#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
কয়েকদিন প্রচন্ড জ্বরে ভুগলো ইফাদ। দিন-দুনিয়ার কোনো হুঁশ নেই এতটাই শরীর খারাপ হলো ওর।
রিতু প্রথমদিকে খানিকটা বিরক্ত হলেও পরে নিজের ছোট মনের চিন্তাধারায় ওর নিজেরই ভীষণ রাগ লাগলো। সারাক্ষণ ওরসাথে এটা-সেটা নিয়ে খুনসুটি, বকবক করা মানুষটার এ অবস্থা ওর মন খারাপ করিয়ে দিলো একপ্রকার। ও যথাসাধ্য খেয়াল রাখলো ইফাদের, সেবাযত্ন করলো। এত অসুস্থতার মধ্যে ইফাদেরও কোনো শক্তি বা ইচ্ছা হলো না বউকে জ্বালাতে। তাই চুপচাপ বউয়ের সেবাটুকু গ্রহণ করল সে, ভালো লাগলো ভীষণ। আবিষ্কার করলো তার বউটি ওপরে ওপরে কাটখোট্টা ব্যবহার করলেও মনের দিক থেকে খুবই নরম একটা মেয়ে। বউয়ের প্রতি ভালোলাগাটা তাই আরো বেড়ে গেলো ওর। জ্বর সারতেই একদিন কোথা থেকে একটা গোলাপ নিয়ে এলো। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় গোলাপটা রিতুকে দিতেই রিতু ভীষণ অবাক হলো কালো রঙের গোলাপ দেখে অবাক হলো৷ এই রঙের গোলাপ হয় সে শুনেছিলো। কিন্তু কখনো দেখেনি, দেখার ভীষণ ইচ্ছে!
দু’দিন আগে ঠিক এ কথাটাই রুফিকে বলছিলো সে। অংক স্যার কি শুনেছিলো কথাটা? রিতু আশ্চর্য হলো। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া গোলাপটা ওর মন ভালো করে দিলো। কিছুটা অবাক হয়েই ও ইফাদকে জিজ্ঞেস করলো,
— এটা কোথায় পেয়েছেন স্যার?
ইফাদ ফোন ঘাঁটার বাহানা দিয়ে বলল,
— বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ওদের বাগান থেকে
ছিঁড়ে এনেছি…
— না বলে?
— হ্যাঁ।
রিতু গোলাপটা রেখে দিলো,
— চুরি করা গোলাপ এনে বউকে দিচ্ছেন? আপনার লজ্জা করছে না? আপনি জানেন চুরি করা একটা গর্হিত কাজ? স্টুডেন্টদের এসবই শিক্ষা দেবেন?
ইফাদ তাকালো,
— এটাকে চুরি বলছো কেন? এটা আমার ভালোবাসা…
— চুরিকে আপনি ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন?
ইফাদ বিরক্ত হলো,
— তুমি বড্ড পাষাণ…
— জামাই চোর হলে তো বউকে পাষাণ হতেই হয়।
— মুখে কথাই খই ফুটছে। এতই যখন জামাই মানো দাও দেখি একটা চুমু…
— কোনো চোরকে আমি চুমু খাবো ভাবলেন কি
করে স্যার?
— ভাবছি না, চাইছি।
রিতু রেগে তাকালো,
— পারবো না দিতে।
ইফাদ ভীষণ বিরক্ত হলো,
— সাতটা চুমু জমা আছে। আপাতত একটা দিয়ে
দিলেই বাকি ছ’দিনেরটা মাফ। নয়তো এখন জোর করে সাতদিনেরটাই নেব…
রিতু ভীষণ রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। লোকটা এত অসহ্য? উফ! দুটো কথা বলেও শান্তি নেই। জ্বর ছাড়তে না ছাড়তেই আবার শুরু করেছে। একে নিয়ে কোথায় যাবে সে?
.
ইফাদ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার পর শ্বশুরের
দাওয়াত রক্ষা করতে গেলো। রিতু বাড়ি এসে দেখলো
খালা, ফুফুরাও আছে। আর বড়ফুফুর ছেলে নাহিদ ভাইকে দেখে তো ও ভীষণ সারপ্রাইজড হলো।
খুশিতে কথা বলাই ভুলে গেলো কিছু মুহূর্তের জন্য।
বিয়েতে সে আসতে পারেনি দেশের বাইরে থাকায়।
রিতু নিজের নাহিদ ভাইকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। বড়ফুফু গদগদ কন্ঠে সবাইকে বলল,
পাখি তার ডানা পাইছে খুশিতো হইবোই।
ইশিতা সে কথারও টিপ্পনী কাটলো। রিতু সেসব গায়ে মাখলো না। এতদিন তো সে বোন, ফুফুদের এই কথাগুলোই মিস করছিলো! রিতু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। রাতের ভূরিভোজন ছিলো নতুন জামাইয়ের জন্য। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই বসার ঘরে
সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতে বসলো। এরমধ্যে রিতুর সাথে নাহিদের বেশ ভালো বন্ডিং দেখে ইফাদের রাগ হলো, হাসফাঁস লাগলো, বিরক্ত লাগলো। দরকারি কলের অযুহাত দিয়ে আড্ডা থেকে সরে এলো সে। এরপর ভবঘুরের মতো রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। ক্ষিপ্ত মেজাজে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করার পরে আচমকা কাদায় পা পড়তেই ওর বিরক্তি চরমে পৌঁছালো। রেগে সেভাবেই শ্বশুরবাড়ি ফিরে এলো ইফাদ। ফ্রেশ না হয়ে কাদামাখা জুতা নিতেই বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। বসার ঘর থেকে রিতুর হা হা, হি হি স্পষ্ট কানে আসছে ওর। নিষ্ঠুর বউয়ের আচরণ ওকে কেন এত পীড়া দিচ্ছে? আর রিতু নি? বর রেখে ভাইয়ের সাথে অট্টহাসি? থাকবে না সে এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত! অসহ্য অনুভব করায় মুনিকে দিয়ে রিতুকে ডেকে পাঠালো সে।
.
নাহিদ ভাইয়ের সাথে অনেক বছর পর দেখা রিতুর।
ব্যাচেলর করতে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলো
অনেক বছর আগে। এরপর আর ফেরেনি। দুই ভাই-বোনের কতদিন পর দেখা! কি একটু বসে
কথা বলছে তাতেও ক্ষান্ত দিতে হলো রিতুকে।
ওর বিরক্তি চূড়ান্তে পৌঁছালো। অংক স্যারকে কথা শোনানোর জন্য একশো একটা মুখ ঝামটা রেডি করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। কিন্তু ঘরে যাবার পর রাগে-দুঃখে ওর চোখ ভিজে ওঠলো। দেখলো অংক স্যার কাদামাখা জুতো নিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। রিতু ফোঁসফোঁস করে ডাকতেই অংক স্যার ঘুমঘুম গলায় ধমক দিলো,
— ঘুমুতে দাও বউ।
— আপনি জুতো নিয়ে শুয়ে আছেন কেন?
— শুয়েছি তো শুয়েছি। তাতে কী এমন ঘোড়ার ডিম হয়েছে?
রিতুর গলা কাঁদোকাঁদো শোনালো,
— আমার এত সুন্দর বিছানার চাদর! নষ্ট করে দিয়ে বলছেন কী ঘোড়ার ডিম হয়েছে?
— কিনে নিও আরেকটা, কাঁদতে হবে না।
— লাগবে না। আপনি উঠুন, জুতো খুলে আসুন…
— পারবো না।
— আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি স্যার।
অংক স্যার ওঠে বসলো। ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— যদি জিজ্ঞেস করো জুতো নিয়ে শুয়েছি কেন,
তাহলে বলব চাদরটা আমার একটুও পছন্দ হয়নি।
তাই নষ্ট করে দিয়েছি…
— আপনার পছন্দ না হলেই সেটা নষ্ট করে দেবেন?
— হ্যাঁ দেব।
রিতু ফুঁসে ওঠল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো।এই পাগলের সাথে কথা বলাই বৃথা। ও ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করল,
— সমস্যাটা কী আপনার? আমাকে ডেকে পাঠালেন কেন?
— আমি চলে যাব।
রিতু চমকালো,
— চলে যাবেন মানে? কোথায়?
— বাড়ি ফিরবো। তোমাকে বলতেই ডাকলাম।
রিতু কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
— কেন? এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমাকে বলুন।
— সমস্যা তো তোমার হচ্ছে। অহেতুক আমাকে এড়িয়ে চলছো। আমার জন্য কারো সাথে হা হা, হি হি করতে পারছো না মনখুলে…
রিতু বিস্ময় নিয়ে বলল,
— আপনাকে এড়িয়ে চলেছি? আর কোথায় হা হা,
হি হি করলাম? আপনি কি ইনডিরেক্টলি নাহিদ ভাইকে মিন করছেন?
ইফাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,
— হ্যাঁ করছি। কারণ আমার তুমি বর রেখে পরপুরুষকে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছো।
— নাহিদ ভাই পরপুরুষ? সে আমার ভাই।
— আপন তো নয়।
— আপনি….
ইফাদ মলিন গলায় বলল,
— যাইহোক এত কথা ভালো লাগছে না। আমাকে ইগনোর করতে হবে না। আমি আসছি…
রিতু আমতাআমতা করে বলল,
— ইগনোর করছিনা তো। তবে চলে গেলে বাবাকে
বলে যান।
ইফাদ গম্ভীর গলায় বলল,
— সরি বাট আমি বলতে গেলে ওনি আটকে দেবেন, লজ্জায় পড়ে যাব। তুমি বলে দিও। অবশ্য এখন
বলতে হবে না৷ যখন খোঁজ করবে তখন বলো।
রিতু অবাক হলো,
— আমি বাবাকে কী বলবো?
— বলবে কাজ ছিলো, চলে গেছে।
রিতু তেঁতে ওঠল,
— মিথ্যে বলতে পারব না।
— তাহলে সত্যিটাই বলে দিও।
ইফাদ কাদা মাখা জুতো নিয়েই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। রিতু হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এই লোকটা
এত অদ্ভুত! শেষমেশ নাহিদ ভাইকে নিয়ে তার জেলাসি? রিতুর হাসি পেলো। পুঁটিমাছওয়ালীর প্রেমে পড়া অংক স্যার কি জানে নাহিদ ভাইয়ের পুতুলের মতো সুন্দর একটা মেয়েও আছে?
এর ঘন্টাখানিক পরে বাবুল মিয়া যখন মেয়ে জামাইয়ের খোঁজ করতে এলেন তখন রিতু মিনমিন করে জানালো ইফাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবুল মিয়া গম্ভীরমুখে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। এরপর অবশ্য আর কেউ বিরক্ত করলো না। রিতু দরজা আটকে ঘুম দিলো। অংক স্যারের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে বহুদিন পর নিজ বাড়িতে, নিজ বিছানায় শান্তির ঘুম দিলো রিতু। সকালবেলা বেশ বেলা করেই ওর ঘুম ভাঙলো। আড়মোড়া ভেঙে বাইরে বেরুতেই ওর চক্ষুচড়ক গাছ হয়ে গেলো। বসার ঘরে বাবার সাথে অংক স্যার বসে আছে। হাসিখুশি ঝলমলে চেহারা৷ আয়েশী ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে। এই লোকটা এখানে কেন? রাতে না চলে গেল? রিতুর চোখ থেকে কোটর বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। অংক স্যারকে একা পাবার পর রিতু বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি কখন এলেন? রাতে গিয়ে সকালে যখন আসবেনই তাহলে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিলো?
ইফাদ ওর কথা শুনে তখনি চমকপ্রদ খবরটা দিলো,
— রাতে তো কোথাও যাইনি।
রিতু হতভম্ব হলো,
— মানে? তাহলে ছিলেন কোথায়?
— শ্বশুর মশাইয়ের সাথে ছিলাম।
রিতু চাপা স্বরে চেঁচালো,
— আপনি আমার সাথে মজা করছেন?
— না।
— মিথ্যে বললেন কেন তাহলে?
— আমার রাগ হচ্ছিলো তাই।
রিতু দরজা ধরে দাঁড়ালো,
— আপনি জানেন আপনার জন্য আমি বাবাকে মিথ্যে বলেছি? বলেছি আপনি ঘরে ঘুমিয়ে আছেন৷ বাবা কী ভাবলো আমায়! ছিহ!
ইফাদ হাসলো। রিতুর ইচ্ছে করলো ওর নাকে ঘুসি মারতে। ওর হাতের ঘুসি খেয়ে যদি লোকটার শিক্ষা
হয়। ওর অগ্নি চক্ষু দেখে ইফাদ বলল,
— ওনি জানেন, আমার আর তোমার মধ্যে ছোটখাটো মনোমালিন্য হয়েছে। তাই আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছো তুমি!
রিতু দু-চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করলো। ওহ গড! লোকটা এত বদমাশ? বাবার কাছে এতসব মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে? বাবা কি ভাবলো! উফ, লজ্জায় ওর মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।
ও কটমট করে বলল,
— এতবড় মিথ্যে বলতে বুক কাঁপলো না আপনার?
নিভিয়ে রাখা আগুনটা দপ করেই যেন জ্বলে ওঠলো ইফাদের। চাপা রাগে তাই সোজাসাপ্টা জবাব দিলো,
— আমার সাথেই তোমার সব বাজে ব্যবহার, অন্যদের সাথে না। শুধু প্রেমে পড়েছি বলে বিয়ে করেছি তোমাকে। অপরাধ তো কিছু করিনি। তোমার বাবাকে মিথ্যে বলতে আমার যতটা না খারাপ লাগছিলো তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছিলো তোমাকে অন্য ছেলের সাথে হাসতে দেখে। আমার হাত-পা, বুক, হাঁটু সব কাঁপছিলো তোমাকে ওই ছেলেটার সাথে দেখে৷
কষ্ট হচ্ছিলো খুব।র’ক্ত’ক্ষরণ হচ্ছিলো মাথার ভেতর,
বুকের ভেতর ….
অংক স্যার বকবক করতেই থাকলেন। অন্যদিকে
রিতু আনমনা হয়ে, একদৃষ্টে, অদ্ভুত চোখে দেখছিলো
য়ে রইলো তার অংক স্যারকে। শুনছিলো লোকটার অভিমানী কথা, অদ্ভুত স্বীকারোক্তি।
____________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সিনেমাটিক, ড্রামাটিক। ভালো লাগলেই আগাবেন৷ নয়তো সময় নষ্ট করবেন না। ধন্যবাদ।]
চলবে…
্