#শখের_সাদা_শাড়ি
১৫.
সমীর সব থেকে বড় ধাক্কা টা খেল অনুষ্ঠানের ফাইনাল রাউন্ডে। নিজের বাবা কে জাজ হিসেবে দেখে একে বারেই ভরকে গেল। কয়েক সেকেন্ড একদম ই পলক ফেললো না। আর তারপর ই চোয়াল শক্ত করে উঠে এলো। ভদ্র লোকের নাম সওলাত খান। বর্তমান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বড় এক নাম। বেশ ভালো ডিজাইন করতে পারেন। আর সেই গুন টাই পেয়েছে ছেলে সমীর খান। তবে দুজনের মাঝের দূরত্ব যে সব দুমড়ে মুচড়ে দিলো। এর আগের বার ন্যাশনাল পর্যায়ে অনলাইন অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভদ্রলোক। শুধু সেই কারনে জিতে যাওয়া রাউন্ড টা ফেলে আসে সমীর। সবাই খুব বুঝিয়েছিলো তবে সে নারাজ। এতে নিজ ক্যারিয়ারের ক্ষতি করে ফেললো সমীর।এই নিয়ে কখনোই আপসোস করে নি। ভদ্রলোকের ছায়া টা যেখানে থাকবে সমীর ঠিক তার বিপরীতে অবস্থান করবে। সমীর এর নাম ডাকা হলো। তার করা ডিজাইন গুলো অলরেডি মনিটরে দেখানো হচ্ছে। শুধু ব্রিফিং দিবে। সমীর এর নাম টা শুনে সওলাত খান বেশ চমকালেন। আগের বারের ঘটনা টা তিনি জানতেন না। প্রধান অতিথি হিসেবে স্বীয় দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন কেবল। তবে এবার যে একে বারে বিচারকের আসরে। সমীর আসছে না দেখে সওলাত খান বার বার তাকাচ্ছেন। ছেলের মুখ টা দেখা হয় না আজ কতো গুলো বছর। সত্যি বলতে তিনি সন্তান দের ভালোবাসেন। মাঝের করা এক ভুলের জন্য সন্তান রা আলাদা হয়ে গেলো। কি করার ছিলো ওনার? দ্বিতীয় স্ত্রী তথা কাননবালার পেটে যে ভুলক্রমে ওনার সন্তান এসেছিলো। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ভুলের জন্য বিয়ে টা করে নিতে হলো তাড়াহুড়ো করে। বড্ড ভুল ছিলো সেসব। নিজ স্ত্রী কে খুব একটা ভালোবাসতেন না তিনি। পরনারী তে আসক্ত হয়ে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিলেন। আর নিজের বৈধ সন্তান দের হারিয়ে ফেললেন। বুকের ভেতর টা ছ্যত করে উঠে। পাশ থেকে একজন বিচারক বললেন ” সওলাত সাহেব দেখেন এই ছেলের কাজ গুলো। কি নিখুত ডিজাইন। যতো গুলো ডিজাইন এসেছে সব থেকে বেস্ট। ”
ছলছল নয়নে হাসার চেষ্টা করলেন তিনি। চোখের জল টুকু বহু কষ্টে আটকে রেখে দিলেন। ছেলেকে দেখার জন্য মনের ভেতর ঝড় বইতে শুরু করলো। অধৈর্য হয়ে কয়েক বার সিট থেকে উঠার চেষ্টা ও করলেন। অতঃপর সমীর এর দেখা মিলে। ছিমছিমে শরীরের লম্বা দেহের ছেলে। চেহারা ভালো খারাপ না। তবে সব থেকে সুন্দর হচ্ছে চিকন কপাল টা। এমন সুন্দর কপাল যে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। লম্বা চুল গুলো যখন কপালে এসে আছড়ে পরে তখন মনে হয় এই পৃথিবীর সব থেকে সুদর্শন পুরুষ সমীর। মনে মনে চাপা গর্ব করলেন তিনি। এই গুনী ছেলে টার যে তাঁর সেটা ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে। সমীর খুব স্বাভাবিক ভাবেই মঞ্চে এলো। মাইক তুলে দেওয়া হলো।
” থ্যাংকস টু অল। যারা আমাকে এমন সুন্দর, বিশেষ আয়োজনে অংশ হতে নির্বাচিত করেছিলেন। আমি দীর্ঘ এক মাস যাবত কাজ করে আজ ফাইনাল রাউন্ডে মাইক হাতে উপস্থিত। বিজয় হয়তো বা খুব নিকটে। যেহেতু ফাইনাল সেহেতু বিজয়ী না হলে ও আমরা সবাই এক একজন রানার্সআপ এটা সিউর। মোট কথা হেরে যাওয়ার কোনো চান্স নেই। সে যাই হোক, আমি হয়তো সকল কে এমন এক সংবাদ দিতে চাই এর ফলে মিডিয়া কিংবা ভিউয়ার্স সকলেই তিক্ত মতামত পোষন করবেন। এই ভিন্ন ভিন্ন মতামত গ্রহণে আমি দ্বিধান্বিত না। আমি জানি আমাকে ফেস করতে হবে অনেক কিছু তবু আমি সেটা বলবো। আর ইটস ফাইনাল। ”
সওলাদ সাহেব ছেলের কথা টা কে খুব পজেটিভ ভাবে গ্রহণ করলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন ছেলে বুঝি বলবে সওলাত খান আমার বাবা। তিনি একেবারে তৈরি হয়ে রইলেন ছেলে কে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য। সমীর কে অলরেডি সাংবাদিক রা প্রশ্ন করা শুরু করেছে। সমীর এক বার ও তাকালো না বাবার দিকে। চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলল ” আমি নিজের নাম এই প্রতিযোগিতা থেকে উইথড্রো করতে যাচ্ছি। ”
উর্মির সাথে কথা বলছে সমীর। দুজনের কন্ঠ টাই মলিন। একে অপরের থেকে কি যেন লুকোচ্ছে। সমীরের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই সমীর অন্য কথায় এলো।
” সৌমেন ভাই এর কি খবর গো? শুনলাম বিদেশে আসবেন। ”
” হ্যাঁ মাহফুজ স্যার তেমন টাই বলেছেন। সেদিন সৌমেন স্যার ও বললো। ”
” তাহলে তো ঠিক ই যাবে। ”
” হ্যাঁ। এখন বলো তোমার অনুষ্ঠানের কি হলো। আজ কালের মধ্যেই তো ফাইনাল হওয়ার কথা তাই না? ”
” হুম। খেয়েছো? ”
” অনেক আগেই। আপা কে খাইয়েই খেয়ে নিয়েছি। ”
” ও হ্যাঁ রাত তো অনেক হলো। আপার কি খবর? ”
” ভালো। বেবি টা আজকাল যন্ত্রণা দিচ্ছে। কিক করলেই আপা ককিয়ে উঠে। ”
” ইস কি বলো এটা যন্ত্রণা? এটা তো দারুণ লাগার কথা। বেবি কিক করার ফিল টা ভাবো কেমন লাগে। ”
” হুম হয়েছে মিস্টার। মায়েরাই বুঝেন কেমন লাগে। ”
” কষ্ট হলে ও সুখ তো আছে। আমি তো আমার বেবির প্রতি টা কিক ফিল করতে চাই। ”
” হা। আগে বিয়ে করে একটা বেবি পয়দা তো করো। ”
” করবো তো। খুব দ্রুত করবো। ”
” তাই। তো মেয়ে দেখেছো নাকি? ”
” উম দেখি নি। তবে চাইলে তুমি দেখতে পারো। ”
আনমনেই হাসলো সমীর। এদিকে উর্মি দাঁত চেপে বলল–
” হুম দেখবো তো। ”
” দেখো প্লিজ। মেয়ে টা যেন খুব সুইট হয়। একদম তোমার — ”
” আমার কি? ”
উর্মির উদিগ্ন কন্ঠ। সমীর ফিঁচেল হেসে বলল
” তোমার বিপরীত। তুমি তো একটা ঝাল মেয়ে। আমার সুইট কাউ কে লাগবে। বহু দিনের শখ। ”
কল কেটে দিয়েছে উর্মি। সমীর হেসে আবার কল করলো। ভাবলো এখনি বলে দিবে শখের মেয়েটি উর্মি। তবে দ্বিতীয় বার কল করে সুইচ অফ পেলো ফোন। এতো রাগ করেছে মেয়েটা?
দু দিনের মাথায় দেখা গেল সৌমেন খুব অসুস্থ। মুখ দিয়ে লালার মতো কি যেন বের হয়। এসব দেখে সৌমেন কে ফাইল দিতে আসা ড্রাইভার চিৎকার করে উঠে। দ্রুত পায়ে ছুটে আসে উর্মি সহ সবাই। উর্মি দেখতে পায় সৌমেন কেমন যেন বিহেভ করছে। সবাই ধরে হসপিটালে নিয়ে আসে। যাওয়ার পূর্বে উর্মি মাহফুজ স্যার কে কথা টা জানান। ভদ্রলোক এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান। কারো গলা শুনতে পায় উর্মি। তিনি বলছেন কে ফোন করেছে? সৌমেন?
হসপিটালের করিডোরে মানুষের ভীড় জমেছে। প্রতি টা স্টাফ ছুটে এসেছেন। সৌমেন স্যারের এমন অসুস্থতা কেউ আশা করে নি। মাহফুজ সাহেব আর ওনার স্ত্রী লতিফা বেগম ছুটে এলেন। ভদ্র মহিলা উন্মাদের মতো কাঁদছেন। ছেলের জন্য যেন শরীরের প্রতি টি রক্ত বিন্দু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। উর্মি লতিফা বেগম কে সিটে বসালেন। মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই তো দুপুরেই উর্মি কে ডেকে বলল উর্মি এবার এর কাজ টা খুব ভালো করেছো। তুমি খুব ভালো কর্মী। ডাক্তার বের হয়ে আসতেই লতিফা বেগম ছুটে গেলেন। থমথমে ডাক্তার কিছু বলতে নারাজ। তবে মাহফুজ সাহেব কে দেখে না বলে আর থাকতে পারলেন না। তিনি শুধু জানালেন সৌমেন এর অবস্থা ভালো নয়। শরীরে বিশেষ ধরনের মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। যার ফলে পরিবর্তন এসেছে সৌমেন এর জেনিটিক বৈশিষ্ট্য সহ ব্রেনের। হয়তো বা সৌমেন এর স্মরণ শক্তি আর বুদ্ধিমত্তায় প্রভাব পরবে। ব্যাস এই টুকু শুনেই জ্ঞান হারালেন লতিফা বেগম। মাহফুজ সাহেব ও ভেঙে পরলেন। প্রতি টা মানুষ চুপ চাপ। শুধু উর্মি চিৎকার করে বলল
” আন্টির হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে দ্রুত বেডে নিতে হবে ওনাকে। ”
রাতে সমীর এর নাম্বারে কল করলো উর্মি। পুরো আটা নব্বই টা মিস কল এসেছে। উর্মি রিসিভ করতে পারে নি কারন সৌমেন এর পরিবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। সমীর কল রিসিভে সময় নিলো না। ঝটপট বলল–
” সারাদিনে কল রিসিভ করো নি উর্মি। তুমি ঠিক আছো। ”
” চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি। তবে সৌমেন স্যার অসুস্থ। ”
” কি হয়েছে? ”
পুরো ঘটনা বর্ননা করলো উর্মি। এতে সমীর ব্যথিত হলো। দুজনের মাঝের সম্পর্ক টা সুন্দর। সৌমেন এর খোঁজ নিতে ফোন করবে বলে ঠিক করলো। এদিক টা সামলে দ্রুত ফিরে আসবে বলে ও স্থির হলো। উর্মির মন টা ভীষণ পানসে ঠেকে। সমীর ও নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কিছু সময় গেলে দুজনেই প্রসঙ্গ বদল করলো। এক পর্যায় এসে উর্মি জানতে চাইলো সমীর এর ফাইনাল রাউন্ড এর রেজাল্ট। আজ বাদে কাল তো সত্যি টা জানবেই উর্মি। সে জন্য সমীর বলল
” আমি নিজের নাম উইথ ড্রো করে নিয়েছি উর্মি। ”
” কেন? ”
আজ আর লুকায় নি সমীর। একে একে বর্ননা করলো নিজের বাবার প্রতারণা। মা ভাই কে নিয়ে চলে আসার ঘটনা। সবশেষে উর্মি চুপচাপ। চোখ দুটো ভরে গেছে জলে। অথচ সমীর কতো টা সহজ গলায় বলে যাচ্ছে। সমীর আর ও বলল মা কতো টা ভালোবাসতেন বাবা কে। মাংস কে একদম চিড়ে ফেলে বাঁধাকপি দিয়ে ভাজি করা ছিল বাবার সব থেকে প্রিয়। সেদিন মা শখ করে বাবার জন্য সেই রান্না টাই করেছিলেন। তবে বাবা এসেছিলেন অন্য নারীর হাত ধরে। কেউ সেদিন মুখে তুলে নি খাবার। পরদিন ময়লার গাড়ি করে চলে গিয়েছিল শখের রান্না।কয়েক সপ্তাহ মুখ বুজে ছিলো সমীর। খুব কষ্ট করে জব খুঁজে মা ভাই কে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল ওর শখের গল্প।
চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
পর্ব ১৬
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=157948996766003&id=100076527090739