমহিলার সাথে একদিনের সুন্দর স্মৃতির কথা স্মরণ হলো। মায়ের স্নেহ পাওয়ার জন্য ঝিলের মনটা ভীষণ অশান্ত হয়ে পড়ল।

এবার অভিনব ফিরল তিন মাস পর। ঝিলের ভেতরটা
ঝ ল সে যাচ্ছিল কিন্তু প্রকাশ ছিল না। অভিনব ফিরেই গেল দানেশের কাছে। রজনী প্রেগনেন্ট। কথাটা শুনে না এসে পারছিল না। প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে রাহিন। টাকা পয়সার পাশাপাশি খোঁজ খবর ও রাখে সে। যদিও সবটাই তার বাবার নির্দেশে। ইববান শিকদার ভাতিজাকে বাড়িতে ফেরার অনুমতি না দিলেও খোঁজ খবরের ক্রুটি রাখেন নি। এসব জানে না দানেশ। সবটাই হচ্ছে অগোচরে। রজনী রান্না করতে গেলে অভিনব বাঁধা দিল।
“ভাইয়া আপনি খালি মুখে ফিরে যাবেন?”

“খালি মুখে কোথায়। এই তো চা নাস্তা খেলাম। তুমি বোসো। দানেশ কি করছিস এখন?”

“ঘুরছি ফিরছি।”

“মজা না ভাই। কিছু করছিস নাকি বসে আছিস?”

“পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ কিছু কি আর করব? তবে একটা ছোট বিজনেস শুরু করেছি। ভাইয়ের টাকায় আর কদিন।”

কথা শেষে হাসল দানেশ। ব্যথাটা লুকানোর প্রয়াস যেন। অভিনব ধীরে স্বস্তে উঠে পড়ল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“পাশেই একটা কারখানা খুলতে পারিস।”

“সেটা করা যেত। তবে এত গুলো পুরুষ মানুষ এখানে কাজ করলে রজনীর জন্য সমস্যা হয়ে যাবে।”

“পুরুষ মানুষ দিয়ে নয় মেয়ে মানুষ দিয়েই বিজনেস শুরু করতে বলেছি। চা তৈরির বিজনেস।”

আইডিয়াটা ভালো লাগল দানেশের। সেদিন বিকেল বেলা ওদের বেশ জমজমাট আড্ডা চলল। অভিনব বেশ কিছু উপহার এনেছে। সেসব পেয়ে রজনী প্রায় কেঁদে ফেলল। নিজের ভাইয়ের কথা স্মরণ হলো। আয়ুষ নিশ্চয়ই এমন উপহার দিত। কিন্তু ভাগ্য আজ কোথায় দাঁড় করিয়েছে। অভিনব অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল দু পরিবারে মধ্যে একটা মিল করানোর। কিন্তু ব্যর্থতার উদয় হয়ে গেল তার আগেই। একটা জমি নিয়ে মামলা চলছিল। সেটা জিতে গেল মির্জারা। এতে শিকদাররা পুরো চটে গিয়েছে। হাই কোর্টে আপিল করেছে। আবার দু পরিবারের মাঝে লড়াই শুরু হলো। অথচ জমির মৃল্য খুব বেশি নয়। গত কয়েক বছরে মামলায় যে পরিমান টাকা খরচ হলো তা দিয়ে ওমন চার জমি কেনা যেত। টাকা দিয়ে যেন আত্মসম্মান কেনা হচ্ছে। অভিনব পুরো দমে পিছিয়ে এল এবার। মামাদের সাথে বৈঠক বসিয়েছে। পুরো বিষয়টা খুলে বলল। ঝিল ওর স্ত্রী এটা শুনে শিকদারটা যেন অদ্ভুত রকমের খুশি হয়েছে। ও বাড়ির মেয়েকে আনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল। কারণ এটা মির্জাদের উইক পয়েন্ট। কিন্তু মির্জারা নুইয়ে যাবার পরিবর্তে খেপে গেল। তারা মেয়ে দিবে না। শিকদাররা ও সুযোগ ছাড়তে চাইছে না। ঝিল পড়ল মহাবিপদে। এক দিকে ভালোবাসা আর অন্যদিকে পরিবারের সম্মান। এ নিয়ে মামলা অবধি হয়ে গেল। ঝিল যদি সায় দেয় তবে বাবা চাচাদের সম্মান মাটির সাথে মিশে যাবে। অন্যদিকে নিজের ভালোবাসা হারাতে হবে। এত চিন্তায় মেয়েটি আর সামাল দিতে পারছিল না। রাতে ঘুম হতো না। তাই ঘুমের ঔষধ নেওয়া শুরু হলো। অভিনব কল করলে সোজা সাপ্টা মানা করে দিল। এখন কিছু সময় একা থাকতে চায়। ধীরে ধীরে ওদের সম্পর্কটা অবনতির পথে যাচ্ছিল। আয়ুষ এ সময়টা কেমন করে যেন ঝিলের বন্ধু হয়ে গেল। জাফর মির্জা মনে মনে আয়ুষের সাথে মেয়ের সম্পর্ক চাইছিলেন। বিষয়টা তিনি খোলসা করে বলে দিলেন। এসব শুনে ঝিল বিশেষ কিছু বলে নি। ওর নীরবতা যেন পাহাড় সম আশ্চর্য তৈরি করে দিচ্ছে। সব শুনে অভিনব চটে গেল বেশ। ঝিলের ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাগে আক্রোশে ওর চোখ দুটি রক্তিম হয়ে উঠেছে। ইদানীং আয়ুষ ঝিলকে ভার্সিটি দেওয়া নেওয়া করে। অভিনবকে চিনতে অসুবিধা হলো না। অভিনব ঝিলের দিকে আগালে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। ঝিল নিশ্চুপ।
“ওর কাছে যাওয়ার সাহস করবেন না অভিনব সরকার ইহান।”

আয়ুষের দিকে ফিরে ও তাকাল না অভিনব। ও তাকিয়ে আছে ঝিলের দিকে। মেয়েটার শরীর দুলছে। চোখ দুটি স্থির। অভিনব এক পা এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করলেই আয়ুষের হাতটা ওর বুকে এসে ঠেকল। ওদের দেহের বলিষ্ঠতা প্রায় কাছাকাছি। দুজনের চোখাচোখি হলো এবার। অভিনবর মুখের চোয়াল ক্রমাগত উঠা নামা করছে।
“দূরত্ব বজায় রাখেন।”

অভিনবর ভীষণ হাসি পেল। যেই মেয়েটা ওর বুকের মাঝে তার থেকে কিসের দূরত্ব বজায় রাখবে? তবু ঝিলের পানে তাকাল আশা নিয়ে। ঝিল উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে। ছেলেটার মন তিক্ত হয়ে এল। চোখ দুটো ভয়ানক দেখাচ্ছে। ফর্সা মুখটা এতটা ভয়ঙ্কর লাগছে যে আশেপাশের মানুষ গুলোও কেমন থমকে গেল।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here