#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩০
জারিফের থেকে অনুমতি পেয়ে কথা রুমের ভেতরে পা বাড়ায়। জারিফ কপাল কুঁচকে কথার দিকে চাইলো।কথার হাতে Basic Essay বই।বইটা দুইহাতে চেপে ধরে জারিফের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে কথা স্ট্রেইট দাঁড়ায়।জারিফ স্বাভাবিকভাবে শুধালো,
“কিছু বলবে?”
কথা ক্ষীন আওয়াজে একটু টেনেটেনে বললো,”ভাইয়া।একটা লাইন ঠিক বুঝতে পারছি না।একটু ট্রান্সলেট করে দিবেন, প্লিজ।”
কথাটা বলে হাতে থাকা বইটা মেলে ধরে জারিফের সামনে।জারিফ কথার হাত থেকে বইটা নিলো।ইশারা করতেই কথা আরেকটু এগিয়ে এসে এক আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,”এইটা।”
কিছুক্ষণ পর কথা ফের কন্ঠে কোমলতা নিয়ে ঠোঁট আওড়ায়,”ভাইয়া আরেকটা বিষয় জানার ছিলো।আপনি অনুমতি দিলে বলতাম আরকি।”
সব সময় সবার সামনে যেকোনো কথা বলে ফেলার অভ্যাস থাকলেও,সামনের মানবটার সামনে কথা মেপে মেপে কথা বলে।সামনের মানুষটাকে রেসপেক্ট করে সাথে ভ’য়-ও করে।আবার মানুষটার পার্সোনালিটি কথাকে তেমনই মুগ্ধও করে।অন্য আর পাঁচজন কাজিনদের মতো তাদের মধ্যে কখনো ইয়ার্কির সম্পর্ক নেই। জাস্ট ভালোমন্দ এতটুকুই কথা হয়।এর বাইরে হাসি ঠাট্টা কোনোদিনই হয়নি।কথা কথা বলার আগ্রহ দেখালেও তার এই স্বল্পভাষি গম্ভীর এটিটিউডের মালিক কাজিন সর্বদা ডিস্টেনস বজায় রেখে চলে।আর এই ডিস্টেনস বজায় রেখে চলাতেই সবাই যেনো বেশি করে তার উপর মুগ্ধ হয়। জারিফ গম্ভীর গলায় বললো,
“ওকে। প্রবলেম নেই বলো।”
কথা ভ্রু যুগল কুঁচকে চিকন স্বরে ফের বললো,”ভাইয়া কোন প্রকাশনীর বই কিনলে ভালো হবে।ইয়ে মানে কোন কোন প্রকাশনী বেশি ভালো আরকি।আসলে আপনি তো অনেক জ্ঞান রাখেন।তাই আপনার থেকে জানতে চাচ্ছি।”
জারিফ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে কয়েকটা প্রকাশনীর নাম বললো।কথা স্মিত হেসে বললো,”থ্যাংকস আ লট ভাইয়া।”
জারিফ বিছানার উপর নিজের পাশে রাখা ফোনের দিকে একবার চাইলো।লিয়া তো লাইনে আছে।এটা খেয়াল হতেই জারিফ তৎক্ষনাৎ বলল,”আচ্ছা কথা এবার তুমি আসতে পারো কেমন।”
কথা ঘাড় নাড়িয়ে,”ঠিক আছে।”বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।এমন সময় কিছু ভেবে জারিফ কথাকে ডেকে উঠলো,”কথা ওয়ান মিনিট।ওয়েট।”
কথা তড়িৎ পেছন ঘুরে দাঁড়ালো।জারিফ বলল,”তোমার কি কি বই লাগবে তার লিস্ট করো।আর লিস্টটা মায়ের কাছে দিও।সময় করে একসময় আমি নিয়ে আসবো।”
জারিফ নিজের দায়িত্ব বোধ থেকে মনে করে,জারার বই আরো প্রয়োজনীয় সবকিছু তো আমি নিজেই নিয়ে আসি।আর কথা সেও তো নিজের বোনের মতই।মেয়েটা যখন কিনবে বললো তখন একজন দায়িত্ববান মানুষের মধ্যে পরে নিজ থেকেই সেগুলো এনে দেওয়া। আর মেয়েটা এবাড়ি থেকে এখন পড়াশোনা করছে।তাই তার ভালোমন্দ দেখা এবাড়ির সবার দায়িত্বের মধ্যে পরে।যদিও কথার পড়াশোনার খরচসহ বাদবাকি আনুষঙ্গিক সব কিছুর ব্যয় ফুপাই দেয়।শুধু থাকা আর খাওয়া।আর মামারা জামাকাপড় এটাসেটা খুশি হয়ে দেয় এতটুকুই।কথা ইতস্তত করে।জড়তা নিয়ে বলল,
“নাহ্।ঠিক আছে ভাইয়া।আমি কলেজ থেকে আসার সময় বইগুলো লাইব্রেরী থেকে নিয়ে আসবো।”
“আমাকে এমনিতেও কালকে একবার লাইব্রেরীতে যেতে হবে।আমার নিজেরই কিছু প্রয়োজন আছে ।তাই বলছি তোমার কি কি বই প্রয়োজন তা একটু টুকে রেখো।আমি সেইসময় নিয়ে আসবো।”
কথা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়। অতঃপর চলে যায়।কথা চলে যেতেই জারিফ ফোনটা হাতে নেয়।জারিফ ভেবেছে লিয়া হয়তো কল কে’টে দিয়েছে।জারিফকে ভুল প্রমাণিত করে লিয়া এখনো লাইনে আছে।জারিফ কণ্ঠে একরাশ শীতলতা নিয়ে শান্ত স্বরে বলল,”সরি।এতক্ষণ ওয়েটিং এ রাখার জন্য।”
ফোনের ওপাশ থেকে আদেশের সুরে লিয়া বলল,”সরি টরি রাখেন।দেশজুড়ে দায়িত্ব পালন করছেন। আর এদিকে বউয়ের দিকে গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলছেন।আপনি এখন আমাকে বলুন আপনি আগামী রোজ শুক্রবার আপনার শ্বশুর বাড়িতে আসছেন। ইনভাইট রক্ষার্থে যদি আমার শ্বশুড়বাড়ি থেকে কেউ না আসে।তাহলে আমার নিজের কাছেই বিষয়টা খা’রাপ লাগবে।আপনার বউয়ের প্রেস্টিজের ব্যাপার স্যাপার,হু।”
জারিফ পায়ের সাথে পা জড়িয়ে বিছানার হেডের সাথে হেলান দেয়। শব্দহীন মৃদু হাসলো।যা ওপাশের রমণী বুঝতে পারলো না।জারিফ ফের বলল,”ও লিয়া আবার এককথা বলতে ভালো লাগছে না।বললাম তো জামাই পরিচয়ে এই প্রোগ্রামে যাচ্ছি না।আর কেনো যাচ্ছি না।তার কারন তো তোমাকে বললামই।তোমার যাতে অসম্মান হয় এরকম কিছু আমি জেনেশুনে কোনোদিনই করবো না।আমার বউয়ের সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। ইনভাইট রক্ষার্থে আমি না গেলেও আমার পরিবারের লোক যাবে।”
“এই আপনি দেখছি খুব জিদ ধরে আছেন।”
“তুমিও তো কম জেদি নও।আমার উপর সহৃদয় হও। তাহলে তোমাকে ফাস্ট প্রায়োরিটি দিয়ে শ্বশুরবাড়ির দাওয়াত খেতে যেতাম।অন্যদের দাওয়াত ইগনোর করতাম।”
জারিফের শেষের কথাশুনে লিয়ার কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হলো।লিয়া মনেমনে রিপিট করলো,অন্যদের দাওয়াত মানে? অতঃপর লিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রশ্ন করে উঠলো,”অন্যদের দাওয়াত মানে?কোথায় আবার দাওয়াত? বুঝলাম না।”
জারিফ একটু থতমত খেয়ে বসে। তড়িৎ বলল,”তেমন কিছু নয়।ভুল শুনেছো হয়তো। আচ্ছা বাদ দাও।”
একটু থামলো জারিফ।কথা ঘুরাতে ফের বলল,”এই লিয়া।আমি তো টেনশনে আছি।”
লিয়া কোনো প্রকারের ভনিতা ছাড়াই সোজাসুজি স্পষ্টভাবে শুধায়,”কিসের টেনশন?”
জারিফ গলার স্বর একটু খাদে নামিয়ে ফের বলল,”তুমি এতো জিদি।আবার আমি শান্ত-শিষ্ট ভদ্র-সভ্য হলেও জিদ আমার কম নেই।তা তো তুমি জানোই।”
“হাহ!নিজেই নিজেকে শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র-সভ্য উপাধি দিচ্ছেন।আমি তো আপনার মধ্যে সভ্য এর স-ও খুঁজে পাইনা।”
“তোমার কাছে আমি সভ্য হতে চাই না। বউয়ের কাছে সভ্য হওয়া মানে নিজেরই লস।আর অসভ্য হলে অনেক লাভ।বুঝলে?কাছে থাকলে প্রাকটিক্যালি বুঝিয়ে দিতাম।”
লিয়া বিড়বিড় করে বলল,”অসভ্য।”
জারিফ শব্দ করে হাসলো।একহাতে চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করে নিয়ে ফের বলল,”যা বলছিলাম।তুমি জিদি আমিও জিদি এখন তো দুইজনের এই জীন আমাদের বাচ্চা পেলে কেমন জিদি হবে। আল্লাহ মালুম।”
লিয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।লিয়ার হাসির ঝংকার এপাশের মানব মুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করতে থাকে। এরমধ্যে রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে ডাকেন।লিয়া জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আম্মু ডাকছে।আমি পরে কথা বলছি,হ্যা।”
“ওকে। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
.
পরেরদিন,,
আজ সকালে লিয়ারা ওর দাদুবাড়িতে আসছে।বিয়ে বাড়িতে এখনো আত্বীয় স্বজন তেমন কেউ আসেনি।আসলে বিয়েটা খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে হচ্ছে না।আগে একটা দূর্ঘটনা ঘটায়। তাসনিমের বাবা বেশি লোকজনকে ইনভাইট করেননি।নিকট আত্মীয় স্বজন যাদেরকে না বললেই নয়,শুধু তাদেরকে বলেছেন। ঘরোয়াভাবে করতে গিয়েও নিকট আত্মীয় স্বজন আর কম তো নয়।আত্বীয় স্বজনেরা আজকে দুচারজন আসছে।বাকিরা আগামীকাল।আবার কেউ কেউ এক্কেবারে বিয়ের দিন আসবে।ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা সাতটার ঘর ছুঁইছুঁই।ড্রয়িংরুমের সোফায় তিনবোন বসে গল্প করছে। তাসনিম মাঝে দুইপাশে লিয়া আর তুলি।বড়রা হয়তো ভেতরে নিজেদের রুমে।কেউ কেউ হয়তো মাগরিব এর নামাজ শেষ করে রুমেই আছে।নিচে এরা তিনবোন জমিয়ে গল্প করছে। লিয়া তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে শুধালো,
“আপু কালকে তো তোমার হলুদ।আর আলিফ ভাইয়ার বাড়ি তো ঢাকা ।অতো দূর থেকে হলুদ নিয়ে আসবে কোন সময়? তাহলে হলুদ প্রোগ্রাম শুরু হবে কখন?”
তাসনিম কিছু বলার আগেই পাশ থেকে তুলি গমগমে কণ্ঠে বলল,”আরে আলিফ ভাইয়া তো এখানেই থাকে।বিয়েটা এখান থেকেই করবেন।ঢাকাতে নয়। আন্টিও এখন ভাইয়ার সাথেই থাকে।বিয়ের কথা ঠিক হওয়ার পরপরই বড়সড় একটা ফ্লাট নিয়েছে।আর ভাইয়ার নিকট আত্মীয়রা বিয়ের জন্য ময়মনসিংহে আসবে।আর আসবে কি কেউ কেউ তো অলরেডি চলেই এসেছে।তাইনা আপু?”
শেষের কথাটা তাসনিমের দিকে তাকিয়ে বলে তুলি। তাসনিম কপাল কুঁচকে ছোট করে বলে,”হুম।”এরমধ্যে তুলি কিছু ভেবে নিয়ে ঠোঁট আওড়ায়,”আচ্ছা আপু। আমাদের এদিকে তো একটা নিয়ম নতুন বউয়ের সাথে নানী -দাদি এরা যায়।বিশেষ করে বিয়ের সাথে। কিন্তু আমাদের তো নানী বেঁচে নেই।আর দাদিমনি তো অসুস্থ। মনেহয় না তোমার সাথে যেতে পারবে।”
তাসনিম একটু নড়েচড়ে বসলো।বলল,”নানীমনি নেই দাদমনি যেতে পারবে না।তাতে কি হয়েছে?তোরা দু’জন তো আছিস।তোরা যাবি।আর ছোটো বোনেরা তো যায়।”
লিয়া তড়িৎ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,”এই এই আপু আমি যেতে পারব না। প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড।আমার নতুন একজায়গা গেলে ঠিকঠাক ঘুম হয়না।আর এটাসেটা সমস্যা হয়েই থাকে।তাই আমাকে যেতে বলো না প্লিজ।”
লিয়া অসহায় চাহনিতে তাসনিমের দিকে চাইলো।তুলি কাঠকাঠ গলায় বলল,”লিয়া না গেলে। আমিও যাবো না।লিয়া রাজি হলে নাহয় ভেবে দেখতাম।”
তাসনিম বলল,”এই লিয়া কি সমস্যা হবে আবার?আমি থাকবো তো।আর স্যারের মা খুব ভালো। আন্টি আছেন।তাই বলছি তুই নির্দ্বিধায় রাজি হতে পারিস।আর তোরা গেলে আমার ভালো লাগবে,হুম।জোর করছি না।তবে বলবো ভেবে দেখিস কেমন?”
লিয়া ঠোঁট উল্টে চুপচাপ রয়।হ্যা না কিছুই বলে না আর।তুলির কিছু মনে হতেই হঠাৎ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,”এই লিয়া তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম। ইশশ্! ভুলেই গিয়েছি তো।ঈদের দিন বিকেলে আম্মু মেজো চাচিমার সাথে ফোনে কথা বলার সময় তোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই চাচিমা বললো,তুই জারিফ ভাইয়ার সাথে বাইরে গিয়েছিস।তা কোথায় কোথায় ঘুরলি শুনি?শশীলজ, জয়নুল আবেদীন পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন নাকি ড্রিমল্যান্ড?”
তুলি ভ্রু বাঁকিয়ে লিয়ার দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে রয়।লিয়া কানের পাশে মশা তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে একহাত নাড়িয়ে বলল,”ধূর! এসব কোথাও না।ড্রিমল্যান্ড – ট্রিমল্যান্ড কোথাও না।সোজা শ্বশুরের ল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলো।”
তুলি বড়বড় চোখ করে চাইলো। অবাক হয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে ফের বলল,”বাব্বাহ!বিয়ের পর প্রথম ঈদ শ্বশুর বাড়িতে করলি।বেশ ইন্টারেস্টিং তো ব্যাপারটা।”
তাসনিম ফোন ওপেন করে এফবিতে ঘুরাঘুরি করতেই।এমন সময় মেসেঞ্জারে আলিফের মেসেজ আসে। সাউন্ড অফ থাকায় কোনো শব্দ হয়না।সবুজ বাতি জ্বলে থাকা দেখে হয়তো ডাক্তার সাহেব এইসময় মেসেজ করেছেন।তাসনিম বেশ বেকায়দায় পরে।এখন এদের দুজনের মাঝে বসে কোনো মেসেজ লিখতে গেলে। তাসনিমের থেকে আগে দুইপাশ থেকে দুইটা হামলি খেয়ে মেসেজ দেখতে থাকবে।আবার হুট করে এখন উঠে গেলেও দুই বোন টিপ্পনি কাটবে। লজ্জায় ফেলতে এই দুইটার জুড়ি নেই। তাসনিম আলিফের মেসেজটা সীন না করে ফোনটা অমনি রেখে দিলো।আর উসখুস করতে থাকে। এরমধ্যে রাজিয়া সুলতানা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে লিয়াকে ডেকে বললেন,
“লিয়া ফোন কোথায় তোর?কোথায় রাখিস,হ্যা?”
লিয়া মাথাটা তুলে সামনে দৃষ্টি দিলো।বলল,”রুমে আছে। কিন্তু কেনো বলতো?”
রাজিয়া সুলতানা লিয়ার কাছাকাছি এসে হাতে থাকা লিয়ার ফোনটা লিয়ার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“জারিফ ফোন দিয়েছিলো।বলল,তোর নম্বরে কল দিয়ে নাকি পাচ্ছে না।বিকেল থেকে নাকি ট্রায় করছে।”
লিয়া মায়ের হাত থেকে নিজের ফোনটা নেয়।মৃদু আওয়াজে বলল,”দুপুরের পর থেকে ফোন হাতে নেইনি। ফোন সাইলেন্ট ছিলো খেয়াল করিনি।”
রাজিয়া সুলতানা কিছু না বলে কিচেনের দিকে যেতে থাকেন।তুলি টিপ্পনি কে’টে বলল,”ফোনটা তো সব সময় কাছে কাছে রাখবি ।বেচারা জারিফ ভাইয়া উপায় না পেয়ে শেষমেষ কিনা শ্বাশুড়িকে ফোন দিয়েছে। বউয়ের সাথে বেচারা কথা বলতে না পেরে এতক্ষণ দমবন্ধ হয়ে আসছিলো হয়তো।যা যা বোন তাড়াতাড়ি কথা বলে অক্সিজেনের যোগান দে।”
তাসনিম ঠোঁট টিপে হাসতে থাকে।লিয়া মোটামোটা চোখে তুলির দিকে চাইলো। দাঁত কটমট করে একটু টেনে বলল,”তু….লি ।বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু।”
তাসনিম ফোড়ন কে’টে বলল,”আহ্!তুলি ছোট বোনকে কেউ এভাবে জ্বালায়।আমার মিষ্টি বোনটা লজ্জা পাচ্ছে তো। লজ্জায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে তার শুভ্র বদনে।”
লিয়া কাঁদো কাঁদো ফেস করে করুণ সুরে বলল,”আপু তুমিও এরকম বলছো। ঠিকঠাক বাড়িতে পৌঁছায়েছি কিনা হয়তো এটা জানার জন্য ফোন দিয়েছে,হু।”
তাসনিম মাথা নাড়িয়ে বলল,”হুম।তাইতো।”
“আমার ছোটো আপার কি খবর?”
গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই লিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে জান্নাত বেগমকে দেখতে পায়। জান্নাত বেগম সিঙ্গেল সোফায় আয়েশ করে বসলেন।লিয়া কিছু বলার আগেই জান্নাত বেগম মশকরা করে ফের বললেন,”তা ছোটো আপা তিনমাস তো হয়েই আসলো।পরীক্ষা শেষ। তোমার সিদ্ধান্তটা তো আমাকে আর জানালে না।”
লিয়ার নিটোল কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হলো। তড়িৎ বলল,”কিসের সিদ্ধান্ত দাদিমনি?”
জান্নাত বেগম মৃদু হাসলেন।মনেমনে খুশিও হলেন।তবে সেসব প্রকাশ না করে ফের মুখায়বে গম্ভীরতার ছাপ টেনে নিয়ে বললেন,”এরমধ্যেই ভুলে গেলে ছোটো আপা।আমি তো বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম।ছোটো আপা কি বলে সেইটা জানার জন্য।নাত জামাইয়ের ব্যাপারে তোমার মতামত কি?”
লিয়া এতক্ষণে পুরো বিষয়টা টের পেলো। খানিকটা লজ্জাও পেলো। সেদিন তো বড়বড় করে অনেক কথায় বলেছিলো এই দূর্ঘটনা বয়ে বেড়াতে পারবো না, হেনতেন আরো কতকি। এসব কথা মনে পড়তেই লিয়া ভ্যাবাচেকা খায় এখন দাদিমনিকে কিভাবে সবটা বলবে।লিয়া আড়ষ্টতাকে দূরে ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। জান্নাত বেগমের সোফার হাতলের উপর বসলো। দুইহাতে দাদিমনির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,”ও দাদিমনি এভাবে লজ্জা দিও না,প্লিজ। বলেছিলাম তো অনেক কিছুই।পরে যখন বুঝলাম তোমার নাত জামাই চোখে না হারালেও আমাকে চাইছে।তার চোখের ভাষা বলছে,সে আমাকে চায়।তাই আর অভিমানটা পুষে রাখতে পারলাম না।”
জান্নাত বেগম লিয়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”আমি খুব খুশি হয়েছি ছোটো আপা।উপরওয়ালার উপর হাজারো শুকরিয়া সময় থাকতে থাকতেই তোমরা একে অপরকে বুঝে নিয়েছো। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তোমাদের অনাগত সংসার জীবন যেনো সুখে শান্তিতে কাটে। পরিবারের সবার সাথে মিলেমিশে আনন্দে কাটাতে পারো।আরো দোয়া করি জীবনে অনেক বড় হও। ভালোমন্দ বাছ বিচার করে চলো।”
আরো এটাসেটা উপদেশ মূলক কথা বলেন দাদিমনি। অতঃপর লিয়া রুমে আসে।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জারিফের কাছে কল ব্যাক করে।ব্যালকনিতে মৃদু বাতাস আসছে।হালকা বাতাসে লিয়ার শরীরটা শিহরিত হয়ে উঠলো।বেশ ভালোই লাগছে এই অন্ধকার ঘেরা রাতের পরিবেশে মৃদু বাতাসে ব্যালকনিতে। দ্বিতীয় বারের সময় জারিফ কল তুলে।কল রিসিভ করেই ওপাশ থেকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জারিফ শুধায়,
“কোথায় থাকো তুমি?মানছি বাড়ীতে সবার সাথে ব্যস্ত সময় পার করছো।তাই বলে সারাদিনে একবারো একটা কল দেওয়া যায়না। উফ্!আবার এদিকে বিকেল থেকে ফোন দিচ্ছি তবুও তুলছো না। তোমার মতলব কি? বলতো শুনি? বাড়িতে গিয়ে বরকে একদম ভুলে টুলে গেলে না-কি?”
জারিফের একনাগাড়ে বলা কথাগুলো লিয়া শুনছে আর মিটমিট করে হাসছে। লিয়া শান্ত গলায় বলল,” রিল্যাক্স জনাব রিল্যাক্স।সরি!খুব খুউউউব সরি!আসলে অনেকদিন পর বাড়িতে আসছি।সবার সাথে সময় কাটাতে গিয়ে সময় হয়ে উঠেনি।আর আসার পর ফোন হাতে নেওয়াই হয়নি।”
জারিফ ছোট করে শ্বাস টেনে নিলো। স্বাভাবিকভাবে বলল,”বাসার সবাই কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে সবাই।”
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কাটে লিয়া। এরমধ্যে পেছন ঘুরে রুমের দিকে পা বাড়ায়।দু একদম যেতেই তুলির গলার আওয়াজ আসে,”লিয়া?কোথায় তুই?”
লিয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই বলল,”এখানে।”তুলি সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।তুলির একহাতে আইসক্রিম।বাম হাতের সাহায্যে তুলি কপালটা মুছে নিলো। প্রচন্ড গরম পড়ছে। বৃষ্টির দেখা মিলছে না। জনজীবন বিপর্যস্ত এই খেপাটে গরমে।তুলি ব্যালকনির দিকে আসতে থাকে।একহাত কপালে রেখে তুলি বলল,
“উফ্ফ!আন্দার কিতনি গারমি হে!”
“বাহার কিতনি সারদি হে!”
মুচকি হেসে সুর করে লিয়া বললো।তুলি ফিক করে হেঁসে উঠলো। অতঃপর তুলি ব্যালকনির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো।ব্যালকনিতে হালকা বাতাস আসছে।তুলি প্রফুল্ল চিত্তে বলল,”সত্যি তো এখানে একটু তাও ঠান্ডা আছে।আর রুমের ভেতর ফ্যানের বাতাস মনে হচ্ছে হিটার অন করে দিয়েছি।”
তুলি হাতে থাকা দুইটা কোণ আইসক্রিম থেকে একটা লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”এটা তোর।ছোটো চাচ্চু সবার জন্য আইসক্রিম এনেছে।যা গরম পড়ছে বাবা।এখন ঠান্ডা ঠান্ডা আইসক্রিম খেয়ে দেহটা ঠান্ডা করি। কি বলিস?”
লিয়া আইসক্রিম খেতে খেতে বলল,”হুম।”
.
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলে জানান দিচ্ছে রাত্রি বারোটা পেরিয়েছে।বিয়ে বাড়ি চারিদিকে সাজসাজ রব।পুরো বাড়ি লাল নীল সবুজ এক কথায় হরেক রঙের বাহারি লাইটিং এ ঝলমল করছে। তাসনিম ফোন হাতে নিয়ে সামনে ধরে আছে। তাসনিম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে।আর রুমে লিয়া আর তুলি ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে।আজকে তিনবোন একসাথেই শুয়েছে।বিয়ে হয়ে যাবে আপুকে আর এভাবে পাওয়া যাবে না।এই নিয়ে দুইবোনের আফসোসের শেষ নেই। সন্ধ্যা থেকে হলুদ মেহেন্দি এসব নিয়ে হইহুল্লোড় করতে করতে বেশ ক্লান্ত ছিলো লিয়া আর তুলি।তাইতো বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে।তাসনিমও মাত্রই শুয়েছিলো। এমন সময় ডাক্তার সাহেবের কল আসে। তাসনিম কল রিসিভ করে ব্যালকনিতে আসে।হটস আ্যপে ভিডিও কলে কথা বলছে।
ঝলমলে বিভিন্ন রঙের আলো তাসনিমের মুখের উপর এসে পড়ছে।তাসনিমকে থেকে থেকেই যেনো কৃত্রিম আলোরা রাঙিয়ে দিচ্ছে।আর সেই রাঙানো মুখটা ফোনের ওপাশ থেকে কেউ একজন নিষ্পলক চাহুনিতে চেয়ে দেখছে।আলিফ সফট ভয়েজে বলল,”তোমার মুখে এখনো হলুদের আভা ছড়িয়ে আছে।তোমাকে দারুণ লাগছে।আমার চোখে তো নেশা ধরে যাচ্ছে।চোখের নেশাটা থেকে থেকেই বুকে জ্বলন ধরাচ্ছে।আমাকে ভীষণ তৃষ্ণার্ত করছে।”
তাসনিমের কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোনোর উপক্রম।তাসনিম ঠোঁট কামড়ে ধরে এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতে পারলো না।আলিফ তাসনিমের লজ্জা পাওয়া মুখশ্রী দেখে স্মিত হাসলো। ইচ্ছে করে লজ্জা দিতে ফের বলল,”এভাবে ঠোঁট কামড়ে ধরো না।এমনিতেই তোমার কোমল গোলাপী ঠোঁটে নিজেকে ডুবাতে ইচ্ছে করে ।আবার ঠোঁট কামড়ে ধরছো।আমার তো নিজেকে বেসামাল
আলিফকে থামিয়ে দিয়ে তাসনিম তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,”রাত অনেক হয়েছে। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।এখন রাখি।”
আলিফ নিঃশব্দে চমৎকার হাসলো। শান্ত কণ্ঠে বলল,”ওকে।রোজরোজ রাত জাগলে শরীর খা’রাপ করবে।তাই আজকে বেশি করে ঘুমিয়ে নাও।আমি একজন ডাক্তার হয়ে জেনেশুনে নিজের বউয়ের ক্ষতি চাইবো না।তাই বলছি আজকে ডাবল ঘুম দিয়ে নাও।কেমন?কালকে না হয়”
“গুড নাইট।”
আলিফের কথার মাঝেই তাসনিম এটা বলে।আলিফকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে
তাসনিম দ্রুত কল কে’টে দেয়।কল কে’টে হাফ ছেড়ে যেনো বাঁচে।বড় করে শ্বাস টেনে নেয়।
.
পার্লার থেকে আর্টিস্ট এসে তাসনিমকে বউ সাজাচ্ছে। ব্রাইডাল সাজে সাজানো হচ্ছে।লিয়া আকাশি রঙের থ্রি পিস পড়েছে।ভেজা চুলগুলো চিরুনি করে নিজের রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।এই দুইদিনে জারিফের সাথে ফোনে খুব কমই কথা হয়েছে।বাড়িতে লোকজন আবার বিয়ে বাড়ি মানেই ব্যস্ততা এটাসেটা।তাই বেশি কথা হয়নি।রাতে একবার করে কথা হয়েছে।লিয়া জারিফকে আর একবারো আসা প্রসঙ্গে কিছু বলেনি।জারিফও কিছু বলেনি। লিয়া দেখতে চায় জারিফ কি করে।তবে লিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস জারিফ মুখে যাই বলুক না কেনো।ঠিক আসবে।লিয়া জারিফের কথা ভাবছিলো আর দৃষ্টি দেয় গেইট বরাবর।বর যাত্রী এখনো আসেনি।দাওয়াতের অতিথিরা আসা শুরু করেছে।লিয়া চাতক পাখির ন্যায় গেইটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আছে।এমন সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় জারিফের গাড়ি দেখে লিয়ার একমিনিটও দেরি হয় না চিনতে।লিয়া প্রফুল্ল চিত্তে নিচে নামে।লিয়া বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়ায়। পার্কিং লনে গাড়ি পার্ক করিয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে নীল নামে।জারিফের বদলে নীলকে নামতে দেখে লিয়া কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রয়।লিয়া ভাবে হয়তো জারিফ ব্যাক সিটে আছে।নীল দরজা খুলে দেয়।জারিফের বাবা আর মা নামে।লিয়া সৌজন্যতার খাতিরে এগিয়ে যায়।ওনাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে ভেতরে আসতে বলে। এরমধ্যে এনামুল খাঁন গিয়ে ভালোমন্দ কথা বলে ভেতরে নিয়ে আসেন।
লিয়ার মুখটা ম্লান হয়ে আসে।লিয়া এতক্ষণ উসখুস করছিলো জারিফের কথা কিভাবে শুনবে?শ্বশুর শাশুড়ি ভেতরে যেতেই লিয়া নীলের পাশে দাঁড়ালো। প্রথমে এটাসেটা কিছু বলল। অবশেষে লিয়া ইতস্তত বোধ নিয়েই নীলকে শুধালো,”আপনার ভাইয়া আসলো না যে।”
নীল মৃদু আওয়াজে বলল,”ব্রো বলল আমাকে গাড়ি নিয়ে আসতে।আমি জিজ্ঞেস করলাম তুই যাবি না?আমাকে গাড়ি নিতে বলছিস যে। ব্রো বলল,ওর নাকি কি কাজ আছে। এতটুকুই বলল।আর কিছু বলেনি।”
আজ তো এমনিতেই হলিডে।তাহলে কি কাজ থাকবে?একথা লিয়া মনেমনেই আওড়ালো।তবে মুখে এসব কিছুই বললো না।লিয়া জোর করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো,”ভেতরে চলুন।”
.
তাসনিম কে খুব সুন্দর করে কনের সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। লাল টকটকে লেহেঙ্গা। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক কৃষ্ণচূড়ার মতো লাগছে।দুইগালে গোলাপি আভা। টানাটানা নজরজোড়া আকর্ষণীয় সাজে দারুণ লাগছে। লিয়া তাসনিমের পাশে বসে আছে।লিয়ার বারবার জারিফের উপর রা’গ হচ্ছে।সাথে মনে ভীষণ অভিমান জমেছে।এতো করে বললাম তবুও বান্দা আসলোই না।লিয়ার ভাবনার ছেদ ঘটে তুলির ডাকে।তুলি ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“এই লিয়া বর চলে এসেছে।চল গেইটে যেতে হবে।আমি তো ভেবেছি গেইটে মোটা অঙ্কের টাকা তুলবো,হ্যা।”
লিয়া বিরস কণ্ঠে বলল,”আমি গেইটে ফেইটে কোথাও যাবো না।তুই যা।আমি আপুর কাছে আছি।”
তুলি দুইহাত কোমড়ে রাখলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”এই এখন এসে এরকম কেনো বলছিস।সকাল অব্দিও না দু’জনে কত কি প্লান করলাম,হু।চল ছোটো চাচ্চু তোকে আমাকে ডাকছে।সাথে কাজিন পার্টি সবাইকেই।”
লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। অবশেষে আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও গেইটে যেতে থাকে।
চলবে,,,
রিচেইক দেওয়া হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এত্ত এত্ত সরি!এতো লেইট হওয়ার জন্য।