#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৩২)
অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে দেখে প্রায় থমকে গেল অভিনব। গলার কাছটার তরল শুকিয়ে এসেছে। চোখ দুটি ভীষণ আপ্লুত। আবেগ লুকানোর চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ সামনের ব্যক্তিটি নির্দ্বিধায় হাতের গ্লাস থেকে অমৃত সুধা পান করে চলেছে। বোনাস হিসেবে হাতে রয়েছে আবার সিগারেট ফ্লিটার! অভিনবর গলাটা ধরে এল। ঝিল এত সময় অলিভিয়ার সাথে ঘুরছিল। হঠাৎ করেই ছেলেটার থমকে যাওয়া অবস্থা দেখে ফিরে এল।
“কি হয়েছে তোমার? অসুস্থ দেখাচ্ছে।”
এক পলক তাকাল অভিনব। ঝিলের দুটি চোখ শীতল। ঠোঁটের কোণ জুড়ে একটা প্রাপ্তি। আচমকা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল সে। কানাডার শহরে এসবে কেউ মাথা ঘামায় না। কেউ তাকাচ্ছে না অবধি। ছেলেটার হৃদয়ের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছে ঝিল। আলগোছে পিঠে হাত রাখল সে।
“রুমে যাবে?”
“উঁহু।”
“বোসো একটু।”
“উঁহু।”
“সমস্যাটা না বললে আমি বুঝব কেমন করে?”
“কখনো হারিয়ে যেও না প্রজাপতি।”
“হারাব না। কিন্তু তোমার কী হলো?”
“জানি না। তবে ভয় হচ্ছে।”
“ভয় নেই। আমি আছি তো। কখনো ছাড়ব না তোমায়।”
অভিনবর যে কি হয়েছে কে জানে। ঝিল একই ভাবে পিঠে হাত বুলাতে লাগল। কিছু সময় পর শান্ত হলো ছেলেটা। ছেড়ে দিয়ে অন্যপাশ ফিরে দাঁড়াল। পুরোটা সময় অভিনবর খারাপ লাগাটা নজরে এসেছে ঝিলের। কিন্তু বিশেষ কোনো জোর খাটায় নি সে। হিটারের উষ্ণতায় রাতের আঁধার যখন ওদের ভালোবাসায় সিক্ত করছিল ঠিক সে সময়টায় ইষৎ মন খারাপের দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটি বলল অভিনব।
“মুনতাহার অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে।”
ঘটনাটি জানে ঝিল। তাই সে চমকে উঠল।
“তাকে কোথায় দেখলে?”
“পার্টিটে ছিল।”
“আমায় কেন দেখালে না? ইস আমি মিস করে গেলাম। তাকে খুব দেখার ইচ্ছে আমার।”
“ভাঙাচোরা একজনকে দেখে কি করবে ঝিল? ওর অবস্থা চোখে দেখার মতো না।”
“কি হয়েছে?”
“পুরো বদলে গেছে মেয়েটি। ভদ্র,সাধারণ মেয়েটির হাতে আজ ওয়াইনের গ্লাস।”
চমকে উঠল ঝিল। অভিনবর বড্ড মন খারাপ। ঝিল বিষয়টা কল্পনাও করতে পারছে না। খুব রাগ হলো ওর। বিশেষ করে আরফান এর উপর। কি করে পারল এমনটা করতে? তারপরই মনে হলো সে রাতের ঘটনা। ঝিল যদি সেদিন অভিনবকে ছেড়ে দিত। পরিবার এর কথা ভাবতে গিয়ে সেটা নিশ্চয়ই অন্যায় হয়ে যেত। না ও ভালো থাকত আর না অভিনব। তার হৃদয়টা বেসামাল হয়ে পড়ল ক্ষণিকেই। অভিনব ইষৎ নিচু হয়ে ঝিলের ঘাড়ে মুখ দিয়ে রইল। এই মানুষটাকে ছাড়া আসলেই ভালো থাকা সম্ভব না। কোনো কালেই না।
দুদিন পর একটা শপে এসে মুনতাহাকে পুনরায় দেখল অভিনব। মেয়েটির পরনে জিন্স প্যান্ট আর টি শার্ট। লম্বা চুল গুলো কাঁধে এসে ঠেকেছে। চোখ দুটো বিষণ্ণ। ত্বক কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। হাতে বিয়ারের বোতল। সেটার দিকে গভীর নজর দিয়ে আছে। অভিনবর কেন যেন রাগ হলো। যদিও কোনো অধিকার খাটানো যায় না তবু সে অধিকার খাটালো। চট করেই কেড়ে নিল হাতের বোতলটি। মুনতাহা এক সাগরসম রাগ,ক্রোভ নিয়ে তাকিয়ে আ হ ত হলো। মাথাটা নিচু করে ফেলেছে। এমনকি চোখ দুটো থেকে গড়িয়ে পড়ল জল।
“এটা আমি কি দেখছি! আমার দেখা নম্র,ভদ্র মেয়েটি কিনা শেষমেশ…”
“ঘৃণা করবেন তো ভাইয়া। তবে তাই করেন। আমি ঘৃণারই যোগ্য।”
“ভেবেছিলাম শক্ত হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু এভাবে ভেঙে যাবে আশা করি নি। নিজেকে হারিয়ে দিচ্ছ।”
“হারিয়ে দিচ্ছি? আমি তো হেরে গেছি সেই কবেই। যখন আমার স্বামী আমার সাথে বিছানায় থেকে অন্য নারীর অনাবৃত দেহ কল্পনা করেছে।”
চোখ বন্ধ করে নিল অভিনব। কতটা অকপটে কথা গুলো বলে যাচ্ছে মুনতাহা। যে নারী ইষৎ দৃষ্টিতেই লজ্জায় ডুবে যায় সে নারী আজ কতটা লজ্জাহীন হয়েছে! মুনতাহা বিয়ারের বোতল গুলো রেখে দিল। ঝিল জিনিসপত্র নেওয়া শেষ করে অভিনবকে ডাকতে এল। তখনি নজরে এল মুনতাহাকে। শুরুতেই সে চিনতে পারল না। তবে সেদিনের বর্ননা মিলিয়ে বুঝতে পারল। মুনতাহাও থমকে গিয়েছে। ঝিলের দু একটা ফটো দেখেছে সে। মির্জা বাড়ির মেয়েটি বরাবরই সকলের চর্চায় থাকত। ভাই আর পাপাদের বুকের মধ্যে থেকেছে কি না। সেই থেকেই খানিকটা আগ্রহ জেগেছিল। লুকিয়ে একটি ফটো সংগ্রহ করেছিল সে। শুনেছিল অভিনবর সাথে তার প্রণয় রয়েছে। মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বুঝতে পারল। সে এগিয়ে এসে ঝিলের গাল ছুঁয়ে দিল।
“মাশআল্লাহ। লোকের কথাই সত্য। ছবির থেকেও বাস্তবে অধিক সুন্দরী তুমি।”
কিছুটা লজ্জা বোধ করল ঝিল। অভিনব কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
“ভাইয়া, এই বাচ্চা মেয়েটিকে কখনো ছেড়ে দিয়েন না। ভারী মিষ্টি কিন্তু।”
অভিনব মনে মনে আওড়াল ছাড়ব না। কিন্তু মুখে বলল, “ছাড়তে চাইলেই কি ছাড়া যায়? জিজ্ঞেস করে দেখ আমি সেসব কল্পনা করলেও খু ন করে ফেলবে আমায়।”
দারুণ করে হাসল মুনতাহা। ওদের দেখে ভালো লাগছে। ঝিল খানিকটা লজ্জিত হয়ে পড়ল। অভিনব কাছিয়ে এসে হাত রাখল ঝিলের কাঁধে। তারপর মুনতাহার উদ্দেশ্যে বলল, “সুযোগ দিলে সবাই সুযোগ নিতে চাইবে। তুমি আমায় হতাশ করলে মুনতাহা। ভাইয়ের বউ হিসেবে নয় তবে ছোট বোনের ন্যায় ট্রিট করেছিলাম আমি। ভুলে গেলে কি বলেছিলাম?”
“বাস্তবতা আমার সাথে ছিনিমিনি করেছে।”
“ভুল। একদম ই সঠিক পথে নেই তুমি।”
“ঝিল তুমি একদিন আমাদের বাসায় যাবে। বাড়িতে তোমার অনেক গল্প করেছিলাম আমি।”
প্রসঙ্গ বদলে ফেলার ন্যায় কথাটি বললেও অভিনব এক চুল ছাড়ল না। বরং এগিয়ে এসে বলল, “তোমার বয়সের তুলনায় তুমি বড় অপরিপক্ক মুনতাহা। তবে এমন বলব না আরফান ভাইকে ধরে রাখতে না পারা তোমার ব্যর্থতা।”
“ব্যর্থতা আমারই ভাইয়া। মুখ লুকিয়ে বাঁচতে হয়।”
“নিজেকে এত তাচ্ছিল্য কেন করলে?”
“তাচ্ছিল্য নয়। এটাই সত্যি।”
অভিনব হতাশ হলো। মেয়েটির জন্য ওর খারাপ লাগছে। ঝিল কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সহসা মিশতে পারে না সে। মুনতাহাকে প্রায় জড়িয়ে ধরল।
“আপু আপনার মতো মিষ্টি মেয়ে আমি আগে দেখি নি। জানি না কেন আপনার সাথে এমন হলো। কিন্তু যে জীবন বেছে নিয়েছেন সেটাও সঠিক নয়।”
“হয়ত তোমরা ঠিক।”
মুনতাহা অন্যমনস্ক। অভিনব চোখের ইশারায় আর কিছু বলতে নিষেধ করল। ঝিল তবু চেয়ে রইল মেয়েটির পানে। দু একটা কথার পর তাগাদা দিয়ে মুনতাহা বলল, “আশা করছি আমাদের আবারও দেখা হবে। ঝিলকে নিয়ে যাবেন ভাইয়া।”
এড্রেস দিয়ে গেল মুনতাহা। তারপরই এলোমেলো পায়ে চলে গেল। কি অদ্ভুত লাগে দৃশ্যটি। মানুষের জীবন কতভাবে বদলে যেতে পারে।
পরের দুদিন ঝিলের বেশ মন খারাপ ছিল। বার বার বলছিল মুনতাহার জীবনটা কি ঠিক করা যায় না। ঝিলের এমন বাচ্চামো দেখে অভিনবর বুক চিরে বেরিয়েছে কেবল দীর্ঘশ্বাস। ওদের জীবনটাই যেখানে এলোমেলো সেখানে আরেকজনের জীবন ঠিক করার কথা বেমানান লাগারই কথা। কিন্তু ঝিল এটা মানতে নারাজ। ওর কথা মতে মুনতাহার মতো মেয়ে এমন জীবনের সাথে যায় না। অন্তত নিজের জন্য বেঁচে থাকুক মেয়েটি। অভিনব নিজেও এই বিষয়ে ভেবেছে। তবে কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে খুব বেশি নাক গলানো যায় না। ঝিলের কথা ভেবেই সে ঠিক করেছে মুনতাহার বাসায় যাবে। তার পরের সপ্তাহে একদিন তরুণ কল করল। বেচারা অনেক কষ্টে নাম্বার জোগাড় করেছে।কল করেই রেগে অস্থির।
“এভাবে কেউ আড়াল হয়? এতটা নিষ্ঠুর তুই। আন্টি আর আঙ্কেলের কথা ভাবলি না। ওনারা টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
“শান্ত হ তরুণ।”
“কি শান্ত হব। তুই জানিস সেদিন আঙ্কেলের শরীর কি পরিমানে খারাপ হয়েছিল।”
“জানি।”
“হোয়াট! তুই কি বল তো। জেনে ও কেন এমন করছিস।”
“আমি ওদের খবর রাখি তরুণ।”
“তবে নিজের খবরটা কেন দিস না?”
“কারণ আমার মতো ঝিল ও নিজের পরিবারের ছেড়ে এসেছে। ওর পরিবার ও একই ভাবে চিন্তিত। আমি তো এর আগেও নিখোঁজ হয়েছি কিন্তু ওর পরিবার, যাই হোক মম পাপার সাথে এখুনি আমি যোগাযোগ করতে পারছি না।”
ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তরুণ। একটা সময় পর বলল, “ওদের কি দোষ বলতে পারিস?”
“ওদের দোষ, ওরা নিজের পরিবারের কথাই শুধু ভেবেছে। একবার ভাবে নি অন্যদের কথা।”
“এটা ভুল।”
অনেকটা অভিমান নিয়েই কথা গুলো বলেছে অভিনব। চাপা কষ্টটা আড়াল করতে বলল,
“সময় যাক।”
“তুই একটু বেশিই করে ফেলছিস। আন্টি চেয়েছে তার ভাইদের সাথে সম্পর্কটা সুন্দর রাখতে। এটা কি খুব বেশি কিছু?”
“তার ভাইয়েরা নিশ্চয়ই ভালো মানুষ নন।”
“আর ঝিলের পাপারা?”
“তারাও।” বলে চুপ হয়ে গেল অভিনব। এই দুই পরিবারের জন্য নিজের বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে ফেলল না সে? পরক্ষণেই ভাবল ঝিল ও তো কষ্টে আছে। কিছুই মস্তিষ্কে এল না। অভিনব কল রেখে ডিভানে গা এলিয়ে দিল। ঝিল কিচেন থেকে ফিরেছে। দারুণ এক খাবার রান্না করেছে এমি। সেটা বলতে এসে অভিনবকে দেখতে পেল। তারপর কি মনে করে যেন বলল, “আন্টি আঙ্কেলের কথা মনে পড়ে?”
অভিনব আড়াল করার ন্যায় ঋনাত্মক উত্তর দিল। ঝিল সামান্য হেসে ছেলেটার গাল স্পর্শ করল। ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল ছেলেটা।
“কি এনেছ?”
“আড়াল করতে চাচ্ছ?”
“ধ্যাত আমি আবার কি আড়াল করব।”
“তুমি বড় নিষ্ঠুর অভিনব।”
স্মিত হেসে অভিনব বলল, “হঠাৎ এমন কেন মনে হলো তোমার?”
“নিজের সব কষ্ট আড়াল করে যাচ্ছ। আমার পরিস্থিতিটা বোঝার জন্য নিজের পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছ।”
“তেমন নয়।”
“রাতের ফ্লাইটে আন্টি আঙ্কেল আসবে। তাদের কষ্ট দিয়ে আমরা নিশ্চয়ই শান্তি পাব না।”
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি